বিষয়বস্তুতে চলুন

বঙ্গ রাজ্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(বঙ্গ (প্রাচীন রাজ্য) থেকে পুনর্নির্দেশিত)
বঙ্গ

আনু. ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ–আনু. ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পরবর্তী বৈদিক যুগে বঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যগুলি, আনু. ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পরবর্তী বৈদিক যুগে বঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যগুলি, আনু. ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
প্রাচীন ভারতে বঙ্গ ও পূর্বকালীন প্রতিবেশী
প্রাচীন ভারতে বঙ্গ ও পূর্বকালীন প্রতিবেশী
রাজধানীসম্ভবত কোটালীপাড়া (অধুনা গোপালগঞ্জ )
প্রচলিত ভাষাবৈদিক সংস্কৃত
ধর্ম
ঐতিহাসিক বৈদিক ধর্ম
সরকাররাজতন্ত্র
রাজা (রাজা বা প্রধান) 
• আনু. খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী
সমুদ্রসেন
• আনু. খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দী
Chadrasena
ঐতিহাসিক যুগলোহার যুগ
• প্রতিষ্ঠা
আনু. ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
• বিলুপ্ত
আনু. ৩৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
পূর্বসূরী
উত্তরসূরী
বৈদিক যুগ
নন্দ সাম্রাজ্য
সমতট
বর্তমানে যার অংশবাংলাদেশভারত

বঙ্গ ভারতীয় উপমহাদেশের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ সীমার মধ্যে একটি প্রাচীন রাজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক বিভাগ ছিল। রাজ্যটি বাংলা অঞ্চলের অন্যতম নামের একটি। বর্তমানে বাংলার দক্ষিণাংশ এবং পূর্বাংশ জুড়ে রাজ্যটির মূল অঞ্চলটি অবস্থিত ছিল। প্রাচীন ভারতের মহাকাব্য ও গল্পে এবং শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বঙ্গের উল্লেখ বিশেষভাবে দেখা যায়।

বঙ্গ সম্ভবত গঙ্গারিডাই সাম্রাজ্যের কেন্দ্র ছিল, যা অসংখ্য গ্রিক-রোমান লেখক দ্বারা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের সঠিক রাজধানী শনাক্ত করা যায়নি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনের পর, প্রাচীন বাংলা গৌড় ও বঙ্গ নামক দুটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন, গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বর্তমান বাংলাদেশের কোটালীপাড়া স্বাধীন বঙ্গ রাজাদের রাজধানী ছিল।

ভারতীয় ও গ্রিক-রোমান লেখকগণ এই অঞ্চলের যোদ্ধা হাতির কথা উল্লেখ করেছেন। ভারতীয় ইতিহাসে, বঙ্গ তার শক্তিশালী নৌবাহিনীর জন্য উল্লেখযোগ্য। হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতে বঙ্গের অসংখ্য উল্লেখ রয়েছে, যা ভারতের দুটি প্রধান সংস্কৃত মহাকাব্যের একটি। অন্য মহাকাব্য, রামায়ণ, রাজ্যটিকে অযোধ্যার মিত্র রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছে।প্রত্নাত্ত্বিক প্রমাণ অনুসারে মৌর্যপূর্ব যুগ থেকে পাল-সেন যুগ পর্যন্ত চন্দ্রকেতুগড় বঙ্গ রাজ্যের একটি অন্যতম প্রধান নগরী ছিল।[] প্রাচীন জৈন উপাঙ্গে বাংলার প্রাচীন বন্দর নগরী তাম্রলিপ্তকে বঙ্গ রাজ্যের রাজধানী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[]

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

বঙ্গ উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণ চিক্কণ মৃৎপাত্র যুগে নিম্ন গাঙ্গেও ব-দ্বীপে একটি রাজ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বঙ্গ রাজ্যের অধিবাসীরা নিজের বিশাল নৌবহর দ্বারা ব-দ্বীপে অবস্থিত একাধিক দ্বীপ নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশ যাত্রা করতেন। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থসমূহে বঙ্গকে নাবিকদের দেশ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আনুমানিক ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বঙ্গরাজ সিংহবাহুর পুত্র বিজয় সিংহ ৭০০ সৈন্য নিয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে বর্তমান শ্রীলঙ্কায় পৌঁছান এবং সিংহল নামে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।[] বঙ্গ অতীতে প্রধানত বৈদিক হিন্দুধর্ম, জৈন ধর্ম এবং পরবর্তীতে বৌদ্ধধর্মের পীঠস্থান ছিল।

বঙ্গের মুদ্রা (৪০০-৩০০ খ্রীষ্টপূর্ব)

বঙ্গকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে শাসনকেন্দ্র বলা হয়েছে। এছাড়াও কালিদাস বঙ্গকে ভারতবর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী নৌশক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। একাধিক শিলালিপি এবং গ্রন্থ থেকে বঙ্গের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের নাম জানতে পারা যায়। এদের মধ্যে উপবঙ্গ বিভাগটি বর্তমান যশোর এবং তৎসংলগ্ন জঙ্গলাকীর্ণ সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বিক্রমপুরবঙ্গ এবং নাব্যবঙ্গ বা অনুত্তরবঙ্গ নামে আরো দুটি বিভাগের উল্লেখ পাওয়া যায় যা বর্তমানে বৃহত্তর ঢাকা-ফরিদপুর এবং বরিশালকে নির্দেশ করে।[]

অজন্তা গুহাচিত্রে বঙ্গ রাজপুত্র বিজয় সিংহের লঙ্কা দ্বীপের রাজা হিসেবে অভিষেকের দৃশ্য।

বঙ্গ রাজ্যের শাসকদের নাম বেশিরভাগই অজানা। আনুমানিক ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পর প্রাচীন বঙ্গ রাজ্য মৌর্য, গুপ্ত, গৌড়, খড়্গ, পাল, চন্দ্র, বর্মণ, সেন এবং দেব সাম্রাজ্যের অংশ হয়। বাঙ্গালা নামটি বৃহৎ বঙ্গকে বোঝাতে প্রায়ই ব্যবহৃত হতো। উদাহরণস্বরূপ, চোল সাম্রাজ্যের একটি শিলালিপিতে চন্দ্র রাজবংশের সঙ্গে যুদ্ধের সময় এই ভূমিকে বাঙ্গালাদেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[] আনুমানিক ৭২০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ আনন্দদেবের কুমিল্লার তাম্রশাসন থেকে জানা যায় তিনি শ্রী বাঙ্গালা মৃগাঙ্ক উপাধি ব্যবহার করতেন, যার অর্থ বাঙ্গালার চন্দ্র।[][] এছড়াও অষ্টম শতকে রচিত বাংলা সাহিত্য চর্যাগীতিতেও বঙ্গ, বঙ্গালদেশ এবং বঙ্গালী জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় মুসলিম আগ্রাসনের পর এই অঞ্চলকে বাঙ্গালাহ্ নামে অভিহিত করা হয়, যেটা প্রাচীণ বাঙ্গালা শব্দ থেকে এসেছে। এই নামগুলোই আধুনিক বঙ্গ বা বাংলা নামের পূর্বসূরি।

মহাভারতে উল্লেখ

[সম্পাদনা]

মহাভারতে (৬।৯) অঙ্গ, বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্য তিনটাকে ভারতবর্ষ বা প্রাচীন ভারতের নিকটবর্তী রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১২ বছর তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে অর্জুন বঙ্গ ও কলিঙ্গের সকল পবিত্র স্থানে এসেছিলেন।[]

পূর্বাঞ্চলের অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্রসুহ্ম - এই পাঁচটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একই বংশের সন্তান। এঁরা ছিলেন গিরিব্রজ শহরের কাছে অবস্থিত মগধ রাজ্যের অধিবাসী গৌতম দীর্ঘতম ঋষির ঔরসজাত এবং বলি রাজার দত্তক পুত্র।[]

ভীমের বঙ্গ অভিযান

[সম্পাদনা]

কর্ণের অঙ্গ রাজ্য জয় করার পর ভীম পার্বত্য অঞ্চলের এক শক্তিশালী রাজাকে পরাস্ত করেন। এরপর মদগিরির রাজাকে পরাস্ত করার পর পাণ্ডবগণ পুণ্ড্র অঞ্চলের রাজা বাসুদেব ও কৌশিক-মচ্ছের রাজা মহৌজকে পরাজিত করেন। তারপর তাঁরা বঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন। সমুদ্রসেন ও তাম্রলিপ্তের রাজা চন্দ্রসেনকে পরাজিত করে তাঁরা সুহ্ম রাজ্যের কৈবর্ত রাজাকেও পরাজিত করেন। এরপর তাঁরা সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের রাজাদের পরাজিত করেন। এরপর তাঁরা লৌহিত্য রাজ্যের দিকে অগ্রসর হন। (২।২৯)

অন্যান্য বঙ্গ অভিযান

[সম্পাদনা]

ভার্গব রাম কাশ্মীর, দারদ, কুন্তি, ক্ষুদ্রক, মালব, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, বিদেহ, তাম্রলিপ্ত, রক্ষোবাহ, বিতাহোত্র, ত্রিগার্ত ও মার্তিকাবত রাজ্য জয় করেছিলেন। (৭।৬৮) কর্ণ অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মণ্ডিকা, মগধ ও করকখণ্ডের অংশবিশেষ জয় করেন। (৩।২৫২)

অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল, বৎস, গর্গ্য, করুষ ও পৌণ্ড্র রাজ্যগুলিকে বাসুদেব কৃষ্ণ জয় করেছিলেন। (৭।১১)

অর্জুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় বঙ্গ, পুণ্ড্র ও কোশল রাজ্যগুলিকে জয় করেন। (১৪।৮২)

যুধিষ্ঠিরের করদ রাজ্য

[সম্পাদনা]

অঙ্গ, বঙ্গ ও পুণ্ড্র রাজ্যের রাজারা যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় উপস্থিত থাকতেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। (২।৪) বঙ্গ, অঙ্গ, পুণ্ড্র, ওড্র, চোল, দ্রাবিড়, অন্ধ্র রাজ্য যুধিষ্ঠিরকে কর দিত বলে উল্লিখিত হয়। (৩।৫১) অঙ্গ, বঙ্গ, পুণ্ড্র, সনবত্য ও গয়া - এই সদ্বংশজাত ক্ষত্রিয় রাজারা নিয়মিত যুদ্ধবিদ্যার চর্চা করতেন। বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ, তাম্রলিপ্ত, সুপুণ্ড্রক, দৌবলিক, সাগরক, পাত্রোনা, সৈসব ও কর্ণপ্রবর্ণকরা দলে দলে যুধিষ্ঠিরের রাজদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকতেন। (২। ৫১)।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে বঙ্গ

[সম্পাদনা]

বঙ্গ সেনাবাহিনী যুদ্ধহস্তী পরিচালনায় দক্ষ ছিল। কলিঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে তাঁরাও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষ নেয়। (8।১৭) কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় বঙ্গের রাজা ছিলেন ভগদত্ত। (৬।৯৩)

বঙ্গের রাজাগণ

[সম্পাদনা]

মহাভারতের দ্বিতীয় পর্বে (শ্লোক পর্বাধ্যায় ২৯) সমুদ্র সেনচন্দ্র সেন নামে দুই রাজার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও তাঁরা বঙ্গের রাজা ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। এই পর্বেই ৪৩ পর্বাধ্যায়ে কর্ণকে অঙ্গ ও বঙ্গের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কৃষ্ণের শত্রু পুণ্ড্রক বাসুদেবকে (জরাসন্ধের বন্ধু) বঙ্গ, পুণ্ড্র ও কিরাতদের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। (২।১৪) অষ্টম পর্বে ভগদত্তকে বঙ্গের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

সম্ভবত এই রাজারা বঙ্গ রাজ্য জয় করেছিলেন। মহাভারতের অন্যান্য অংশে এঁদের পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলির রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ভগদত্ত ছিলেন বঙ্গের উত্তর দিকে অবস্থিত প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের রাজা। পুণ্ড্রক বাসুদেব ও কর্ণ ছিলেন বঙ্গের পূর্ব দিকে অবস্থিত পুণ্ড্র ও অঙ্গ রাজ্যের রাজা।

অন্যান্য উল্লেখ

[সম্পাদনা]

মহাভারতের অন্য জায়গায় আছে বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্যের রাজারা পুণ্ড্রের পুণ্ড্রক বাসুদেবের সঙ্গে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত ছিলেন।[১০]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

পাদটীকা

[সম্পাদনা]
  1. "Chandraketugarh" 
  2. "Tamluk"Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০২৫ 
  3. Malaẏaśaṅkara Bhaṭṭācārya (২০০৮)। Glimpses of Buddhist Bengal। Indian Institute of Oriental Studies & Research। আইএসবিএন 978-81-901371-7-1 
  4. "Vanga – Banglapedia" 
  5. "Chandra Dynasty, the – Banglapedia" 
  6. Friedberg, Arthur L.; Friedberg, Ira S. (১২ এপ্রিল ২০২৫)। Gold coins of the World। Coin & Currency Institute। আইএসবিএন 978-0-87184-308-1 
  7. "Copperplates"Banglapedia। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০২৫ 
  8. (Mbh 1:217)
  9. (1:104), (2:21).
  10. (1:189) (2:33)