ইসলামি নারীবাদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(ইসলামী নারীবাদ থেকে পুনর্নির্দেশিত)

২০০২ সালে মারগট বাদরান অনুসারে, ইসলামনারীবাদের একটি সমন্বয়কে "ইসলামি দৃষ্টান্তে একটি নারীবাদী আলোচনা ও চর্চা" হিসেবে ধরা হয়।[১] ইসলামি নারীবাদীগণ ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা থেকে তাঁদের মত প্রকাশ করেন,[২] ব্যক্তিগত ও পাবলিক ক্ষেত্রসমূহে নারী ও পুরুষের পূর্ণাঙ্গ সাম্য দাবি করেন, এবং এই আলোচনা ও বিতর্কগুলোতে অমুসলিমদেরকে নিয়ে আসেন। ইসলামি আলেমদের মতে ইসলামি নারীবাদ ধর্মনিরপেক্ষ নারীবাদের তুলনায় অধিক মৌলবাদী (radical)[৩] এবং কুরআন এবং এর কেন্দ্রীয় পাঠ নিয়ে ইসলামের আলোচনার মধ্যেই এটি অবস্থান করে।[৪] মরক্কোর সমাজবিজ্ঞানী "ফাতেমা মারনিসি এবং আমিনা ওয়াদুদলেইলা আহমেদ এর মতো শিক্ষায়তনিকগণ" ইসলামি নারীবাদকে একটি "স্কুল অফ থট" বা দার্শনিক ঘরানা হিসেবে প্রকাশ করেন।[৫]

ইসলামি নারীবাদ ধারণার পক্ষের লোকেরা বলেন, মুসলিম-প্রধান রাষ্ট্রগুলো থেকে অনেক সময়ই নারী রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রের সচিবগণ এসেছেন, যেমন আজারবাইজানের লালা শেভকেত, পাকিস্তানের বেনজীর ভুট্টো, সেনেগালের মামে মাদিওর বয়ে, তুরস্কের তানসু চিলের, কসভোর কাকুশা জাশারি, ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী এবং বাংলাদেশে খালেদা জিয়াশেখ হাসিনা। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারা তিনি প্রতিস্থাপিত হন, যিনি বাংলাদেশে সর্বাধিক সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন।[৬]

সংজ্ঞা[সম্পাদনা]

"ইসলামি নারীবাদী" এবং "ইসলামবাদী" শব্দ দুটির মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। নারী ও পুরুষ সকলের ক্ষেত্রেই এই শব্দদুটো প্রযোজ্য হতে পারে।

"ইসলামি নারীবাদী"[সম্পাদনা]

ইসলামু নারীবাদীগণ ধর্মীয় গ্রন্থসমূহকে নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেন। তাঁরা ইসলাম ও ইসলামের শিক্ষা থেকে তাঁদের মত প্রকাশ করেন,[২] ব্যক্তিগত ও পাবলিক ক্ষেত্রসমূহে নারী ও পুরুষের পূর্ণাঙ্গ সাম্য দাবি করেন এবং এই আলোচনা ও বিতর্কগুলোতে অমুসলিমদেরকে নিয়ে আসেন।

ইসলামি আলেমদের মতে ইসলামি নারীবাদ ধর্মনিরপেক্ষ নারীবাদের তুলনায় অধিক মৌলিক বা মৌলবাদী[৩] এবং কুরআন এবং এর কেন্দ্রীয় পাঠ নিয়ে ইসলামের আলোচনার মধ্যেই এটি অবস্থান করে।[৪]

সাম্প্রতিক সময়ে সমাজের বিভিন্ন দিক থেকে ইসলামি দলগুলোর সমর্থনের লাভের উদ্দেশ্যে ইসলামি নারীবাদের ধারণা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। এছাড়াও শিক্ষিত মুসলিম নারীগণ সমাজে তাদের ভূমিকাকে শক্তিশালী করার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে।[৭]

"ইসলামবাদী"[সম্পাদনা]

ইসলামবাদীগণ রাজনৈতিক ইসলামকে সমর্থন করেন। এই রাজনৈতিক ইসলাম হচ্ছে কুরআন এবং হাদিস থেকে আসা খিলাফত বা ইসলামি সরকার ব্যবস্থার ধারণা। কোনো কোনো ইসলামবাদী জনসাধারণের ক্ষেত্রে বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়সমূহে (লোকজীবনে) নারী অধিকারের পক্ষে থাকেন, কিন্তু ব্যক্তিগত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না।[৮] সুদানীয় আলেম এবং ইসলামি রাজনীতিবিদ সুয়াদ আল-ফাতিহ আল-বাদাওয়ি বলেন, নারীবাদ তাকওয়ার (ধর্মনিষ্ঠা বিষয়ক ইসলামি ধারণা) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং তাই ইসলাম ও নারীবাদ একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা (অর্থাৎ, একটি গ্রহণ করলে আরেকটিকে বর্জন করতে হবে)।[৯] জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর মুসলিম-খ্রিশ্চিয়ান আনডারস্ট্যান্ডিং-এর মারগট বাদরান বলেন, ইসলাম ও নারীবাদ সম্পূর্ণভাবে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন নয়, এবং "ইসলামি নারীবাদ কুরআনের শিক্ষা ও নিয়ম থেকেই আসে"। এটি নারী এবং পুরুষের জন্য অধিকার ও ন্যায় ও তাদের অস্তিত্বের পূর্ণতা দাবি করে। ইসলামি নারীবাদ যেরকম উচ্চমাত্রায় বিতর্কিত বিষয়, তেমনি দৃঢ়ভাবে গৃহীত বিষয়ও বটে।"[১০]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ইসলামের অধীনে প্রাথমিক পরিবর্তন[সম্পাদনা]

খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে ইসলামের প্রথম দিকে নারী অধিকারের পরিবর্তনসমূহ বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং উত্তরাধিকারপ্রাপ্তিতে প্রভাব ফেলেছিলো।[১১] অক্সফোর্ড ডিকশনারি অফ ইসলাম অনুসারে, সেইসময় আরব সমাজগুলোতে কন্যা শিশুহত্যার নিষেধাজ্ঞার ফলে সাধারণভাবে নারীর অবস্থার উন্নতি হয়েছিল, যদিও কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে ইসলামের পূর্বে ও পরে উভয়ক্ষেত্রেই শিশুহত্যার চর্চা ছিল।[১২]

ইসলামী আইন অনুসারে, বিবাহকে আর অবস্থা নয়, চুক্তি হিসেবে দেখা হয়, যেখানে নারীর সম্মতি (সক্রিয় সম্মতি বা মৌন সম্মতি) বাধ্যতামূলক ছিলো।[১৩][১৪][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন][১৫][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন][১৬][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন] পূর্বে কন্যার পিতাকে বধূমূল্য হিসেবে যৌতুক দিতে হতো, ইসলামি আইন অনুসারে বৈবাহিক উপহার হিসেবে যৌতুক প্রদান করা হয় যা স্ত্রী তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে অধিকার করতে পারে।[১৪][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন][১৫][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট বলেন, মুহাম্মাদ তাঁর সময়ে ও তাঁর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নারী অধিকার রক্ষায় কাজ করেছিলেন এবং নারী সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের উন্নয়ন করেছিলেন - এমনটা বলা যেতে পারে। ওয়াট ব্যাখ্যা করেন, "ইসলাম যে সময়ে শুরু হয়েছিল, নারীদের অবস্থা ভয়াবহ ছিলো - তাঁদের সম্পত্তির অধিকার ছিলো না, তাঁদেরকে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে দেখা হতো, আর যদি কোনো পুরুষের মৃত্যু হতো তাঁর সকল সম্পত্তি তাঁর পুত্রদের কাছে চলে যেতো।" মুহাম্মাদ "নারীদেরকে সম্পদ অধিকার, উত্তরাধিকার, শিক্ষা ও বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দান করে তাদেরকে মৌলিক নিরাপত্তা প্রদান করেন।"[১৭][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন] হাদ্দাদ এবং এসপোসিতো বলেন, "মুহম্মদ পারিবারিক জীবন, বিবাহ, শিক্ষা, এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারী অধিকার ও বিভিন্ন সুবিধাদির সুযোগ করে দিয়ে সমাজে নারীর অবস্থার উন্নয়ন করতে সাহায্য করেন"।[১৫][পূর্ণ তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

ইসলাম নারীদের অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করেছেন এই ধারণার নারীবাদী সমালোচনাও রয়েছে। লেইলা আহমেদ বলেন, ইসলামের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, অন্তত কিছু নারী ইসলাম-পূর্ব যুগে সম্পদের উত্তরাধিকারী হতেন, ব্যবসা পরিচালনা করতেন, নিজেদের স্বামী পছন্দ করে নিতেন, এবং সম্মানজনক পেশায় নিযুক্ত হতেন।[১৮] ফাতিমা মারনিসি একইভাবে যুক্তি দেখান, ইসলাম-পূর্ব যুগের রীতি নীতি নারীদের যৌনতা এবং নারীদের সামাজিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে কম নয়, বরং অধিক মাত্রায় উদার ছিল।[১৯]

মাহুদ এ, মোয়েল জে, হাডসন সি, এবং লেদারস এল. নারীদের নিয়ে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন যেখানে নমুনা ব্যক্তিবর্গকে তাদের নিজেদের ধর্মে নারী হিসেবে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় এবং প্রশ্ন করা হয় যে এই ভূমিকা তাদের ক্ষমতায়ন করে কিনা। একজন উত্তরদাতা বলেন, "ইসলাম এবং তার শিক্ষা সমাজে নারীকে পুরুষের সমান অধিকার দিতে পারে, এবং ব্যক্তিমালিকানাধীক ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে বঞ্চিত করে না। আমি বাস্তবিকই মনে করি, কিছু মুসলিম ইসলামের শিক্ষাকে বিকৃত করেছে এবং আমাদের সংস্কৃতিকে ভুলে গেছে। আমি মনে করি ইসলামকে নারীর ক্ষমতায়নের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যায়।"[২০]

ইসলামি স্বর্ণযুগে[সম্পাদনা]

যেখানে প্রাক-আধুনিক যুগে আনুষ্ঠানিক নারীবাদী আন্দোলনের অভাব ছিল, সেখানে ইসলামি স্বর্ণযুগের সময় কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নারী অধিকার ও স্বাধীনতার উন্নয়নের কথা বলেছিলেন। এই লোকদের মধ্যে মধ্যযুগের রহস্যবাদী এবং দার্শনিক ইবনে আরাবী রয়েছেন, যিনি বলেন পুরুষের মতো নারীরাও আধ্যাত্মিক অবস্থা অর্জন করতে পারে।[২১] পরবর্তী যুগে অষ্টাদশ শতকের সংস্কারক উসমান ড্যান ফোডিও এর কন্যা নানা আসমাউ মুসলিম নারীর সাক্ষরতা এবং শিক্ষার জন্য কাজ করেন।[২২]

শিক্ষা[সম্পাদনা]

সম্পদশালী সম্ভ্রান্ত নারীগণ প্রায়ই ইসলাম ধর্মীয় এবং ইসলাম শিক্ষার প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দান করতো, যদিও বিংশ শতকের পূর্বে এগুলোর মধ্যে খুব কম প্রতিষ্ঠানেই নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হতো। যেমন, ফাতিমা আল-ফিহরি ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে আল-কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, কিন্তু ১৯০০ এর শতকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা শুরু করে (যাদের মধ্যে ফাতিমা আল-কাব্বাজ উল্লেখযোগ্য)। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের আইয়ুবীয় রাজবংশের বেলায়ও এটা দেখা যায়: দামেস্কোতে ১৬০টি মসজিদমাদ্রাসা তৈরি করা হয়, এর মধ্যে নারীগণ ২৬টিতে ওয়াকফ ব্যবস্থায় (দাতব্য ট্রাস্ট বা ট্রাস্ট আইন) অর্থ দান করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকদের অর্ধেকই ছিল নারী।[২৩]

দ্বাদশ শতকের সুন্নি আলেম ইবনে আসাকির এর মতে, নারী শিক্ষার সুযোগ ছিল। তিনি বলেন বালিকা ও নারীরা শিক্ষাগ্রহণ করে ইজাযাহ্‌ (প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী) গ্রহণ করতে পারতেন এবং উলামা ও "শিক্ষিকা" হতে পারতেন। এটি বিশেষ করে শিক্ষিত এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ পরিবারেই দেখা যেত, যেখানে পুত্র ও কন্যা উভয়ের জন্যই সর্বোচ্চ সাম্ভাব্য শিক্ষা নিশ্চিত করা হতো।[২৪] ইবনে আসাকির নিজেই ৮০ জন ভিন্ন ভিন্ন নারী শিক্ষিকার কাছে পড়াশুনা করেছেন। মুহাম্মাদ মদিনায় নারীদেরকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি আগ্রহীদের জন্য প্রশংসা করেছিলেন:[২৫] "আনসার নারীরা কতই চমৎকার; লজ্জা তাদেরকে ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত হতে আটকাতে পারেনি।"

নারীদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রেণীকক্ষে গিয়ে শিক্ষাগ্রহণ করা খুব বিরল ছিলো। তাঁরা অনানুষ্ঠানিক বক্তৃতা এবং মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন ক্ষেত্রের শিক্ষা অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতেন। কোনো কোনো পুরুষ এই চর্চাকে অনুমোদন করতেন না, যেমন মুহাম্মাদ ইবনে আল-হাজ (মৃত্যু ১৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) সেই সময়ে নারীদের এই আচরণ ও এরকম অনানুষ্ঠানিত শিক্ষাগ্রহণের উপর বিতৃষ্ণ ছিলেন।[২৬]

মধ্যযুগে নারীর প্রসঙ্গে আব্দুল হাকিম মুরাদ লেখেন:

[ভাবুন,] একজন শায়খের কাছ থেকে ধর্মগ্রন্থ [এর আবৃত্তি] শোনার সময় সকলে যখন একত্রিত হয় তখন নারীগণ কী করে। সেখানে নারীরাও ধর্মগ্রন্থের বাণী শোনার জন্য একত্রিত হয়। পুরুষেরা একদিকে বসে থাকে, নারীরা তাদের মুখোমুখি বসে। কখনও কখনও এও দেখা যায় যে, কোনো নারী দাঁড়ালো, আবার বসে পড়ল, আবার উচ্চস্বরে আওয়াজ করল। এছাড়া তার আওরা সকলের সামনে চলে আসে। যেখানে নিজেদের গৃহেই নারীদের এরকম প্রকাশ নিষিদ্ধ, সেখানে মসজিদে পুরুষের সামনে এরকম আচরণ কীভাবে অনুমোদিত হতে পারে?

এখানে, 'আওরাহ্‌' বলতে নারীর শরীরের সেই অংশগুলোকে বোঝানো হয় যাকে ইসলাম অনুসারে ঢেকে রাখা উচিৎ।

মধ্যযুগে নারীর প্রসঙ্গে আব্দুল হাকিম মুরাদ লেখেন:

প্রাচ্যবাদী ইগনাজ গোল্ডজিহার দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগীয় হাদিস পণ্ডিতদের মধ্যে সম্ভবত পনেরো শতাংশ ছিল নারী, তাঁরা মসজিদে শিক্ষাদান করতেন এবং নিষ্ঠার ও নৈতিকতার জন্য তারা সর্বজনীনভাবে তারা প্রশংসিত ছিলেন। কায়রোতে সাকলাতুনিয়া মাদ্রাসার মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে নারীর দ্বারা অর্থায়ন হতো, এবং কেবল নারীরাই সেগুলোতে পড়াতেন ও কাজ করতেন।[২৭]

পঞ্চদশ শতাব্দীতে, আল-সাখাভী তাঁর সমগ্র ১২ খন্ডের জীবনী-সংক্রান্ত অভিধান দাও আল-লামি নামক গ্রন্থটিকে নারী পণ্ডিতদেরকে উৎসর্গ করেন, সেই গ্রন্থে ১,০৭৫ জন নারী পণ্ডিতের কথা উল্লেখ করা হয়।[২৮]

১৯৯৫ সালে যখন তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসে, তখন নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ হয় এবং তা তলানিতে চলে যায়। তালেবানকে উৎখাত করা হলে পুনরায় নারীশিক্ষার পুনরুজ্জীবিত হবার সুযোগ তৈরি হয়, তবে অবশিষ্ট কুসংস্কার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় পুরুষের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকার কারণে তা কঠিন হয়ে যায়।[২৯] আগস্ট ২০১২-তে, ইরানের একটি সরকারি সূত্র একটি সংবাদ প্রকাশ করে যে, ৩৬টি ইরানি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৭টি কারিগরি, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে স্নাতকোত্তর কোর্সে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হবে।[৩০]

নাগরিক ও সামরিক পেশা[সম্পাদনা]

খিলাফতের সময় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় পটভূমি থেকে শ্রমশক্তি এসেছে, সেই সময়ে পুরুষ ও নারী উভয়ই বিভিন্ন পেশা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।[৩১] সেইসময় নারীরা প্রাথমিক সেক্টর (উদাহরণস্বরূপ কৃষক হিসাবে), মাধ্যমিক সেক্টর (নির্মাণ শ্রমিক, বস্ত্রশিল্পে রং দেয়া ও চড়কার কাজ ইত্যাদি) এবং টারশিয়ারি সেক্টরের (বিনিয়োগকারী, চিকিৎসক, সেবিকা, গিল্ড এর প্রধান, দালাল, পাইকার, ঋণদাতা, পণ্ডিত ইত্যাদি) বিস্তৃত পরিসরের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড ও বৈচিত্র্যময় পেশায় জড়িত ছিলো।[৩২][৩৩] মুসলিম নারী সেই সময়কার বস্ত্রশিল্পের কিছু শাখা যেমন স্পিনিং, ডায়িংএমব্রয়ডারিতে একচেটিয়া ছিল।[৩২] সেই সময় বস্ত্রশিল্প ছিল সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে বেশি বিশেষায়িত ও বাজারমুখী শিল্প।

দ্বাদশ শতাব্দীতে, বিখ্যাত ইসলামি দার্শনিক এবং কাজি (বিচারক) ইবনে রুশদ দাবি করেন যে, নারী সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমান এবং শান্তিযুদ্ধ উভয় ক্ষেত্রেই তারা উন্নতি করবার সমান ক্ষমতা রাখে। এক্ষেত্রে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তিনি আরব, গ্রিক ও আফ্রিকান যোদ্ধাদের উদাহরণ দেন।[৩৪] মুসলিম ইতিহাসের প্রথম দিকে, মুসলিম বিজয়ফিতনায় (বেসামরিক যুদ্ধ) সৈন্য বা সেনাধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করেছে এরকম উল্লেখযোগ্য নারীর উদাহরণ হচ্ছে নুসাইবাহ্‌ বিনতে ক্বাব আল মাজিনিয়াহ,[৩৫] আয়েশা,[৩৬] খাওলাহ্‌ এবং ওয়াফেইরা।[৩৭]

সম্পত্তি, বিবাহ ও অন্যান্য অধিকার[সম্পাদনা]

ইসলামী আইনের অধীনে নারীর উত্তরাধিকার হওয়া ও উত্তরাধিকার প্রদানের; স্বাধীনভাবে তাদের আর্থিক বিষয় পরিচালনার; এবং চুক্তির দ্বারা বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষমতা রয়েছে।[৩৮] হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর আইনের প্রফেসর নোয়া ফেল্ডম্যান লিখেছেন:

লিঙ্গবাদ এর জন্য সাধারণ আইন এর ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিবাহিত নারীদের মধ্যে সম্পত্তির অধিকার ছিল না, এবং তাদের স্বামী ব্যতীত তাদের আইনগত ব্যক্তিত্বও ছিল না। ঔপনিবেশিক আমলে যখন ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশগুলোতে মুসলিমদের ক্ষেত্রে শরিয়তের পরিবর্তে তাদের আইন প্রয়োগ করে, তখন মুসলিম বিবাহিত নারীরা তাঁদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় যা তারা ইসলামি আইনে সবসময় লাভ করতো।[৩৯]

১৫ শতক থেকে আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে বিবাহ বিচ্ছেদ খুব অস্বাভাবিক ছিলো, সেসময় মুসলিম বিশ্বে বিবাহ বিচ্ছেদ (তালাক) এর হার তুলনামূলকভাবে সাধারণ ঘটনা ছিলো। অন্তত একটি গবেষণা অনুযায়ী মামলুক সালতানাত এবং অটোমান সাম্রাজ্যে প্রথম দিকে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় বেশি ছিলো।[৪০] ১৫ শতকের মিশরে আল-সাখাভী ৫০০ জন নারীর বৈবাহিক ইতিহাস নথিবদ্ধ করেছিলেন, যা মধ্যযুগের বিবাহের সবচেয়ে বড় নমুনা। সেখান থেকে দেখা যায়, মিশরসিরিয়ার মামলুক সালতানাতের অন্তত এক তৃতীয়াংশ নারী একাধিক বিবাহ করেছিলেন, এবং অনেকে তিনবার বা তারও বেশি বিবাহ করেছিলেন।[৪১]

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি[সম্পাদনা]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Al-Ahram Weekly | Culture | Islamic feminism: what's in a name?"। মার্চ ২০, ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১০, ২০১৯ 
  2. "Women In Islam"milligazette.com। ২২ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ 
  3. "Islamic feminism: what's in a name?" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ মার্চ ২০১৫ তারিখে by Margot Badran, Al-Ahram, January 17–23, 2002
  4. "Exploring Islamic Feminism" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ এপ্রিল ২০০৫ তারিখে by Margot Badran, Center for Muslim-Christian Understanding, Georgetown University, November 30, 2000
  5. Lindsey, Ursula (১১ এপ্রিল ২০১৮)। "Can Muslim Feminism Find a Third Way?"। New York Times। সংগ্রহের তারিখ ১১ এপ্রিল ২০১৮ 
  6. "Prime Minister of Bangladesh - PM Office Email Address." MediaBangladeshnet about Bangladesh Print Electronic Internet More. N.p., 15 Nov. 2015. Web. 01 Oct. 2016.
  7. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১০ এপ্রিল ২০১১ তারিখে Rob L. Wagner: "Saudi-Islamic Feminist Movement: A Struggle for Male Allies and the Right Female Voice", University for Peace (Peace and Conflict Monitor), March 29, 2011
  8. "ISLAMIC FEMINISM AND THE POLITICS OF NAMING"iran-bulletin.org। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ 
  9. Hale, Sondra (২০১৩)। "Sudanese Women in National Service, Militias & the Home"। Doumato, Eleanor; Posusney, Marsha। Women and Globalization in the Arab Middle East: Gender, Economy, and Society। Lynne Rienner। পৃষ্ঠা 208। আইএসবিএন 1588261344 
  10. "Independent Lens . SHADYA . Muslim Feminism | PBS"www.pbs.org। ২০১৮-০৬-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-২৭ 
  11. ""Women and Islam" in ''Oxford Islamic Studies Online''"। Oxfordislamicstudies.com। ২০০৮-০৫-০৬। ডিওআই:10.1093/0198297688.003.0006। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৩-৩০ 
  12. Giladi, Avner (মে ১৯৯০)। "Some Observations on Infanticide In Medieval Muslim Society"International Journal of Middle East Studies22 (2): 185–200। সংগ্রহের তারিখ ২ আগস্ট ২০১৮ 
  13. "Sahih al-Bukhari » Book of Wedlock, Marriage (Nikaah)"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-০২ 
  14. Khadduri, Majid. Socialist Iraq: A Study in Iraqi Politics since 1968. Washington: Middle East Institute, 1978. Print.
  15. Esposito, John L. Islam: The Straight Path. New York: Oxford UP, 1998. Print
  16. Esposito, John L. Islam: The Straight Path. New York: Oxford UP, 1998. N. page 339. Print.
  17. Watt, W. Montgomery. Islamic Creeds: A Selection. Edinburgh: Edinburgh UP, 1994. Print.
  18. Leila Ahmed, Women and the Advent of Islam, Signs: Journal of Women in Culture and Society, Vol. 11, No. 4, pp. 665-691
  19. Mernissi, Fatima (১৯৭৫)। Beyond the Veil: Male-female Dynamics in Modern Muslim Society। Saqi Books। পৃষ্ঠা 66। আইএসবিএন 9780863564413 
  20. Carland, Susan। "Islam and feminism are not mutually exclusive, and faith can be an important liberator"The Conversation (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-২৭ 
  21. Hakim, Souad (২০০২), "Ibn 'Arabî's Twofold Perception of Woman: Woman as Human Being and Cosmic Principle", Journal of the Muhyiddin Ibn 'Arabi Society, 31: 1–29 
  22. Mack, Beverly B.; Boyd, Jean (২০০০), One Woman's Jihad: Nana Asma'u, Scholar and Scribe, Indiana University Press 
  23. Lindsay, James E. (২০০৫), Daily Life in the Medieval Islamic World, Greenwood Publishing Group, পৃষ্ঠা 197, আইএসবিএন 978-0-313-32270-9 
  24. Lindsay, James E. (২০০৫), Daily Life in the Medieval Islamic World, Greenwood Publishing Group, পৃষ্ঠা 196 & 198, আইএসবিএন 978-0-313-32270-9 
  25. Lindsay, James E. (২০০৫), Daily Life in the Medieval Islamic World, Greenwood Publishing Group, পৃষ্ঠা 196, আইএসবিএন 978-0-313-32270-9 
  26. Lindsay, James E. (২০০৫), Daily Life in the Medieval Islamic World, Greenwood Publishing Group, পৃষ্ঠা 198, আইএসবিএন 978-0-313-32270-9 
  27. Abdal Hakim Murad। "Islam, Irigaray, and the retrieval of Gender"। Masud.co.uk। ২০১২-০৫-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০৮-১৩ 
  28. Guity Nashat, Lois Beck (২০০৩), Women in Iran from the Rise of Islam to 1800, University of Illinois Press, পৃষ্ঠা 69, আইএসবিএন 978-0-252-07121-8 
  29. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :0 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  30. "Iranian Women: Victims of Economic Strain"Muftah (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১২-০৯-০৬। ২০১৬-১০-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  31. Maya Shatzmiller, pp. 6–7.
  32. Maya Shatzmiller (1994), Labour in the Medieval Islamic World, Brill Publishers, আইএসবিএন ৯০-০৪-০৯৮৯৬-৮, pp. 400–1
  33. Maya Shatzmiller, pp. 350–62.
  34. Ahmad, Jamil (সেপ্টেম্বর ১৯৯৪), "Ibn Rushd", 6=Monthly Renaissance, 4 (9), ২০১১-০৭-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-১৪ 
  35. "ABCNEWS.com : The Cost of Women in Combat"realnews247.com। ২০১৬-০১-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ 
  36. Black, Edwin (২০০৪), Banking on Baghdad: Inside Iraq's 7,000 Year History of War, Profit, and Conflict, John Wiley and Sons, পৃষ্ঠা 34, আইএসবিএন 978-0-471-70895-7 
  37. Hale, Sarah Josepha Buell (১৮৫৩), Woman's Record: Or, Sketches of All Distinguished Women, from "The Beginning Till A.D. 1850, Arranged in Four Eras, with Selections from Female Writers of Every Age, Harper Brothers, পৃষ্ঠা 120 
  38. Badr, Gamal M.; Mayer, Ann Elizabeth (১৯৮৪), "Islamic Criminal Justice", The American Journal of Comparative Law, 32 (1): 167–169, জেস্টোর 840274, ডিওআই:10.2307/840274 
  39. Noah Feldman (মার্চ ১৬, ২০০৮)। "Why Shariah?"। New York Times। ২০১২-১১-১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১০-০৫ 
  40. Rapoport, Yossef (২০০৫), Marriage, Money and Divorce in Medieval Islamic Society, Cambridge University Press, পৃষ্ঠা 2, আইএসবিএন 978-0-521-84715-5 
  41. Rapoport, Yossef (২০০৫), Marriage, Money and Divorce in Medieval Islamic Society, Cambridge University Press, পৃষ্ঠা 5–6, আইএসবিএন 978-0-521-84715-5