বিষয়বস্তুতে চলুন

কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(জন্মাষ্টমী থেকে পুনর্নির্দেশিত)
কৃষ্ণজন্মাষ্টমী
জন্মাষ্টমীতে পূজিত কৃষ্ণের বালগোপাল মূর্তি
অন্য নামজন্মাষ্টমী
পালনকারীসনাতনী
ধরনধর্মীয়
উদযাপন২-৮ দিন
পালনউপবাস, পূজা-প্রার্থনা
তারিখভাদ্র কৃষ্ণ পক্ষ অষ্টমী
সম্পর্কিতকৃষ্ণ

জন্মাষ্টমী বা কৃষ্ণজন্মাষ্টমী (দেবনাগরী कृष्ण जन्माष्टमी) একটি হিন্দু উৎসব। এটি বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়। এর অপর নাম কৃষ্ণাষ্টমী, গোকুলাষ্টমী, অষ্টমী রোহিণী, শ্রীকৃষ্ণজয়ন্তী ইত্যাদি।[]

হিন্দু পঞ্জিকা মতে, সৌর ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে যখন রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য হয়, তখন জন্মাষ্টমী পালিত হয়। উৎসবটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, প্রতি বছর মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোনো এক সময়ে পড়ে।[] কৃষ্ণের জীবনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড (গান বা কীর্তন, গীতিনাট্য, নাট্য, যাত্রা ইত্যাদি) এর মাধ্যমে রাসলীলা, কংস বধ ইত্যাদি কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করা হয়। মথুরা, বৃন্দাবন, মণিপুর ইত্যাদি স্থানে এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত আড়ম্বরের সাথে করা হয়।[] রাস লীলায় কৃষ্ণের ছোট বয়সের কর্ম-কাণ্ড দেখানো হয়, অন্যদিকে, দহি হাণ্ডি প্রথায় কৃষ্ণের দুষ্টু স্বভাব প্রতিফলিত করা হয় যেখানে কয়েকজন শিশু মিলে উচ্চস্থানে বেঁধে রাখা মাখনের হাড়ি ভাঙতে চেষ্টা করে। এই পরম্পরাকে তামিলনাডুতে উরিয়াদি নামে পালন করা হয়। কৃষ্ণের জন্ম হওয়ায় নন্দের সকলকে উপহার বিতরণের কাহিনী উদ্‌যাপন করতে কৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর পর বহু স্থানে নন্দোৎসব পালন করা হয়।[]

কিংবদন্তি

[সম্পাদনা]
Painting of Krishna being carried across the river.
কৃষ্ণকে নদী পার করিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য

শ্রী কৃষ্ণ হলেন দেবকী এবং বাসুদেব এর অষ্টম সন্তান। পুরাণ , মহাভারত, ভাগবতের বর্ণনা এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনা অনুসারে কৃষ্ণের জন্মতারিখ হল [] খ্রীষ্টপূর্ব ৩২২৮ সালের ১৮ জুলাই এবং তার অন্তর্ধানের দিন খ্রীষ্টপূর্ব ৩১০২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি।[][] কৃষ্ণ মথুরার যাদববংশের বৃষ্ণি গোত্রের মানুষ ছিলেন।[]

শ্রীকৃষ্ণের সংক্ষিপ্ত জীবনী

[সম্পাদনা]

শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন দেবকি ও বসুদেব এর সন্তান এবং হিন্দু ধর্মাম্বলীরা তার জন্মদিন জন্মাষ্টমী হিসেবে পালন করে।

  শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সময় চারিদিকে অরাজকতা, নিপীড়ন, অত্যাচার চরম পর্যায়ে ছিল। সেই সময় মানুষের স্বাধীনতা বলে কিছু ছিল না। সর্বত্র ছিল অশুভ শক্তির বিস্তার।

   শ্রীকৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন তার জীবনের শত্রু। মথুরাতে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের সাথে সাথে সেই রাতে তার বাবা বসুদেব তাঁকে যমুনা নদী পার করে গোকুলে পালক মাতা পিতা যশোদা ও নন্দর কাছে রেখে আসেন।

জন্মাষ্টমী কীভাবে পালন করা হয়

[সম্পাদনা]

হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশেষত বৈষ্ণবদের কাছে জন্মাষ্টমী একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই উৎসব নানা ভাবে উদ্‌যাপন করা হয়। যেমন - ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী নৃত্য, নাটক যাকে বলা হয় রাসলীলা বা কৃষ্ণ লীলা, মধ্যরাত্রি তে শ্রীকৃষ্ণের জন্মের মুহূর্তে ধর্মীয় গীত গাওয়া, উপবাস, দহি হান্ডি প্রভৃতি।

রাসলীলা তে মূলত শ্রীকৃষ্ণের ছোটবেলার বিভিন্ন ঘটনা দেখানো হয়।

অন্যদিকে দহি হান্ডি প্রথায় অনেক উঁচুতে মাখনের হাড়ি রাখা হয় এবং অনেক ছেলে মিলে মানুষের পিরামিড তৈরি করে সেই হাড়ি ভাঙ্গার চেষ্টা করে। তামিলনাড়ুতে এ প্রথা উড়িয়াদি নামে পরিচিত।

এই দিন মানুষ কৃষ্ণের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করার জন্য অভুক্ত থাকে, ধর্মীয় গান গায় এবং উপবাস পালন করে।

   শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথিতে মধ্যরাতে তার ছোট ছোট মূর্তি কে স্নান করিয়ে কাপড় দিয়ে মোছা হয় এবং দোলনায় সাজানো হয়। তারপর উপাসক মন্ডলী নিজেদের মধ্যে খাদ্য ও মিষ্টান্ন বিনিময় করে উপবাস ভঙ্গ করে।

   গৃহস্থ মহিলারা বাড়ির বিভিন্ন দরজার বাইরে, রান্নাঘরে শ্রী কৃষ্ণের পদচিহ্ন এঁকে দেন যা শ্রীকৃষ্ণের যাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জন্মাষ্টমী ব্রত মাহাত্ম্য

[সম্পাদনা]

পুরাণে জন্মাষ্টমী ব্রতমাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে নিম্নরূপ:

হে রাজন্! এই আমি বিষ্ণুর জন্মদিবসীয় ব্রতের বিবরণ বললাম। এটি শ্রবণেও পাপ সকল নষ্ট হয়; পরন্তু যিনি এই ব্রত আচরণ করেন, তাঁর না জানি কত ফলই হয়ে থাকে। যে মানব বা মানবী এই হরিব্রত আচরণ করে, সে ইহজন্মেই অতুল ঐশ্বর্য্য প্রাপ্ত হয়ে থাকে। ধৰ্মকামাভিলাষী জনগণ তৃতীয়া, ষষ্ঠী,অষ্টমী এবং একাদশী এই কয়টী তিথি—পূৰ্ব্ব তিথি দ্বারা বিদ্ধা হলে পরিত্যাগ করবেন। সুতরাং এই ব্রতেও সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমী বিশেষভাবেই বৰ্জনীয়। যথোক্ত নক্ষত্র না ঘটলেও নবমী-যুক্তা অষ্টমীই গ্রহণীয় । সূর্যোদয়ের পর যদি কিঞ্চিৎকাল অষ্টমী এবং অন্য সকল দিন নবমী থাকে, আর মুহূৰ্ত্তমাত্র কালও রোহিণী-নক্ষত্রের যোগ ঘটে, তাহলে সেই দিনই সম্পূর্ণ অষ্টমী বলে ধরবে। হে রাজন! বুধ বা সোমবারে যদি রোহিণীযুক্তা অষ্টমী হয়, তাহলে আর ব্রতকোটি দ্বারাও প্রয়োজন নেই। সোম কিম্বা বুধবারে উদয়ের পর কিঞ্চিৎকাল অষ্টমী পরে সমস্ত দিন নবমী, এরূপ দিন শত বছরের মধ্যে ক্বচিৎ লভ্য হয় কি না সন্দেহ। যথোক্ত নক্ষত্র না ঘটলেও নবমীযুতা অষ্টমীই গ্রহণীয় । যদি রোহিণী নক্ষত্রের যোগ ঘটে, তাহলে সপ্তমীবিদ্ধা অষ্টমীও কৰ্ত্তব্য। যে নবমী তিথিতে কলা কাষ্ঠা বা মুহূৰ্ত্তমাত্রও অষ্টমী-যোগ ঘটে, সেই তিথিই গ্রাহ্য, পরন্তু সপ্তমীযুতা অষ্টমী কদাচ গ্রাহ্য নয়। তার উপর যদি ঐ নবমী সোম বা বুধবারে ঘটে, তবে আর কথা কি ? নবমীযুক্ত অষ্টমী যে কুল-কোটির উদ্ধার সাধন করে, তা বলাই বাহুল্য। হে রাজন! এই অষ্টমী যদি পল পরিমিত সপ্তমী দ্বারাও বিদ্ধ হয়, তথাপি সুরাবিন্দুষ্পৃষ্ট গঙ্গাজলকলসের ন্যায় তা পরিত্যজ্য।

দিলীপ বললেন,—কে আগে এই ব্রত করেছিলেন ? কার দ্বারাই বা এটি প্রকাশিত হয় এবং এই ব্রত করলে কিরূপ পুণ্যই বা হয় ? হে মহামুনে! তা আমার নিকট বলুন। বশিষ্ঠ বললেন, মহারাজ চিত্রসেন অত্যন্ত পাপপরায়ণ ছিলেন। তিনি অগম্যাগমন; ব্রাহ্মণের স্বর্ণস্তেয়, সদা সুরাপান এবং নিয়ত যথেচ্ছ মাংস ভক্ষণ করতেন । রাজা চিত্রসেন এইরূপে পাপযুক্ত হয়ে প্রতিনিয়ত প্রাণিবধে নিরত থাকতেন এবং পতিত চণ্ডালগণের সাথে সর্বদা আলাপ করতেন। এ হেন রাজা একদা মৃগয়ায় মনোনিবেশ করলেন । বনের ভিতর বাঘ আছে জানতে পেরে তিনি সেখানে তাকে বেষ্টন করালেন এবং দূতগণকে বললেন—আমিই একে নিধন করব; অন্য যে কেউ একে বধ করবে, সে আমার বধ্য হবে । সেই বাঘ কিন্তু রাজার সামনেই পালিয়ে গেল। রাজা তখন লজ্জিতভাবে বাঘের পেছনে অনুসরণ করলেন। তিনি সতর্কতার সাথে বাঘবিনাশের জন্য অনেক ক্লেশ অনেক দুঃখ পেলেন। পিপাসায় তাঁর অশেষ ক্লেশ হল। তিনি সন্ধ্যাকালে যমুনার তীরে আসলেন । ঐ দিন কৃষ্ণের জন্মদিন, রোহিণীযুক্তা অষ্টমী তিথি। হে নরাধিপ! ঐ দিন দেবকন্যাগণ গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, ও নানা সুশোভন উপহার দ্রব্য দ্বারা যমুনার তীরে জন্মাষ্টমীব্রত করছিল । পুজায় গন্ধ পুষ্প ও কুঙ্কুম আদি মনোহর দ্রব্য দেওয়া হয়েছিল। বহু গুণান্বিত অন্ন দর্শনে রাজার ভোজনের ইচ্ছা হল । রাজা বললেন — অন্নের অভাবে আজ আমার প্রাণ নিশ্চয়ই বহির্গত হবে। স্ত্রীগণ বললেন – হে রাজন! হরির জন্মাষ্টমীদিনে আপনি ভোজন করবেন না। যে ব্যক্তি কৃষ্ণজন্মদিনে অন্ন ভোজন করে তার গৃধ্র, খর, কাক ও গো-মাংস ভক্ষণ করা হয়। ফলে, জন্মাষ্টমীদিনে ভোজনে নরগণের কি কি ছিদ্রই না উৎপন্ন হয়ে থাকে ? হে নৃপ! যে ব্যক্তি দেহে প্রাণ থাকতে জয়ন্তীব্রত না করে, জয়ন্তী তিথিতে উপবাস না করে, যমমন্দিরই তার শাসন-স্থান হয়। জয়ন্তী তিথিতে ভোজন করলে, যথাবিধি নিত্য যা দান করা হয়, তাও পিতৃগণ ভোজন করেন না, তাঁরা সকলেই পতিত হয়ে থাকেন।

হে নরাধিপ ! এইরূপ ব্রতবৃত্তান্ত শ্রবণ করে রাজা চিত্রসেনও কিঞ্চিৎ পুষ্প, গন্ধ ও বস্ত্র এনে সহর্ষে ব্রত পালন করলেন। ব্রত অনুষ্ঠানের পর তিথি অবশেষে পারণ করলেন । ব্রতের প্রভাবে চিত্রসেন মরণান্তে দিব্য বিমানে আরোহণ করে পিতৃদের সাথে হরিগৃহে উপনীত হলেন । মথুরায় গমন করে শ্রীকৃষ্ণ বদনকমল অবলোকন করলে মানুষ যে ফল প্রাপ্ত হয়, কৃষ্ণজন্মাষ্টমীব্রতের গুণে সেই ফলই লাভ হয়ে থাকে। দ্বারকায় বিশ্বেশ্বর হরিকে দর্শন করলে দীনজনগণ যে ফল প্রাপ্ত হয়, কৃষ্ণজন্মাষ্টমী ব্রতের অনুষ্ঠানেও সেই ফল লাভ হয়ে থাকে।

— পদ্ম পুরাণ, ব্রহ্মখণ্ডম্, []

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

পাদটীকা

[সম্পাদনা]
  1. "Sri Krishna Janamashtami celebrated in the city"The Hindu। আগস্ট ২৪, ২০০৮। সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৮-১২ 
  2. Ashtami Rohini 2011 in Kerala – Sri Krishna Jayanti and Janmashtami
  3. "In Pictures: People Celebrating Janmashtami in India"। সংগ্রহের তারিখ ১০ আগস্ট ২০১২ 
  4. Packert, Cynthia. The Art of Loving Krishna: Ornamentation and Devotion. Indiana University Press, 2010. Print.
  5. Knott, Kim (২০০০)। Hinduism: A Very Short Introduction। Oxford University Press, USA। পৃষ্ঠা 160। আইএসবিএন 0-19-285387-2 
  6. "Information on Lord Krishna Birth and Death Time"। সংগ্রহের তারিখ ২৯ মার্চ ২০১৫ 
  7. Krishna
  8. Pargiter, F.E. (1972) [1922]. Ancient Indian Historical Tradition, Delhi: Motilal Banarsidass, pp.105–107.
  9. পঞ্চানন তর্করত্ন। পদ্ম পুরাণ। নবভারত পাবলিশার্স। 

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]