বাংলা থিয়েটার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাংলা ভাষায় অভিনীত থিয়েটারকেই প্রাথমিকভাবে বাংলা থিয়েটার বুঝায়। বাংলা থিয়েটার প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে সঞ্চালিত হয়। সম্ভবত এই শব্দটি কিছু হিন্দি থিয়েটারকেও বুঝাতে পারে যা বাঙালি জনগণের দ্বারা গৃহীত হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসনের সময়ে বাংলা থিয়েটারের উৎপত্তি হয়েছে। ১৯ শতকের প্রথম দিকে ব্যক্তিগত বিনোদন হিসাবে এটি শুরু হয়েছিল।[১] স্বাধীনতার প্রাক্কালে, বাংলা থিয়েটারগুলি ব্রিটিশ রাজের অপছন্দের বিষয়গুলি প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী আন্দোলন থিয়েটারকে সামাজিক সচেতনতার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। থিয়েটার কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য এখনো যোগ করেছে এবং সেগুলির শক্তিশালী প্রভাব আছে। এই দলগুলো বাণিজ্যিক বাংলা থিয়েটার থেকে মতাদর্শগতভাবে নিজেদের পার্থক্য বজায় রেখেছে। একে নাট্যমঞ্চও বলা হয়।[২]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

নাট্যমঞ্চ প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন রুশ মনীষী লেবেদেফ। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ডোমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রিট) তিনি ‘বেঙ্গলী থিয়েটার’ স্থাপন করে ২৭ নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল নামক একটি বাংলা অনুবাদ-নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর আগে কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল, যেখানে কেবল ইংরেজি নাটকই অভিনীত হতো। লেবেদেফের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে উনিশ শতকে বাঙালিরা কলকাতায় বেশ কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মাণ করেন, যেমন: হিন্দু থিয়েটার (১৮৩১), ওরিয়েন্টাল থিয়েটার (১৮৫৩), জোড়াসাঁকো নাট্যশালা (১৮৫৪), বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ (১৮৫৭) ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষভাগে ঢাকায়ও কয়েকটি নাট্যমঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি (১৮৬৫), ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ (১৮৯০-৯২ এর মধ্যে), ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার (১৮৯৭) ইত্যাদি। এ সময় মুন্সীগঞ্জ শহরে ‘জগদ্ধাত্রী নাট্যমঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যা এখনও বর্তমান। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি মঞ্চ নির্মিত হয়, যেমন: খুলনা থিয়েটার (১৯০৫), করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ( টাঙ্গাইল, ১৯১১) ইত্যাদি। এ সময় টাঙ্গাইলের সন্তোষ, এলেংগা, শিবপুর, আলোয়া ও করটিয়ার জমিদাররা বেশ কয়েকটি মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ঢাকায় নির্মিত হয় মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট (১৯৫০)। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘকাল যাবৎ ঢাকায় স্বতন্ত্র কোন নাট্যমঞ্চ নির্মিত না হলেও বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চ বিশেষভাবে নাট্যাভিনয়ের জন্য ব্যবহূত হতে থাকে, যেমন: মহিলা সমিতি মিলনায়তন, গাইড হাউস মিলনায়তন ইত্যাদি। সম্প্রতি ঢাকার গুলিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৬০০ আসনবিশিষ্ট ‘ঢাকা মহানগর নাট্যমঞ্চ’। এখানে প্রধানত নাট্যাভিনয় হয়। এগুলি ছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি সাধারণ মঞ্চে নাটকের অভিনয় হয়, যেমন: ব্রিটিশ কাউন্সিল মিলনায়তন, গণগ্রন্থাগার মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন, কচিকাঁচা মিলনায়তন, ওয়াপদা মিলনায়তন, অশ্বিনীকুমার টাউন হল (বরিশাল, ১৯৩০), জে.এম.সেন হল (চট্টগ্রাম), মুসলিম হল (চট্টগ্রাম) ইত্যাদি।[২]

উভয় বঙ্গের কয়েকটি প্রধান থিয়েটার বা নাট্যমষ্ণ[সম্পাদনা]

  • এমারেল্ড থিয়েটার এটি ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলুটোলা নিবাসী গোপাললাল শীল এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে থিয়েটারের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্যপট ও পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করান এবং গ্যাসের আলোর পরিবর্তে ডায়নামোর সাহায্যে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করেন। প্রতিষ্ঠা বছরেরই ৮ অক্টোবর থিয়েটারের উদ্বোধন দিবসে কেদারলাল চৌধুরীর একখানি পৌরাণিক নাটক মঞ্চস্থ হয়; কিন্তু দক্ষ পরিচালনার অভাবে থিয়েটারের দর্শকসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। এমতাবস্থায় গোপাল শীলের আমন্ত্রণে গিরিশচন্দ্র ঘোষ এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কয়েকখানি পুরাতন ও নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেন। সেগুলির মধ্যে পূর্ণচন্দ্র ও বিষাদ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

কিছুদিন পরে প্রখ্যাত মঞ্চাধ্যক্ষ ধর্মদাস সুর এর মঞ্চসজ্জায় নিযুক্ত হন। কিন্তু খেয়ালি মানুষ গোপাল শীল দুবছরের মাথায় থিয়েটার বিক্রি করে দেন। তার পরেও বিভিন্ন মালিকানায় ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি পর্যন্ত এর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। কেদারলাল রায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, অতুলকৃষ্ণ মিত্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৪০খানা নাটক এমারেল্ড থিয়েটারে অভিনীত হয়। এর প্রধান শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি, মহেন্দ্র বসু, রাধামাধব কর, মতিলাল সুর, বনবিহারিণী, ক্ষেত্রমণি, সুকুমারী, কুসুম, গুল্ফন হরি প্রমুখ।[২]

  • ওরিয়েন্টাল থিয়েটার এটি ১৮৫৩ সালে কলকাতার ২৬৮ নং গরানহাটা, চিৎপুরে গৌরমোহন আড্ডির ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল বাড়ির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানত স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্ররাই অভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। শেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের অভিনয়ের জন্য মি. ক্লিঞ্জার ও মিসেস এলিস ছাত্রদের শিক্ষা দেন। প্রতিষ্ঠা বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় এবং এর দ্বিতীয় অভিনয় হয় ৫ অক্টোবর। ১৮৫৪ সালের ২ ও ১৭ মার্চ ওরিয়েন্টাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় মার্চেন্ট অফ ভেনিস। মিসেস গ্রেইর্গ নামে জনৈকা মহিলা ‘পোর্সিয়া’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি শেক্সপীয়রের হেনরি ফোর্থ ও হেনরি পার্কার মেরিডিথের এ্যামেচার নাটকদুটি অভিনীত হয়। ১৮৫৭ সালের মে মাসে শেক্সপীয়রের আর একখানি নাটক অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয় সংবাদ প্রভাকরে। ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের ব্যয় নির্বাহ হতো টিকিট বিক্রয়ের অর্থ দিয়ে, যেহেতু এটি কোন বিত্তবানের প্রাসাদের থিয়েটার ছিল না। এর নাট্যাভিনয়ের বিজ্ঞাপন এবং বিবরণসমূহ সংবাদ প্রভাকর, বেঙ্গল হরকরা, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, দি মর্নিং ক্রনিকল, দি সিটিজেন ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।[২]
  • ক্রাউন থিয়েটার মঞ্চ এটি ১৮৯০ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে কোনও এক সময় পুরান ঢাকার নবাব বাড়ির সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে প্রথমে ছিল ‘পূর্ববঙ্গ রঙ্গভূমি’ নাট্যগোষ্ঠীর মঞ্চ; কিন্তু এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে ক্রাউন থিয়েটার সেটি ভেঙ্গে নতুন করে মঞ্চ নির্মাণ করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের আপত্তির কারণে মঞ্চটি এক সময় ইসলামপুরে স্থানান্তরিত হয়। ১৮৯৭ সালে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হলে ক্রাউন থিয়েটারের কতিপয় অভিনেতা-অভিনেত্রী সেখানে যোগ দেন এবং এর ফলে ক্রাউনের কর্মকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছুকাল পরে ক্রাউন থিয়েটার চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু করলে নাট্যমঞ্চ হিসেবে এর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।[২]
  • গাইড হাউস মিলনায়তন এটি ঢাকার নিউ বেইলী রোডে বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয় প্রাঙ্গণে অবস্থিত। আশির দশক থেকে এই মঞ্চটি নিয়মিত নাট্য প্রদর্শনীর অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। নাট্য প্রদর্শনীর সংখ্যাবৃদ্ধি, নতুন নতুন নাট্যদলের উদ্ভব, নাটকের দর্শক সৃষ্টি ইত্যাদি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গাইড হাউস মিলনায়তনের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। দ্বিতীয় ধাপে ঢাকা শহরে এখানেই প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী শুরু হয়। গাইড হাউস মিলনায়তনে বিভিন্ন নাট্যদল কর্তৃক মঞ্চস্থ কয়েকটি প্রধান নাটক হলো: বহুবচনের প্রজাপতির লীলালাস্য (১৯৭২), ইডিপাস (১৯৮২); থিয়েটারের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (১৯৭৬), ঘরে-বাইরে (১৯৮৫), কোকিলারা (১৯৮৯), আন্তিগোনে (১৯৯২); ঢাকা থিয়েটারের শকুন্তলা (১৯৭৮); নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দেওয়ান গাজীর কিস্সা, বিসর্জন (১৯৮৫); সুবচন নাট্য সংসদের জীবন ঘষে আগুন (১৯৮৬); লোক নাট্যদলের পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯১), মহাপ্রয়াণ (১৯৯৪), একাত্তরের দিনগুলো (১৯৯৫); সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর আসমান তারা শাড়ী (১৯৯১), বাজিমাৎ (১৯৯৪); কুশিলব নাট্য সম্প্রদায়ের নো ভেকেনসি (১৯৯১); নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু (১৯৯১), লালসালু (১৯৯১), তুঘলোক (১৯৯২); সড়কের হ্যালুসিনেশন (১৯৯২); ঢাকা লিটল থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভেনিস (১৯৯৩); থিয়েটার আর্টের কোর্ট মার্শাল (১৯৯৩), কালান্তর (১৯৯৪), গোলাপজান (১৯৯৫); কণ্ঠশীলনের পুতুল খেলা (১৯৯৩), ভৃত্য রাজকতন্ত্র (১৯৯৫); ঢাকা সুবচন নাট্যদলের বিবিসাব (১৯৯৪); ঢাকা পদাতিকের ফেরা (১৯৯৪); জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারের পাবলিক (১৯৯৫) ইত্যাদি।[২]
  • গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার এটি ১৮৭৩ সালে ভুবনমোহন নিয়োগী কর্তৃক কলকাতার বিডন স্ট্রিটে (বর্তমান মিনার্ভা থিয়েটারের স্থলে) প্রতিষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পরে কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চটি লিজ নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে পরিচালনা করেন; কিন্তু মাত্র চার মাসের মধ্যেই কৃষ্ণধন ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং ভূবনমোহন পুনরায় থিয়েটারটি নিজের হাতে নিয়ে পূর্বনামেই চালাতে থাকেন। ১৮৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে অমৃতলাল বসুর হীরকচূর্ণ ও উপেন্দ্রনাথ দাসের সুরেন্দ্র বিনোদিনী নাটক এখানে অভিনীত হয়। হীরকচূর্ণ নাটকে বাংলার রঙ্গমঞ্চে প্রথম রেলগাড়ি দেখানো হয়। পরবর্তীকালে এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: প্রকৃত বন্ধু, সরোজিনী, বিদ্যাসুন্দর, গজদানন্দ ও যুবরাজ, কর্ণাটকুমার ইত্যাদি।[২]
  • জোড়াসাঁকো নাট্যশালা-১ এটি প্যারীমোহন বসু কর্তৃক ১৮৫৪ সালে তার কলকাতাস্থ জোড়াসাঁকো বারাণসী ঘোষ স্ট্রিটের নিজস্ব বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ বছরই ৩ মে এই মঞ্চে শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকটি অভিনীত হয়। মহেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণধন দত্ত, যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন। সংবাদ প্রভাকর (৫ মে ১৮৫৪) পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রায় চারশত ভারতীয় ও ইংরেজ দর্শক হিসেবে উপস্থিত ছিল। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা (১১ মে ১৮৫৪) নাট্যশালার নিকট বাঙালি দর্শকদের জন্য বাংলা ভাষায় নাটক অভিনয়ের প্রস্তাব দেয়।[২]
  • জোড়াসাঁকো নাট্যশালা-২ এটি ১৮৬৫ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। সেকালের বিখ্যাত গোপাল উড়িয়ার যাত্রাগান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মঞ্চাভিনয়ে উদ্বুদ্ধ করে এবং তিনি গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলীর সহায়তায় এ নাট্যশালা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মধুসূদনের কৃষ্ণকুমারী, একেই কি বলে সভ্যতা এবং গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবুবিলাস নাটক অভিনীত হয়। এরপর উদ্যোক্তাগণ সমকালীন সমাজের সমস্যা নিয়ে রচিত নাটক আহবান করে পুরস্কারসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। বিচারকদের বিচারে রামনারায়ণ তর্করত্নের নবনাটক শ্রেষ্ঠরূপে নির্বাচিত হয় এবং নাট্যকারকে একটি রূপার থালায় ২০০ রৌপ্যমুদ্রা পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি নাটকটি অভিনীত হয়। অক্ষয় মজুমদার, সারদা গাঙ্গুলী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ এতে অভিনয় করেন। ৯ জানুয়ারি ন্যাশনাল ও ২৮ জানুয়ারি সোমপ্রকাশ পত্রিকায় উক্ত প্রযোজনার উচ্চ প্রশংসা করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল জোড়াসাঁকো নাট্যশালার শেষ অভিনয়।[২]
  • ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার এটি জমিদার কিশোরীলাল রায়চৌধুরী কর্তৃক ১৮৯৭ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিশোরীলাল প্রথমে ক্রাউন থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু এক সময় এর শিল্পী ও কর্মকর্তাদের মধ্যে সমঝোতার অভাব দেখা দিলে তিনি ক্রাউনেরই কতিপয় শিল্পী নিয়ে ‘ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটার’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে বর্তমান লায়ন সিনেমা হলের জায়গায় এ মঞ্চটি নির্মিত হয়েছিল। ডায়মন্ড কলকাতা থেকে অভিনেত্রী এনে, প্রয়োজনে স্থানীয় বাইজিদের দিয়ে অভিনয় করাত। এ মঞ্চে অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হলো: দুর্গেশনন্দিনী, দেবীচৌধুরানী, বিজয় বসন্ত, আলীবাবা, নবীন তপস্বিনী, বিল্বমঙ্গল, নন্দদুলাল, তরুবালা ইত্যাদি। এর টিকিটের হার ছিল দুই টাকা, এক টাকা, আট আনা ও চার আনা। ঢাকায় পেশাদার থিয়েটার প্রচলনের পেছনে ডায়মন্ড জুবিলি থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।[২] ইত্যাদি।

প্রকারভেদ[সম্পাদনা]

শ্রীজানসেনা গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত তোহর গাঁ ভি এক দিন

পশ্চিমবঙ্গের অনেক থিয়েটারগুলিকে বিস্তৃতভাবে কলকাতা ভিত্তিক থিয়েটার এবং গ্রামীণ থিয়েটারে ভাগ করা যায়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বাইরে, "বাংলা থিয়েটার" শব্দটি মূলত কলকাতা ভিত্তিক গোষ্ঠীকে বোঝায়, যেহেতু পল্লী থিয়েটার কম সুবিখ্যাত। দুই ধরনের থিয়েটারের ফর্ম এবং কন্টেন্ট অনুরূপ, কিন্তু কলকাতা-ভিত্তিক থিয়েটারগুলিতে ভাল তহবিল এবং অভিনেতা-অভিনেত্রী যুক্ত থাকে। এর প্রধান কারণ হল  একটি বৃহত্তর দর্শকের কাছে অভিনয়ের জন্য কলকাতায় গ্রামাঞ্চলে থেকে দক্ষ শিল্পীদের আগমন।

এছাড়াও বাংলা লোক থিয়েটারগুলিও রয়েছে। এই সব লোক থিয়েটারগুলিতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে কথিত বাংলা ভাষার অনেক উপভাষা  উচ্চারিত হয়। বৃহত্তর বাংলা থিয়েটার কলকাতায় কথিত উপভাষা ব্যবহার করে আর বাংলা লোক থিয়েটারগুলি অন্যান্য  উপভাষায় অভিনয় করা হয়ে থাকে।

বাংলার পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চালানো যাত্রা নামে আরেকটি বাঙালি বা বাংলা থিয়েটার রয়েছে। যাত্রার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি প্রথাগত বাদ্যযন্ত্রের বিস্তৃত ব্যবহার ও অতি-অভিনব। বর্তমানে গল্পগুলির সংকটের জন্য যাত্রার আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। অনেক জনপ্রিয় বাঙালি চলচ্চিত্র শিল্পীরা যাত্রায় অংশ নেয়।

একটা সময়ে বড় মাঠে মঞ্চ বেঁধে যাত্রাপালা হত। আর তা দেখতে ছুটে যেত বহু মানুষ। মাটির ওপর চট পেতে মহিলা, পুরুষদের বসার জায়গা বাঁশের ব্য়ারিকেড দিয়ে আলাদা করা থাকত. দিন কয়েক আগে পাড়ায় পাড়ায় মাইকে অমুক জায়গায় যাত্রা আছে বলে ঘোষণা করা হত। সঙ্গে বিলি হত লিফলেট। আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই লিফলেট নেওয়ার জন্য় প্রচার গাড়ির পিছনে ছুটত। তারপর নির্ধারিত দিনে যাত্রা দেখতে ভিড় জমাত যাত্রা প্রেমীরা।

ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলার যাত্রা শিল্প। করোনা পরিস্থিতির ফলে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো যাত্রা শিল্পেও প্রভাব পড়েছিল। নাভিশ্বাস উঠেছিল যাত্রা শিল্পের সঙ্গে জড়িত কলাকুশলী থেকে মালিকদের। বুকিং নেই, অ্যামেচার যাত্রার গদিগুলিও বন্ধ। বহু যাত্রা কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছু যাত্রা শিল্পী অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হন। জনপ্রিয় এক যাত্রা শিল্পীকে তো মানিকতলা বাজারে মাছ বিক্রি করতেও দেখা গিয়েছিল।

তবে এ বছর পুজোর পর থেকে যাত্রা পাড়া আবার ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে। ছন্দে ফিরছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার শতাধিক অ্যামেচার যাত্রা দল। ডায়মন্ড হারবার দুই নম্বর ব্লকের মাথুর গ্রাম পঞ্চায়েতের আসাপুর গ্রাম । এই গ্রামেই একটি যাত্রা সংস্থা এখন ব্যস্ত মহড়ায়। গ্রামের প্রবীণ নবীনদের যাত্রা উল্লাস দেখার মতো। এবছর অনেক বরাত মিলেছে।  এর ফলে অর্থ আসবে সংসারও হবে স্বচ্ছল।

হিন্দী থিয়েটার যা বাঙ্গালী জনগণের দ্বারা গৃহীত হয়, ১৯৯৫ সালে শ্যামনান্দ্র জালানের অধীনে অনামিকা দিয়ে শুরু করে উষা গাঙ্গুলী পরিচালিত রংগাকারমী (১৯৭৬) এবং পাদটিক (১৯৭২) পদাতিক দ্বারা প্রযোজনা করা হয়েছে।[৩][৪]

সঙ্গীত[সম্পাদনা]

১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ তম শতাব্দীতে থিয়েটারগুলির নিজস্ব বাংলা সঙ্গীত ছিল। এই থিয়েটার সঙ্গীত বিষয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ অগ্রণী ছিল; তার আগে বাংলা থিয়েটারের যুগে থিয়েটার সঙ্গীতের ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল, এবং তার মৃত্যুর পর বাংলা থিয়েটার সঙ্গীত আরো পরীক্ষামূলক হয়ে ওঠে। গিরিশ চন্দ্রের যুগে, সমস্ত স্তর-নাটকগুলিতে কিছু প্রথাগত বাংলা সংগীত, এবং নৃত্য-গায়ক, যেগুলি নাটকগুলি শুরু হওয়ার আগে এবং নাটকের মধ্যে ব্যবহার করা হত। পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে কীর্তনাঙ্গের গান থাকবে, মহাকাব্যগুলিতে খ্যামটার মতো আদিবাসী শৈলী অন্তর্ভুক্ত হবে, এবং কমেডি এবং নাটকীয় নাটকগুলির মধ্যে প্রায়ই নিধু বাবু দ্বারা টপ্পা গানগুলি অন্তর্ভুক্ত হয়।

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি[সম্পাদনা]

ভারত[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ[সম্পাদনা]

উল্লেখযোগ্য থিয়েটার গ্রুপ[সম্পাদনা]

ভারত[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Kundu, Pranay K. Development of Stage and Theatre Music in Bengal. Published in Banerjee, Jayasri (ed.), The Music of Bengal. Baroda: Indian Musicological Society, 1987.
  2. "নাট্যমঞ্চ - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-২৮ 
  3. Dharwadker, Aparna Bhargava (২০০৫)। Theatres of Independence: Drama, Theory, and Urban Performance in India Since 1947। University of Iowa Press। পৃষ্ঠা 440। আইএসবিএন 0-87745-961-4 
  4. Ahuja, Chaman (২৯ অক্টোবর ১৯৯৭)। "Calcutta,home to Hindi Theatre"The Hindu। ২৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা – Centre for the Study of Culture and Society Media Archive-এর মাধ্যমে।  একের অধিক |কর্ম= এবং |সংবাদপত্র= উল্লেখ করা হয়েছে (সাহায্য)একের অধিক |work= এবং |newspaper= উল্লেখ করা হয়েছে (সাহায্য)

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • Bengali stage, 1795-1873, by Brajendra Nath Banerjee. Published by Ranjan Pub. House, 1943.
  • Bengali theatre, by Kironmoy Raha. Published by National Book Trust, India, 1978.
  • The story of the Calcutta theatres, 1753-1980, by Sushil Kumar Mukherjee. Published by K.P. Bagchi, 1982.
  • The Bengali Drama: Its Origin and Development, by P. Guha-Thakurta. Published by Routledge, 2001. আইএসবিএন ০-৪১৫-২৪৫০৪-৪. Excerpts