বিষয়বস্তুতে চলুন

মধ্যযুগীয় ইসলামে জ্যোতিষশাস্ত্র

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক মানচিত্র, রাশিচক্র ও চন্দ্র নক্ষত্রমণ্ডল, Zubdat al-Tawarikh (ইতিহাসের নির্যাস) গ্রন্থ থেকে। ১৫৮৩ সালে এটি উসমানীয় সুলতান মুরাদ তৃতীয়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।

মধ্যযুগে কিছু মুসলিম জ্যোতিষবিদ্যার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এর একটি কারণ ছিল তাঁদের বিশ্বাস যে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপর একটি কারণ ছিল মরুভূমি অঞ্চলের মানুষরা প্রায়শই রাতে ভ্রমণ করতেন এবং তারা পথনির্দেশনার জন্য নক্ষত্রমণ্ডলের জ্ঞান ব্যবহার করতেন।[][]

ইসলামের আবির্ভাবের পর মুসলমানদের নামাজের সময় নির্ধারণ, কাবার দিক নির্ণয় এবং মসজিদের সঠিক অভিমুখ স্থির করার প্রয়োজন পড়ে। এসব কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা যুক্ত হয় এবং সেই সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব পৃথিবীর ঘটনাবলি ও মানুষের জীবনে পড়ে—এমন বিশ্বাসও গড়ে ওঠে।[] এ ধরনের প্রভাব নিয়ে যে শাস্ত্র চর্চা করা হতো, তা ছিল জ্যোতিষ (আরবি: علم النجوم ইল্‌ম আন-নুজুম) নামে পরিচিত। এটি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানের (আরবি: علم الفلك ইল্‌ম আল-ফালাক, অর্থাৎ 'আকাশ গঠনের বিজ্ঞান') একটি শাখা।[]

এই জ্ঞানের ভিত্তি ছিল আরব ও পারস্যের, বাবিলীয়, হেলেনীয় এবং ভারতীয় ঐতিহ্যে। ৮ম শতকে বাগদাদে আরবরা এক বিশাল মানমন্দির ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার পর এই জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিদ্যার চর্চা উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়।

মধ্যযুগ জুড়ে মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে জ্যোতিষবিদ্যার ব্যবহার নিয়ে গভীর দার্শনিক বিতর্ক চলেছে। তবে জ্যোতিষের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে যথেষ্ট পরিমাণে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হতো। এই জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা ও উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়।

প্রারম্ভিক ইতিহাস

[সম্পাদনা]

মধ্যযুগীয় ইসলামি জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান পটলেমির Almagest ভিত্তিক হেলেনীয়রোমান যুগের ঐতিহ্য অনুসরণ করে বিকশিত হয়। বাগদাদ ও দামেস্কে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জ্যোতিষ/জ্যোতির্বিজ্ঞানের শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। বাগদাদের খলিফা আল-মানসুর শহরে একটি বিশাল মানমন্দির ও গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যা একসময়ে বিশ্বের প্রধান জ্যোতির্বিদ্যা কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হয়। এই সময় জ্যোতির্বিদ্যায় বিপুল উন্নতি সাধিত হয়। আধুনিক যুগের বহু তারার নাম আরবি উৎস থেকে আগত।

প্রভাবশালী ইসলামি জ্যোতিষবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবু মা'শার আল-বালখি বা আলবুমাসুর (৮০৫–৮৮৫)। তাঁর রচিত গ্রন্থ Introductorium in Astronomiam (আরবি: কিতাব আল-মুদখাল আল-কবীর)-এ তিনি বলেন, "গ্রহগুলির বিচিত্র গতি পর্যবেক্ষণ করলেই কেবল এই পৃথিবীর অসংখ্য রূপান্তরের মর্ম বোঝা সম্ভব"।[] এই গ্রন্থটি মধ্যযুগে স্পেন হয়ে ইউরোপে অনূদিত হয়ে প্রবেশ করে এবং সেখানকার জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুনর্জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

পার্সীয়রাও চিকিৎসা ও জ্যোতিষশাস্ত্রকে একত্রিত করে একটি নতুন ধারা তৈরি করেন, যেখানে তারা বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদের গুণাগুণকে রাশি ও গ্রহের সঙ্গে সংযুক্ত করতেন।[] যেমন, মঙ্গল গ্রহকে গরম ও শুষ্ক প্রকৃতির হিসেবে বিবেচনা করা হতো, ফলে এটি এমন গাছপালার সঙ্গে যুক্ত ছিল যেগুলির স্বাদ ঝাঁঝালো বা তীব্র—যেমন হেলেবোর, তামাক বা সরিষা। এই বিশ্বাস ইউরোপীয় ভেষজবিদদের, যেমন কালপেপার, দ্বারা গৃহীত হয় এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আবির্ভাব পর্যন্ত বজায় থাকে।

পার্সীয়রা আরও একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যেখানে রাশিচক্রের উদয় লগ্ন (ascendant) ও প্রতিটি গ্রহের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় করে একটি 'অংশ' হিসেব তৈরি করা হতো।[] উদাহরণস্বরূপ, 'সৌভাগ্যের অংশ' নির্ণয় করতে সূর্য ও উদয় লগ্নের ব্যবধান Moon-এ যোগ করা হতো। যদি এইভাবে গণনা করা অংশটি দশম ঘরে এবং তুলা রাশিতে অবস্থান করত, তাহলে তা অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের ইঙ্গিত দিত।

ওমর খৈয়াম প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জি, যা শাস্ত্রীয় রাশিচক্রের ভিত্তিতে তৈরি, এখনও আফগানিস্তানইরান-এ সরকারিভাবে সূর্য হিজরি ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আরেকজন উল্লেখযোগ্য পার্সীয় জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষী ছিলেন কুতুব আল-দীন আল-শিরাজী, যিনি ইরানের শিরাজ শহরে ১২৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩১১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পটলেমির Almagest-এর সমালোচনা করেন এবং ১২৮১ সালে The Limit of Accomplishment Concerning Knowledge of the Heavens ও ১২৮৪ সালে The Royal Present নামে দুটি বিশিষ্ট গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে তিনি গ্রহগুলির গতি নিয়ে পটলেমির মতামতের পরিমার্জন ও উন্নয়ন ঘটান।

উলুঘ বেগ ছিলেন ১৫শ শতকের তিমুরিদ সুলতান এবং একজন গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী। ১৪২৮ সালে তিনি একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন এবং পটলেমির পর প্রথম মৌলিক তারামানচিত্র প্রস্তুত করেন, যেখানে অনেক তারার অবস্থান সংশোধন করা হয় এবং নতুন অনেক তারাও যুক্ত করা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

মধ্যযুগীয় উপলব্ধি

[সম্পাদনা]

মধ্যযুগীয় ইসলামি বিশ্বের কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী—যেমন আল-ফারাবি (আলফারাবিয়ুস), ইবনুল হায়থাম (আলহাজেন), আবু আলি ইবনে সিনা (আভিসেনা), আবু রাইহান আল-বিরুনি এবং ইবনে রুশ্দ (আভেরোস)—জ্যোতিষবিদ্যার কিছু নীতিকে খণ্ডন করেছিলেন। তাঁদের এই বিরোধিতার পেছনে ছিল দুটি মূল কারণ: একদিকে ছিল বৈজ্ঞানিক যুক্তি (কারণ জ্যোতিষশাস্ত্রে ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলি ছিল অনুমাননির্ভর এবং পরীক্ষালব্ধ নয়), অপরদিকে ধর্মীয় মতানৈক্য (এটি প্রথাগত ইসলামি পণ্ডিতদের মতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল)।[]

তবে এই সমালোচনাগুলি মূলত জ্যোতিষবিদ্যার "বিচারিক শাখা" (judicial astrology) সম্পর্কিত ছিল, প্রাকৃতিক নীতিসমূহ নয়। উদাহরণস্বরূপ, ইবনে সিনার Resāla fī ebṭāl aḥkām al-nojūm (তারকার রায় বাতিল বিষয়ক পত্র) নামে একটি প্রবন্ধে তিনি জ্যোতিষবিদ্যার মৌলিক ধারণাকে পুরোপুরি খণ্ডন করেননি। বরং, তিনি স্বীকার করেছিলেন যে প্রতিটি গ্রহেরই পৃথিবীতে কিছু না কিছু প্রভাব রয়েছে। কিন্তু তাঁর বক্তব্য ছিল, জ্যোতিষীরা এই প্রভাবের প্রকৃত মাত্রা নির্ধারণ করতে সক্ষম নন। মূলত, ইবনে সিনা জ্যোতিষবিদ্যার মৌলিক বিশ্বাস অস্বীকার করেননি, বরং মানুষের সীমিত জ্ঞান ও পর্যবেক্ষণক্ষমতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।[]

আরেকজন দামেস্কের পণ্ডিত ছিলেন ইবন কাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ (১২৯২–১৩৫০), যিনি প্রাক-সালাফি ধারার প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি তাঁর Miftah Dar al-Sa'adah গ্রন্থে জ্যোতিষবিদ্যার বিরোধিতা করেন এবং তা করার জন্য অভিজ্ঞতালব্ধ যুক্তি ব্যবহার করেন। তিনি মনে করতেন, জ্যোতিষবিদ্যা মূলত ভাগ্য গণনার (divination) সঙ্গে সম্পর্কিত।[]

তিনি যুক্তি দেন যে, তারাগুলি গ্রহগুলোর তুলনায় আকারে অনেক বড়, এবং বলেন:[]

"তোমরা যদি জবাবে বলো যে এই দূরত্ব এবং ক্ষুদ্রতার কারণেই তাদের প্রভাব নগণ্য, তাহলে প্রশ্ন জাগে—তাহলে কেন তোমরা সবচেয়ে ছোট গ্রহ বুধকে এত বেশি প্রভাবশালী মনে করো? আবার, কেন তোমরা আল-রাস ও আল-ধানাব (যা কেবল দুটি কাল্পনিক বিন্দু—উর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী গ্রন্থি) এর প্রভাব স্বীকার করো?"

তিনি আরও বলেন, আকাশগঙ্গা আসলে "অগণন ক্ষুদ্র তারা একত্রে জড়ো হয়ে স্থির তারামণ্ডলে গঠিত", এবং এইসব তারার প্রভাব জানার চেষ্টা করা "নিশ্চয়ই অসম্ভব"।[]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. ওয়াসিম আখতার, Contributions of Ancient Arabian and Egyptian Scientists on Astronomy; Public Science & Reference ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১২-০৫-১৭ তারিখে, সংগ্রহের তারিখ: ১৯ আগস্ট ২০১১।
  2. Ayduz, Salim; Kalin, Ibrahim; Dagli, Caner (২০১৪)। The Oxford Encyclopedia of Philosophy, Science, and Technology in Islam। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 64। আইএসবিএন 9780199812578 
  3. "Introduction to Astronomy, Containing the Eight Divided Books of Abu Ma'shar Abalachus"World Digital Library। ১৫০৬। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৭-১৫ 
  4. Parker, Derek; Parker, Julia (১৯৯০)। The New Compleat Astrologer। New York: Crescent Books। 
  5. Saliba, George (১৯৯৪b), A History of Arabic Astronomy: Planetary Theories During the Golden Age of Islam, New York University Press, পৃষ্ঠা 60 & 67–69, আইএসবিএন 978-0-8147-8023-7 
  6. Saliba, George (২০১১)। "Avicenna: viii. Mathematics and Physical Sciences"Mathematics and Physical Sciences Encyclopaedia Iranica, Online Edition 
  7. Livingston, John W. (১৯৭১), "Ibn Qayyim al-Jawziyyah: A Fourteenth Century Defense against Astrological Divination and Alchemical Transmutation", Journal of the American Oriental Society, 91 (1): 96–103, জেস্টোর 600445, ডিওআই:10.2307/600445 
  8. Livingston, John W. (১৯৭১), "Ibn Qayyim al-Jawziyyah: A Fourteenth Century Defense against Astrological Divination and Alchemical Transmutation", Journal of the American Oriental Society, 91 (1): 96–103 [99], জেস্টোর 600445, ডিওআই:10.2307/600445 

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]