কলকাতার পর্যটক আকর্ষণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কলকাতা শহরের দিগন্ত
কলকাতা, আনন্দমুখর শহর

দিল্লি এবং মুম্বাইয়ের পর কলকাতা (আগে যা কলিকাতা নামে পরিচিত ছিল ) ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম মহানগর। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে অর্থাৎ ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ অব্দি কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। ১৮৫০'র দশকে কলকাতায় ব্রিটিশ কোম্পানি'র তত্ত্বাবধানে বিরাট সংখ্যক নির্মাণকার্য সম্পাদিত হয়। এই সময়ে গড়ে উঠা নির্মাণকার্যগুলি বিশেষভাবে নব্য গোথিক, বারোক, নিও ক্লাসিক এবং প্রাচ্য নির্মাণ ধারার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সেই সময় যখন উত্তর ভারতের অধিকাংশ বড় শহরের নির্মাণকার্যে মিনিমালিজম'র গভীর ছাপ পরিলক্ষিত হয় কলকাতায় এক ভিন্ন স্থাপত্যশৈলী গড়ে উঠে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ, পর্তুগিজ এবং ফরাসি স্থাপত্যশৈলীর দ্বারা প্রভাবিত। আজ এই কাঠামোগুলোর অধিকাংশই সঠিক যত্নের অভাবে ধুঁকছে। যদিও এদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য কাঠামোগুলোকে প্রতিনিয়ত সংস্কারের মাধ্যমে ঐতিহ্য ভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কলকাতার এই কাঠামোগুলোকে সংরক্ষণের প্রচেষ্টা যে করা হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু প্রায়ই মামলা, ভাড়াটে সমস্যা, মালিকানা বিরোধ, পুরাতন টেন্যান্সার আইন এবং তহবিলের অভাবের দরুন সংরক্ষণ কার্য বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে না।

জাদুঘর এবং গ্রন্থাগার[সম্পাদনা]

  • ১৯০১ সালে তৎকালীন ভারত সম্রাজ্ঞী তথা ইংল্যান্ডের মহারানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতিতে কলকাতার বুকে গড়ে তোলা হয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ১৯০৬ সালে তাজমহলের আদলে গড়ে ওঠা বিখ্যাত এই স্মৃতিসৌধের, আর্থিক অনুমোদনের স্বীকৃতি দেন লর্ড কার্জন। ১৯২১ সালে এই সৌধ সাধারণ জনগণের প্রবেশের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বিখ্যাত স্থপতি উইলিয়াম এমারসন এবং তাঁর অনুগামী ভিন্সেন্ট এস ১০.৫ মিলিয়ন টাকা ব্যয়ে এই স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলেন। মোটা অঙ্কের এই টাকার পুরোটাই ভারত এবং ব্রিটেনের অভিজাত পরিবারের স্বেচ্ছাকৃত দানের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়। বিখ্যাত এই স্মৃতিসৌধে সংরক্ষিত হয়েছে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের অসংখ্য চিত্রকলা, মুঘল ঘরানার ক্ষুদ্র চিত্রশিল্প, কোম্পানি স্কুলের তৈলচিত্র (বিশেষত টমাস ড্যানিয়েল এবং উইলিয়াম ড্যানিয়েলের কাকা-ভাইপো জুটি), ঐতিহাসিক শিল্পকর্ম যেমন বাংলার নবাবের সিংহাসন, অনেক লিথোগ্রাফ এবং ঐতিহাসিক স্বার্থের দস্তাবেজ, এবং কলকাতার ইতিহাসে (রাজধানী স্বাধীনতার পরেও যোগ করা) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজ-শিল্পকর্ম। সবুজ ঘাসের গালিচা বেষ্টিত এই সৌধ রাতের আলোয় এক মোহনীয় মায়ার সৃষ্টি করে। সন্ধেবেলা ঘাসের গালিচা বেষ্টিত জায়গায় একটি লেজার অডিও-ভিজুয়াল শো দেখানো হয়। এই সৌধের চূড়ায় অধিষ্ঠিত বিজয়ের গ্রিক দেবী নাইকিকে অনেকেই নানা ভৌতিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত বলে মনে করেন।[১]


  • ভারতীয় জাদুঘর এশিয়ার সর্ববৃহৎ যাদুঘর এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রাচীনতম (এশিয়াটিক সোসাইটির অবস্থান ১৮১৪)। মিউজিয়ামটি ১৮৭৫ সালে তার বর্তমান বাসস্থানের স্থানান্তরিত হয়। চৌরঙ্গী এভিনিউ (বর্তমানে জে.এল. নেহেরু রোড) এ অবস্থিত, এটি সম্ভবত ভারতের প্রাকৃতিক ইতিহাসের বৃহত্তম সংগ্রহ এবং স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতীয় শিল্প সংগ্রহ। এই সংগ্রহালয়ের ন্যাশনাল হিস্ট্রি অ্যান্ড জিওলজিক্যাল বিভাগের উল্কি হল এবং ডাইনাসর হল, অ্যান্সিমাসটিক্স সেকশন এবং গান্ধার শিল্পের সংগ্রহ, বর্মী কাঠামো, মুগল ক্ষুদ্রচিত্র এবং তিব্বতীয় ব্যানার বিভাগ ভারতীয় আর্ট সেকশন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষের অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে এবং আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফটের সরকারি কলেজ একই ভবনে রয়েছে। জাদুঘরের সার্ভে অব ইন্ডিয়া সদর দপ্তর সম্প্রতি যাদুঘর থেকে বিজন নগর স্থানান্তরিত হয়েছে। ভারতীয় যাদুঘরে চমৎকার ঐতিহাসিক মূল্যের একটি গ্রন্থাগার আছে যেখানে ব্রিটিশ রাজ ও কলকাতার বিষয়ে অনেক তথ্য বিদ্যমান।


  • মার্বেল প্রাসাদ, উত্তর কলকাতায় চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে অবস্থিত একটি ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ছোট ম্যাগাজি এবং পাখির একটি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সংগ্রহালয়। ১৮৩৫ সালে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক কর্তৃক নির্মিত এই সংগ্রহালয়ে সঞ্চিত হয়েছে অজস্র মূল্যবান সামগ্রী। এদের মধ্যে আছে দু'টি স্বল্প প্রচারিত প্রচারিত রূবেণ পেইন্টিং এবং একটি জোশিয়ো রেইনল্ডস'র পেইন্টিং। তাছাড়াও এই সংগ্রহালয়ের আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বৃদ্ধি করছে আনুমানিক পঞ্চাশোধিক মার্বেল পাথর।


  • গুরুদাস দত্ত রোডের বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল যাদুঘরটি এশিয়ায় প্রথম জনপ্রিয় বিজ্ঞান জাদুঘর। ১৯৫৯ সালে এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। ডয়েচে মিউজিয়ামের আদলে তৈরী এই জাদুঘরটি ইন্টারেক্টিভ জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্রদর্শনী এবং ভারতের ঐতিহাসিক শিল্প হোল্ডিংসদের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ। ১৮৮০-১৯৫০ সময়কালের পুরানো গ্র্যামোফোন, সাউন্ড রেকর্ডার, টেলিফোন, বাষ্প ইঞ্জিন, সড়ক রোলারস এবং অন্যান্য শিল্প যন্ত্রপাতিগুলি এই সংগ্রহালয়কে সমৃদ্ধ করেছে। এই জাদুঘরে সংগ্রহে আছে একটি রোলস-রয়স ফ্যান্টম মডেলের ভিন্টেজ গাড়ি। এই সংগ্রহালয় সক্রিয়ভাবে স্কুলে শিশুদের জন্য গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প, সচেতনতা প্রোগ্রাম এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান পর্যবেক্ষণের আয়োজন করে।


  • সায়েন্স সিটি ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের কাছাকাছি অবস্থিত একটি এলাকা যেখানে অনেকগুলি ইন্টারেক্টিভ বিজ্ঞান এবং জীবিত জীববিজ্ঞান প্রদর্শনীর পাশাপাশি কলকাতার প্রথম ওমনিমেক্স থিয়েটারও আছে।


  • জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ঠাকুর পরিবারের পূর্বপুরুষের বাড়ি যা ১৯৬১ সালে একটি যাদুঘরে রূপান্তরিত হয়। এই বিশাল বিস্তৃত ইটের দালানগুলি প্রায় এক শতকের কাছাকাছি সময় জুড়ে কলকাতার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং নারী মুক্তি আন্দোলনে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছিল। এখানেই প্রথম ব্রাহ্ম বিবাহের আয়োজন করা হয় এবং সেই সময়ে এই বাড়িটি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। জাদুঘরের তিনটি বৃহৎ গ্যালারী রয়েছে- তাদের মধ্যে একটিতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কাজ, একটিতে রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের গ্যালারি যেমন তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরগগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর , এবং তৃতীয় গ্যালারিতে রয়েছে বাংলার নবজাগরণের ইতিহাস।


  • ডায়মন্ড হারবার রোডের গুরুসদয় মিউজিয়ামটি হল স্যার গুরুসদয় দত্তের জীবনকালে তাঁর দ্বারা সংগৃহীত অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের সংগ্রহশালা। ১৯৪১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর এই সংগ্রহের সম্ভার বাংলার লোকশিল্প সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য স্যার গুরুসদয় দত্তের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ব্রতচারী সোসাইটির কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি ১৯৬৩ সালে ভারত সরকারের সহায়তায় জনসাধারণের জন্য একটি যাদুঘর হিসেবে খুলে দেওয়া হয়। এই সংগ্রহশালায় রয়েছে সূক্ষ্ম হস্তশিল্প, পোড়ামাটির প্যানেল, কাঁথার কাজ এবং কালীঘাট পটচিত্র (অথবা ১৯০০ সালের শেষের দিকে হাতে আঁকা স্ক্রোল)। কলকাতার কলেজস্ট্রিটে অবস্থিত আশুতোষ মিউজিয়াম হল বাংলার লোকশিল্পের জন্য আরেকটি বিশেষ যাদুঘর যেখানে গোটা ভারতবর্ষের লোকশিল্পের সম্ভার চোখে পড়ার মতো। তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহারের চন্দ্রকেতুগড় ও তমলুকের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলগুলি থেকে সংগৃহিত শিল্পকর্মগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন থাকা মিউজিয়াম গুলোর মধ্যে এটিই প্রথম। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে নামকরণ করা এই জাদুঘরটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালন করে।


  • নেহেরু শিশু জাদুঘর জওহরলাল নেহেরুর নামে নামকরণ করা হয়, যার বাচ্চাদের প্রতি ভালোবাসা ছিল সর্বজনবিদিত। পণ্ডিত জওহর লাল নেহরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য, জাতীয় সাংস্কৃতিক সমিতি ১৯৭২ সালে উনার জন্মদিনে এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে। জাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পুতুল এবং খেলনাগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়াও পুতুলের মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়েছে রামায়ণমহাভারতের বিভিন্ন ঘটনাবলী। এটি ১৯৭২ সালে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সাধারণত "নেহেরু শিশু জাদুঘর" হিসাবে উল্লেখ করা হয়; এই যাদুঘরটি বিগত দিনে অসাধারণ অগ্রগতির সাক্ষী হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও বাংলাদেশ, জাপান, চীন, রোডেশিয়া, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এই দেশগুলির পুতুলও এই সংগ্রহালয়ে সংগৃহীত হয়েছে। এইগুলি ছাড়াও এই সংগ্রহালয়ে রয়েছে দিল্লি, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, চেন্নাই, মহারাষ্ট্র, আন্দামান, মেক্সিকো, পর্তুগিজ এবং আরও অনেক জায়গার পুতুলের পোশাক। এমনকি এখানে গণেশের বিভিন্ন রূপ এবং শৈলী নিয়ে একটি পৃথক কেবিন রয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী প্রশাসনিক কার্যালয়[সম্পাদনা]

  • কলকাতা হাইকোর্ট - এটি ভারতের প্রাচীনতম হাইকোর্ট। এটি ১৮৬২ সালের হাইকোর্ট আইনের অধীনে ফোর্ট উইলিয়ামের বিচার বিভাগের হাইকোর্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি এর এখতিয়ারভুক্ত। হাইকোর্ট ভবনটি হল বেথেলের ইয়েপেসে স্ট্যান্ড হাউসের সঠিক প্রতিরূপ।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Victoria Memorial. iloveindia.com