দুর্গাপূজা
দুর্গাপূজা | |
---|---|
অন্য নাম | দুর্গোৎসব, শারদোৎসব |
পালনকারী | বাঙালি হিন্দু (প্রধান ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক হিন্দু উৎসব), ওড়িয়া,[১] ও অসমীয়া (অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব), বিহারি, ভোজপুরি, ত্রিপুরী, মৈথিল, নেপালি, ভুটানি, বার্মিজ, বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষুদ্র উপজাতীয় জাতিসমূহ যেমন: সাঁওতাল, চাকমা, মণিপুরী, ইত্যাদি ও উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি (অঞ্চল ভেদে বিভিন্ন নামে উৎযাপিত হয়)[২] |
ধরন | ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব |
পালন | হিন্দু দেবতাদের পূজা, পারিবারিক এবং অন্যান্য সামাজিক সমাবেশ, কেনাকাটা এবং উপহার প্রদান, ভোজ, প্যান্ডেল পরিদর্শন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান |
শুরু | মহালয়া |
সমাপ্তি | বিজয়াদশমী |
তারিখ | শুক্লা প্রতিপদ থেকে দশমী পর্যন্ত |
সংঘটন | বার্ষিক |
সম্পর্কিত | নবরাত্রি, মহালয়া, দশেরা, কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা |
দেশ | ভারত |
---|---|
সূত্র | unesco.org/durga-puja |
ইউনেস্কো অঞ্চল | কলকাতা |
অন্তর্ভূক্তির ইতিহাস | |
অন্তর্ভূক্তি | ২০২২ (১৬তম অধিবেশন) |
তালিকা | প্রতিনিধি |
হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
দুর্গাপূজা বা দুর্গোৎসব (সংস্কৃত: दुर्गा पूजा) হল দেবী দুর্গার পূজাকে কেন্দ্র করে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত একটি হিন্দু উৎসব।[৩] এটি সারা বিশ্বে হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা পালিত হয়, তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িশা, বিহার, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ (পূর্বাঞ্চল) এবং বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। এটি বাংলা বর্ষপঞ্জির আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।[৪][৫] দুর্গাপূজা মূলত দশ দিনের উৎসব,[৬][৭] যার মধ্যে শেষ পাঁচটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ।[৫] আশ্বিনের নবরাত্রির পূজা শারদীয় পূজা এবং বসন্তের নবরাত্রির পূজা বাসন্তিক বা বসন্তকালীন দুর্গাপূজা নামে পরিচিত। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার দুর্গাপূজা ইউনেস্কোর অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত করা হয়।[৮][৯][১০]
দুর্গাপূজা ভারত, বাংলাদেশ, নেপালসহ ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে পালিত হয়ে থাকে। তবে সনাতনী বাঙালীর প্রধান উৎসব হওয়ার দরুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে ও বাংলাদেশে দুর্গাপূজা বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এমনকি ভারতের আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মণিপুর এবং ওড়িশা রাজ্যেও দুর্গাপূজা মহাসমারোহে পালিত হয়ে থাকে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যে প্রবাসী বাঙালি সনাতনীগণ ও স্থানীয় জনসাধারণ নিজ নিজ প্রথা মাফিক শারদীয়া দুর্গাপূজা বা নবরাত্রি উৎসব পালন করে। এমনকি পাশ্চাত্য দেশগুলোতে কর্মসূত্রে বসবাসরত বাঙালি হিন্দুরাও দুর্গাপূজা পালন করে থাকেন। ২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট হলে "ভয়েসেস অফ বেঙ্গল" মরসুম নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে স্থানীয় বাঙালি সনাতনী অভিবাসীরা ও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ এক বিরাট দুর্গাপূজার আয়োজন করেন।[১১]
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি দিন যথাক্রমে "দুর্গাষষ্ঠী", "দুর্গাসপ্তমী", "মহাষ্টমী", "মহানবমী" ও "বিজয়াদশমী" নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে বলা হয় "দেবীপক্ষ"। দেবীপক্ষের সূচনার অমাবস্যাটির নাম মহালয়া; এই দিন সনাতনীরা তর্পণ করে তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। দেবীপক্ষের শেষ দিনটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। এই দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দেবী লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কোথাও কোথাও পনেরো দিন ধরে দুর্গাপূজা পালিত হয়। সেক্ষেত্রে মহালয়ার আগের নবমী তিথিতে পূজা শুরু হয়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো যে, কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে, অষ্টাদশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী উগ্রচণ্ডা তথা দশভুজার বোধন করা হবে কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথিতে, ষোড়শভুজা ভগবতী ভদ্রকালীর বোধন করা হবে কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এবং চতুর্ভুজা ও দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহের বোধন করা হবে যথাক্রমে শুক্ল প্রতিপদে এবং শুক্লা ষষ্ঠীতে। আবার মহাকাল সংহিতার বিধানে প্রতিমাভেদে উগ্রচণ্ডার কৃষ্ণনবম্যাদিকল্পে, ভদ্রকালীর প্রতিপদাদি কল্পে ও কাত্যায়নী দুর্গার ষষ্ঠ্যাদি কল্পে পূজার অনুষ্ঠান বিধেয়। [২]
পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলাদেশ, আসাম, বিহার, উড়িষ্যায় প্রচলিত "দুর্গোৎসব" মূলতঃ কালিকাপুরাণে বর্ণিত পদ্ধতি নির্ভর, তবে বলা হয়ে থাকে যে, বাংলায় দুর্গোৎসব মূলতঃ বৃহন্নন্দীকেশ্বর পুরাণ (যার অস্তিত্ব তর্কসাপেক্ষ), কালিকা ও দেবী পুরাণে বিধৃত রীতি অনুযায়ী তিনটি ভিন্নধারায় সম্পন্ন হয়। অনেক সময় আবার মহাকাল সংহিতায় বর্ণিত পদ্ধতির কদাচিৎ অনুসরণ করা হয়, যা তান্ত্রিক দুর্গোৎসব নামে পরিচিত। পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতির জন্য অবশ্য স্মার্ত রঘুনন্দনের দুর্গোৎসবতত্ত্ব ও তিথিতত্ত্বের অনুসরণ করা হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্যাপতির দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী বা শূলপাণি রচিত দুর্গোৎসববিবেক প্রভৃতি স্মৃতিভাষ্য বা মহাকালসংহিতা/কালীবিলাস তন্ত্র বর্ণিত পদ্ধতিরও অনুসরণ করা হয়। আবার বিহারে দুর্গোৎসব মূলতঃ দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী অনুসারে নিষ্পন্ন হয়।
পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির এবং অনেক পরিবারে এই রীতি প্রচলিত আছে। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতে দুর্গাসপ্তমী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দুর্গাসপ্তমী থেকে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত) চার দিন সরকারি ছুটি থাকে। বাংলাদেশে বিজয়াদশমীতে সর্বসাধারণের জন্য এক দিন সরকারি ছুটি থাকে।
পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলোতেই আয়োজিত হয়। কলকাতা শহরের পুরনো ধনী পরিবারগুলোর দুর্গাপূজা "বনেদি বাড়ির পূজা" নামে পরিচিত। পারিবারিক দুর্গাপূজাগুলোতে শাস্ত্রাচার পালনের উপরেই বেশি জোর দেওয়া হয়। পূজা উপলক্ষে বাড়িতে আত্মীয়-সমাগম হয়ে থাকে। অন্যদিকে আঞ্চলিক স্তরে এক একটি অঞ্চলের বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করেন তা বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত। ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সময় সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। মূলতঃ দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দে মাতরম গানটি রচনা করেন যা ভারতের স্বাধীনতা-আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ বিপ্লবী ও জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। এখন সর্বজনীন পূজায় "থিম" বা নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক মণ্ডপ, প্রতিমা ও আলোকসজ্জার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। থিমগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে "শারদ সম্মান" নামে বিশেষ পুরস্কারও দেওয়া হয়। এছাড়া বেলুড় মঠসহ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিভিন্ন শাখাকেন্দ্র এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘের বিভিন্ন কেন্দ্রের সন্ন্যাসীরা দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। তবে, ঝাড়খণ্ডের নিকটবর্তী পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির চা-বাগানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী অসুর জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা এই সময়টা শোক হিসেবে পালন করে।
[১২] মহিষাসুর মর্দিনীর প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পূর্বপুরুষ এর শেকড় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার উথলী গ্রামের দুর্গা পুজার ইতিহাস :
অবিভক্ত ভারতের খুলনা জেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী একটি গ্রাম উথলী। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ইসলামকাটি ইউনিয়নের কর্দমাক্ত মেঠো পথে ঘেরা সুফলা সুজলা গ্রাম উথালী। মহিষাসুর মর্দিনীর প্রানপুরুষ স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পারিবারিক বংসপজ্ঞী খুজতে যেয়ে কিছু প্রাচীন কাগজ পত্রের সন্ধান পাই। সেখান থেকে উথলীর সামান্য কিছু তথ্য আমাদের হাতে আসে। প্রাচীন কালে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে ওঠে কপোতাক্ষের তীরে আজকের উথালী (প্রাচীন বুড়ন দ্বীপ)। এই গ্রামে কোঠাবাড়ি নামক স্থানে ১০৮ টি ঘরের সমন্বয়ে এক বিশাল অট্টালিকা গড়ে ওঠে। সেখানেই প্রথমে শুরু হয় দুর্গাপুজা। একটা তালপাতায় ১০৭৬ বঙ্গাব্দের বাৎসরিক দুর্গাপুজার হিসাব আবিস্কৃত হয়। সেখানে পুজার মোট খরচ আট আনা লিপিবদ্ধ আছে। উথালী (প্রাচীন বুড়ন দ্বীপ) এর দুর্গা পুজার সঠিক হিসাব জানা না গেলেও আপাতত এটা ৩৫৪ বছরের ও অধিক পুরাতন। পরবর্তীতে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে এটা পুনরায় নতুন করে তৈরি করা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে শত শত বছর ধরে প্রতিবদ থেকে দেবী শৈলপুত্রি, দেবী মহাগৌরি, দেবী কাত্যয়নী, দেবী স্কন্দমাতা, দেবী চন্দ্রঘণ্টা, দেবী ব্রহ্মচারিণী, দেবী কালরাত্রি, দেবী সিদ্ধিদাত্রী ও দেবী কুষ্মাণ্ডা এই নয় রুপে নবদুর্গা পুজিত হয়ে আসছেন। কালের বিবর্তনে বড় বড় দালানকোঠা ,হাজার হাজার বিঘা সম্পত্তি হারিয়ে গেলেও এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ভদ্রবংসের অস্তমিত শেষ প্রদীপ উথালীর দুর্গা পূজা অলৌকিক ভাবে মাত্র ১১ জন সদস্য এর হাতে টিকে রয়েছে। তথ্যসুত্র:আনন্দ বাজার পত্রিকা, কলকাতা,ভারত। তারিখ:১৪/১০/২০২৩
অকালবোধন
[সম্পাদনা]অকালবোধন হল দুর্গাপূজার প্রারম্ভিক অনুষ্ঠান। কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে, রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে, শরৎকালে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই এই সময়টি তাদের পূজা যথাযথ সময় নয়। অকালের পূজা বলে তাই এই পূজার নাম হয় "অকালবোধন"।[১৩] এই দুই পুরাণ অনুসারে, রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। কৃত্তিবাস তার রামায়ণে লিখেছেন, রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। তবে রামায়ণের প্রকৃত রচয়িতা বাল্মীকি মুনি রামায়ণে রামচন্দ্রকৃত দুর্গাপূজার কোনো উল্লেখ করেন নি। উপরন্তু রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদেও এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না।[১৪] তবে এই প্রচলিত তথ্য অনুসারে স্মৃতিশাস্ত্রসমূহে শরৎকালে দুর্গাপূজার বিধান দেওয়া হয়েছে।[১৩] হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, "...অকালবোধন শরতে বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ ছাড়া আর কিছুই না।"[১৫]
পৌরাণিক উপাখ্যান
[সম্পাদনা]ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
[সম্পাদনা]ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ-এ কৃষ্ণকে দুর্গাপূজার প্রবর্তক বলা হয়েছে। বিভিন্ন দেবদেবীরা কীভাবে দুর্গাপূজা করেছিলেন, তার একটি তালিকা এই পুরাণে পাওয়া যায়। তবে এই প্রসঙ্গে কোনো পৌরাণিক গল্পের বিস্তারিত বর্ণনা এই পুরাণে দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে:
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা।
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।
অর্থাৎ, সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা কৃষ্ণ বৈকুণ্ঠের আদি-বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয় দুর্গাপূজা করেছিলেন। ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা। এরপর থেকেই পৃথিবীতে মুনিঋষি, সিদ্ধপুরুষ, দেবতা ও মানুষেরা নানা দেশে নানা সময়ে দুর্গাপূজা করে আসছে।[১৬]
দেবীভাগবত পুরাণ
[সম্পাদনা]শাক্তধর্মের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু[টীকা ১] পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদসাগরের তীরে দুর্গার মাটির মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। এই সময় তিনি "বাগ্ভব" বীজ জপ করতেন এবং আহার ও শ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একশো বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। এর ফলে তিনি শীর্ণ হয়ে পড়লেও, কাম ও ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হন এবং দুর্গানাম চিন্তা করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবরে পরিণত হন। তখন দুর্গা প্রীত হয়ে তাকে বর দিতে আসেন। মনু তখন দেবতাদেরও দুর্লভ একটি বর চাইলেন। দুর্গা সেই প্রার্থনা রক্ষা করেন। সেই সঙ্গে দুর্গা তার রাজ্যশাসনের পথ নিষ্কণ্টক করেন এবং মনুকে পুত্রলাভের বরও দেন।[১৭]
দেবীমাহাত্ম্যম্
[সম্পাদনা]দুর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক গল্প প্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পটি পাওয়া যায় শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্-এ। এই গল্পটি হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম্ আসলে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোক আছে। এই বইতে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি গল্প ও দুর্গাপূজা প্রচলনের একটি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পে দুর্গাই কেন্দ্রীয় চরিত্র।
রাজা সুরথের গল্প
[সম্পাদনা]রাজা সুরথের গল্পটি শ্রীশ্রীচণ্ডী-র প্রধান তিনটি গল্পের অবতরণিকা ও যোগসূত্র। সুরথ ছিলেন পৃথিবীর রাজা। সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। কিন্তু একবার এক যুদ্ধে এক যবন জাতির হাতে তার পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তার মন্ত্রী ও সভাসদেরা তার ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। সুরথ মনের দুঃখে বনে চলে আসেন। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা রাজাকে সমাদর করে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। কিন্তু বনে থেকেও রাজার মনে সুখ ছিল না। সব সময় তিনি তার হারানো রাজ্যের ভালমন্দের কথা ভেবে শঙ্কিত হতেন। এমন সময় একদিন বনের মধ্যে সুরথ সমাধি নামে এক বৈশ্যের দেখা পেলেন। তার সঙ্গে কথা বলে সুরথ জানতে পারলেন, সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তার সব টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাও তিনি সব সময় নিজের স্ত্রী ও ছেলদের কল্যাণ-অকল্যাণের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হন। তাদের মনে প্রশ্ন জাগল, যারা তাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, তাদের প্রতি তাদের রাগ হচ্ছে না কেন? কেনই বা তারা সেই সব লোকেদের ভালমন্দের কথা চিন্তা করে করে শঙ্কিত হচ্ছেন? দুজনে মেধা ঋষিকে এই কথা জিজ্ঞাসা করলে, ঋষি বললেন, পরমেশ্বরী মহামায়ার প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। সুরথ তাকে মহামায়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে, তিনি একে একে তাকে তিনটি গল্প বলেন। এই গল্পগুলিই শ্রীশ্রীচণ্ডী-র মূল আলোচ্য বিষয়। বইয়ের শেষে দেখা যায়, মেধার গল্প শুনে সুরথ ও সমাধি নদীর তীরে তিন বছর কঠিন তপস্যা ও দুর্গাপূজা করলেন এবং শেষে দুর্গা তাদের দেখা দিয়ে সুরথকে হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন এবং বৈশ্যকে তত্ত্বজ্ঞান দিলেন।[১৮]
মধুকৈটভের কাহিনি
[সম্পাদনা]শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে সংক্ষেপে মধুকৈটভের উপাখ্যানটি বর্ণিত হয়েছে : প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হলে বিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে বিষ্ণু নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হল। ভীত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্যে তার নয়নাশ্রিতা যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই স্তবটি গ্রন্থে উল্লিখিত চারটি প্রধান স্তবমন্ত্রের অন্যতম। এই স্তবে সন্তুষ্টা দেবী বিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সঙ্গে মহাসংগ্রামে রত হলেন। মহামায়া শেষে ঐ দুই অসুরকে বিমোহিত করলে তারা বিষ্ণুকে বলে বসে, “আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা প্রীত; তাই আপনার হাতে মৃত্যু হবে আমাদের শ্লাঘার বিষয়। পৃথিবীর যে স্থান জলপ্লাবিত নয়, সেখানে আপনি আমাদের উভয়কে বিনাশ করতে পারেন।” বিষ্ণু বললেন, “তথাস্তু।” এবং অসুরদ্বয়ের মাথা নিজের জঙ্ঘার উপর রেখে তাদের বধ করলেন।[১৮]
মহিষাসুরের কাহিনি
[সম্পাদনা]শ্রীশ্রীচণ্ডী গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনিগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় মধ্যম চরিত্রে উল্লিখিত মহিষাসুর বধের কাহিনীটি। এই কাহিনী অনুসারে : পুরাকালে মহিষাসুর দেবতাদের শতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হলেন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হলেন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমণ্ডল ভীষণাকার ধারণ করল। প্রথমে বিষ্ণু ও শিব ও পরে ব্রহ্মার মুখমণ্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হল। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হল। সু-উচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। [কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন; শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন।[১৯]]
যাই হোক, এক এক দেবতার তেজপ্রভাবে বহুবর্ণময়ী দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল - শিবের তেজে মুখমণ্ডল, যমের তেজে কেশদাম, সন্ধ্যার তেজে ভ্রূযুগল, অগ্নিতেজে ত্রিনয়ন, । প্রত্যেক দেবতা তাঁদের আয়ুধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহনরূপে সিংহ দান করলেন। এই মহাদেবীই অষ্টাদশভুজা জয়া মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন । দেবী ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল।
মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তাঁর বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে মায়াবী মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন; কিন্তু দেবী সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করলেন। দেবী বললেন,
“ | গর্জ গর্জ ক্ষণং মূঢ় মধু যাবৎ পিবাম্যহম। ময়া ত্বয়ি হতেঽত্রৈব গর্জিষ্যন্ত্যাশু দেবতাঃ।। | ” |
- রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন।।
এই বলে দেবী লম্ফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর আরোহণ তার কণ্ঠে পা দিয়ে শূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে তাঁকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পলায়ন করল এবং দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন।[২০]
শুম্ভ-নিশুম্ভের কাহিনি
[সম্পাদনা]দেবীমাহাত্ম্যম্-এ বর্ণিত দেবী পার্বতী সংক্রান্ত তৃতীয় ও সর্বশেষ কাহিনিটি হল শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের কাহিনি। গ্রন্থের উত্তর চরিত্র বা তৃতীয় খণ্ডে বিধৃত পঞ্চম থেকে একাদশ অধ্যায়ে এই কাহিনি বর্ণিত হয়েছে : শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামে দুই অসুরভ্রাতা স্বর্গ ও দেবতাদের যজ্ঞভাগ অধিকার করে নিলে দেবগণ হিমালয়ে গিয়ে আদিদেবী মহাদেবীকে স্তব করতে লাগলেন (পঞ্চম অধ্যায়ে উল্লিখিত এই স্তবটি অপরাজিতস্তব নামে পরিচিত; এটি হিন্দুদের নিকট অতিপবিত্র ও নিত্যপাঠ্য একটি স্তবমন্ত্র; “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা” ও সমরূপ মন্ত্রগুলি এই স্তবের অন্তর্গত)। এমন সময় সেই স্থানে পার্বতী গঙ্গাস্নানে উপস্থিত হলে,দেবতাদের কষ্ট দেখে আদ্যাদেবী ইন্দ্রাদি দেবতার স্তবে প্রবুদ্ধা হয়ে তার দেহকোষ থেকে সৃষ্টি করেন এই দেবী কে আর পার্বতী এই দেবীর সাথে বীন্ধ পর্বতে যান ও বিন্ধ্ বাসিনী নামে অভিহিত হন। এই দেবী কৌশিকী নামে আখ্যাত হলেন ও শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। শুম্ভ-নিশুম্ভের চর চণ্ড ও মুণ্ড তাকে দেখতে পেয়ে নিজ প্রভুদ্বয়কে বললেন যে এমন স্ত্রীলোক আপনাদেরই ভোগ্যা হবার যোগ্য। চণ্ড-মুণ্ডের কথায় শুম্ভ-নিশুম্ভ মহাসুর সুগ্রীবকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত করে দেবীর নিকট প্রেরণ করলেন। সুগ্রীব দেবীর কাছে শুম্ভ-নিশুম্ভের কুপ্রস্তাব মধুরভাবে ব্যক্ত করল। দেবী মৃদু হেসে বিনীত স্বরে বললেন, “তুমি সঠিকই বলেছ। এই বিশ্বে শুম্ভ-নিশুম্ভের মতো বীর কে আছে? তবে আমি পূর্বে অল্পবুদ্ধিবশত প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যে আমাকে যুদ্ধে পরাভূত করতে পারবে, কেবলমাত্র তাকেই আমি বিবাহ করব। এখন আমি প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করি কি করে! তুমি বরং মহাসুর শুম্ভ বা নিশুম্ভকে বল, তাঁরা যেন এখানে এসে আমাকে পরাস্ত করে শীঘ্র আমার পাণিগ্রহণ করেন। আর বিলম্বে কি প্রয়োজন?” সুগ্রীব ক্রোধান্বিত হয়ে দেবীকে নিরস্ত হতে পরামর্শ দিল। কিন্তু দেবী নিজবাক্যে স্থির থেকে তাকে শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে প্রেরণ করলেন।
দেবীর কথায় কুপিত হয়ে অসুররাজ শুম্ভ তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দৈত্যসেনাপতি ধূম্রলোচনকে প্রেরণ করলেন। ধূম্রলোচনের সঙ্গে দেবীর ভয়ানক যুদ্ধ হল ও সেই যুদ্ধে ধূম্রলোচন পরাজিত ও নিহত হল। এই সংবাদ পেয়ে শুম্ভ চণ্ড-মুণ্ড ও অন্যান্য অসুরসৈন্যদের প্রেরণ করল। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য দেবী নিজ দেহ থেকে দেবী কালীর সৃষ্টি করলেন। চামুণ্ডা ভীষণ যুদ্ধের পর চণ্ড-মুণ্ডকে বধ করলেন। তখন দেবী কৌশিকী তাকে চামুণ্ডা আখ্যায় ভূষিত করলেন।
চণ্ড-মুণ্ডের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সকল দৈত্যসেনাকে সুসজ্জিত করে প্রেরণ করলেন দেবীর বিরুদ্ধে। তখন তাকে সহায়তার প্রত্যেক দেবতার শক্তি রূপে দেবী পার্বতী তার এক এক অঙ্গ থেকে এক এক দেবীকে সৃষ্টি করেন । এই দেবীরা হলেন ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বারাহী, নারসিংহী, ঐন্দ্রী প্রমুখ। এঁরা প্রচণ্ড যুদ্ধে দৈত্যসেনাদের পরাভূত ও নিহত করতে লাগলেন। এই সময় রক্তবীজ দৈত্য সংগ্রামস্থলে উপস্থিত হল। তার রক্ত একফোঁটা মাটিতে পড়লে তা থেকে লক্ষ লক্ষ রক্তবীজ দৈত্য সৃষ্টি হয়। এই কারণে কৌশিকী কালীর সহায়তায় রক্তবীজকে বধ করলেন। কালী রক্তবীজের রক্ত মাটিতে পড়তে না দিয়ে নিজে পান করে নেন।
এরপর শুম্ভ আপন ভ্রাতা নিশুম্ভকে যুদ্ধে প্রেরণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর দেবী দুর্গা নিশুম্ভকে বধ করলেন। প্রাণপ্রতিম ভাইয়ের মৃত্যুর শোকে আকুল হয়ে শুম্ভ দেবীকে বলল, “তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।” তখন দেবী বললেন,
“ | একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মামপরা। পশ্যৈতা দুষ্ট মধ্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।। | ” |
-একা আমিই এ জগতে বিরাজিত। আমি ছাড়া দ্বিতীয় কে আছে? রে দুষ্ট, এই সকল দেবী আমারই বিভূতি। দ্যাখ্, এরা আমার দেহে বিলীন হচ্ছে।
তখন অন্যান্য সকল দেবী কৌশিকী দেহে মিলিত হয়ে গেলেন। দেবীর সঙ্গে শুম্ভের ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হল। যুদ্ধান্তে দেবী শুম্ভকে শূলে গ্রথিত করে বধ করলেন। দেবতারা পুনরায় স্বর্গের অধিকার ফিরে পেলেন।যুদ্ধ পরে কৌশিকী পার্বতীর দেহে বিলীন হয়ে যান। পরে দেবী পার্বতী মালভূমের রাজার মাধ্যমে নিজের এই রূপের পুজো শুরু করেন।
কালিকা পুরাণ
[সম্পাদনা]যদিও কালিকা পুরাণের মূল উপজীব্য বিষয় কামাখ্যা মন্দির ও নরকাসুর বৃত্তান্ত - তবুও এর ৫৭,৫৮,৫৯, ৬০, ৬১তম অধ্যায়ে দুর্গাপূজার রীতিনীতির বিস্তারিত বিবরণ বিধৃত আছে, পূজায় ব্যবহার্য্য "জটাজুটসমাযুক্তাং ...." ধ্যানমন্ত্রটির উল্লেখ আছে আর তাই এই পুরাণের আলোচনা এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বিশেষতঃ ৬০ তম অধ্যায়ে মহিষাসুর বধের কাহিনী আছে যা দেবীভাগবত,মার্কণ্ডেয় বা বামন পুরাণের কাহিনী থেকে স্বতন্ত্র।
উপাখ্যানটির বিন্যাস মহাদেব আর বেতাল-ভৈরবের কথোপকথনের মাধ্যমে। কাহিনীর সূচনায় মহিষাসুরের বিনাশ কামনায় দেবতাদের সম্মিলিত স্তুতিতে প্রসন্নচিত্ত মহামায়া ষোড়শভুজা ভদ্রকালী রূপে আবির্ভূতা হয়ে দেবতাদের কাত্যায়নের আশ্রমে যেতে আদেশ করেন। সেখানে দেবতারা আদ্যাদেবীর দর্শনলাভের আশায় যান ও ত্রিমূর্তির ( ব্রহ্মা, বিষ্ণু , মহেশ্বর) সাক্ষাৎ লাভ করেন, ক্রমে তাঁরা মহিষাসুরের অত্যাচার-উৎপীড়নের কথা তুলে ধরলে ত্রিমূর্তি কোপাবিষ্ট হন। তাঁদের ও অন্যান্য দেবতাদের ক্রোধরশ্মি সুবৃহৎ এক তেজচক্র সৃষ্টি করে, যা ক্রমে দশভুজা তপ্তকাঞ্চনবর্ণা দেবী দুর্গার রূপ নেয়।
এদিকে মহিষাসুর নিশীথ দুঃস্বপ্নে দেবী ভদ্রকালীকে খড়্গাঘাতে তাঁর শিরশ্ছেদ করে রক্তপান করতে দেখেন। সন্ত্রস্ত অসুররাজ সপার্ষদে পরদিন সকালে দেবীর আরাধনা করলে দেবী মহামায়া তাঁকে ষোড়শভুজা অতসীপুষ্পবর্ণা ভদ্রকালী রূপে দর্শন দেন। মহিষ শিবাংশী - শিবের বরে রম্ভাসুরের ঔরসে তাঁর জন্ম, শিবের প্রসাদেই তাঁর ত্রিলোকবিজয়ের বৈভব-প্রতিপত্তি, আবার নিয়তির নির্দেশে তিনি নারীরই বধ্য, তাই জাগতিক অন্যান্য কামনার পরিবর্তে তাঁর মনে জাগে ভিন্ন এক "অমরত্ব" লাভের আকাঙ্ক্ষা। মহামায়ার হাতে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তাঁর কাছেই মহিষাসুর আসুরিক মনোবৃত্তির স্খালন আর যজ্ঞভাগ লাভের বর প্রার্থনা করেন। দেবী অসুরত্ব মোচনের বর দিলেও যজ্ঞভাগের মনোবাঞ্ছাটি অপূর্ণ রাখেন, বিকল্পে দেন ত্রিলোকপূজ্য হওয়ার বর। তিনি জানান যে তাঁর মহিষাসুর বধ এক সন্ততঃ ঘটনা - যুগ-যুগান্তরে, কল্পে কল্পান্তরে যা ঘটে চলেছে। ইতোপূর্বে অঞ্জননিভা অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা ও অতসীপুষ্পবর্ণা ষোড়শভুজা ভদ্রকালী রূপে মহিষাসুরকে তিনি বধ করেছেন আর পরবর্তীতে দশভুজা তপ্তকাঞ্চনাভা কাত্যায়নী দুর্গা রূপে তাঁকে আবারো বধ করবেন। আর এই তিনরূপে দেবীর পদলগ্ন হয়ে মহিষাসুর দেব-দানব-মানব সবার পূজা পাবেন।
প্রতিশ্রুতিমতই দেবী দশভুজারূপে অন্তিমকল্পের যুদ্ধে মহিষকে বধ করেন আর মহিষও দেবীর পদসংলগ্ন হয়ে দেবীর সাথে সাথে পূজা পেতে থাকেন। আদ্যাশক্তির আশীর্বাদে মহিষের অসুরস্বভাব মুছে যায়, চলে যায় দেবতাদের প্রতি বিদ্বেষ আর পুনর্জন্মের চক্র থেকে অব্যাহতি মেলে।
এই প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অবশ্য আরও দুটি প্রতিশ্রুতির আখ্যান কালিকা পুরাণের এই অধ্যায়ে বর্ণিত আছে - একটি হল রম্ভাসুরের কঠোর তপস্যায় তুষ্ট মহাদেবের বরদান আর সেই অঙ্গীকারের দায়বদ্ধতা থেকে মহিষাসুর রূপে তিন কল্পে রম্ভের পুত্রত্ব স্বীকার। অন্যটি মহাদেবীর কাছে মহাদেবের অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া - তিন কল্পে যোগবদ্ধ মহিষ শরীরে দেবীর পদপ্রান্তে থেকে তাঁর সাযুজ্যলাভ ও মহিষ শরীরে সিংহরূপী হরির সঙ্গে দেবীর ভারবহন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ
[সম্পাদনা]বাল্মীকির রামায়ণে রামের দুর্গাপূজার কোনো বিবরণ নেই। কিন্তু রামায়ণের পদ্যানুবাদ করার সময় কৃত্তিবাস ওঝা কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এর কাহিনি কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে সংযোজিত করেছেন। কৃত্তিবাসি রামায়ণ অনুসারে, রাবণ ছিলেন শিবভক্ত। মা পার্বতী তাকে রক্ষা করতেন। তাই ব্রহ্মা রামকে পরামর্শ দেন, শিবের স্ত্রী পার্বতী কে পূজা করে তাকে তুষ্ট করতে। তাতে রাবণ বধ রামের পক্ষে সহজসাধ্য হবে। ব্রহ্মার পরামর্শে রাম শরৎকালে পার্বতীর দুর্গতিনাশিনী রূপের বোধন, চণ্ডীপাঠ ও মহাপূজার আয়োজন করেন। আশ্বিন মাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিন রাম কল্পারম্ভ করেন। তারপর সন্ধ্যায় বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস করেন। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও সন্ধিপূজার পরেও দুর্গার আবির্ভাব না ঘটায়, রাম ১০৮টি নীল পদ্ম দিয়ে মহানবমী পূজার পরিকল্পনা করেন। হনুমান তাকে ১০৮টি পদ্ম জোগাড় করে দেন। মহামায়া রামকে পরীক্ষা করার জন্য একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখেন। একটি পদ্ম না পেয়ে রাম পদ্মের বদলে নিজের একটি চোখ উপড়ে দুর্গাকে নিবেদন করতে গেলে, দেবী পার্বতী আবির্ভূত হয়ে রামকে কাঙ্ক্ষিত বর দেন।[২১] তবে সম্প্রতি একটি জরিপে দেখা গেছে কৃত্তিবাস ওঝা যে কাহিনী সংকলন করেছেন, তা রামচন্দ্রের প্রকৃত জীবনী বাল্মিকী রামায়ণে বা রামায়ণের অন্যান্য অনুবাদসমূহ যেমন, তুলসীদাস রচিত হিন্দি রামচরিতমানস, তামিলভাষায় কাম্ব রামায়ণ, কন্নড় ভাষায় কুমুদেন্দু রামায়ণ, অসমীয়া ভাষায় কথা রামায়ণ, ওড়িয়া ভাষায় জগমোহন রামায়ণ, মারাঠি ভাষায় ভাবার্থ রামায়ণ, উর্দু ভাষায় পুথি রামায়ণ প্রভৃতিতে উল্লেখিত হয় নি। এছাড়াও যোগবাশিষ্ট রামায়ণে উক্ত হয়নি।[২২]
পূজা মন্ত্র
[সম্পাদনা]সনাতম ধর্মের যেকোনো পূজার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সংস্কৃত মন্ত্রগুলি। দুর্গাপূজা মহাপূজা,(কারণ এতে মহাস্নান-পূজন-হোম-বলিদান - এই চারটি কর্ম জড়িত) এখানে পূজামন্ত্রের সঙ্গে শ্রীশ্রী চণ্ডীও পঠিত হয় । ঢাক-ঢোল-খোল-করতাল-শঙ্খ-ঘন্টা বাদ্যের সম্মিলিত ঐকতান, ধূপ-ধুনোর সুগন্ধী ধোঁয়া, ফুল-মালা-নৈবেদ্য-চন্দন-অগুরু-কস্তুরী-কর্পূরের মিলিত সুবাস, তার সাথে মন্ত্রোচ্চারণ ও মন্দ্রস্বরে চণ্ডীপাঠ এক ভাবগম্ভীর পবিত্র পরিবেশের সৃষ্টি করে। পূজায় প্রচলিত দেবী দুর্গার ধ্যানমন্ত্র:
“ |
|
” |
দুর্গা পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার মন্ত্র:
“ |
|
” |
দুর্গা প্রণাম মন্ত্র:
“ |
|
” |
মূর্তিতত্ত্ব
[সম্পাদনা]বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী; তার মুকুটের উপরে শিবের ছোট মুখ ,দেবীর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষ্মী ও নিচে গণেশ; বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়।কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গার প্রচলন করেন । তারা কার্তিকেয়র রূপ দেন জমিদারপুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে । এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গা এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষ্মী, বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। কলকাতার কোনও কোনও বাড়িতে দুর্গোৎসবে লক্ষ্মী ও গণেশকে সরস্বতী ও কার্তিকেয়ের সঙ্গে স্থান বিনিময় করতে দেখা যায়। আবার কোথাও কোথায় দুর্গাকে শিবের কোলে বসে থাকতেও দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গার বিভিন্ন রকমের স্বতন্ত্র মূর্তিও চোখে পড়ে। তবে দুর্গার রূপকল্পনা বা কাঠামোবিন্যাসে যতই বৈচিত্র থাকুক, বাংলায় দুর্গোৎসবে প্রায় সর্বত্রই দেবী দুর্গা সপরিবারে পূজিতা হন। এই প্রসঙ্গে স্বামী প্রমেয়ানন্দের উক্তিটি স্মরণীয়ঃ
“ | ...ধনদাত্রী লক্ষ্মী, বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী, শৌর্য-বীর্যের প্রতীক কার্তিকেয়, সিদ্ধিদাতা গণেশ ও তাঁদের বাহন-সকলের মূর্তিসহ মহামহিমময়ী দুর্গামূর্তির পরিকল্পনা ও পূজা বাংলার নিজস্ব।[২৩] | ” |
দুর্গা
[সম্পাদনা]হিন্দু শাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা নিম্নোক্তরূপে প্রদত্ত হয়েছে:
“ | দৈত্যনাশার্থবচনো দকারঃ পরিকীর্তিতঃ। উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত।। |
” |
- ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ, দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই দুর্গা। অন্যদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে, “দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্তিতা” – অর্থাৎ, দুর্গ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে অভিহিতা।[২৫] আবার শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি।[২৬]
সিংহ
[সম্পাদনা]দুর্গার বাহন সিংহ। শ্রীশ্রীচণ্ডী-তে সিংহকে "মহাসিংহ", "বাহনকেশরী", "ধূতসট" ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে।[২৭] দুর্গাপূজার সময় সিংহকেও বিশেষভাবে পূজা করা হয়। দেবীপুরাণ-এ উল্লিখিত সিংহের ধ্যানে তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিষ্ণু, শিব, দুর্গা প্রমুখ দেবদেবীরা অবস্থান করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[২৮] অপর একটি ধ্যান মন্ত্রে সিংহকে বিষ্ণুর একটি রূপ বলা হয়েছে।[২৯] কালীবিলাস তন্ত্র-এ দুর্গার বাহনকে বলা হয়েছে বিষ্ণুরূপী সিংহ।[৩০]
সিংহের প্রণামমন্ত্রে বলা হয়েছে:
“ | ওঁ সিংহস্ত্বং হরিরূপোহসি স্বয়ং বিষ্ণুর্ণসংশয়। পার্ব্বত্যা বাহনস্ত্বং হি অতঃ পূজয়ামি ত্বামহম্।। |
” |
কালিকাপুরাণ অনুসারে, মহামায়া কামাখ্যার বাহন হওয়ার জন্য শিব শবদেহ, ব্রহ্মা রক্তপদ্ম ও বিষ্ণ সিংহের মূর্তি ধারণ করেছিলেন।[৩১]
মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, হিমালয় দুর্গাকে সিংহ দেন। শিবপুরাণ অনুসারে, শুম্ভ-নিশুম্ভকে বধ করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গাকে সিংহ দেন।[৩২] পদ্মপুরাণ-এ আছে, দুর্গার ক্রোধ থেকে সিংহের জন্ম হয়।[৩৩] দেবীপুরাণ অনুযায়ী, বিষ্ণু দুর্গার বাহন সিংহকে নির্মাণ করেছিলেন এবং সেই সিংহে সকল দেবতার অধিষ্ঠান হয়েছিল।[৩৪]
সিংহ রজোগুণের এক প্রচণ্ড শক্তির উচ্ছ্বাসের প্রতীক। স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন,
“ | সত্ত্বগুণের অনুগত হলে সেই শক্তি লোকস্থিতির সহায়ক হয়ে ওঠে। ... (সিংহ) আসুরিকতা ও পাশবিকতার উচ্ছেদ সাধনপূর্বক দেবীর লোকস্থিতিমূলক পূণ্য কর্মের সহায়কারী।[৩৫] | ” |
এছাড়াও সিংহ মানুষের পশুত্ববিজয়েরও প্রতীক। স্বামী প্রমেয়ানন্দ লিখেছেন,
“ | প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে পশুশক্তি। পুরুষকার ও সাধন-ভজনের দ্বারা মানুষ যখন যথার্থ মনুষ্যত্বে উপনীত হয় তখন তার পশুভাব কেটে গিয়ে দেবভাব জাগ্রত হয়। আর তখনই সে প্রকৃত শরণাগত হওয়ার যোগ্যতা লাভ করে, সার্থক জীবনের অধিকারী হয়। দেবীর চরণতলে সিংহ সেই ভাবেরই প্রতীক।[৩৬] | ” |
মহিষাসুর
[সম্পাদনা]মহিষাসুর অসুর, অর্থাৎ দেবদ্রোহী। তাই দেবীপ্রতিমায় দেবীর পদতলে দলিত এই অসুর ‘সু’ এবং ‘কু’-এর মধ্যকার চিরকালীন দ্বন্দে অশুভ শক্তির উপর শুভশক্তির বিজয়ের প্রতীক। স্বামী প্রমেয়ানন্দের ভাষায়,
“ | সাধকের পক্ষে অসুর অবিদ্যা। বিদ্যারূপিণী মা অবিদ্যা বিনাশ করে মহামুক্তির বিধান করেন। সাধারণ মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট, ভয়-ভীতি, আপদ-বিপদ – এ-সকলই আসুরিক শক্তির কার্য। পরমকরুণাময়ী মা নিরন্তর অসুর বিনাশ করে সন্তানের কল্যাণ বিধান করছেন।[৩৭] | ” |
তবে অসুর হলেও দুর্গোৎসবে মহিষাসুরের পূজা কিন্তু শাস্ত্রনির্দিষ্ট। কালিকা পুরাণ অনুসারে, মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে ভদ্রকালীর হাতে নিজের শিরশ্ছেদ ও রক্তপানের স্বপ্নদৃশ্য দেখে ভীত মহিষাসুর ভদ্রকালীকে তুষ্ট করেন। ভদ্রকালী তাঁর ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে বরদান করতে ইচ্ছুক হন। মহিষাসুর যজ্ঞভাগ বর চাইলে দেবী সেই বর দিতে অস্বীকৃত হন; কিন্তু মহিষাসুরকে এই বর দেন যে যেখানেই দেবী অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা, ষোড়শভুজা ভদ্রকালী ও দশভুজা দুর্গা রূপে পূজিতা হবেন, সেখানেই তাঁর চরণতলে থেকে মহিষাসুরও পূজা পাবেন। কালিকা পুরাণের বর্ণনায় আরও জানা যায় যে স্বয়ং মহাদেব রম্ভাসুরের কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তিন জন্মে মহিষাসুর রূপে তাঁর পুত্র হিসাবে জন্ম নেন, আর জগজ্জননী দুর্গার পদলগ্ন হয়ে সিংহরূপী বিষ্ণুর সঙ্গে দেবীর ভার বহন করেন।
পূজাকালে মহিষাসুরের প্রণাম মন্ত্রে তাই বলা হয়
“ |
|
” |
গণেশ
[সম্পাদনা]গণেশ কার্যসিদ্ধির দেবতা। হিন্দু পুরাণের নিয়ম অনুসারে, অন্যান্য দেবতার আগে গণেশের পূজা করতে হয়। গণেশের পূজা আগে না করে অন্য কোনো দেবতার পূজা করা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। স্বামী প্রমেয়ানন্দ লিখেছেন,
“ | গণশক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ সেখানে কর্মের সকল প্রকার বাধাবিঘ্ন দূরীভূত হয়। দেবাসুর-যুদ্ধে দেবতারা যতবারই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অসুরদের সঙ্গে লড়াই করেছেন ততবারই তাঁরা জয়ী হয়েছেন। গণেশের আর এক নাম বিঘ্নেশ, অর্থাৎ বিঘ্ননাশকারী। বিঘ্নেশ প্রসন্ন থাকলে সিদ্ধি নিশ্চিত।[৩৯] | ” |
মুষিক
[সম্পাদনা]গণেশের বাহন মূষিক বা ইঁদুর। ইঁদুর মায়া ও অষ্টপাশ ছেদনের প্রতীক। ব্রহ্মর্ষি শ্রীসত্যদেবের ভাষায়,
“ | অথর্বশীর্ষের সায়নভাষ্যে উক্ত হইয়াছে মুষ্ণাতি অপহরতি কর্মফলানি ইতি মূষিকঃ। জীবের কর্মফলসমূহ অজ্ঞাতসারে অপহরণ করে বলিয়া ইহার নাম মূষিক। প্রবল প্রতিবন্ধকস্বরূপ কর্মফল বিদ্যমান থাকিতে সিদ্ধিলাভ হয় না। তাই, কর্মফল হরণের উপর সিদ্ধি প্রতিষ্ঠিত।[৪০] | ” |
লক্ষ্মী
[সম্পাদনা]লক্ষ্মী শ্রী, সমৃদ্ধি, বিকাশ ও অভ্যুদয়ের প্রতীক। শুধু ধনৈশ্বর্যই নয়, লক্ষ্মী চরিত্রধনেরও প্রতীক। স্বামী নির্মলানন্দের ভাষায়,
“ | ধন, জ্ঞান ও শীল – তিনেরই মহনীয় বিকাশ দেবী লক্ষ্মীর চরিত্রমাহাত্ম্যে। সর্বাত্মক বিকাশের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা বলেই তিনি কমলা। কমল বা পদ্মের ন্যায়ই তিনি সুন্দরী; তদীয় নেত্রদ্বয় পদ্মের ন্যায় আয়ত। তাঁর শুভ করে প্রস্ফুটিত পদ্মকুসুম; পদ্মবনেই তাঁর বসতি।[৪১] | ” |
মহানামব্রত ব্রহ্মচারী অন্যদিকে সমুদ্রমন্থনে সমুদ্ভূতা দেবী লক্ষ্মীর মূর্তিতত্ত্বের অপর এক ব্যাখ্যাও দিয়েছেন,
“ | যাঁহারা বিচক্ষণ তাঁহারা ভূমি-প্রকৃতি কর্ষণ করিয়া শস্যধন আহরণ করেন, বন-প্রকৃতি অনুসন্ধান করিয়া ধন আহরণ করেন। খনি প্রকৃতি খনন করিয়া স্বর্ণধন সংগ্রহ করেন। এই সকলই সাগরমন্থন। ... এই সকল সাগর-মন্থনে ধনাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর আবির্ভাব।[৪২] | ” |
পেচক
[সম্পাদনা]লক্ষ্মীর বাহন পেচক বা প্যাঁচা। রূপে ও গুণে অতুলনীয় এই দেবীর এমন কিম্ভূত বাহন কেন, সে নিয়ে বেশ কয়েকটি মত প্রচলিত। প্রথমেই স্মরণে রাখা কর্তব্য, হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও পেচককে লক্ষ্মীর বাহনের মর্যাদা দান করা হয়নি। এই বিশ্বাস একান্তই বাঙালি হিন্দু লোকবিশ্বাস।
প্যাঁচা দিবান্ধ। মনে করা হয়, যাঁরা দিবান্ধ অর্থাৎ তত্ত্ববিষয়ে অজ্ঞ, তারাই পেচকধর্মী। মানুষ যতকাল পেচকধর্মী থাকে ততদিনই ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করে সে।[৪৩] মহানামব্রত ব্রহ্মচারীর মতে,
“ | পেচক মুক্তিকামী সাধককে বলে, সকলে যখন ঘুমায় তুমি আমার মতো জাগিয়া থাকো। আর সকলে যখন জাগ্রত তখন তুমি আমার মতো ঘুমাইতে শিখ, তবেই সাধনে সিদ্ধি। কৈবল্যধন লাভ।
পরমার্থধনাভিলাষী সাধক পেঁচার মতো রাত্রি জাগিয়া সাধন করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্জনে থাকে। লক্ষ্মীমার বাহন রূপে আসন লইয়া পেচকের যে ভাষণ তাহা বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন প্রকার সাধকের উপাদেয় সম্পদ।[৪৪] |
” |
সরস্বতী
[সম্পাদনা]সরস্বতী বাণীরূপিণী বাগদেবী; তিনি জ্ঞানশক্তির প্রতীক।
“ | দেবীর হাতে পুস্তক ও বীণা। পুস্তক বেদ শব্দব্রহ্ম। বীণা সুরছন্দের প্রতীক নাদব্রহ্ম। শুদ্ধ সত্ত্বগুণের পূর্তি, তাই সর্বশুক্লা। শ্বেতবর্ণটি প্রকাশাত্মক। সরস্বতী শুদ্ধ জ্ঞানময়ী প্রকাশস্বরূপা। জ্ঞানের সাধক হইতে হইলে সাধককে হইতে হইবে দেহে মনে প্রাণে শুভ্র-শুচি।[৪৫] | ” |
হংস
[সম্পাদনা]সরস্বতীর বাহন হংস। হংস হিন্দুদের নিকট একটি পবিত্র প্রতীক।
“ | সরস্বতী-ব্রহ্মবিদ্যা। যে সাধক দিবারাত্র অজপা মন্ত্রে সিদ্ধ তিনিই হংসধর্মী। মানুষ সুস্থ শরীরে দিবারাত্র মধ্যে একুশ হাজার ছয়শত ‘হংস’ এই অজপা মন্ত্রজপরূপে শ্বাস-প্রশ্বাস করিয়া থাকে। মানুষ যতদিন এই স্বাভাবিক জপ উপলব্ধি করিতে না পারে, ততদিন ‘হংসধর্মী’ হইতে পারে না; সুতরাং ব্রহ্মবিদ্যারও সন্ধান পায় না।[৪৬] | ” |
কার্তিকেয়
[সম্পাদনা]দেবসেনাপতি কার্তিকেয় বা কার্তিক সৌন্দর্য ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক।
“ | যুদ্ধে শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন একান্ত প্রয়োজনীয়। তাই সাধক-জীবনে এবং ব্যবহারিক জীবনে কার্তিকেয়কে প্রসন্ন করতে পারলে শৌর্য-বীর্য আমাদের করতলগত হয়...[৪৭] | ” |
ময়ূর
[সম্পাদনা]কার্তিকেয়ের বাহন ময়ূর। সৌন্দর্য ও শৌর্য – কার্তিকেয়ের এই দুই বৈশিষ্ট্যই তার বাহন ময়ূরের মধ্যে বিদ্যমান।
শিব
[সম্পাদনা]অন্যান্য মূর্তি
[সম্পাদনা]দেবীর ধ্যান মন্ত্র বলা হয়,
"অষ্টাভি শক্তিভিস্তাভিঃ সততং পরিবেষ্টিতাং।"
অর্থাৎ, তিনি সবসময় অষ্ট শক্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। এই অষ্টশক্তি হলেন উগ্ৰচণ্ডা, প্রচণ্ডা, চণ্ডোগ্ৰা, চণ্ডনায়িকা, চণ্ডা, চণ্ডবতী,চণ্ডরূপা, অতিচণ্ডিকা। তবে বর্তমানে দেবী বিগ্রহে এই অষ্টশক্তির বিগ্রহ সংযুক্ত থাকে না। যদিও, এনাদের পূজা করা হয় দেবীর সাথেই।
আচার ও অনুষ্ঠানসমূহ
[সম্পাদনা]চণ্ডীপাঠ
[সম্পাদনা]মহালয়া
[সম্পাদনা]মহালয়া বা পিতৃপক্ষের দিন থেকে মূলত দুর্গা পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। তবে এ দিনটির তাৎপর্য মূলত ভিন্ন। এ তিথিকে পিতৃপক্ষও বলা হয়ে থাকে। এ দিনে পিতৃপক্ষের শেষ এবং দেবী পক্ষের শুরু হয়। এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপুরুষের স্মরণ করে, পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্মা যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষেরও শেষদিন এটি। মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্মার শান্তির জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয়, পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন। যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই আজ স্মরণ করার তাদের জন্য ও অঞ্জলি প্রদান করতে হয়।
এ সম্পর্কে মহাভারতে একটি কাহিনী বর্ণীত আছে যে: প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তার আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তার পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণকে স্বর্ণ প্রদান করেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়। এই কাহিনির কোনো কোনো পাঠান্তরে, ইন্দ্রের বদলে যমকে দেখা যায়।
“ | ময়া দত্তেন তোয়েন তৃপ্যান্ত ভুবনত্রয়ম
আব্রহ্ম স্তম্ভ পর্যন্তং জগত্ তৃপ্যতু |
” |
দুর্গাষষ্ঠী
[সম্পাদনা]কল্পারম্ভ
[সম্পাদনা]বোধন
[সম্পাদনা]আমন্ত্রণ ও অধিবাস
[সম্পাদনা]সপ্তমীপূজা
[সম্পাদনা]নবপত্রিকা
[সম্পাদনা]নবপত্রিকা ওড়িশা ও বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নটি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নটি পাতা নয়, নটি উদ্ভিদ। এগুলি হল -
- কদলী বা রম্ভা (কলা),
- অপরাজিতা,
- হরিদ্রা (হলুদ),
- জয়ন্তী,
- বিল্ব (বেল),
- দাড়িম্ব (দাড়িম),
- অশোক,
- মানকচু,
- ধান
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ।
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়। এই নয় দেবী হলেন রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী। এই নয় দেবী একত্রে "নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা" নামে নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন।
মহাসপ্তমীর দিন সকালে নিকটস্থ নদী বা কোনো জলাশয়ে (নদী বা জলাশয়ে না থাকলে কোনো মন্দিরে) নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তার পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাষ্ঠসিংহাসনে স্থাপন করা হয়। পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমাস্থ দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পূজা করা হয় না।
মহাস্নান
[সম্পাদনা]দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হল মহাস্নান। মহাসপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্নানের পর মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়।[৪৮] দুর্গাপ্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে স্নান করানো হয়।[৪৯] মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলে দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানো হয়।[৪৮] মহাস্নানের প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে স্বামী ত্যাগিবরানন্দ লিখেছেন,
এই সকল ক্রিয়ানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণীজসম্পদ, ভূমিসম্পদ প্রভৃতি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে। এমনকী চাষা-ভূষা, মুচি-মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ, মালি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, ঋষি, দাস প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা প্রেরণ করে। এককথায় সার্বিক সমাজলক্যাণ চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।[৪৯]
পূজায় বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা তথা পতিতালয়ের দ্বারের মাটি ব্যবহারের কারণ হিসেবে বিশ্বাস করা হয় যে যখন পুরুষেরা পতিতালয়ের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে পতিতার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পাপ সংগ্রহ করেন, তখন জীবনের সঞ্চিত সমস্ত পুণ্য সেই দরজাতেই ফেলে আসেন তারা৷ পতিতালয়ের মাটি তাই পরম পবিত্র। পতিতারা সমাজের অপবিত্রতা নিজের মধ্যে ধারণ করে সমাজকে পবিত্র রাখে বলে এই মাটি পূজার অন্যতম উপাদান।[৫০][৫১][৫২][৫৩]
অষ্টমীপূজা
[সম্পাদনা]অষ্টমী পূজা হলো দুর্গা পূজার একটি গুরুত্ব পূর্ণ অংশ। এই অষ্টমীর দিনে অনেক মানুষ পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে দেবী দুর্গাকে নিজের মনের ইচ্ছা জানায়। পূজার সূচনায় দন্তকাষ্ঠ ও উষ্ণোদকে দেবীর মুখপ্রক্ষালনের পর মহাস্নান, সাধারণ পূজার নিয়মে ন্যাস, অর্ঘ্যস্থাপন প্রভৃতির পর দুর্গা, কার্তিক,গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর পৃথক ষোড়শোপচার পূজা, নবপত্রিকা পূজা, সর্বতোভদ্রমণ্ডলে অষ্টশক্তি, অষ্টমাতৃকা, নবঘট- নবপতাকায় নবদুর্গার পূজা, ৬৪ যোগিনী ও কোটি যোগিনীর পূজা, দেবীর অস্ত্রপূজার পর সিংহ, মহিষাসুর, ময়ূর, মুষিকের পঞ্চোপচার পূজা সমাধা করা হয়। এই দিন অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে ৪৮ মিনিটে চামুণ্ডা রূপে দেবী দুর্গাকে পুজো করা হয়। এই দিন বিভিন্ন মন্দিরে চালকুমড়ো, চিনি প্রভৃতি বলি দেবার রীতি প্রচলিত আছে। এই দিন অষ্টমীর সন্ধি পুজোর সময় অষ্ট মাতৃকা, ৬৪ ও কোটি যোগিনীরও পুজো করা হয়। এই দিন বেশিরভাগ মন্দিরে দেবী দুর্গাকে লুচি সুজির ভোগ দেওয়া হয়। এই মহাষ্টমী তিথি হল দুর্গা পূজার মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান দিন।
কুমারী পূজা
[সম্পাদনা]তন্ত্রশাস্ত্রমতে, কুমারী পূজা হলো ষোলো বছরের অনধিক অরজঃস্বলা কুমারী মেয়েকে দেবীজ্ঞানে পূজা করা। বিশেষত দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।
সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ষোলো বছরের কম বয়স্কা কোনো কুমারী বালিকাকে দেবীজ্ঞানে পূজা করার রীতি আছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণ মতে, দেবী অম্বিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়ে বেলগাছে দেবীর বোধন করতে নির্দেশ দেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবীকে কুমারী নামে অভিহিত করা হয়েছে। দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারী মন্দিরে আরাধ্যা দেবী কুমারী রূপেই পূজিতা হন। যেহেতু কুমারী পূজা তান্ত্রিক মতবাদের প্রতিফলন তাই ভারতের সব শক্তিপীঠেই কুমারী পূজা হয়ে থাকে। কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে বিভিন্ন নামে পূজা করা হয়। এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুই বছরে সরস্বতী, তিন বছরে ত্রিধামূর্তি, চার বছরে কালিকা, পাঁচ বছরে সুভগা, ছ'বছরে উমা, সাত বছরে মালিনী, আট বছরে কুঞ্জিকা, ন'বছরে কালসন্দর্ভা, দশ বছরে অপরাজিতা, এগারো বছরে রুদ্রাণী, বারো বছরে ভৈরবী, তেরো বছরে মহালক্ষ্মী, চোদ্দ বছরে পঠিনায়িকা, পনেরো বছরে ক্ষেত্রজ্ঞা এবং ষোলো বছরে অম্বিকা নামে অভিহিতা হয়। তন্ত্র মতে, কন্যা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত তারা দেবীরূপে পূজিত হতে পারে। আরও বলা হয় যে, একটি কুমারী কন্যাকে খাওয়ানোর অর্থ বিশ্বভুবনকে খাওয়ানো।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর, স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপূজার অষ্টমী তিথিতে প্রথম কুমারী পূজার সূচনা করেন।[৫৪] বেলুড় মঠে রঘুনন্দন প্রণীত তত্ত্ব অনুসারেই পূজা নিষ্পন্ন হয়। পুজোয় সারদা দেবীর নামে সংকল্প করা হয়। পশুবলির ব্যবস্থা করা হলেও তা হয়নি।
সন্ধিপূজা
[সম্পাদনা]দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অধ্যায় হল সন্ধি পূজা । দুর্গাপূজার অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে ৪৮ মিনিট এই পূজা হয়ে থাকে। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট নিয়ে মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। যেহেতু অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে এই পূজা হয়, তাই এই পূজার নাম সন্ধিপূজা অর্থ্যাৎ সন্ধি-কালীন পূজা। এই পূজা দুর্গাপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ, এইসময় দেবী দুর্গাকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়ে থাকে। সন্ধিপুজোর মাহেন্দ্রক্ষণেই দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। এই পূজা সম্পন্ন হয় তান্ত্রিক মতে। এই পূজায় দেবীকে ষোলটি উপাচার নিবেদন করা হয়। এই সময় বলিকৃত পশুর স্মাংস-রুধি (মাংস ও রক্ত) এবং কারণ (মদ) দেবীর উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়।[৫৫]
নবমীপূজা
[সম্পাদনা]দশমীপূজা
[সম্পাদনা]বিসর্জন ও বিজয়া দশমী কৃত্য
[সম্পাদনা]দশমির দিন সকালে প্রথা মেনে পূজা সম্পন্ন করার পর ঢাক ঢোল বাজিয়ে বেদনা মিশ্রিত আনন্দের সাথে জলাশয় বা নদী দেবীর ঘট বিসর্জন করে দেবীকে বিদায় জানানো হয় । শুরু হয় আবার এক বছরের প্রতীক্ষা।
অপরাজিতা পূজা
[সম্পাদনা]অপরাজিতা পূজা দুর্গাপূজার একটি অঙ্গ। দুর্গার অপর নাম অপরাজিতা। তবে এই দেবীর মূর্তি অন্যরকম। ইনি চতুর্ভূজা; হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা; গায়ের রং নীল; ত্রিনয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা।[৫৬] বিজয়াদশমীর দিন বিসর্জনের পর পূজামণ্ডপের ঈশানকোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতার লতা রেখে এই দেবীর পূজা করা হয়। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে, ইনি "...বৈষ্ণবী শক্তি বিষ্ণুমায়া লক্ষ্মী ও শিবশিক্তি শিবানীর মিশ্রণে কল্পিতা।"[৫৭]
পূজা উদ্যাপন
[সম্পাদনা]পশ্চিমবঙ্গ
[সম্পাদনা]শরৎকালীন দুর্গাপূজা পশ্চিমবঙ্গের প্রধান হিন্দু উৎসব। বাংলা পঞ্জিকার আশ্বিন বা কার্তিক মাসে (সেপ্টেমর-অক্টোবর মাসে) এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণে রাবণ বধের জন্য রামের দুর্গাপূজার পৌরাণিক কাহিনিটি উল্লেখিত হয়েছে। দুর্গার পূজা বসন্তকালের উৎসব হলেও, রাম শরৎকালে তার পূজা করেছিলেন। এই পূজা অকালবোধন নামে পরিচিত।[৫৮] তাই বাসন্তী পূজা এখনও প্রচলিত থাকলেও, শারদীয়া দুর্গাপূজাই মহাসমারোহে পালিত হয়।
সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী থেকে দশমী তিথি পর্যন্ত দুর্গাপূজা পালিত হয়। বাঙালি হিন্দুরা এই উৎসবকে হিমালয়ে দেবী দুর্গার বাপের বাড়ি ফেরার অনুষ্ঠান হিসেবেই দেখে। বাঙালি হিন্দু সমাজে এই পূজা উপলক্ষে নতুন পোশাক পরার চল রয়েছে। পূজার সময় মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে প্রতিমা দর্শনও বাঙালি হিন্দুদের একটি বিশেষ প্রথা।[৫৯]
বাংলাদেশ
[সম্পাদনা]হিন্দুধর্ম বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়। হিন্দুদের বৃহত্তম উৎসব হওয়ার জন্য তাই বাংলাদেশেও গ্রাম ও শহরে ৩২ হাজারের বেশি দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়। দুর্গাপূজার বিজয়াদশমীর দিনে বাংলাদেশে সরকারিভাবে একদিন ছুটি দেওয়া হয়।[৬০]
বাংলাদেশে দুর্গাপূজার দৃশ্য
[সম্পাদনা]ময়মনসিংহ শহরের শিববাড়ি মন্দিরের মন্ডপে দুর্গাপূজায় পুরোহিত ব্যাতিত সকলেই নারী।
বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা
[সম্পাদনা]প্রচলিত মত হল, বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা করেন নদীয়ার (এখন রাজশাহী জেলার) তাহেরপুরে রাজা কংস নারায়ণ রায় বাহাদুর। ১৫৮০[৬১] সালে পূজা শুরু হয়।কথিত আছে সেই সময় এই পূজায় কংস নায়রাণ ৮-৯ লক্ষ টাকা খরচ করেছিলেন। তিনি কংস নারায়ণ মন্দিরও ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।[৬২][৬৩] রাজকীয় অনুষ্ঠান করার ইচ্ছায় কংসনারায়ণ মহাযজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নেন। রাজপুরোহিত ছিলেন নাটোর বাসুদেবপুরের ভট্টাচার্য বংশের পণ্ডিত রমেশ শাস্ত্রী। বংশানুক্রমে কংসনারায়ণ পশুবলি-বিরোধী বলে অশ্বমেধ বা গোমেধ যজ্ঞ করা যাবে না বলে দুর্গাপূজা শুরু করেন। আর একটি দাবী মতে, তারও আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর (১৪৮৬ - ১৫৩৪) প্রধান শিষ্য নিত্যানন্দ খড়দহে স্বগৃহে প্রতিমায় দুর্গোৎসব করেছিলেন।[৬৪] আর একটি মতে কনৌজের পাঁচ কুলীন ব্রাহ্মণের এক ব্রাহ্মণ সুধানিধির বংশকে ‘ঘোষাল’ উপাধি দেন বাংলার শাসক লক্ষণ সেন। ১৪৫০ সালে সেই সুধানিধি বংশের আশুতোষ ঘোষাল কোন্নগরে আসেন। সেই ঘোষাল বংশের পারিবারিক নথি অনুসারে, কোন্নগরের বাড়িতে ১৪৫৪ সালে বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা হয়। আরো একটি মতে ১৫০৭ সালে চন্দননগরের খলিসানির বসু বাড়িতে করুণাময় বসু দুর্গাপূজার প্রবর্তন করে। সেই দুর্গাপূজারর বিস্তৃতি ছড়ায় সেই বংশের রামকমল বসুর আমলে। পর্তুগিজদের সঙ্গে ব্যবসা করতেন বলে তাঁকে বলা হতো ‘ফিরিঙ্গি কমল বসু’। রামকমল বসুর নামে আপার চিৎপুর রোডের (বর্তমানে রবীন্দ্র সরণি) বাড়িতে এখন বর্তমানে ‘মাতৃমঙ্গল প্রতিষ্ঠান’ নামে হাসপাতাল রয়েছে।[৬৪]
আরও একটি দাবী মতে, বাংলায় সবার আগে মাটির মূর্তিতে দুর্গাপূজা হয়েছে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরে। তখন মল্লভূমের রাজধানী প্রদ্যুম্ননগরে ছিল। রাজা জগৎমল্ল (রাজত্বকাল ৯৯৪ থেকে ১০০৭) ছিলেন এই বংশের ১৯ তম রাজা। লোকশ্রুতি মতে প্রদ্যুম্ননগর থেকে রাজধানী বিষ্ণুপুরে সরিয়ে আনেন এবং রাজা জগৎমল্ল মৃন্ময়ী দেবীর মূর্তি পূজা শুরু করেন।[৬৪]
বনেদি বাড়ির পুজো
[সম্পাদনা]পারিবারিক স্তরে বাসন্তী ও দুর্গা দেবীর পূজা প্রধানত ধনী পরিবারগুলিতেই আয়োজিত হয়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে পুরনো ও ধনী বা এককালীন সেখানকার উচ্চ রাজবংশের পরিবারগুলিতে বাসন্তীপূজা "বনেদি বাড়ির পূজা" নামে পরিচিত। যোড়শ শতক থেকেই বাংলার রাজবাড়ি ও জমিদারবাড়িগুলোয় বসন্তকালে বাসন্তীপুজো অনুষ্ঠিত হয়।মহিষাসুর মর্দিনীর প্রাণপুরুষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পূর্বপুরুষ এর শেকড় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার উথলী গ্রামের দুর্গা পুজার ইতিহাস :
অবিভক্ত ভারতের খুলনা জেলার কপোতাক্ষ তীরবর্তী একটি গ্রাম উথলী। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ইসলামকাটি ইউনিয়নের কর্দমাক্ত মেঠো পথে ঘেরা সুফলা সুজলা গ্রাম উথালী। মহিষাসুর মর্দিনীর প্রানপুরুষ স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের পারিবারিক বংসপজ্ঞী খুজতে যেয়ে কিছু প্রাচীন কাগজ পত্রের সন্ধান পাই। সেখান থেকে উথলীর সামান্য কিছু তথ্য আমাদের হাতে আসে। প্রাচীন কালে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে ওঠে কপোতাক্ষের তীরে আজকের উথালী (প্রাচীন বুড়ন দ্বীপ)। এই গ্রামে কোঠাবাড়ি নামক স্থানে ১০৮ টি ঘরের সমন্বয়ে এক বিশাল অট্টালিকা গড়ে ওঠে। সেখানেই প্রথমে শুরু হয় দুর্গাপুজা। একটা তালপাতায় ১০৭৬ বঙ্গাব্দের বাৎসরিক দুর্গাপুজার হিসাব আবিস্কৃত হয়। সেখানে পুজার মোট খরচ আট আনা লিপিবদ্ধ আছে। উথালী (প্রাচীন বুড়ন দ্বীপ) এর দুর্গা পুজার সঠিক হিসাব জানা না গেলেও আপাতত এটা ৩৫৪ বছরের ও অধিক পুরাতন। পরবর্তীতে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দে এটা পুনরায় নতুন করে তৈরি করা হয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে শত শত বছর ধরে প্রতিবদ থেকে দেবী শৈলপুত্রি, দেবী মহাগৌরি, দেবী কাত্যয়নী, দেবী স্কন্দমাতা, দেবী চন্দ্রঘণ্টা, দেবী ব্রহ্মচারিণী, দেবী কালরাত্রি, দেবী সিদ্ধিদাত্রী ও দেবী কুষ্মাণ্ডা এই নয় রুপে নবদুর্গা পুজিত হয়ে আসছেন। কালের বিবর্তনে বড় বড় দালানকোঠা ,হাজার হাজার বিঘা সম্পত্তি হারিয়ে গেলেও এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ভদ্রবংসের অস্তমিত শেষ প্রদীপ উথালীর দুর্গা পুজা অলৌকিক ভাবে মাত্র ১১ জন সদস্য এর হাতে টিকে রয়েছে।তথ্যসুত্র:আনন্দ বাজার পত্রিকা।১৪/১০/২৩
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নতুন রীতি প্রচলন করে মহালয়ার দিন থেকে শুরু করলেন সকলের মঙ্গলকামনায় যজ্ঞ, টানা নবমী পর্যন্ত চলত সেই যজ্ঞ৷ কথিত আছে, মহালয়ার পর থেকে নাকি কখনও আগুন নিভত না। যজ্ঞের দেবী এখানে রাজরাজশ্বরী, শক্তির প্রতীক। তাই যোদ্ধাবেশী। দেবীর বাহন এখানে সিংহরূপী। এখনও সেই প্রথা মেনেই রাজবাড়িতে পুজো হয় একচালার যোদ্ধা দেবীর। প্রতিমার মাটি মাখতে ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র গঙ্গাজল। নবদ্বীপ থেকে নিয়ে আসা হয় সেই জল। আগে পুজোতে বাড়ির মহিলারা উপস্থিত থাকলেও প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় দেবীর সঙ্গে যাওয়ার নিয়ম ছিল না। তখন নীলকণ্ঠ পাখি দেবীপ্রতিমার সঙ্গে ভাসানে যেত। ভাসান হয়ে গেলেই সে ফিরে আসত রাজবাড়ির বারান্দায়; এরপর অন্দরমহলে শুরু হয়ে যেত বিজয়ার প্রস্তুতি। এখন আর রাজবাড়ির পুজোতে সেই জৌলুস না থাকলেও রয়ে গিয়েছে আচার রীতি। এখনও দেবীর পুজোয় ব্যবহার করা হয় ১০৮ টি ফোটা পদ্ম। জল আনা হয় নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে। আগে পুজোর পরে তৈরি হতো মাটির অসুর মূর্তি। রাজা তিরধনুক নিয়ে বধ করতেন তাকে। সে রীতিও এখন আর নেই। তবে এখনও দেশ বিদেশের লোক পুজোর সময় সকলে আমন্ত্রিত হন রাজ দালা।
চিল্কিগড়ের পুজো
[সম্পাদনা]সামন্ত রাজা গোপীনাথ মত্ত গজসিং স্বপ্নে নির্দেশ পেয়েছিলেন রানির হাতের কঙ্কণ দিয়ে তৈরি করতে হবে মায়ের চতুর্ভুজা অশ্বারোহী মূর্তি, কনক দুর্গা নামে পুজো নেবেন মা চণ্ডী। সেই থেকেই শুরু হয় চিল্কিগড় রাজবাড়ির দুর্গা পুজো। অনেক খুঁজেও যখন পূজার জন্য কোনও ব্রাহ্মণ পাওয়া যায়না, তখন ওড়িশা থেকে আনা হয় রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীকে। সেই থেকে এই ষড়ঙ্গী বংশই বংশ পরম্পরায় পুজো করে আসছে এখানে৷ কথিত আছে, এক সময় মায়ের পুজো সেরে বাড়ি ফেরার পথে রাজ পুরোহিতকে ছোবল মারে একটি কালো খরিস সাপ। পুরোহিত যখন যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট তখনই স্বপ্নে দেখা দিলেন নীল শাড়ি পরিহিতা চতুর্ভুজা দুর্গা; সুস্থ হলেন পুরোহিত, দেবীর আশীর্বাদে অঞ্চলে তারপর থেকে আর দেখা যায়নি এই সাপ। রাজত্ব অবলুপ্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে রাজবাড়ির ১৫ দিনের পুজো নেমে আসে ৫ দিনে। এই ৫ দিনই মহা সমারোহে হয় চণ্ডীপাঠ। আয়োজন হয় বলির৷ দেবী এখানে রক্তমুখী, তাই বলি বাধ্যতামূলক। এক সময় নরবলিও হত৷ কথিত আছে, একবার এক বালককে নিয়ে আসা হয় বলি দিতে। হাঁড়ি কাঠে গলা দেওয়ার পর দুর্গামন্ত্র জপ করতে শুরু করে সে; জানা যায় সে এক ব্রাহ্মণ সন্তান। সেই থেকে নরবলি বন্ধ হয়। এখন মহাষ্টমীতে মায়ের কাছে নিবেদন করা হয় ১০ থেকে ১২ টি মোষ আর পাঁচশোর-ও বেশি ছাগল। এখন পঞ্চমীর দিন রাজবাড়ির মহিলারা মায়ের মন্দিরে গিয়ে মাকে নতুন সাজে সাজান৷ অষ্টমী পুজোর দিন মন্দিরে উপস্থিত থাকেন কেবলমাত্র রাজবাড়ির লোকজন। পুজো হয়ে গেলে মন্দির খুলে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্য৷ অষ্টমীতেই পাওয়া যায় বিরাম ভোগ। পুজোর পাশাপাশি প্রাসাদ প্রাঙ্গনে বসে মেলা৷ হয় নাচ গানের অনুষ্ঠান৷ সেকালের রাজা-প্রজা সকলেই এখন একইসঙ্গে মেতে ওঠেন উৎসব অঙ্গনে।
শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো
[সম্পাদনা]১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে হেরে গিয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা৷ সেই যুদ্ধে ব্রিটিশদের যাঁরা সহায়ক ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা নবকৃষ্ণদেব৷ জয়ের আনন্দেই সে বছর নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো করেন তিনি৷ সে বছর পুজোর অন্যতম অতিথি ছিলেন লর্ড ক্লাইভ। এখনও সেই পরম্পরা মেনেই পুজোর আয়োজন হয় এখানে৷ শিকাগো বক্তৃতার পর স্বামী বিবেকানন্দকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল এই বাড়ির নাটমন্দিরেই৷ রাজা নবকৃষ্ণের আদি বাড়ি ছিল এটি৷ পরে তিনি পোষ্যপুত্র গোপীমোহনকে এই বাড়িটি দান করে নিজে নতুন বাড়িতে উঠে যান৷ এত গুণীজনের সমাবেশ হতো নাটমন্দিরে, অথচ বাইরে আসার হুকুম ছিল না বাড়ির মেয়েদের৷ পর্দানশীন অন্তঃপুরিকাগণ শুধুমাত্র অষ্টমীর দিনে চিকের আড়াল থেকে প্রতিমা দেখে অঞ্জলি দিতেন৷ সে সময় সারা দেশ থেকে আসতেন বত্রিশজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ৷ কৃষ্ণা নবমী তিথি থেকে তারা শুরু করতেন চণ্ডীপাঠ, সেই পাঠ শেষ করতে হতো ষষ্ঠীর দিন৷ এখনও হয় ২১০ বার চণ্ডীপাঠ৷ কাশী থেকে ব্রাহ্মণরা এসে বেদ এবং রামায়ণ পাঠ করেন৷ একবার পুজোর বলির জন্য উৎসর্গ করা পশু আশ্রয় নেয় পরিবারের তৎকালীন কর্তা হিন্দুকুলচূড়ামণি রাধাকান্ত দেবের পায়ের তলায়৷ সে বছর থেকে পশুবলি বন্ধ হয়ে যায় শোভাবাজার বাড়িতে৷ তখনকার প্রথা মেনে আজও নানা ধরনের ভাজা আর মিষ্টি দিয়ে হয় মায়ের ভোগ৷ বাড়িতে ভিয়েন বসিয়ে তৈরি হয় মিষ্টি৷ রাজবাড়ির প্রসাদ নিতে আসেন দূর-দূরান্তের মানুষ
শ্রীখন্ড কর্তারায় দুর্গাপুজো (কাটোয়া)
[সম্পাদনা]এটি বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত ব্রজবুলি ভাষার কবি গোবিন্দ দাস ও দামোদর সেন এর বাড়ির দুর্গা পুজো।যেটি কিনা শ্রীখন্ড নামক গ্রামে অবস্থিত পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ার কাছে।
এখন এই পুজোকে এই অঞ্চলের মানুষ কর্তা রায় বাড়ির দুর্গা পুজো বলেই চেনেন। দামোদর সেন এর সময় থেকেই এই পুজো আড়ম্বরের সঙ্গে এখনও চলছে।এই পুজো প্রায় ৮০০ বছরের ও বেশি বলে জানাযায়।এখনও শ্রী চিরঞ্জীব ও সুলোচন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বৃন্দাবন চন্দ্র ,রাধারাণী ও দুগ্ধ কুমার শিব নিত্য পুজো পান এই বাড়িতে।তাঁর দ্বারা নিজের হাতে প্রতিষ্ঠিত সেই সব মূর্তি পুজো হয়। দুর্গাপূজা শুরু হয় তিথি মেনে বোধনের পূজা দিয়ে তিথি শুরু হয় প্রায় ১০ থেকে ১৫ দিন আগে যে বছর যেমন তিথি থাকে। একমাত্র এই গ্রামে এখনো এই বাড়িতেই বোধন হয়। দুর্গা পুজোয় রয়েছে কিছু বৈচিত্র্য। তারা নিজের নিয়মে পুজো করেন।তাদের একটি পুরনো বই আছে সেই বই দেখেই হয় পুজোয় জোগাড়।আগে শাক্ত মতে পুজো হলেও, বহু বছর হলো বৈষ্ণব মতেই পুজো হয়। বর্তমানে বর্ধমান অঞ্চলে অন্যতম বৈষ্ণব মতে পূজিতা এই দেবী।দেবী সাদা ঘোড়ার মত সাদা সিংহের পিঠে বর্তমান।গ্রামের মানুষের ঢল নামে এই পুজোয়। কাটোয়া অঞ্চলের সবথেকে ও পূর্ব বর্ধমান জেলার পুরনো পুজোগুলোর মধ্যে একটি।এছাড়াও এই দেবী মুর্তি পুজোর সময় শিকল দিয়ে পিছন থেকে বেঁধে রাখা হয় কারণ দেবী সন্ধি পুজোর সময় নড়ে ওঠেন। আর যেখানে অন্যান্য জায়গায় সন্ধি পুজো সবাই দেখতে পান কিন্তু এই পুজোর এখানে পর্দা দিয়ে ঠাকুর কে ঢেকে রাখা হয় ।সেই সময় ওই ঠাকুর ঘরে পুরোহিত ও একজন মাত্র এই বাড়ির সেবায়েত ছাড়া আর কেউ থাকেন না। কারণ দেবী মুর্তি তখন উগ্র রূপ ধারণ করেন এমনটি মনে করা হয়। নানান হিন্দু শাস্ত্রে জানা যায় এই ২৪ মিনিট মায়ের মাতৃ ভাব থাকে না এই সময় তিনি উগ্র চন্ডী রূপ ধারণ করেন। এই বাড়িতে এমন হয়েছে যে অনেকেই দেখতে চেয়েছেন তার পড়ে অজ্ঞান হয়ে যান বা নানা রকম ঐশ্বরিক দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেছেন তাই এটাকে পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় ও বলিদানের বাজনা বাজলে পর্দা সরিয়ে সবাইকে দর্শনের সুযোগ করে দেওয়া হয় এই রকম রীতি চলে আসছে। বর্তমানে এই দায়িত্ব ভার সামলাচ্ছেন তরুণ সদস্য অরিন্দম রায়। বর্তমানে অন্যান্য বনেদি বাড়িতে যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে লোক বলের অভাবে পূজার কাজকর্ম করাতে হচ্ছে পয়সা দিয়ে লোক রেখে। কিন্তু এখনো এই পরিবারই এই গ্রামের মধ্যে যারা নবীন ও প্রবীণ প্রজন্ম একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করে চলছেন নিজের হাতে গয়না পরানো থেকে শুরু করে ফুলতলা,মালা গাঁথা,পূজার কাজকর্ম এবং প্রতিমা নিরঞ্জন অবধি পুরোটাই তারা পুরো পরিবারের সদস্য,সদস্যারা মিলে করার চেষ্টা করেন।নবীন প্রজন্মের মধ্যে রয়েছে পুজোর নিয়ম পবিত্রতা বজায় রাখার উৎসাহ প্রবীণরা সমস্ত দিক থেকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে চলেছেন এতদিন যে দায়িত্বভার তারা সামনে এসেছেন এখন সেই দায়িত্ব নতুন প্রজন্ম আনন্দের সঙ্গে কাঁধে তুলে নিয়েছেন দেখে তারাও আনন্দিত। এছাড়াও বহু,ক্ষেত্র সমিক্ষক ও লেখক রাও ভির করেন এই পুজো দেখার জন্য।
এটি ব্রজ বুলি ভাষার কবি গোবিন্দ দাসএর বাড়ির পুজো।যিনি কিনা বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত সব পদ রচনা করেছে বৈষ্ণব সাহিত্যের ইতিহাসের বিখ্যাত কর্তা দামোদর সেন এনিও এই বাড়ির কৃতি সন্তান। এখন এই বাড়ি কে সবাই কর্তা রায় বা বনকাটা রায় বলেই চেনেন।কারণ লোক মুখে জানা যায় এনার এই গ্রাম তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। বৈদ্য বংশীয় সমস্ত মানুষদের এই গ্রামে এনারাই প্রথম আনেন বলেন জানা যায়। সেজন্যই শিখন্ডের নাম আগে বৈদ্য খন্ড ছিল।
বাংলাদেশের বাগেরহাটে শিকদার বাড়ি পূজা
[সম্পাদনা]প্রতিবছর শিকদার বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমাসহ একহাজার থেকে দুইহাজার প্রতিমা বানানো হয়। অনেক দুরদুরান্ত থেকে লোকজন এই পূজামন্ডপে ভিড় জমায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
নোয়াখালী রামেন্দ্র সাহার বাড়ি পূজা
[সম্পাদনা]নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজ রোডের রামেন্দ্রসাহার বাড়ির সামনে বিশাল আকারের ৭১ ফুট দেবী দুর্গার প্রতিমা।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
রাজশাহীর কংসনারায়ণের পূজা
[সম্পাদনা]মুঘল আমলে বাংলাদেশের রাজশাহীতে এক এলাহি পুজোর আয়োজন করেছিলেন কংসনারায়ন। তখন তিনি খরচ করেছিলেন প্রায় ৯ লক্ষ টাকা যেটা এখনকার হিসাবে দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকা, দুর্গা পূজার ইতিহাসে এটাই প্রথম এলাহি আয়োজন ছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
মুখোপাধ্যায় পরিবারের আড়াইশো বছরের প্রাচীন পুজো বীরভূমের কুন্ডলা গ্রামে।
ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত বহুপ্রাচীন গ্রাম কুন্ডলার বিত্তশালী হাটুরাম মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত দুর্গা পুজো এলাকার সবথেকে প্রাচীন পুজো। দাদন ও তেজারতির কারবারে বিপুল সম্পদের অধিকারী হয়ে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন দুর্গাপুজোয়। পরে তাঁর বংশধরেরা পুর্বে মুর্শিদাবাদ জেলার বড়োঞা থানা থেকে পশ্চিমে মহম্মদবাজার এবং উত্তরে নলহাটি থেকে দক্ষিনে সিউড়ি পর্যন্ত এক বিশাল জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। ধনসম্পদ অর্জনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুজোর জাঁকজমক ও বেড়ে চলে তা এলাকায় প্রবাদে পরিণত হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় এবং সন্ধিপুজো এখনও শুরু হয় বন্দুক দেগে । ১৭৬০ খ্রীস্টাব্দ নাগাদ কুন্ডলার মুখোপাধ্যায় পরিবারের এই দুর্গাপুজো শুরু হয়।
মঠ ও মন্দিরের পূজা
[সম্পাদনা]কালীঘাট মন্দির
[সম্পাদনা]কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পূজা কবে শুরু হয়েছিল, তা জানা যায় না। এই পূজার বিশেষত্ব হল, এখানে দুর্গাপ্রতিমা আনা হয় না। মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপিত দেবী কালীর মূর্তিকেই দুর্গার মন্ত্রে চামুণ্ডা দুর্গা রূপে পূজা করা হয়। পূজা হয় কালিকা পুরাণ মতে। দুর্গাষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় মন্দির চত্বরের মনসাতলায় বেল গাছ পুঁতে সেখানে বোধন হয়। মহাসপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্নানের মাধ্যমে পূজা শুরু হয়। কালীঘাট মন্দিরে কালী মূর্তির দুই পাশে দুটি নবপত্রিকা রাখা হয়।[টীকা ২] মূর্তির ডানদিকের নবপত্রিকাটি সেবায়েতদের পক্ষ থেকে এবং বাঁদিকেরটি সেবায়েতদের গুরুদের পক্ষ থেকে বসানো হয়। মহাষ্টমী ও মহানবমী তিথিতে কুমারী পূজা করা হয়। মহানবমীতে বলিদান হয়। এই দিনে বলিদান মন্দিরের পুরোহিত ছাড়া কাউকে দেখতে দেওয়া হয় না। মন্দিরের সব দরজা বন্ধ করে বলি দেওয়া হয়। দুর্গাপূজার সময় কালীঘাট মন্দিরে বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা করা হয়। মহানবমীর রাতে পান্তা ভাত দিয়ে ভোগ দেওয়ার রীতি আছে। বিজয়াদশমীর দিন সিঁদুরখেলা হয়। এই সময় মন্দিরে পুরুষদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। এই দিনই নবপত্রিকা বিসর্জনের মাধ্যমে মন্দিরের দুর্গাপূজার সমাপ্তি ঘটে। দুর্গাপূজা উপলক্ষে বহু মানুষ কালীঘাট মন্দিরে আসেন ও পূজা দেন। কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে এই সময় মন্দিরের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ পুলিশ বাহিনী নিয়োগ করা হয়।[৬৫]
বেলুড় মঠ
[সম্পাদনা]রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠের অন্যতম প্রধান উৎসব হল শারদীয়া দুর্গাপূজা। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। সারদা দেবী এই দুর্গাপূজার সময় মঠে উপস্থিত ছিলেন।[৬৬] সারদা দেবী এর পরেও কয়েক বার বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা দেখতে এসেছিলেন।[৬৭] বেলুড় মঠে দুর্গাপূজার সময় কলকাতার কুমারটুলি থেকে প্রতিমা নিয়ে আসা হতো। বর্তমানে মঠ প্রাঙ্গনেই প্রতিমা তৈরি হয়।[৬৮] এখানে বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ মতে পূজা হয়। এই পূজার একটি বৈশিষ্ট্য হল, পূজার সঙ্কল্প এখনও সারদা দেবীর নামেই হয়ে থাকে। ১৯০১ সাল থেকেই কুমারী পূজা বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার একটি অঙ্গ।[৬৮]
বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার সূচনা হয় জন্মাষ্টমীর দিন। এই দিন কাঠামো পূজা হয়। এরপর মূর্তি নির্মিত হলে, দুর্গাষষ্ঠীর আগের দিন স্থানীয় জগন্নাথ মন্দির থেকে শালগ্রাম শিলা নিয়ে আসা হয়। এরপর দুর্গাষষ্ঠী থেকে বিজয়াদশমী পর্যন্ত সাধারণ শাস্ত্রবিধি অনুসারে পূজা হয়। বিজয়াদশমীর দিন সন্ধ্যায় মঠের ঘাটেই গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জন হয়।[৬৯] বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা দেখার জন্য প্রতিদিন প্রচুর জনসমাগম হয়। সরকারি ও বেসরকারি পরিবহন সংস্থাগুলি এই উপলক্ষে দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষ যানবাহনের ব্যবস্থা করে। বেলুড় মঠ ছাড়াও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অন্যান্য শাখাকেন্দ্রেও পরে দুর্গাপূজা শুরু হয়েছে।
বিষ্ণুপুর মৃন্ময়ী মন্দির
[সম্পাদনা]পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরের মৃন্ময়ী মন্দির রাজ্যের একটি অন্যতম প্রধান দুর্গামন্দির। এই মন্দিরটি স্থাপিত হয়েছিল ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে।[৭০] এখানে দুর্গার দশভূজা মূর্তি "মৃন্ময়ী" নামে পূজিত হয়। মৃন্ময়ী মল্লভূমের রাজপরিবারের কুলদেবী। মৃন্ময়ী মন্দিরের শারদীয়া দুর্গাপূজা ১৮ বা ১৯ দিন ধরে চলে। মহালয়ার আগের নবমীতে জীমূতবাহন পূজা হয়। ওই দিন "বিল্ববরণ" নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। দুর্গাপূজার সময় তিনটি বিশেষ পট রাজবাড়ি মন্দিরে আনা হয়। এগুলির নাম হল বড় ঠাকুরানি, মাইতো ঠাকুরানি ও ছোটো ঠাকুরানি বা পটেশ্বরী। জিতাষ্টমীর পরদিন বড় ঠাকুরানি নামের পটটি মন্দিরে আনা হয়। দুর্গাষষ্ঠীর আগের চতুর্থীর দিন মাইতো ঠাকুরানি নামের পটটি মন্দিরে এনে পূজা করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মহাসপ্তমীর দিন মাইতো ঠাকুরানি ও ছোটো ঠাকুরানিকে এক সঙ্গে মন্দিরে আনা হয়। ছোটো ঠাকুরানির পটটি সোনার তৈরি। মহাসপ্তমী থেকে যথানিয়মে পূজা হয়। তবে এই পূজায় পশুবলি দেওয়া হয় না। মহাষ্টমীর দিন রাজবাড়ি থেকে রাজবাড়ির গৃহদেবী বিশালাক্ষীর অষ্টাদশভূজা অষ্টধাতুর মূর্তিটি মন্দিরে আনা হয়। সন্ধিপূজার সময় তোপধ্বনি করা হয়। মহানবমীর দিন রাতে খচ্চরবাহিনী পূজা নামে একটি বিশেষ পূজা হয়। এই পূজা দুজন পুরোহিত ছাড়া আর কাউকে দেখতে দেওয়া হয় না। মহাসপ্তমী, মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিন একান্ন পীঠশক্তির বিশেষ পূজা এই মন্দিরের দুর্গাপূজার একটি বৈশিষ্ট্য। দশমীর দিন ঘটবিসর্জন, দীপদান, অপরাজিতা পূজা ও রামচন্দ্র পূজা হয়। দ্বাদশীর দিন মাঝরাতে রাবণকাটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পূজা শেষ হয়।[৭১]
নতুন দিল্লি কালীবাড়ি
[সম্পাদনা]নতুন দিল্লি কালীবাড়ির দুর্গাপূজা দিল্লি শহরের সবচেয়ে পুরনো দুর্গাপূজাগুলির একটি। পূজাটি শুরু হয়েছিল ১৯২৫ সালে। সেই সময় পূজা হতো বার্ড রোডের (অধুনা বাংলা সাহিব রোড) আদি মন্দিরে। স্থানীয় বাঙালি হিন্দু অধিবাসীরা পূজার সময় মন্দিরে আসেন। ১৯৩১ সালে নতুন মন্দিরটি তৈরি হলে সেখানেই দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয়।[৭২][৭৩] কালীবাড়ির পূজা হয় সাবেকি রীতি অনুযায়ী। দুর্গাপ্রতিমাটি হয় একচালার প্রতিমা এবং শোলার সাজবিশিষ্ট। ১৯৩৬ সাল থেকে পূজার ব্যাপারে কিছু নির্দিষ্ট আচার মেনে চলা হচ্ছে। পূজা উপলক্ষে রবীন্দ্রসংগীত ও আবৃত্তির প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়। কলকাতার শিল্পীরা মণ্ডপ তৈরি করে।[৭৪][৭৫]
কাশ্মীরি গেটের অন্য পূজাটি পরিচালিত হয় দিল্লি দুর্গাপূজা সমিতির দ্বারা। এটি ১৯১০ সাল থেকে চলে আসছে। তিমারপুর অ্যান্ড সিভিল লাইনস পূজা সমিতির পূজাটি তিমারপুরে চলছে ১৯১৪ সাল থেকে।[৭৬]
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির দেশের প্রধান মন্দির। এই মন্দিরটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে নির্মিত। এটি একটি দুর্গামন্দির এবং এখানেও মহাসমারোহে শারদীয়া দুর্গাপূজা আয়োজিত হয়। পূজার সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সহ বিরোধী দলনেতা, সাংসদ ও বিখ্যাত ব্যক্তিরা এই মন্দির পরিদর্শনে আসেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এই মন্দির দর্শনে আসেন। পূজায় ভোগ খাওয়ানো হয়। বিজয়াদশমীতে পার্শ্ববর্তী প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজয়া সম্মেলনী হয়। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সংগীত ও চলচ্চিত্র জগতের বিশিষ্ট শিল্পীরা উপস্থিত থাকেন।
সংস্কৃতি
[সম্পাদনা]কুমারটুলি
[সম্পাদনা]কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলটি মাটির দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের জন্য বিখ্যাত। কুমারটুলি থেকে শুধু কলকাতা বা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেই নয়, আমেরিকা, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশেও দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। বিদেশে সরবরাহের জন্য মাটি ছাড়া অন্যান্য উপাদানেও দুর্গাপ্রতিমা বানানো হয়। এর কারণ মাটি ভঙ্গুর, পরিযানে স্থানান্তরের অসুবিধে। ১৯৮৯ সালে কুমারটুলির শিল্পী অমরনাথ ঘোষ শোলার দুর্গাপ্রতিমা তৈরি করে সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া ফাইবার গ্লাসের দুর্গাপ্রতিমাও অন্যান্য দেশে সরবরাহ করা হয়।[৭৭]
২০০৬ সালের হিসেব অনুসারে, কুমারটুলি থেকে মোট ১২,৩০০টি দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। এই অঞ্চল থেকে প্রতিবছর বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশে দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। বিদেশে প্রবাসী বাঙালি হিন্দুদের কাছে দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করে দেওয়ার জন্য কুমারটুলিতে বেশ কিছু কর্মী কাজ করে।[৭৮] মোহনবাঁশি রুদ্রপাল, সনাতন রুদ্রপাল, প্রদীপ রুদ্রপাল, রাখাল পাল, গণেশ পাল, অলোক সেন, কার্তিক পাল, কেনা পাল প্রমুখ শিল্পীরা কুমারটুলির প্রধান প্রতিমাশিল্পী। কলকাতার অধিকাংশ পূজার প্রতিমা এরাই বানান। মিনতি পাল, সোমা পাল, কাঞ্চি পাল, চাঁপারানি পাল, চায়না পাল প্রমুখ মহিলা শিল্পীরাও আজকাল প্রতিমা তৈরি করছেন।[৭৯] কুমারটুলির শিল্পীদের দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। বিশিষ্ট প্রতিমাশিল্পী গোপেশ্বর পাল এই পূজার প্রতিমা তৈরি করেছিলেন।
জনপ্রিয় মাধ্যমে দুর্গাপূজা
[সম্পাদনা]আগমনী গান
[সম্পাদনা]পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, যজ্ঞস্থলে পিতা দক্ষ প্রজাপতির মুখে পতি শিবের নিন্দাবাণী ও কটূক্তি শুনে ক্রোধে ও ক্ষোভে অধীরা সতী দেহত্যাগ করেছিলেন এবং শিবকে আবার পতিরূপে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় গিরীরাজ হিমালয়ের গৃহে দেবী মহামায়া তার কন্যা পার্বতীরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পুরাণে বর্ণিত মহিষাসরমর্দিনী চণ্ডিকা বা শুম্ভ নিশুম্ভ দলনি কৌশিকী এই সকল দেবী মাতা পার্বতীর অবতার।
অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে রচিত বাংলা আগমনী গানগুলিতে দুর্গারূপে শিবজায়া পার্বতীর সপরিবারে পিতৃগৃহে অবস্থানের এই আনন্দময় দিনগুলোর এবং তার বিবাহিত জীবনের অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়। এসব গানে একদিকে যেমন ফুটে উঠেছে কন্যা বিরহে কাতরা মা মেনকার গভীর অপত্যস্নেহ, অন্যদিকে তেমনি চিত্রিত হয়েছে স্বামী সোহাগিনী পার্বতীর গর্ব ও আনন্দের উচ্ছাস; গৌরী একাধারে জগজ্জননী এবং বাংলার জননীদের কাছে কন্যাসমা। আগমনী গানগুলি শাক্ত পদাবলীর অন্তর্গত; এগুলি রচয়িতাদের মধ্যে সাধক রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত চক্রবর্তী, দাশরথি রায় এবং পরবর্তীকালে নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রভূত মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
মহিষাসুরমর্দিনী
[সম্পাদনা]মহিষাসুরমর্দিনী মহালয়ার দিন ভোরবেলা সম্প্রচারিত একটি বিশেষ বেতার অনুষ্ঠান। এটি ১৯৩২ সাল থেকে আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হচ্ছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাজাতি সদনের একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতানুষ্ঠানে মস্করা করে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, 'ঘরে খিল দেওয়া থাকলেও আমি পৌঁছে যাই সকলের কাছে।' কারণ বেতারে চণ্ডীপাঠ সবাই শোনেন।[৮০] এই অনুষ্ঠানে শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে নির্বাচিত কিছু স্তোত্র,[৮১] আগমনী গান ও বাংলা ভক্তিগীতি সহ শ্রীশ্রীচণ্ডীর দুটি গল্প শ্রুতিনাটকের আকারে শোনানো হয়। সর্বভারতীয় শ্রোতাদের জন্য অনুষ্ঠানটির হিন্দি সংস্করণ একই সময় সম্প্রচারিত হয়। এটি মোট দেড় ঘণ্টার অনুষ্ঠান। প্রথম দিকে এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হতো। ১৯৬০-এর দশক থেকে অনুষ্ঠানটির রেকর্ড সম্প্রচারিত হয়। অনুষ্ঠানটি খুবই জনপ্রিয়।[৮২][৮৩][৮৪] আকাশবাণীর পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানটি ক্যাসেট ও সিডি আকারেও প্রকাশ করা হয়েছে।[৮৫]
এই অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠসহ অন্যান্য পাঠগুলি করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তার পাঠ এতটাই জনপ্রিয় হয় যে, ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এই অনুষ্ঠানটি বন্ধ করে জনপ্রিয় বাঙালি অভিনেতা উত্তমকুমারকে দিয়ে অন্য একটি অনুষ্ঠান করাতে গেলে শ্রোতারা নতুন অনুষ্ঠানটির প্রতি বিরূপ হন। ফলে পরবর্তীতে পুরোনো অনুষ্ঠানটির সম্প্রচারই চলতে থাকে।[৮৬] অনুষ্ঠানটির গান রচনা করেছিলেন বাণীকুমার ভট্টাচার্য এবং সুরারোপ করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।[৮২] গানগুলি গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সুপ্রীতি ঘোষ প্রমুখ বিশিষ্ট শিল্পীরা।[৮৭]
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]
- কলকাতার দুর্গাপূজা
- নবদ্বীপের শাক্তরাস
- গৌরাঙ্গিনী মাতা
- ডুমুরেশ্বরী মাতা
- নবদ্বীপের ভদ্রকালী মাতা
- মৃন্ময়ী মাতা, বিষ্ণুপুর
- বড় দেবী
- মহামায়া
- মহিষাসুর
- হুদুর দুর্গা
- মৃন্ময়ী মন্দির
- শ্রীশ্রীচণ্ডী
- বাংলাদেশে দুর্গা পূজা মন্ডপের তালিকা
পাদটীকা
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Bansil, P. C (২০১১)। Bihar Agriculture: A Perspective। আইএসবিএন 9788180697432।
- ↑ Security cover in place for Durga puja celebrations in Odisha, India Today; Noida's Assamese community celebrates Durga Puja, The Times of India
- ↑ Bradley 2012, পৃ. 214।
- ↑ Kinsley 1988, পৃ. 106–108।
- ↑ ক খ Encyclopedia Britannica 2015।
- ↑ Doniger 1999, পৃ. 306।
- ↑ Lochtefeld 2002, পৃ. 208।
- ↑ "UNESCO – Durga Puja in Kolkata"। ich.unesco.org (ইংরেজি ভাষায়)। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১২-১৫।
- ↑ "UNESCO Intangible Heritage: শুধু দুর্গাপুজো নয়, অতীতে UNESCO স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলার আরও এক সাংস্কৃতিক উত্সবও"। Aaj Tak বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৫।
- ↑ "বিশ্বের দরবারে কলকাতার দুর্গাপুজো, বিরল সম্মান UNESCO-র"। এই সময়। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৬-০৫।
- ↑ [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে- ২৪ আওয়ার মিউজিয়াম ডট অর্গ ডট ইউকে থেকে
- ↑ "দুর্গাপুজো উৎসব নয়, শোকের সময় এরাজ্যের এক জনজাতির কাছে!"। আজকাল। ২০২১-০৬-২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-১০।
- ↑ ক খ "Akaal Bodhan Article"।
- ↑ "Akaal Bodhan Article"। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০১১।
- ↑ হিন্দুদের দেবদেবী, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, পৃ. ২২৭
- ↑ প্রবন্ধ শব্দাঞ্জলিতে দুর্গাপূজা, হরিপদ ভৌমিক, নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা, আশ্বিন ১৪১৪, অক্টোবর ২০০৭, পৃ. ১৬৩ দ্রঃ
- ↑ প্রবন্ধ শব্দাঞ্জলিতে দুর্গাপূজা, হরিপদ ভৌমিক, নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা, আশ্বিন ১৪১৪, অক্টোবর ২০০৭, পৃ. ১৬৩-৬৪ দ্রঃ
- ↑ ক খ শ্রীশ্রীচণ্ডী, প্রথম অধ্যায়
- ↑ শ্রীশ্রীচণ্ডী, অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৬২ সংস্করণের ১০৭ পৃষ্ঠার পাদটীকাটি দ্রষ্টব্য
- ↑ শ্রীশ্রীচণ্ডী, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়
- ↑ রামায়ণ কৃত্তিবাস বিরচিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখিত ভূমিকা সংবলিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৫৭ সংস্করণ
- ↑ জগজ্জননী দেবী দুর্গা শ্রী পতিত উদ্ধরণ গৌর দাস ব্রহ্মচারী সংকলিত, ভক্তিবেদান্ত গীতা একাডেমি, ইস্কন বাংলাদেশ প্রকাশিত
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৩-৪৪
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪ থেকে উদ্ধৃত
- ↑ শব্দকল্পদ্রুম ৩।১৬৬৬; পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪ থেকে উদ্ধৃত
- ↑ শ্রীশ্রীচণ্ডী ৪।৩
- ↑ শ্রীশ্রীচণ্ডী, ২।৫১
- ↑ "দেবীবাহন সিংহের ধ্যান", শ্রীশ্রীচণ্ডী, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ অনূদিত ও সম্পাদিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, পৃ. ৪৯
- ↑ কালিকাপুরাণোক্ত শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায় কাব্যতীর্থ, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ১০০
- ↑ কালীবিলাস তন্ত্র, ১৮।৩০
- ↑ কালিকাপুরাণ, ৫৮।৬৫-৬৭
- ↑ শিবপুরাণ, বায়বীয় সংহিতা, ২১।১০
- ↑ পদ্মপুরাণ, সৃষ্টিখণ্ড, ৪৪।৭৮
- ↑ দেবীপুরাণ, ৭।৪৫।৫০
- ↑ দেবদেবী ও তাঁদের বাহন, স্বামী নির্মলানন্দ, প্রণব মঠ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২৪
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৫
- ↑ মহিষাসুর, সঞ্জয় ভুঁইয়া, বর্তমান পত্রিকা (বর্তমান রবিবার), ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৮ দ্রঃ
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৭
- ↑ সাধন-সমর, ব্রহ্মর্ষি শ্রীসত্যদেব, সাধন-সমর কার্যালয়, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৭৫-৭৬
- ↑ দেবদেবী ও তাঁদের বাহন, স্বামী নির্মলানন্দ, প্রণব মঠ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৫৫
- ↑ মা দুর্গার কাঠামো, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মহাউদ্ধারণ মঠ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৬
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৬
- ↑ মা দুর্গার কাঠামো, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মহাউদ্ধারণ মঠ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭
- ↑ মা দুর্গার কাঠামো, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মহাউদ্ধারণ মঠ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১১
- ↑ সাধন-সমর, ব্রহ্মর্ষি শ্রীসত্যদেব, সাধন-সমর কার্যালয়, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৭৬
- ↑ পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৯
- ↑ ক খ কালিকাপুরাণোক্তk শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায় কাব্যতীর্থ, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭২, ১০৮, ১২৭
- ↑ ক খ "দুর্গাপূজা কোন পদ্ধতিতে হয়", স্বামী ত্যাগিবরানন্দ, সাপ্তাহিক বর্তমান, ১২ অক্টোবর, ২০১৩ সংখ্যা, পৃ. ১৫
- ↑ Fahy, John (২০১৮-০৯-০২)। "Samsara"। Anthropology Now। 10 (3): 93–105। আইএসএসএন 1942-8200। ডিওআই:10.1080/19428200.2018.1602407।
- ↑ Ahsanat, Moazzam Areeba (২৭ জুন ২০১৭)। "Identity catapult in a globalizing world: A critique"। Journal of Politics & Governance। ৩ (১): ১৬-২২। আইএসএসএন 2456-8023। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০২১।
- ↑ পাল, বিশাখা (২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)। "দুর্গাপুজোয় কেন লাগে পতিতালয়ের মাটি?"। সংবাদ প্রতিদিন। ১১ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ আগস্ট ২০২১।
- ↑ "Why soil from a prostitute's area/brothel is used for making Devi Maa's idol during Durga Puja?"। ওড়িশা পোস্ট (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-০২-২১। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-০৫।
- ↑ সংবাদদাতা, নিজস্ব (অক্টোবর ৭, ২০১৯)। "সুভগা রূপে কুমারী পুজো"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-০৭।
- ↑ রদ্রিগেজ, হিলারি (ফেব্রুয়ারি ১, ২০১২)। Ritual Worship of the Great Goddess: The Liturgy of the Durga Puja with Interpretations (ইংরেজি ভাষায়)। নিউ ইয়র্ক: স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক প্রেস। পৃষ্ঠা ৫৯। আইএসবিএন 978-0-7914-8844-7।
- ↑ কালিকাপুরাণোক্ত শ্রীশ্রীদুর্গাপূজা পদ্ধতি, প্রবীরকুমার চট্টোপাধ্যায় কাব্যতীর্থ, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, পৃ. ২০২
- ↑ হিন্দুদের দেবদেবী, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, পৃ. ২৪১
- ↑ "Durga-puja.org"। Durga-puja.org। ২০১২-১০-০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৬-২৫।
- ↑ "Durga The Divine Mother"। সংগ্রহের তারিখ ২ অক্টোবর ২০১১।
- ↑ "BDNews24.com: Durga Puja 13–17 Oct (2010)"। ১০ অক্টোবর ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ অক্টোবর ২০১৩।
- ↑ রহমান, রিমন। "রাজা কংসনারায়ণের দুর্গাপূজা, যার শুরু সাড়ে ৫০০ বছর আগে"।
- ↑ Mostafizur Rahman, Kazi Md.। "Taherpur Rajbari"। http://www.ru.ac.bd/। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। Archived from the original on ২৮ জানুয়ারি ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ৩ অক্টোবর ২০২২।
|ওয়েবসাইট=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য) - ↑ চন্দ, দীপংকর। "রাজা কংসনারায়ণ এবং বাংলার প্রথম দুর্গোৎসব"। দৈনিক প্রথম আলো। দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ৩ অক্টোবর ২০২২।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ গ ভট্টাচার্য, চন্দ্রশেখর। "কংসনারায়ণ নয়, বাঙলায় প্রথম দুর্গাপূজা মল্লরাজার"। ইতিহাস তথ্য ও তর্ক।
- ↑ কালীক্ষেত্র কালীঘাট, সুমন গুপ্ত, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ৬২-৬৪
- ↑ বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গাপূজা, স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৬-৭
- ↑ বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গাপূজা, স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ২৫
- ↑ ক খ বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গাপূজা, স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ১৫
- ↑ বেলুড় মঠে স্বামীজীর দুর্গাপূজা, স্বামী দেবেন্দ্রানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ২৮-৩০
- ↑ মল্লভূম বিষ্ণুপুর, মনোরঞ্জন চন্দ্র, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ১০৪
- ↑ মল্লভূম বিষ্ণুপুর, মনোরঞ্জন চন্দ্র, দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ১০৮-১১০
- ↑ "Kali Bari website to help old bond with the new"। Hindustan Times। ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১১। জানুয়ারি ২৫, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ২২, ২০১৩।
- ↑ "Delhi's old timers remember as another Durga Puja dawns"। Monsters and Critics। অক্টো ১৬, ২০০৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "Tradition fuses with modernity"। The Times of India। অক্টো ৩, ২০১১। ডিসেম্বর ১৪, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ২২, ২০১৩।
- ↑ "Festive spirit pervades the Capital"। The Hindu। অক্টো ১৫, ২০০৭। অক্টোবর ১৭, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ২২, ২০১৩।
- ↑ "How community pujas came about"। India Today। সেপ্টেম্বর ২৫, ২০০৯।
- ↑ Chaliha, Jaya, and Gupta, Bunny, Durga Puja in Calcutta, p.336, Calcutta, the Living City, Vol II, edited by Sukanta Chaudhuri, 1990/2005, p.2, Oxford University Press, আইএসবিএন ০-১৯-৫৬৩৬৯৭-X.
- ↑ Home Chowdhury, Amlan। "Kumartuli, Potters Town"। littleindia.com। ২০০৭-০৯-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৭-১৫।
- ↑ Sahoo, Srilat Saha। "Durga Puja – the festival of peace and harmony"। Press Release। Press Information Bureau, Government of India। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-০৭-১৫।
- ↑ "The voice carries on"। http://www.business-standard.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৯-২১।
|প্রকাশক=
এ বহিঃসংযোগ দেয়া (সাহায্য) - ↑ "durga_puja : Mahalaya"। www.netglimse.com। ২০০৯-০৬-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৬-১৩।
- ↑ ক খ "Biography of Pankaj Kumar Mullick - the versatile musical genius"। www.pankajmullick.org। ২০০৯-০৪-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৬-১৩।
- ↑ Mahalaya ushers in the Puja spirit ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১২-১০-২৫ তারিখে The Times of India, TNN 19 September 2009.
- ↑ Morning Raga ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে Indian Express, PiyasreeDasgupta, Sep 18, 2009.
- ↑ "Mahisasura Mardini by Birendra Krishna Bhadra (AIR Recording) – Details of tracks and artists"। QuiQinQ। ২০১২-১০-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-১০-২১।
- ↑ Timeless Tunes Indian Express, Sep 29, 2008.
- ↑ "Mahalaya : Durga Puja mahalaya : Durga Puja"। www.bangalinet.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৬-১৩।
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- শ্রীশ্রীচণ্ডী, অনুবাদ ও সম্পাদনাঃ স্বামী জগদীশ্বরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৬২ সংস্করণ
- পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯
- নতুন বাংলার মুখ পত্রিকা, শারদোৎসব সংখ্যা ১৪১৪ বঙ্গাব্দ (২০০৭)
- পৌরাণিকা : বিশ্বকোষ হিন্দুধর্ম (প্রথম খণ্ড অ-ন), অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৫ সংস্করণ
- নিবন্ধ বাংলাদেশে দুর্গাপুজো, ইমদাদুল হক মিলন, বর্তমান (রবিবারের ক্রোড়পত্র), ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৮
- মা দুর্গার কাঠামো, মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, মহাউদ্ধারণ মঠ, কলকাতা
- দেবদেবী ও তাঁদের বাহন, স্বামী নির্মলানন্দ, প্রণব মঠ, কলকাতা
- সাধন-সমর, ব্রহ্মর্ষি শ্রীসত্যদেব, সাধন-সমর কার্যালয়, কলকাতা