বিষয়বস্তুতে চলুন

ক্র্যাক প্লাটুন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ক্র্যাক প্লাটুন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একদল তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত দল[], যারা তৎকালীন সময় কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। এই গেরিলা দলটি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে "হিট এন্ড রান" পদ্ধতিতে অসংখ্য আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করে।[][][]

নামকরণ

[সম্পাদনা]

সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের নির্দেশনা ছিল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে বিদেশি সাংবাদিক ও অতিথিরা থাকাকালীন ঢাকা শহরের পরিস্থিতি যে শান্ত নয় এবং এখানে যুদ্ধ চলছে তা বোঝানোর জন্য শহরের আশে-পাশে কিছু গ্রেনেড ও গুলি ছুড়তে হবে; কিন্তু দু:সাহসী এই তরুণেরা ঢাকায় এসে ৯ জুন তারিখে[] সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা করেন এবং বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে যা ছিলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও অচিন্তনীয় কাজ। সন্ধ্যায় বিবিসির খবর থেকে খালেদ মোশাররফ এই অপারেশনের কথা জানতে পেরে বলেন,

'দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল! বললাম, ঢাকার বাইরে বিস্ফোণ ঘটাতে আর ওরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এসেছে।'

তিনিই প্রথম এই দলটিকে "ক্র্যাক" আখ্যা দেন; যা থেকে পরবর্তীতে এই প্লাটুনটি "ক্র্যাক প্লাটুন" নামে পরিচিত হয়।[]

প্লাটুন গঠনের ইতিহাস

[সম্পাদনা]

এই দলটি গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম[] এবং এটিএম হায়দার, বীর উত্তম[] এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নং সেক্টরের অধীন একটি স্বতন্ত্র গেরিলা দল যারা মূলত গণবাহিনীর অংশ বলে পরিচিত।[] এই বাহিনীর সদস্যরা ভারতের মেলাঘর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।[] এই প্রশিক্ষণে গ্রেনেড ছোড়া, আত্ম-গোপন করা প্রভৃতি শেখানো হতো।

আরবান গেরিলা যুদ্ধের জন্য বিশেষায়িত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল দলটি।

বাহিনীর গেরিলাদের পরিচয়

[সম্পাদনা]

এই গেরিলা দলটিতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন

মোটঃ ৩৪ জন:[১০]

  1. আবুল বারক আলভী
  2. শহীদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, বীর বিক্রম
  3. আজম খান
  4. আমিনুল ইসলাম নসু
  5. আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, বীর প্রতীক
  6. ইশতিয়াক আজিজ উলফাত
  7. কাজী কামাল উদ্দিন, বীর বিক্রম
  8. কামরুল হক স্বপন, বীর বিক্রম
  9. গোলাম দস্তগীর গাজী, বীর প্রতীক
  10. আবুল মাসুদ সাদিক চুল্লু[১১]
  11. জহির উদ্দিন জালাল
  12. জহিরুল ইসলাম
  13. নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু
  14. নীলু
  15. পুলু
  16. ফতেহ চৌধুরী
  17. শহীদ বদিউজ্জামান
  18. বদিউল আলম বদি, বীর বিক্রম
  19. মতিন - ১
  20. মতিন - ২
  21. শহীদ মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ
  22. মাহবুব
  23. মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম
  24. মাযহার
  25. রাইসুল ইসলাম আসাদ
  26. লিনু বিল্লাহ
  27. শহীদ শফি ইমাম রুমী
  28. শহীদুলাহ খান বাদল
  29. শাহাদত চৌধুরী
  30. হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক
  31. হিউবার্ট রোজারিও
  32. চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ
  33. অজানা
  34. অজানা [১২]

অপারেশন

[সম্পাদনা]

পাঁচ হতে ছয় জনের এক একটি গ্রুপ তৈরী করে হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে ঝটিকা আক্রমণ করে এই গেরিলা দলটি অপারেশনে অংশ নিতো।[১৩] ঢাকা শহরে তারা মোট ৮২টি অপারেশন পরিচালনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো:[][১৪][১৫][১৬][১৭]

অপারেশন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল

[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের ৯ ই জুন সন্ধ্যায় ১৭ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মিলে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল আক্রমণের ছক আঁকে। তাদের কাছে ছিল ১২ টি গ্রেনেড, ১৬০ রুপি আর প্রত্যেকের কাছে একই করে বেয়নেট। তাদের দলনেতা ছিলেন হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক। অপারেশনের জন্য তাদের গাড়ি চালাচ্ছিলেন এফডিসির ক্যামেরাম্যান বাদল। পিস্তল নিয়ে তার পাশের সিটে কামরুল হক স্বপন বসে ছিলেন। আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং পেছনের সিটে বসা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক। তাদের তিনজনের হাতেই ছিল গ্রেনেড। হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে এসে জিয়া, মায়া এবং হাবিবুল অনেকগুলো গ্রেনেড ফাটিয়ে পালিয়ে গেলেন।

এই অপারেশনের লক্ষ্য ছিল হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের বোঝানো যে, পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক নয়। [১০]

অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট

[সম্পাদনা]

প্লাটুনের সদস্য সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায় ৭ই আগস্ট রাত ৮টায় এই অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। পুরো অপারেশনের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল মাত্র এক মিনিট। এই দলের সদস্য ছিলেন ৭ জন- জুয়েল, আলম, পুলু, স্বপন, সামাদ আর বদি এবং দলনেতা ছিলেন শহীদ বদিউজ্জামান। তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক সামাদ চালাবেন গাড়ি, আলমের হাতে থাকবে চায়নিজ চায়নিজ এলএমজি আর অন্য সবার হাতে স্টেনগান এবং সামাদের কাছে ছিল রিভলবার, জুয়েল আর পুলুর কাছে ছিল ফসফরাস গ্রেনেড আর গ্রেনেড-৩৬। এক মিনিটের এই অপারেশনে পাঁচজন মিলিটারি পুলিশ ও ছয়জন রাজাকার নিহত হয়। পুরো ঢাকাজুড়ে এই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করে। [১৮]

এছাড়াও ক্র্যাক প্লাটুন ঢাকা শহরে আরো যেসব গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করে তার মধ্যে ছিল:

  • অপারেশন গ্যানিজ পেট্রল পাম্প
  • অপারেশন দাউদ পেট্রল পাম্প
  • অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন
  • অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন
  • অপারেশন আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন
  • অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন
  • অপারেশন উলন পাওয়ার স্টেশন
  • অপারেশন তোপখানা রোড ইউএস ইনফরমেশন সেন্টার
  • অ্যাটাক অন দ্য মুভ
  • ডেস্টিনেশন আননোন

মৃত্যুবরণ

[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিনের ধানমণ্ডি বাসা থেকে বদিউন আলমকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী। পরবর্তীতে তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাকে বীরবিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। সেইদিনই ধরা পড়েন রুমী, আজাদ, জুয়েল, সামাদ, মাসুদ সাদেকসহ ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্য। পরবর্তীতে তারা সবাই শহিদ হন। [১০]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "Weekly Shaptahik - A National Weekly of Bangladesh :: WWW.SHAPTAHIK.COM::"। ২৭ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০১২
  2. 1 2 "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"। ১৩ জুন ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩
  3. গর্ভধারিণী : মুক্তিযোদ্ধার সাহসী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা। যায়যায়দিন ঈদ সংখ্যা-২০০৬
  4. 1 2 "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"। ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩
  5. "মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম. সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা "চাঁদপুর নিউজ
  6. আক্রমণ যদি করতে হয় তবে ইন্টারকন্টিনেন্টালেই : মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীরবিক্রম। দৈনিক সমকাল; প্রকাশের তারিখ: ৯ ডিসেম্বর ২০১২।
  7. http://www.ausmukti.com/%E0%A6%AC%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%BE-%E0%A6%A4%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87-59/%5B%5D
  8. "The Daily Janakanth"Daily Janakantha। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০১২
  9. "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"। ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩
  10. 1 2 3 Bhorerkagoj। "ক্র্যাক প্লাটুন : হার না মানা বীরত্বগাথা"www.bhorerkagoj.net। ১১ মে ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মে ২০১৮
  11. একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা চুল্লুর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক, জাগো নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম, ১৭ অক্টোবর ২০১৭
  12. THE CRACK PLATOON, Of valour and love for motherland, New Age, 29 August 2021 ইংরেজি ভাষায়
  13. http://dhanershisnews24.com/index.php/desh-janopod/1418-2012-12-14-14-17-29%5B%5D
  14. "Remembering our victory, our freedom fighters"দ্য ডেইলি স্টার Web Edition {{ওয়েব উদ্ধৃতি}}: |archive-date= এর জন্য |archive-url= প্রয়োজন (সাহায্য)উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: ইউআরএল-অবস্থা (লিঙ্ক)
  15. স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলতে চেয়েছিলেন শহীদ জুয়েল। দৈনিক ইত্তেফাক; প্রকাশকাল: ১৬ ডিসেম্বর ২০১১
  16. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১২ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০১২
  17. "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না"। ৮ মার্চ ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩
  18. "bhorerkagoj"