শীতল পাটি
ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি | |
---|---|
দেশ | বাংলাদেশ |
ধরন | ঐতিহ্যবাহী কারিগরিশিল্প |
ইউনেস্কো অঞ্চল | এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল |
অন্তর্ভূক্তির ইতিহাস | |
অন্তর্ভূক্তি | ২০১৭ (১২তম অধিবেশন) |
শীতল পাটি এক ধরনের মেঝেতে পাতা আসন বা গালিচা। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যগত কুটির শিল্প। মুর্তা বা পাটি বেত বা মোস্তাক নামক গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এগুলো তৈরি হয়ে থাকে। হস্তশিল্প হিসাবে এগুলোর যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো-পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর ও চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত মাদুরকে নকশি পাটিও বলা হয়।[১] জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।[২]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি কর্তৃক বিরচিত এবং ১৯২০-এর দশকে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত” নামীয় বিশালকার গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৪র্থ অধ্যায়ে শীতল পাটি সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়: “... এই শিল্পের মধ্যে শীতল পাটি সর্বপ্রধান ও বিশেষ বিখ্যাত। মূর্ত্তা নামক এক জাতীয় গুল্মের বেত্র দ্বারা ইহা প্রস্তুত হয়। ইহা শীতল, মসৃণ ও আরামজনক বলিয়া সর্বত্র আদৃত। বঙ্গদেশের অন্য কোথায়ও এইরূপ উৎকৃষ্ট পাটি প্রস্তুত হইতে পারে না। পাটির বেত্র রঞ্জিত ক্রমে পাশা, দাবা প্রভৃতি বিবিধ খেলার ছক ইত্যাদি চিত্রিত করা হয়। পাটির মূল্য গুণানুসারে ১০ আনা হইতে ১০ টাকা পর্যন্ত হইতে পারে। বেত্র যত চিকণ হয়, মূল্য ততই বর্ধিত হয়। পূর্বে নবাবের আমলে ২০-২৫ টাকা হইতে ৮০-৯০ টাকা, এমন কি শত দ্বিশত টাকা পর্যন্ত মূল্যের পাটি প্রস্তুত হইত বলিয়াও শুনা যায়। ২০-২১ হাত দীর্ঘ পাটিকে ‘সফ’ বলিয়া থাকে। ইট ও চোঁয়ালিশ পরগণাতেই সর্ব্বোৎকৃষ্ট শীতল পাটি প্রস্তুত হয়। পাটি প্রস্তুতকারকগণ ‘পাটিয়ারা দাস’ নামে খ্যাত। ১৮৭৬-৭৭ খৃষ্টাব্দে শ্রীহট্ট হইতে ৩৯২৭ টাকা মূল্যের পাটি রপ্তানি হইয়াছিল।”
বয়ন পদ্ধতি
[সম্পাদনা]যে গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ থেকে শীতল পাটি তৈরী করা হয় তার স্থানীয় নাম “মুর্তা”। স্থানভেদে একে ‘মুসতাক’, ‘পাটিবেত’ ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। মুর্তা গাছ দেখতে সরু বাঁশের মতো; জন্মে ঝোপ আকারে। গোড়া থেকে কেটে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় মুর্তার কাণ্ড। দা দিয়ে চেঁছে পাতা ও ডাল-পালা ফেলে দেয়া হয়, দূর করা হয় ময়লা। এরপর মাটিতে মাছকাটার বটি ফেলে মুর্তার কাণ্ডটিকে চিড়ে লম্বালম্বি কমপক্ষে চারটি ফালি বের করা হয়। কাণ্ডের ভেতর ভাগে সাদা নরম অংশকে বলে ‘বুকা’। এই বুকা চেঁছে ফেলে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পাটি তৈরী ক’রে তাকে বলা হয় ‘পাটিকর’ বা ‘পাটিয়াল’। পাটিকরের লক্ষ্য থাকে মুর্তার ছাল থেকে যতটা সম্ভব সরু ও পাতলা ‘বেতী’ তৈরী করে নেয়া। বেতী যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত নরম ও মসৃণ হবে। এজন্য হাতের নখ দিয়ে ছিলে বুননযোগ্য বেতী আলাদা করা হয়ে থাকে। বেতী তৈরী হওয়ার পর এক-একটি গুচ্ছ বিড়ার আকারে বাঁধা হয়। তারপর সেই বিড়া ঢেকচিতে পানির সঙ্গে ভাতের মাড় এবং আমড়া, জারুল ও গেওলা ইত্যাদি গাছের পাতা মিশিয়ে সিদ্ধ করা হয়। এর ফলে বেতী হয় মোলায়েম, মসৃণ ও চকচকে। রঙ্গীন নকশাদার পাটি তৈরীর জন্য সিদ্ধ করার সময় ভাতের মাড় ইত্যাদির সঙ্গে রঙের গুঁড়া মেশানো হয়। দক্ষ কারিগর একটি মুর্তা থেকে ১২টি পর্যন্ত সরু বেতি তৈরী করতে সক্ষম। ছিলে ছিলে বেতী তৈরীর সময় পাটিকর বুড়ো আঙ্গুল ও মধ্যমায় কাপড় পঁচিয়ে নেয় যাতে বেতীর ধারে আঙ্গুল না ফেঁড়ে যায়। পাটিকর মাটিতে বসে কাপড় বোনার মতই দৈর্ঘ্য-বরাবর এবং প্রস্থ-বরাবর বেতী স্থাপন ক’রে নেয়। পাটি বোনার সময় বেতীগুলোকে ঘন আঁট-সাঁট ক’রে বসানো হয় যাতে ফাঁক-ফোকড় না-থাকে। নকশী পাটির ক্ষেত্রে পাটিকর তার স্মৃতি থেকে বাদামী বা প্রাকৃতিক রঙের বেতীর সঙ্গে রঙ্গীন বেতী মিশিয়ে নকশা তৈরী করে।
বিস্তৃতি
[সম্পাদনা]সিলেট এই পাটির জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ উপজেলা, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর অঞ্চলে এই গাছ জন্মে এবং পাটি ও পাওয়া যায়। ঢাকার নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজারে শীতল পাটি কিনতে পাওয়া যায়। এর দাম আকার অনুযায়ী বিভিন্ন হয়। নকশা করা পাটিগুলো দাম বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাটি তৈরী-হয়। কিন্তু সিলেট এলাকায় বিভিন্ন স্থানে যে মানের শীতল পাটি তৈরী হয় তা অসাধারণ। সিলেট অঞ্চলের সুনামগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় পাটিকররা তাদের নিপূণতার জন্য শত শত বৎসর যাবৎ প্রসিদ্ধ। শীতল পাটিতে বসে বা শুয়ে যে আরামপ্রদায়ী শীতল অনুভূতি পাওয়া যায় তা ব্যাখ্যাতীত। আধুনিক নগর জীবনেও বিয়ের অনুষ্ঠানে কনের আসন হিসেবে শীতল পাটির ব্যবহার অব্যাহত আছে। শীতল পাটির খণ্ডাংশ অন্যান্য হস্তশিল্পজাত পণ্য তৈরীতে ব্যবহৃত হয়।
ইউনেস্কোর নির্বস্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি
[সম্পাদনা]জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ৬ ডিসেম্বর, ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্প-কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু দ্বীপে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর নিবর্স্তুক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গঠিত আন্তজাতিক পর্ষদ (অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সুরক্ষার জন্য আন্তঃ-সরকারি কমিটি) বাংলাদেশ সরকারের শীতল পাটি বিষয়ক প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাবটি Nomination file no. 1112 হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এই প্রস্তাবনাটি প্রণয়ন করে এবং ইউনেস্কোর নিকট ২০১৬ খ্রি. এর সেপ্টেম্বরে দাখিল করে। ২০১৭ এর ২৭ অক্টোবর ইউনেস্কোর সংশ্লিষ্ট মূল্যায়ন কমিটি বাংলাদেশের প্রস্তাবটি গ্রহণযোগ্য বলে অভিমত ব্যক্ত করে।
ইতোপূর্বে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের বাউল গান, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে জামদানি বয়ন শিল্প এবং ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গল শোভাযাত্রা ইউনেস্কোর নিবর্স্তুক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। অতঃপর ইউনেস্কো বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের শীতল পাটি বুননের ঐতিহ্যগত হস্তশিল্পকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।[৩]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ জিনাত মাহরুখ বানু (২০১২)। "নকশি পাটি"। সিরাজুল ইসলাম ও আহমেদ এ. জামাল। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
- ↑ Traditional art of Shital Pati weaving of SylhetBangladesh[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Traditional art of Shital Pati weaving of SylhetBangladesh[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |