বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলা ভাষা আন্দোলন

পরীক্ষিত
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(ভাষা আন্দোলন থেকে পুনর্নির্দেশিত)
বাংলা ভাষা আন্দোলন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অংশ
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিছিল
তারিখ১৯৪৮ – ১৯৫৬
অবস্থান
কারণপাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ববঙ্গ সরকারের উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত
পদ্ধতি
ফলাফল
পক্ষ
নেতৃত্ব দানকারী

বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশে) সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে; অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। পাকিস্তানের ছিল দুইটি অংশ: পূর্ব বাংলা (১৯৫৫ সালে পুনর্নামাঙ্কিত পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের (প্রায় ১২৪৩ মাইল) অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে অনেকগুলো মৌলিক পার্থক্য বিরাজমান ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান অধিরাজ্য সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণ তথা আরবিকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। আবার, সমগ্র পাকিস্তানের সকল ভাষা লাতিন হরফে লেখার মাধ্যমে বাংলার রোমানীকরণের প্রস্তাবও করা হয়। এসকল ঘটনার প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কার্যত পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি এবং মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ফলস্বরূপ মাতৃভাষা বাংলার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮) এ আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম.এ. ক্লাসের ছাত্র বরকতআব্দুল জব্বারসহ আরও অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হন। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব বাংলায় তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা পূর্ণ হরতাল পালন করে এবং সভা-শোভাযাত্রাসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিকশাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামের এক কিশোর। ২৩শে ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্র-জনতার মিছিলেও পুলিশ অত্যাচার-নিপীড়ন চালায়। এ নির্লজ্জ, পাশবিক, পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল থেকে সেদিনই পদত্যাগ করেন। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্রদের দ্বারা গড়ে ওঠে শহীদ মিনার, যা ২৪ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন, শহীদ শফিউর রহমানের পিতা। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন, দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন।

ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ই মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাউর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লিখিত হয়। ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বৈশ্বিক পর্যায়ে সাংবার্ষিকভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদ্‌যাপন করা হয়।

পটভূমি

দক্ষিণ এশিয়াতে ব্রিটিশশাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়: ভারত, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার), সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) এবং পাকিস্তান (যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা অধুনা বাংলাদেশ নামে পরিচিত)।

বর্তমানের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি পূর্বে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ধর্মীয় নেতা স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, নবাব ওয়াকার-উল-মুলক মৌলভী এবং মৌলভী আবদুল হক প্রমুখদের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় তথা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষার মর্যাদায় উন্নীত হয়।[][] উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এ ভাষাটি আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষাটি অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো-আর্য ভাষা পালি-প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কির ঘনিষ্ঠ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে[] দিল্লি সুলতানাতমুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়।[] এর পারসিক-আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যেখানে হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হত।[]

উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশ বাংলার মুসলমানেরা বাংলা ভাষাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা,[] যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার বিকশিত হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম লীগ ছিল ব্রিটিশ ভারতের একটি রাজনৈতিক দল, যা ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। [] আবার এদিকে ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রস্তাব করে ও সেটার বিরোধিতা করেন বাঙালিদের নেতা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। কিন্তু আবার বিতর্কটি শুরু হয় যখন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম নিশ্চিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে তারিখে চৌধুরী খলীকুজ্জমান ও জুলাই মাসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার প্রস্তাব প্রদান করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মুহম্মদ শহীদুল্লাহমুহম্মদ এনামুল হকসহ বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী প্রবন্ধ লিখে প্রতিবাদ করেন৷[] ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টে ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত থেকে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান ও হিন্দু অধ্যুষিত ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পাকিস্তান অধিরাজ্যের পূর্ববঙ্গ প্রদেশটি দেশের অবশিষ্ট অঞ্চল থেকে প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল এবং ধর্ম ছাড়া পূর্ববঙ্গের সাথে পাকিস্তান অবশিষ্ট অঞ্চলের সাদৃশ্য খুব কমই ছিল।[] ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর বঙ্গ প্রদেশের বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট পূর্ববঙ্গ প্রদেশের মানুষ হিসেবে নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়।[] কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল।[১০] ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে বাংলাকে প্রদেশের আদালত ও শিক্ষার ভাষা ঘোষণা করা ও রাষ্ট্রভাষার সিদ্ধান্ত জনসাধারণের উপর ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।[১১] একই মাসে তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অধ্যাপদকদের নিয়ে গঠিত এই সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার অবস্থান নিয়ে প্রচারণা চালাতে থাকে।[১২] অক্টোবরে এই সংগঠনের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।[১৩] ৫ ডিসেম্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সিদ্ধান্ত নেয় যে উর্দু পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা হবেনা। অন্যদিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভকারীরা প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এলে মৌলানা আকরম খাঁর আশ্বাসে তারা ফিরে যায়।[১৪] ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়।[১৫][১৬] তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়।[১৭] পূর্ববঙ্গে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে।[] কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকে বাদ দেয় ও সাথে সাথে মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে, যার ফলে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের মাঝে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় ও সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়।[১৮] কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।[১৯][২০]

প্রাথমিক পর্যায় (১৯৪৮–১৯৫২)

গণপরিষদের প্রস্তাব

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তমুদ্দিন মজলিস বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্মারকলিপির জন্য স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে এবং কয়েক হাজার স্বাক্ষর সহ একটি স্বারকলিপি সরকারের নিকট প্রেরণ করে। ২৩ ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন ঘোষণা করা হলে পূর্ববঙ্গ থেকে সদস্যগণ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে করাচী যাওয়ার আগে তমুদ্দিন মজলিস তাদেরকে পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাকটিকেট ইত্যাদিতে বাংলা বাদ দেওয়ার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সদস্যগণ ব্যাপারটি দেখার আশ্বাস দেন।[২১]

১৯৪৮ সালের ২৩ ও ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে[২২] পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রথম প্রস্তাবটির বিরোধিতা করা মৌলানা তমিজুদ্দিন খাঁ এবং তা গণপরিষদের ভোটে বাতিল হয়ে যায়।[][২২] দ্বিতীয় প্রস্তাবে[২২] ইংরেজিতে প্রদত্ব বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলেন। এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি।

সংসদ সদস্য প্রেমহরি বর্মন, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন এবং তাদের এ সমর্থনের মাধ্যমে মূলত পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক মতামতই প্রতিফলিত হয়েছিল। তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে পরিষদে উপস্থিত মুসলিম লীগের সকল মুসলিম সদস্য একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন যে, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক।”[২৩][২৪] পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান এ প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। উর্দুকে লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে”। অনেক বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল হয়ে যায়।[][২৫][২৬] পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলে যে তার প্রদেশের জনগণ শুধু উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চায়।[২৭] সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে সেদিন গণপরিষদে উপস্থিত মুসলিম লীগের অনেক বাঙালি মুসলমান সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত সংশোধনীটিকে সমর্থন করতে পারেননি।[২৮]

প্রথম প্রতিক্রিয়া

গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজজগন্নাথ কলেজ ছাত্রদের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে।[২৩] একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তমদ্দুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই ছাত্রসভায় গণপরিষদের সিদ্ধান্ত, খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্য ও গণপরিষদের বাঙালি মুসলিম সদস্যদের নীরবতার প্রতি নিন্দা জানানো হয়। এছাড়া সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়।[২৯] ২৯ ফেব্রুয়ারি তারিখেও ধর্মঘট ঘোষিত হয় এবং ঐদিন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালন করা হয়। সরকারের প্ররোচনায় পুলিশ মিছিলে লাঠিচার্জ করে এবং অনেক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।[২৩] তমদ্দুন মজলিস ঐসময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশ ঘটে।[২৪] ঐ সভায় দ্বিতীয়বারের মত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং শামসুল আলম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এ পরিষদে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও ছাত্রাবাসগুলো থেকে দুই জন করে প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হয়।[২৩] সেখান থেকে ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে।[৩০] অন্যদিকে সিলেটে ৮ই মার্চে গোবিন্দ পার্কে তমুদ্দিন মজলিস ও মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের আয়োজনে জনসভায় বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়। জনসভায় উর্দুর সমর্থক হিসেবে স্বচিহ্নিত দুষ্কৃতকারীরা বাধা দেয় এবং হাঙ্গামা করে, যার ফলে জনসভা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হাঙ্গামার প্রতিবাদে ১০ মার্চ সভার আয়োজন করা হলে জেলা প্রশাসন সিলেট জেলায় ২ মাসের জন্য বাংলা ভাষার প্রশ্নে সভা আয়োজন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।[৩১]

১১ মার্চের কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ ভোরে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট পালিত হয়। সকালে ছাত্রদের একটি দল রমনা ডাকঘরে গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রদের আরও একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। তারা হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে সবাইকে চাপ দিতে থাকে, ফলে বিভিন্ন স্থানে তাদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হতে হয়। লাঠিচার্জের প্রতিবাদে হাইকোর্টের উকিলরা আদালত বর্জন করে।[৩২] এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পূর্ব পাকিস্তানের জেনারের অফিসার কম্যান্ডিং ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং স্বয়ং গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার মধ্য দিয়ে বের করে আনেন।[৩৩] ধর্মঘটে ছাত্রদের উপর গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়া হয়, যারা অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় ছাত্রদের ভয় দেখানোর পাশাপাশি তাদের উপর হামলা করে। হামলায় অধ্যাপক আহসান হাবীব আহত হন।[৩৪] বিকেলে নির্যাতনের প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয় এবং কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ। ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন নঈমুদ্দিন আহমদ।[২৪] সেদিন সমগ্র প্রদেশে ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে।[৩৪]

খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে চুক্তি

১১ তারিখের এ ঘটনার পর ১২ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ ধর্মঘট পালন করা হয়। ১৫ মার্চ ছিল পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার দিন, তাই ওইদিন ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৪ই মার্চে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রদের দ্বারা সতস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট পালিত হয়। ওই দিন ঢাকায় বিকালে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের সভায় ১১ই মার্চের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। তখনো ছাত্রদের একাংশ রাত পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।[৩৫] ১৫ই মার্চে ধর্মঘট সফল করার জন্য টঙ্গী ও কুর্মিটোলায় কর্মীদের রেল কর্মচারীদের আনত৩ পাঠানো হয়। ধর্মঘটে ঢাকার বিভিন্ন অফিসের কর্মচারীরা যোগ দেয়। ধর্মঘট থেকে সরকার আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করতে শুরু করে।[৩৬] আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমূখ অংশগ্রহণ করেছিলেন। আলোচনাসাপেক্ষে দুই পক্ষের মধ্যে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু চুক্তি সম্পাদনের খবর শুনে আন্দোলনকারীরা উত্তেজিত হয়ে যায়। তখন মোহাম্মদ তোয়াহা সহ সংগ্রাম পরিষদের কিছু সদস্য তাদেরকে শান্ত করেন। তবে চুক্তি সম্পাদনের পরও বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত থাকে এবং সেদিন ১৬ই মার্চে ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়।[৩৭] ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে সরকারের এ নমনীয় আচরণের প্রধান কারণ ছিল ১৯ মার্চ জিন্নাহ্‌'র ঢাকা আগমন। তার আসার পূর্বে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দিন চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবিটি তখন পর্যন্ত মেনে নেয়া হয়নি। চুক্তিতে আন্দোলনের সময় গ্রেফতারকৃত বন্দিদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত ছিল।[২৩] চুক্তিগুলো ছিল:[৩৭]

  1. ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে।
  2. পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
  3. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
  4. সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
  5. আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
  6. ২৯শে ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে।
  7. পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে।
  8. রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন "রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই" এই মর্মে মুখ্যমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌র ঢাকা সফর

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় এক ভাষণে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”

১৯ মার্চ ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসে পৌঁছান পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ও স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ও সেখানে তিনি ভাষণ দেন। তার ভাষণে তিনি ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন।[৩৮][৩৯][৪০][৪১][৪২] যদিও তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী; কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন - “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়” ।[][৪০][৪৩][৪৪] তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না” । জিন্নাহ্‌'র এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা - এ ধরনের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।[৩৯] ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়েও তিনি একই ধরনের বক্তব্য রাখেন।[১০] তিনি উল্লেখ করেন এ আন্দোলন সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের কথা পুনরুল্লেখ করেন, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করে ওঠে।

একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহ্‌'র সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি দেয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম।[] কিন্তু জিন্নাহ্ খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করেন।[৪৫] অনেক তর্ক-বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহ্'র নিকট স্মারকলিপি পেশ করে।[২৮] ২৮ মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে দেয়া ভাষণে তার পূর্বেকার অবস্থানের কথাই পুনর্ব্যক্ত করেন।[৪৬] জিন্নাহ্'র ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তমুদ্দন মজলিসের আহ্বায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহা'র কাছে হস্তান্তর করেন।[৩৯] পরবর্তীতে তমুদ্দন মজলিস আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার জন্য কমিউনিস্টদের দায়ী করে একটি বিবৃতি প্রদান করে এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।

লিয়াকত আলি খানের ঢাকা সফর

১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে তিনি এক ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ঐ সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হয়, কিন্তু তিনি কোনোরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ১৭ নভেম্বর তারিখে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করেন এবং সেটি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রেও কোনো সাড়া দেননি।[২৩][৪৭]

ভাষা সমস্যার প্রস্তাবিত সমাধান

এর কিছুদিন পরই, পূর্ব বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে ভাষা সমস্যার ব্যাপারে একটি বিস্তারিত ব্যাখ্যা জানতে মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি গঠন করা হয়, এবং এই বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়।[৪৮] ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে কমিটি তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে; তবে এটি ১৯৫৮ সালের আগে প্রকাশ করা হয়নি। এখানে ভাষা সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে একটি কার্যকর ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়, যেখানে তারা বাংলাকে আরবি অক্ষরের মাধ্যমে লেখার সুপারিশ করেছিলেন।[৪৯]

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫২–১৯৫৬)

১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নওয়াবপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রদের মিছিল।

ভাষা আন্দোলনের মতো আবেগিক বিষয়ের পুনরায় জোরালো হবার পেছনে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।[২৮] তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলত জিন্নাহ্'র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।[৪৫] রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন যে কোনো জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি।[৪৫] নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন করে। সেদিন ছাত্রসহ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।[২৩] পরে তারা তাদের মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমী) দিকে অগ্রসর হয়।[৫০] পরদিন ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয়।[][৫১] সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেয়া হয়। পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।[৪৫]

পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে সমবেত হয়। সমাবেশ থেকে আরবি লিপিতে বাংলা লেখার প্রস্তাবের প্রতিবাদ এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের দাবি জানানো হয়। ছাত্ররা তাদের সমাবেশ শেষে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে।[৫২]

২০ ফেব্রুয়ারি সরকার স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন হলে সভা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ৯৪ নবাবপুর রোডস্থ আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের কিছু সদস্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পক্ষে থাকলেও, সবশেষে ১১-৩ ভোটে[৫৩] ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।[২৩] ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে একই বিষয় নিয়ে পৃথক পৃথক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় সলিমুল্লাহ হলে ফকির শাহাবুদ্দীনের সভাপতিত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফজলুল হক মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত সভায় নেতৃত্ব দেন আবদুল মোমিন। শাহাবুদ্দিন আহমদের প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদকে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নেন আবদুল মোমিন এবং শামসুল আলম।[৫৪]

২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে আমতলায় ঐতিহাসিক ছাত্রসভা।

পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এ দিন সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। পুলিশ অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিক ঘিরে রাখে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ঐসময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার প্রস্তুতি নিলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।[] কিছু ছাত্র ঐসময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌঁড়ে চলে গেলেও বাদ-বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিশ দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিশকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে অনুরোধ জানান এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেন। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় কয়েকজনকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে পুলিশ গ্রেফতার শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে পুনরায় তাদের বিক্ষোভ শুরু করে।

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণ, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রাক্কালে।

বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইনসভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবে। ছাত্ররা ঐ উদ্দেশ্যে আইনসভার দিকে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিশ দৌঁড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে।[২৮] পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন।[৫৫] এছাড়া আব্দুস সালাম, আবুল বরকতসহ আরও অনেকে সেসময় নিহত হন।[][৫৬] ঐদিন অহিউল্লাহ নামের একজন ৮/৯ বছরেরে কিশোরও নিহত হয়।[]

ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়।[৪৩] রেডিও শিল্পীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহ্বান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।[৫৭]

ঐসময় গণপরিষদে অধিবেশন শুরুর প্রস্তুতি চলছিল। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে মাওলানা তর্কবাগিশসহ বিরোধী দলীয় বেশ কয়েকজন অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে এসে দাঁড়ান।[] গণপরিষদে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-সহ ছোট ছয়জন সদস্য মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্যে অনুরোধ করেন এবং শোক প্রদর্শনের লক্ষ্যে অধিবেশন স্থগিত করার কথা বলেন।[২৮] কোষাগার বিভাগের মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, শরফুদ্দিন আহমেদ, সামশুদ্দিন আহমেদ খন্দকার এবং মসলেউদ্দিন আহমেদ এই কার্যক্রমে সমর্থন দিয়েছিলেন। যদিও নুরুল আমিন অন্যান্য নেতাদের অনুরোধ রাখেননি এবং অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন।[][২৮]

২২শে ফেব্রুয়ারির ঘটনা

২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে জানাজা শেষে বিশাল মিছিল বের হয়।

সেদিন আইন পরিষদে বিরোধী দলের সদস্যরা বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারা প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে হাসপাতালে আহত ছাত্রদের দেখতে এবং অধিবেশন মুলতবি করার ঘোষণা দিতে আহ্বান জানান। ক্ষমতাসীন দলের কিছু সদস্যও এই আহ্বানে সমর্থন জানান। কিন্তু নুরুল আমিন তাদের আহ্বানের সাড়া না দিয়ে অধিবেশন অব্যাহত রাখেন এবং হাসপাতালে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে।[২৮] বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক সমাজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহণে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে এবং একপর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। ঐ ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।

শহরের বিভিন্ন অংশে একইভাবে জানাজা ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কলেজ, ব্যাংক-সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজন এই মিছিলে অংশ নিতে আসে।[৪৩] বিকেলে আরেকটি বিশাল মিছিল পুলিশ দ্বারা আক্রান্ত হয়। বিক্ষুদ্ধ জনতা সরকার পক্ষের প্রথম সারির দুটি সংবাদপত্র জুবিলী প্রেস এবং মর্নিং নিউজ অফিসে অগ্নিসংযোগ করে।[৫৮][৫৯] উল্লেখ্য, জুবিলী প্রেস থেকে সকালের পত্রিকা বের হয়েছিল।

একই দিনে পুলিশ দ্বারা আক্রমণ ও হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। নবাবপুর রোডের বিশাল জানাজার মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, ওয়াহিদুল্লাহ এবং আবদুল আউয়াল।[২৩] একই রাস্তায় অহিউল্লাহ নামে নয় বছরের এক বালকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়।[][৬০] জনশ্রুতি আছে, পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে।

২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর সরকার আন্দোলনের বিপক্ষে জোরালো অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে যে, কমিউনিস্ট ও পাকিস্তানবিরোধীদের প্ররোচনায় ছাত্ররা পুলিশকে আক্রমণ করেছিল। তারা বিভিন্নভাবে তাদের এই প্রচার অব্যাহত রাখে। তারা সারাদেশে প্রচারণাপত্র বিলি করে। সংবাদপত্রগুলোকে তাদের ইচ্ছানুসারে সংবাদ পরিবেশনে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে।[৬১] পাশাপাশি ব্যাপক হারে সাধারণ জনগণ ও ছাত্র গ্রেফতার অব্যাহত রাখে। ২৫ ফেব্রুয়ারি আবুল বরকতের ভাই একটি হত্যা মামলা দায়ের করার চেষ্টা করলে, উপযুক্ত কাগজের অভাব দেখিয়ে সরকার মামলাটি গ্রহণ করেনি।[৬২] রফিকউদ্দিন আহমদের পরিবার একই ধরনের একটি প্রচেষ্টা নিলে, ঐ একই কারণে তাও বাতিল হয়। ৮ই এপ্রিল সরকার তদন্ত শুরু করে। কিন্তু এর প্রতিবেদনে মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রদের উপর গুলি করার কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ দেখাতে পারেনি।[৬৩] সরকারের প্রতিশ্রুত প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ প্রত্যাখান করে। ১৪ই এপ্রিল গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন সামনে চলে আসে।[৬৪] এ সমস্যা নিরসনের পক্ষে অনেক সদস্য মত প্রকাশ করলেও মুসলিম লীগের সদস্যরা এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এ বিষয়ের বিপক্ষে তারা ভোট দিলে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। এর মাধ্যমে তারা ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার পর গণপরিষদে বাংলা ভাষার পক্ষে কথা বলার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।[৬৫] ২৭ এপ্রিল বার সেমিনার হলে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ একটি সেমিনার আহ্বান করে এবং সরকারের কাছে ২১-দফা দাবি উত্থাপন করে। ১৬ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সেদিন ছাত্ররা সমাবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় লীগ কমিটির প্রধান নেতা আব্দুল মতিন গ্রেফতার হলে কমিটি আবার পুণর্গঠিত হয়।

আবুল বরকতের পরিবার শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে।

ফেব্রুয়ারি ২৫ তারিখে, কল-কারখানার শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ শহরে ধর্মঘটের ডাক দেয়।[৬৬] ফেব্রুয়ারির ২৯ তারিখে প্রতিবাদে অংশগ্রহকারীরা ব্যাপক পুলিশী হামলার শিকার হন।[৬৭]

চূড়ান্ত পর্যায়

১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি: প্রথম শহীদ দিবস সকালে ছাত্র-জনতার শোক শোভাযাত্রা মেডিক্যাল হোস্টেল মোড়ে (যেখান থেকে গুলি চলেছিল) শহীদানের আত্মার মাগফেরাত কামনায় মোনাজাত করছে।
১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরিতে ফ্যাস্টুন হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।

কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় কর্মপরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি স্মরণে শহীদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও দিবসটি পালনে সম্মত হন।[৬৮] ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের উদ্দেশ্যে প্রশাসনের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভাষা আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে সারা দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় শহীদ দিবস পালিত হয়। অধিকাংশ অফিস, ব্যাংক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষ প্রভাতফেরীতে যোগ দেন। হাজার হাজার মানুষ শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসে এবং মিছিল করে প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে। সহিংসতা রোধের জন্য স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। প্রায় লক্ষ লোকের উপস্থিতিতে আরমানিটোলায় বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে এক-দফা দাবি জানানো হয়, ভাষার দাবির পাশাপাশি মাওলানা ভাসানীসহ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি উত্থাপন করা হয়।[] রেলওয়ের কর্মচারীরা ছাত্রদের দাবির সাথে একমত হয়ে ধর্মঘট পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসের ছাত্ররা শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করে।[৬৯] অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন যে, বাংলাকে যারা রাষ্ট্রভাষা করতে চায় তারা দেশদ্রোহী। তার এ বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়ে তাকে কালো ব্যাজ দেখায়। সাধারণ মানুষের মাঝে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই লেখা সংবলিত স্মারক ব্যাজ বিলি করা হয়। ভাষা সংগ্রাম কমিটি দিবসটি পালন উপলক্ষে সমাবেশ আহ্বান করে। আন্দোলনকে আরো বেগবান করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে বিশেষ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণাদায়ী অমর সঙ্গীত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো... ঐ বছর কবিতা আকারে লিফলেটে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনের সময় পুলিশ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে।[৭০]

প্রতিক্রিয়া

পশ্চিম পাকিস্তানে

যদিও পূর্ব পাকিস্তানের অনেক বাঙালি মনে করেন যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন জাতিগত জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে সংঘটিত হয়েছিল; কিন্তু এ আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের সংস্কৃতির পার্থক্যগুলো সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।[][৪০][৭১] পশ্চিম পাকিস্তানে এ আন্দোলনটি পাকিস্তানি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বিভাগীয় উত্থান বলে মনে করা হয়।[৭২] দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে “একমাত্র উর্দু” নীতি প্রত্যাখ্যান করাকে মুসলমানদের পারসিক-আরবি সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার মূল মতাদর্শের গুরুতর লঙ্ঘন হিসাবে দেখা হয়।[] পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন শক্তিশালী রাজনীতিবিদ মনে করেন যে, “উর্দু” হল ভারতীয় ইসলামী সংস্কৃতির অংশ, আর বাংলাকে তারা হিন্দু সংস্কৃতির সংমিশ্রণে তৈরি বাংলা সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করতেন।[১০] অধিকাংশই যারা “একমাত্র উর্দু” নীতির পক্ষে ছিলেন, তারা মনে করতেন যে, উর্দু কেবলমাত্র পাকিস্তান দেশের ভাষা হিসেবেই নয়, বরং সমগ্র জাতির ভাষা হিসেবে উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এধরনের চিন্তা-ভাবনাও উর্দু নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল; কেননা, পাকিস্তানে তখন আরও বেশ কিছু ভাষাগত পার্থক্যের সম্প্রদায় ছিল।[১০] বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় ক্রমাগতভাবে বর্ণবাদের শিকার হয়। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে আইয়ুব খান বলেন যে, “পূর্ব পাকিস্তান... এখনো হিন্দু সংস্কৃতি এবং প্রভাবের অধীনে রয়েছে।”[১০]

ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত জাতীয়তাবাদীভিত্তিক দলগুলোর কার্যক্রমে গতির সঞ্চার করে।[]

গণমাধ্যমে

পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিতর্কের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সংবাদপত্রগুলো বাংলা ভাষার পক্ষে-বিপক্ষে নানা নিবন্ধ, সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করে ভাষার এই ইস্যুটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।

কলকাতা থেকে মুসলিম লীগের সমর্থক পত্রিকাগুলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রসঙ্গে বেশকিছু প্রবন্ধ ছাপায়। 'দৈনিক ইত্তেহাদ বাংলা ভাষার পক্ষে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। দৈনিক আজাদ-ও ভূমিকা রেখেছিল৷ তারা বাংলার সমর্থনে বেশকিছু প্রবন্ধ ছাপায়।

দেশভাগের আগে দৈনিক আজাদ ভাষার প্রশ্নে করা বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করে। তবে এ ব্যাপারে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতি রহস্যঘেরা ছিল শুরু থেকেই। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কখনো বাংলা ভাষার পক্ষে আবার কখনো বিপক্ষে বক্তব্য বা সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত ভাষার প্রশ্নে এই পত্রিকাটির অবস্থান সুনির্দিষ্ট ছিল না।

১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উর্দু? নামক একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এই পুস্তিকায় আবুল মনসুর আহমদের, দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক, প্রবন্ধও বিদ্যমান ছিল।

শুরু থেকেই মর্নিং নিউজ বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। এই পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করে এবং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও খবর প্রকাশ করত।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানের একচোখা নীতি বিষয়ে তমদ্দুন মজলিসের কয়জন নেতা মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সাথে আলোচনা করেন, কিন্তু মন্ত্রী বিষয়টিকে ' অনিচ্ছাকৃত ভুল’ বলে বক্তব্য করেন। ইত্তেহাদ পত্রিকা তাঁর এই বক্তব্যের ওপর ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।

১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হয়। সেখানে পাকিস্তান গণপরিষদের বাঙালি প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৫ ফেব্রুয়ারিতে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের জন্য দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি অমৃত বাজার পত্রিকা থেকে এই খবর প্রকাশিত হয়৷

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে খাজা নাজিমুদ্দিন গণপরিষদে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীর মনোভাব রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে। ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে দৈনিক আজাদ খাজা নাজিমুদ্দিনের এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এই সম্পাদকীয়-এর বক্তব্যটি বাংলা ভাষার পক্ষে পত্রিকাটির দৃঢ় সমর্থন নির্দেশক। তবে ভাষা আন্দোলনের সময় পত্রিকাটি সর্বতোভাবে উর্দুকেই সমর্থন করে তাও একই বছরে।

কিছু পত্রিকা বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে জিন্দেগী, ইনসাফ, ও দেশের দাবী পত্রিকা হকে তিনজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়।

১৯৪৮ সালের পর বাংলা ভাষা আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এসময় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা করে। দৈনিক আজাদে বিষয়টি নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের খবর বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের ২৪শে মে তারিখে।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সকালেই ছাত্র-ছাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। তৎকালীন আমতলায়[] সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে-বিপক্ষে নানা তর্ক-বিতর্ক চলে। একপর্যায়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঘোষণা আসে এবং ১০ জন করে মিছিল বাহির হবে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিক হতে মিছিল বাহির হয়। স্লোগান ওঠে, ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আন্দোলন শুরু হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ গুলি চালায় এবং ভাষার জন্য অনেকে জীবন দেন।

২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনার পর ভাষার প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করে দৈনিক আজাদ। সেদিন সন্ধ্যায় বিশেষ টেলিগ্রাম প্রকাশ করে দৈনিক আজাদ । ‘ছাত্রদের তাজা খুনে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’ ব্যানার শিরোনাম করা হয়। পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ঘটনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে পরবর্তী কয়েক দিন দৈনিক আজাদ প্রচুর সংবাদ ছাপে। দৈনিক আজাদ ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা নেয়।

অন্যদিকে মর্নিং নিউজ উর্দু ভাষাকে সমর্থন করত। পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে তারা অন্য রূপ দিয়ে ২২শে ফেব্রুয়ারি খবর প্রকাশ করে। ২২শে ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতা ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে অবস্থিত মর্নিং নিউজের প্রেস ও অফিস জ্বালিয়ে দেয়।[৭৩]

পরিণাম

রাজনীতি

১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের উদ্দেশ্যে প্রভাতফেরিতে নগ্ন পায়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৫৪ সালকে পূর্ব বঙ্গের রাজনৈতিক ও ভাষা আন্দোলনের ব্যাপক পট পরিবর্তনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগ বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রস্তাবে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট যেন আন্দোলনের আর কোনো সুযোগ না পায় সেজন্য মুসলিম লীগ তাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখে।[৭৪] সেজন্য তারা ভাষা আন্দোলন দিবসের আগে যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে।[৭৫]

মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাদের ইশতেহার প্রকাশ করে, যেখানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, কৃষি ও শিক্ষা খাতে সংস্কার, এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের আহ্বান জানানো হয়েছিল।[৭৬] দলটি জানুয়ারি ১৯৫৪ সালে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে।[৭৭]

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৪১ দফা ইশতেহার প্রকাশ করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, রাজনৈতিক সংস্কার এবং জাতীয়করণ।[৭৮] কমিউনিস্ট পার্টি ২ ডিসেম্বর ২২ দফা ইশতেহার প্রকাশ করে, যেখানে তারা মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানায় এবং পাশাপাশি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবি তোলে।[৭৯]

বিভিন্ন বিরোধী দলগুলো একত্র হয়ে একটি যৌথ ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানায়। ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির মধ্যে এ বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন হয়।[৮০] পরবর্তীতে নেজামে ইসলাম পার্টি এবং গণতন্ত্রী দলও এই ফ্রন্টে যোগ দেয়।[৮১]

কিন্তু বাংলা ভাষা আন্দোলন দমন করার ফলে সরকার জনসাধারণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ হেরে যায়।[৮২]

প্রথম যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়।[৮৩]

যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে বাংলা একাডেমী গঠন করে। এ প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, গবেষণা এবং মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়।[৮৩] যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে তারিখে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার বাতিল ঘোষণা করে।[৭৫] ১৯৫৫ সালের ৬ জুন তারিখে যুক্তফ্রন্ট পুণর্গঠন করা হয়; যদিও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীপরিষদে যোগ দেয়নি।[৭৪]

যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পর ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবস শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রথমবারের মতো পালন করা হয়। সরকার নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করে। শহীদ ছাত্রদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গণপরিষদের অধিবেশন পাঁচ মিনিটের জন্য স্থগিত রাখা হয়। বাঙালি নেতাদের উদ্যোগে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়।[৭৪][৮৪]

অন্যদিকে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ের অচলাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে ১৯৫৩ সালে মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির একটি সভা করাচীতে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া এবং সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমমর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রভাষা করে হবে।[৮৫] এ সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেয়ার দাবি তোলে সেখানকার প্রতিনিধিত্বকারীরা।[৮৬] আবদুল হক (“বাবা উর্দু” নামে পরিচিত) এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান এবং তার এ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অনড় থাকেন। তার নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালের ২২শে এপ্রিল করাচীতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করা হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নেয় ও মুসলিম লীগের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়।[৮৭][৮৮] সেখানে সহিংস ঘটনায় সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক আল ওয়াহিদ পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়।[৮৯]

অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলা ও অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেয়ার দাবিতে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। তারা সংখ্যালঘু উর্দুভাষী যারা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছিল তাদের মানসিকতার তীব্র সমালোচনা করেন। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। গণপরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট এবার অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করে; যেখানে মুসলিম লীগের আসনসংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম।[৪৩][৮৮]

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি

পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতীক ১৯৫৪ সালে গৃহীত হয়, যেখানে জাতীয় মূলমন্ত্র ঈমান, ইত্তিহাদ, নাজম-এর বাংলা অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয়ের পর পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে।[৯০] ১৯৫৪ সালের ৭ মে গণপরিষদ মুসলিম লীগের সমর্থনে বাংলাকে সরকারী মর্যাদা দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত করে।[৮৮] ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে, অনুচ্ছেদ ২১৪(১)-এ উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।[৭৪] মোহাম্মদ আলী বগুড়া সংসদে সংবিধানের ভাষা-সংক্রান্ত ধারাগুলি উত্থাপন করেন। এই ধারাগুলির অনুযায়ী বাংলা ভাষাকে উর্দুর মতোই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। সংসদ ও আইনসভায় উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় বক্তব্য রাখার সুযোগ ছিল। সংবিধানে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহারের সুযোগেরও বিধান ছিল।[৯১] তবে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে গঠিত সামরিক সরকার উর্দুকে একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি সামরিক সরকার একটি সরকারি বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে ১৯৫৬ সালের সংবিধানের দুটি রাষ্ট্রভাষা নীতির প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়।[৯২]

স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রভাব

বাংলা ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে গণ্য করা হয়। এই আন্দোলনের পর প্রদেশের জনগণের মধ্যে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটি গুরুত্ব পেতে থাকে।[৯৩] বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পর জাতি গঠনের ক্ষেত্রেও এটি ছিল একটি মূল উপাদান।।[৯৪] এই আন্দোলনের সাফল্য পাকিস্তান সরকারকে তাদের ভাষানীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করে এবং এটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করে, যা শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভাব এবং পাকিস্তানের বিভক্তির পথ তৈরি করে।[৯৫] যদিও ১৯৫৬ সালের পর সরকারি ভাষার বিতর্ক সম্পন্ন হয়, কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও পশতুনদের দেনাগুলো বাঙালিদের ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়। জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সামরিক এবং বেসামরিক চাকুরীর ক্ষেত্রে বাঙালিদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব এবং সরকারি সাহায্যের দিক থেকেও বাঙালিদের প্রাপ্ত অংশ ছিল খুবই কম। জাতিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে বাঙালিদের এ বৈষম্যের ফলে চাপা ক্ষোভের জন্ম নিতে থাকে। এরই প্রভাব হিসেবে আঞ্চলিক স্বার্থসংরক্ষণকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন নিরঙ্কুশভাবে বাড়তে থাকে।[৪০] পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কেন্দ্রীয় সরকার এবং যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে প্রদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খানের সামরিক অভ্যূত্থানের অন্যতম প্রধান কারণ।[৪৩] এর ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আরো বড় অধিকার আদায় ও গণতন্ত্রের দাবিতে ছয় দফা আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আকার ধারণ করে।[][১০]

কিংবদন্তি

বাঙালি সংস্কৃতিতে প্রভাব

বাংলা ভাষা আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানে বাঙালী জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে এবং পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মীয় ভাবধারার সাহিত্যচর্চার ইতি ঘটে সেখানে অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল বাংলা সাহিত্যচর্চার বিকাশ ঘটে।[৯৬] এই আন্দোলনের ফলে পূর্ববঙ্গের পরিবেশের আমূল পরিবর্তন ঘটে। প্রদেশের মুসলিম মেয়েরা ইসলামি পোশাকের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসে এবং ছাত্ররা স্যুট-কোট ছেড়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়তে শুরু করে। মেয়েদের বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যোগ দিতে দেখা যায়। এর ফলে প্রদেশে নতুন এক বাঙালি চেতনার উদ্ভব হতে শুরু করে।[৯৩] আন্দোলনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে এবং দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়।[৯৭] বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাবলী নিষিদ্ধ করার ফলে ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনের ফলেই ১৯৫০ এবং ১৯৬০-এর দশকে শহরে রাঢ়ী উপভাষা ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।[৯৮]

স্মৃতিস্তম্ভ

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার; ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাশে নির্মিত
ভারতের কোলকাতায় ভাষা শহীদ মিনার
মোদের গরব, ঢাকায় বাংলা একাডেমিতে একটি স্মারক ভাস্কর্য

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে। কাজ শেষ হয় ২৪ তারিখ ভোরে। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ গেঁথে দেয়া হয়, যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ[৬৬] শহীদ মিনার নির্মাণের খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পাঠানো হয় ঐ দিনই। শহীদ বীরের স্মৃতিতে - এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর।[২৪]

মিনারটি তৈরি হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘেষে। উদ্দেশ্য ছিল যাতে বাইরের রাস্তা থেকে সহজেই দেখা যায় এবং যেকোনো ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই যেন চোখে পড়ে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচু আর ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), নকশা অঙ্কন করেছিলেন বদিউল আলম। তাদের সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালু এবং পুরনো ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি।[২৪] ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২শে ফেব্রুয়ারির শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।[৪৭] ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন[২৪] উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মেডিক্যালের ছাত্রদের আবাসিক হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে।[২৪][৯৯]

অবশেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৩ সালে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।[৪৭] এবং ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ বরকতের মা উক্ত মিনারটি উদ্বোধন করেন।[১০০] ১৯৭১ সালে অপারেশন সার্চলাইট চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেওয়ার পর ১৯৭৩ সালে আবার এটি নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৮৩ সালে নির্মাণ শেষ হয়।[১০১]

উদ্‌যাপন

সিডনির অ্যাশফিল্ড পার্কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিস্তম্ভ ও মাতৃভাষা উদযাপন।

১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদে কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশব্যাপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ।[৭৪] আরমানীটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী।[৭৪][১০২][১০৩]

১৯৫৩ সাল থেকে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ দিন প্রত্যুষে সর্বস্তরের মানুষ খালি পায়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করে এবং শহীদ মিনারে গিয়ে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে। সারাদিন মানুষ শোকের চিহ্নস্বরূপ কালো ব্যাজ ধারণ করে। এছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি তর্পণ করা হয় এবং ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে দিনটি কখনো জাতীয় শোক দিবস, কখনোবা জাতীয় শহীদ দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে। বাংলাদেশে এদিনে সরকারি ছুটি। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে।[][১০৪]

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

মানুষের ভেতর একুশের আবেগ পৌঁছে দিতে একুশের ঘটনা ও চেতনা নিয়ে রচিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকার দেশাত্মবোধক গান, নাটক, কবিতা ও চলচ্চিত্র।[১০৫] ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব সূচিত হয়ে আসছে।[৪৭] ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের চট্টগ্রাম জেলার আহ্বায়ক ও দৈনিক সীমান্তের সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরী "কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি" কবিতা রচনা করেন, যা বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত প্রথম কবিতা। কবিতাটি লেখার পরের দিন লালদীঘিতে পঠিত হওয়ার পর কবির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয় এবং কবিতা বাজোয়াপ্ত করা হয়।[১০৬] ১৯৫৩ সালে "একুশের সংকলন" শিরোনামে কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়।[১০৭] আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর "মাগো ওরা বলে" কবিতায় মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে।[১০৮] জসিমউদদীনের "একুশের গান" কবিতায় বাংলা ভাষার সাথে জনগণের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক হতে বাংলা ভাষা আন্দোলনের চেতনা আগত হয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে।[১০৯] অন্ত্যমিল বিন্যাসে রচিত সুফিয়া কামালের "এমন আশ্চর্য দিন" কবিতায় বাংলা ভাষা আন্দোলনে আন্দোলনকারীদের মৃত্যুকে তুলে ধরা হয়েছে।[১১০] ফররুখ আহমদ ২১শে ফেব্রুয়ারির দিনটি স্মরণে লিখেন "ভাষা-আন্দোলনে নিহত আত্মার প্রতি" কবিতাটি।[১১১] ষাটের দশকে একই বিষয় নিয়ে সিকানদার আবু জাফর "তিমিরান্তিক" ও "বৈরী বৃষ্টিতে" কবিতা দুটি রচনা করেন।[১১২] "ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯" শিরোনামের কবিতায় শামসুর রহমান বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী ফেব্রুয়ারি ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে একত্র করেছেন।[১১৩] "একুশের কবিতা"-এ আল মাহমুদ ভাষা আন্দোলনকে সুদীর্ঘ সময় থেকে চলা আসা আন্দোলন ও বিক্ষোভের ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখিয়েছেন।[১১৪] মাহবুব সাদিক "বাংলা ভাষা আমার" কবিতায় বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন।[১১৫] ১৯৮৫ সালের দিকে রচিত "ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বাগান মালিক" কবিতায় খোন্দকার আশরাফ হোসেন রূপকের মাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে তুলে ধরেছেন।[১১৬] "চর্যাপদের হরিণীর গায়ে তির" কবিতা শামসুল আলমের বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত ভিন্নধর্মী কবিতা যেখানে বাংলা ভাষার অতীত ও বর্তমান ফুটে উঠেছে।[১১৭]

১৯৫৬ সালে জহির রায়হান বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচনা করেন "সূর্যগ্রহণ" নামক ছোটগল্প। রোমান্টিক আবেগ যুক্ত কাব্যিক ধারার এই ছোটগল্প চেতনা বিশিষ্ট হওয়ার ফলে এটি পাঠকদের মন জয় করেছিল।[১১৮] অন্যদিকে লেখকের "মহামৃত্যু" ছোটগল্পে বাংলা ভাষা আন্দোলনে নিহতদের মৃত্যুকে মহিমান্বিত করা হয়েছে।[১১৯] লেখকের "অতিপরিচিত" ছোটগল্পে বাংলা ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সুবিধাবাদী শ্রেণীর স্বরূপ তুলে ধরা হয়।[১২০] ১৯৭১ সালে প্রকাশিত "কয়েকটি সংলাপ" ছোটগল্পে লেখক ১৯৫২, ষাটের দশক ও সম্ভাব্য ভবিষ্যতকে তিনটি পর্যায়ে দেখানোর মাধ্যমে বাংলা ভাষা আন্দোলনের অপব্যবহারকে দেখিয়েছেন।[১২১] এছাড়া "একুশের গল্প" লেখকের বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত অন্যতম উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প।[১২২] শওকত ওসমান রচিত "মৌন নয়" ছোটগল্পটি বাংলা ভাষা আন্দোলন পটভূমিতে রচিত "বহুজনের সম্মিলিত মৌন শোকাবহ পরিবেশ" ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।[১২৩] সাইয়িদ আতিকুল্লাহ রচিত "হাসি"-এ আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর শোকাবহ পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।[১২৪] আনিসুজ্জামানের "দৃষ্টি" গল্পে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রভাব ও তার সাথে নতুন প্রজন্মের মাধ্যমে নতুন আশার ইঙ্গিত দেখানো হয়েছে।[১২৫] গল্পকার সিরাজুল ইসলাম তার "পলিমাটি" ছোটগল্পে বাংলা ভাষা আন্দোলন চলাকালে অন্তর্দন্দের ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।[১২৬] সরদার জয়েনয়দদীন উচিত "বকসো আলী পণ্ডিত" ছোটগল্পে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক সংগ্রামী সত্তাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে দেখানো হয়েছে।[১২৭] অন্যদিকে শহীদুল্লাহ্ কায়সারের "মুন্না" গল্পে বাংলা ভাষা আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার লোকদের অবদানকে দেখানো হয়েছে।[১২৮] বাংলা ভাষা আন্দোলনের উপজীব্যে সেলিনা হোসেনের লেখা "মীর আজিমের দুর্দিন" গল্পে আশির দশকের প্রেক্ষাপটে বর্তমান ও আগের প্রজন্মের মানসিকতা ও চেতনার পার্থক্যকে দেখানো হয়েছে।[১২৯]

তুলনামূলকভাবে অল্প সংখ্যক হলেও বাংলা ভাষা আন্দোলন অবলম্বনে কিছু উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। জহির রায়হান রচিত ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত "আরেক ফাল্গুন" সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।[১৩০] সমালোচকদের মতে ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত সর্বপ্রথম এই উপন্যাসটি শিল্পমানের দিক থেকে মহাকাব্যিক।[১৩১] ৯টি পর্বে বিভক্ত এই উপন্যাসের পটভূমি হচ্ছে ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলন চলাকালীন সময় এবং ১৯৫৫ সালে ভাষা শহীদ দিবস উদযাপনের দিন। উপন্যাসে ভাষা আন্দোলনকে সিপাহী বিদ্রোহের ঘটনার সাথে যুক্ত করা হয়েছে।[১৩২] সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশদের কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সাথে বাংলা ভাষা আন্দোলনে সংঘটিত পাকিস্তান কর্তৃক হত্যাকাণ্ডের সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে।[১৩৩] ১৯৯২ সালে প্রকাশিত জহির রায়হানের আরেকটি উপন্যাস "একুশে ফেব্রুয়ারী"-এ পাঁচটি চরিত্রের গল্প দেখা যায়।[১৩৪] পাঁচটি চরিত্র বাংলা ভাষা আন্দোলন চলাকালীন পৃথক পৃথক শ্রেণি ও চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে এটি লেখা হলেও পরে ঈষৎ সম্পাদিত অবস্থায় দৈনিক সমীপেষুতে প্রকাশিত হয়েছিল।[১৩৫] ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত শওকত ওসমান রচিত "আর্তনাদ" বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমধর্মী উপন্যাস যেটি "কোরাস" ও "একাকী" অংশে বিভক্ত।[১৩৬] এতে মৃত্যুর দিকে ধাবিত একটি চরিত্রের চিন্তাচেতনাকে শৈল্পিক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করা হয়েছে।[১৩৭] ১৯৮১ সালে রচিত সেলিনা হোসেনের "যাপিত জীবন" বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে রচিত উপন্যাস। এতে ১৪টি পর্বে ভারত ভাগ হতে শুরু করে বিভিন্ন ঘটনাকে উপজীব্য করা হয়েছে।[১৩৮] এছাড়া লেখিকার ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত উপন্যাস "নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি" বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত না হলেও এতে বাংলা ভাষা আন্দোলন সীমিত পরিসরে উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৩৯]

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কমিউনিস্ট বন্দিদের মঞ্চস্থ করার জন্য রণেশ দাশগুপ্ত সাহিত্যিক মুনীর চৌধুরীকে একটি নাটক লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে কারাগারে বসে তিনি "কবর" নাটকটি রচনা করেন।[১৪০] এরপর নাটকটি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৬৫ সালে নাটকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্চস্থ হওয়ার পর বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এই নাটক আনিসুজ্জামানের মতে "রাজনৈতিক চেতনার কলামণ্ডিত রূপ"।[১৪১] নাটকে ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সমসাময়িক পরিস্থিতি ফুটে উঠে।[১৪২] ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদ রচিত নাটক "বিবাহ", যেখানে বাংলা ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[১৪৩] নাটকটিতে নাট্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্যের ব্যর্থতাকে ফুটিয়ে তুলেছেন।[১৪৪] সৈয়দ শামসুল হকের বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত নাটক "আমাদের জন্ম হলো" প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। এতে নাটকের মাধ্যমে শিল্পরস প্রকাশের চেয়ে ইতিহাসকে তুলে ধরার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।[১৪৫] বাংলা ভাষা আন্দোলনের চেতনা পরবর্তী সময়ে জাতির কাছে কীভাবে বিবেচিত হচ্ছে তা দেখা যায় ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত আলাউদ্দিন আল আজাদের "কালমহাকাল" নাটকে যা প্রকাশের ৪ বছর আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম সম্প্রচার হয়।[১৪৬] ১৯৫১ সালে আসকার ইবনে শাইখ রচিত "দুর্যোগ" নাটকে ফুটে উঠেছে বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক কাল।[১৪৭]

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণার বিপরীতে বাঙালিদের প্রতিবাদের ঘটনাকে উপজীব্য করে গীতিকার আনিসুল হক চৌধুরীর লেখা গান বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত সর্বপ্রথম গান।[১৪৮] ১৯৫৩ সালে মোশাররফ উদ্দীন আহমেদ আরেকটি গান "মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিলো" রচনা করেন যা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। একই বছরে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত "একুশে ফেব্রুয়ারী" গ্রন্থে সংকলিত আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী" গানটি শহীদ দিবস উদযাপনের গান হিসেবে পরিচিত যা গীতিকার ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা অবলম্বনে লিখেছেন।[১৪৯] ১৯৫৩ সালে বাংলা ভাষা আন্দোলনের কর্মী আবু নছর মোহাম্মদ গাজীউল হক রচনা করেন "ভুলবো না" যার সুরের সাথে আজ হিমালয় কী চোটী সে গানের মিল পাওয়া যায়।[১৫০] চারণকবি শেখ শামসুদ্দিন আহমদ ১৯৫২ সালে "রাষ্ট্রভাষা" শিরোনামে গান লিখেন। বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত এই গানে বাঙালির স্বকীয়তাকে তুলে ধরা হয়েছে।[১৫১] ১৯৫৩ সালে আবদুল লতিফ রচিত ও সুরকৃত "ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়" বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য গান।[১৫২] ১৯৬৯ সালে ফজল-এ-খোদা রচিত ও আব্দুল জব্বারের সুর করা সালাম সালাম হাজার সালাম গানটি আন্দোলনের শহীদদের প্রতি উৎসর্গ করে তৈরি।[১৫৩] ১৯৫৫ সালে কবিয়াল রমেশ শীলের রচিত "ভাষার জন্য জীবন হারালি" বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পরিচিত গান।[১৫৪] এছাড়া বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিম বাংলা ভাষা আন্দোলনের একাধিক গান রচনা করেছেন।[১৫৫]

আরও দেখুন

টীকা

  1. এটি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের পাশের অবস্থিত

তথ্যসূত্র

  1. 1 2 উপাধ্যায়, আর (১ মে ২০০৩)। "Urdu Controversy – is dividing the nation further"পেপার্স। সাউথ এশিয়া অ্যানালাইসিস গ্রুপ। ২১ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
  2. 1 2 3 4 5 রহমান, তারিক (১৯৯৭)। "The Medium of Instruction Controversy in Pakistan" (পিডিএফ)জার্নাল অফ মাল্টিলিঙ্গুয়াল অ্যান্ড মাল্টিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট১৮ (২): ১৪৫–১৫৪। ডিওআই:10.1080/01434639708666310আইএসএসএন 0143-4632। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে (PDF) আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুন ২০০৭
  3. শাশ্বতী হালদার (২০১২)। "অপভ্রংশ"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর (সম্পাদকগণ)। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন ৯৮৪৩২০৫৯০১ওসিএলসি 883871743ওএল 30677644M
  4. "A Historical Perspective of Urdu"। উর্দু ভাষার পদোন্নতির জন্য জাতীয় পরিষদ। ১১ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুন ২০০৭
  5. ভট্টাচার্য, টি (২০০১)। "Bangla" (পিডিএফ)। গ্যারি, জে এবং রুবিনো, সি (সম্পাদক)। Encyclopedia of World's Languages: Past and Present (Facts About the World's Languages)। নিউ ইয়র্ক: এইচ ডব্লিউ উইলসন। আইএসবিএন ০৮২৪২০৯৭০২। ২৫ জুন ২০০৬ তারিখে মূল থেকে (পিডিএফ) আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২০ জুন ২০০৭ {{বই উদ্ধৃতি}}: |format= এর জন্য |url= প্রয়োজন (সাহায্য)উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: সম্পাদকগণের তালিকা (লিঙ্ক)
  6. রহমান, তারেক (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)। "The Urdu-English Controversy in Pakistan"। মর্ডান এশিয়ান স্টাডিজ৩১ (1): ১৭৭–২০৭। ডিওআই:10.1017/S0026749X00016978পিএমআইডি 312861
  7. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,বাংলাদেশ (নবম-দশম শ্রেণী) (২০১৫)। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি (বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়)। পৃ. ১ থেকে ৪ পর্যন্ত।
  8. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১।
  9. 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 "ভাষা আন্দোলন"বাংলাপিডিয়া - বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। ৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
  10. 1 2 3 4 5 6 ওল্ডেনবার্গ, ফিলিপ (আগস্ট ১৯৮৫)। ""A Place Insufficiently Imagined": Language, Belief, and the Pakistan Crisis of 1971"। দ্য জার্নাল অফ এশিয়ান স্টাডিজ৪৪ (৪): ৭১১–৭৩৩। ডিওআই:10.2307/2056443আইএসএসএন 0021-9118জেস্টোর 2056443
  11. উমর ১৯৭১, পৃ. ১১–১২।
  12. উমর ১৯৭১, পৃ. ১৪।
  13. উমর ১৯৭১, পৃ. ৪২।
  14. উমর ১৯৭১, পৃ. ১৯–২০।
  15. মর্নিং নিউজ। ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৭।
  16. দৈনিক আজাদ। ঢাকা: আবুল কালাম শামসুদ্দিন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৪৮।
  17. উমর ১৯৭৯, পৃ. ৩৫।
  18. উমর ১৯৭১, পৃ. ৪৩।
  19. আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ২২৭-২৮।
  20. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড,বাংলাদেশ (নবম-দশম শ্রেণী) (২০১৮)। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি (বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়)। পৃ. ১ থেকে ৪ পর্যন্ত।
  21. উমর ১৯৭১, পৃ. ৪৩–৪৪।
  22. 1 2 3 উমর ১৯৭১, পৃ. ৫২।
  23. 1 2 3 4 5 6 7 8 9 মালেক, আবদুল (২০০০)। হোসেন, আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার (সম্পাদক)। ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস। ঢাকা: সেলিনা হোসেন, পরিচালক, গবেষণা সংকলন ফোকলোর বিভাগ, বাংলা একাডেমি। পৃ. ৫–২৭। আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪০৪৫-৮
  24. 1 2 3 4 5 6 7 একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস - আহমদ রফিক পৃষ্ঠা: ৫৬, ১৪২, ৫৯
  25. রহমান, হাসান হাফিজুর (১৯৮২)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র। তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
  26. "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র. পৃ-৫৪-৬৫
  27. উমর ১৯৭১, পৃ. ৫৪।
  28. 1 2 3 4 5 6 7 আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৩৭৭-৩৯৩
  29. উমর ১৯৭১, পৃ. ৬৩।
  30. উমর ১৯৭১, পৃ. ৬৪।
  31. উমর ১৯৭১, পৃ. ৬৫–৬৭।
  32. উমর ১৯৭১, পৃ. ৬৯–৭২।
  33. আইয়ুব খান ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টারস’; পৃষ্ঠা: ৩৮
  34. 1 2 উমর ১৯৭১, পৃ. ৭৭।
  35. উমর ১৯৭১, পৃ. ৮০।
  36. উমর ১৯৭১, পৃ. ৮২।
  37. 1 2 উমর ১৯৭১, পৃ. ৮৫।
  38. চৌধুরী, জি. ডব্লিউ. (এপ্রিল ১৯৭২)। "Bangladesh: Why It Happened"। International Affairs৪৮ (২)। Royal Institute of International Affairs: ২৪২–২৪৯। ডিওআই:10.2307/2613440আইএসএসএন 0020-5850জেস্টোর 2613440
  39. 1 2 3 উমর ১৯৭৯, পৃ. ২৭৯
  40. 1 2 3 4 উদ্দিন ২০০৬, পৃ. ৩-১৬, ১২০-১২৪
  41. দৈনিক আজাদ। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮।
  42. আর. উপাধ্যায় (৭ এপ্রিল ২০০৭)। "De-Pakistanisation of Bangladesh"। বাংলাদেশ মনিটর, সাউথ এশিয়া অ্যানালাইসিস গ্রুপ। ১১ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০০৭
  43. 1 2 3 4 5 জেমস হেইটজম্যান এবং রবার্ট ওয়ার্ডেন, সম্পাদক (১৯৮৯)। "Pakistan Period (1947–71)"Bangladesh: A Country Study। সরকারী মুদ্রণ অফিস, কান্ট্রি স্টাডিজ ইউএস। আইএসবিএন ০-১৬-০১৭৭২০-০। ২২ জুন ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৬ জুন ২০০৭
  44. সাঈদ, খালিদ বিন (সেপ্টেম্বর ১৯৫৪)। "Federalism and Pakistan"। Far Eastern Survey২৩ (৯): ১৩৯–১৪৩। ডিওআই:10.1525/as.1954.23.9.01p0920lআইএসএসএন 0362-8949জেস্টোর 3023818
  45. 1 2 3 4 আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ২৬৩-২৬৫
  46. উমর ১৯৭৯, পৃ. ২৯০
  47. 1 2 3 4 ইসলাম, রফিকুল (২০০০)। আমার একুশে ও শহীদ মিনার। ঢাকা: পরমা। পৃ. ৬২–৮৫। আইএসবিএন ৯৮৪-৮২৪৫-৩৯-১
  48. মণ্ডল, রানিতা (২৪ জুন ২০০২)। "Chapter 4 : Other Activities"Muhammad Shahidullah & His Contribution To Bengali Linguistics। সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজস, মহীশূর, ভারত। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০০৭
  49. দৈনিক আজাদ। ২৪ মে ১৯৫০।
  50. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Sri নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  51. দৈনিক আজাদ। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।
  52. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৫২
  53. পরিষদের সভায় মোট ১৫জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু মোহাম্মদ তোয়াহা ভোট দানে বিরত ছিলেন।
  54. গাজীউল হক, একুশের সংকলন, প্রকশিত: ১৯৮০, পৃষ্ঠা: ১৩৮
  55. ইতিহাস, কবির উদ্দিন আহমেদ. পৃ-২২৫-২৬
  56. "ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন ছাত্রসহ চার ব্যক্তি নিহত ও সতেরো ব্যক্তি আহত"। দৈনিক আজাদ। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।
  57. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২২, ১৯৫২
  58. দৈনিক আজাদ, ফেব্রুয়ারি ২৩, ১৯৫২
  59. "বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থা পরিষদের শুপারিশ। শুক্রবার শহরের অবস্থার আরো অবনতি: সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনী তলব। পুলিশ ও সেনাদের গুলিতে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত: সাত ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারি। শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শতস্ফূর্ত হরতাল পালন"। দৈনিক আজাদ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।
  60. আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৪৮৩
  61. আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৫১৫-৫২৩
  62. দৈনিক আজাদ, ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
  63. আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৫৪৬-৫৫২
  64. দৈনিক আজাদ, ২০ মার্চ ১৯৫২
  65. দৈনিক আজাদ, ১১ই এপ্রিল ১৯৫২
  66. 1 2 দৈনিক আজাদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
  67. উমর ১৯৭৯, পৃ. ৪১৭-৪১৮
  68. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ফেব্রুয়ারি ৮, ১৯৫৩
  69. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ১৯৫৩
  70. আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৬০৪-৬০৯
  71. "বাংলাদেশের ইতিহাস" (ইংরেজি ভাষায়)। ডিসকভার বাংলাদেশ। ৯ জুন ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২১ জুন ২০০৭
  72. রহমান, তারিক (সেপ্টেম্বর ১৯৯৭)। "Language and Ethnicity in Pakistan"। এশিয়ান সার্ভে৩৭ (৯): ৮৩৩–৮৩৯। ডিওআই:10.1525/as.1997.37.9.01p02786আইএসএসএন 0004-4687জেস্টোর 2645700
  73. "সংবাদপত্রে-ভাষা-আন্দোলন"। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০
  74. 1 2 3 4 5 6 আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৬০৮–৬১৩
  75. 1 2 আল হেলাল ২০০৩, পৃ. ৬০০-৬০৩
  76. Nair, pp137–138
  77. Nair, p156
  78. Nair, p139
  79. Nair, p145
  80. Nair, p148
  81. Nair, p149
  82. আহমদ ২০২৫, পৃ. ১২৭।
  83. 1 2 বশীর আল হেলাল (২০১২)। "বাংলা একাডেমী"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর (সম্পাদকগণ)। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন ৯৮৪৩২০৫৯০১ওসিএলসি 883871743ওএল 30677644M
  84. "গম্ভীরপূর্ণ পরিবেশে শহীদ দিবস উদযাপন"। Weekly Notun Khobor। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬।
  85. সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ২১, ১৯৫৩
  86. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ২১, ১৯৫৪
  87. দৈনিক আজাদ। ২২শে এপ্রিল ১৯৫৪।
  88. 1 2 3 "UF elections victory"ক্রনিকলস অব পাকিস্তান। ১৮ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১১ ডিসেম্বর ২০১১
  89. দৈনিক আজাদ, এপ্রিল ২২, ১৯৫৪
  90. "PAKISTANIS IN RIOT ON LANGUAGE ISSUE"। New York Times। ২৩ এপ্রিল ১৯৫৪। প্রোকুয়েস্ট 113105078
  91. Callahan, John (৮ মে ১৯৫৪)। "PAKISTANIS MAKE BENGALI OFFICIAL: East Zone Tongue Is Raised to Status Equal to Urdu, the Western Language"। New York Times প্রোকুয়েস্ট 112939727
  92. Lambert, Richard D. (এপ্রিল ১৯৫৯)। "Factors in Bengali Regionalism in Pakistan"। Far Eastern Survey২৮ (4)। Institute of Pacific Relations: ৪৯–৫৮। ডিওআই:10.2307/3024111আইএসএসএন 0362-8949জেস্টোর 3024111
  93. 1 2 মুখার্জি ১৯৭২, পৃ. ৫৯।
  94. Schendel, Willen van (২০২০)। "A History of Bangladesh"Cambridge.org (মার্কিন ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০২৩
  95. Rahman, Tariq (২০০২)। "Language, Power and Ideology 37, no. 45"Economic and Political Weekly, jstor.org (মার্কিন ইংরেজি ভাষায়)। জেস্টোর 4412816। সংগ্রহের তারিখ ২৬ নভেম্বর ২০২৩
  96. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৫–১৬।
  97. লিন্টনার, বের্টিল (জানুয়ারি ২০০৪)। "Chapter 17: Religious Extremism and Nationalism in Bangladesh" (পিডিএফ)। সাতু লিমায়ে, রবার্ট উইর্সিং, মোহন মালিক (সম্পাদক)। Religious Radicalism and Security in South Asia [দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় মৌলবাদ ও নিরাপত্তা] (PDF)। হনলুলু, হাওয়াই: এশিয়া-প্যাসিফিক সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ। পৃ. ৪১৩। আইএসবিএন ০-৯৭১৯৪১৬-৬-১। ৪ এপ্রিল ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জুন ২০০৭{{বই উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: একাধিক নাম: সম্পাদকগণের তালিকা (লিঙ্ক)
  98. Rubel, Abul Hasan (১৫ নভেম্বর ২০১৭)। ঢাকার ভাষা, ঢাকাইয়া ভাষা, নাকি অন্য ভাষাকালের কণ্ঠ। সংগ্রহের তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২
  99. দ্য ডেইলি স্টার, ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
  100. "জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫"- ওলি আহাদ পৃ-১৫৩
  101. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৯২–১৯৩।
  102. "গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে শহীদ দিবস উদ্‌যাপন"। সাপ্তাহিক নতুন খবর। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬।
  103. সাপ্তাহিক নতুন খবর, ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৫৬
  104. খান, সানজিদা। "জাতীয় পুরস্কার"বাংলাপিডিয়া। এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। ৩ জুলাই ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুন ২০০৭
  105. আমিনজাদে, রোনাল্ড; ডগলাস ম্যাকঅ্যাডাম; চার্লস টিলি (১৭ সেপ্টেম্বর ২০০১)। "Emotions and Contentious Politics"। Silence and Voice in the Study of Contentious Politics। কেমব্রিজ: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃ. ৪২। আইএসবিএন ০৫২১০০১৫৫২। ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০০৭
  106. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৬।
  107. খাতুন ২০২৪, পৃ. ২১।
  108. খাতুন ২০২৪, পৃ. ২৬।
  109. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৩০।
  110. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৩১।
  111. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৩২।
  112. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৩৩।
  113. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৩৯–৪০।
  114. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৪৬।
  115. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৫৭।
  116. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৫৯।
  117. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৬১।
  118. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৬৩–৬৪।
  119. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৬৫।
  120. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৬৬।
  121. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৬৭–৬৯।
  122. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৬৯।
  123. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৭০।
  124. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৭১–৭২।
  125. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৭৩–৭৪।
  126. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৭৪।
  127. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৭৬–৭৭।
  128. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৭৯।
  129. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৮০–৮১।
  130. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৯১।
  131. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৯২।
  132. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৯৩।
  133. খাতুন ২০২৪, পৃ. ৯৩–৯৬।
  134. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১১৩।
  135. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১২০।
  136. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১২৪।
  137. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১২৯।
  138. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১২৯–১৩০।
  139. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৪৭।
  140. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৫০।
  141. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৫১।
  142. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৫৮।
  143. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৬০।
  144. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৬৪।
  145. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৬৫।
  146. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৬৯।
  147. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৭৪।
  148. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৭৫।
  149. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৭৭।
  150. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৮০।
  151. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৮১।
  152. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৮২।
  153. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৮৪।
  154. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৮৫।
  155. খাতুন ২০২৪, পৃ. ১৮৯।

গ্রন্থপঞ্জি

আরও পড়ুন

  • আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫।
  • আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬।

বহিঃসংযোগ