মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

প্রকৃতি বিজ্ঞান ইসলামের স্বর্ণযুগে উন্নয়নের ধারায় গতিশীল ছিল (বিশেষ করে অষ্টম থেকে তেরো শতকের সময়)। এ সময়ে প্রভূত গ্রিক পন্ডিতের বিভিন্ন কাজে যেমন এরিস্টটল, টলেমি, ইউক্লিড এর কাজসহ নিওপ্লেটোনিজম-এ নতুনত্ব আনেন ইসলামিক পন্ডিতেরা।[১] উক্ত সময়ে ইসলাম ধর্মতত্ত্ব তার অনুসারীদেরকে জ্ঞান অর্জনের দিকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে।[২] যার ফলে আল ফারাবি, আবু বিশর মাত্তা, ইবনে সিনা, আল হাসান ইবনে হায়থাম এবং ইবনে বাজ্জাহদের মত জ্ঞানী ব্যক্তিদের উত্থান হয়।[৩] তাঁদের কাজসমূহ মধ্যযুগের বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত। গ্রিক পন্ডিতদের গবেষণা ও আবিষ্কার এবং বিভিন্ন তত্ত্ব তখন আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হতো এবং আরবি ভাষা সেসময় সাধারণ ভাষার (লিংগুয়া ফ্রান্সা) অবস্থানে ছিল। বিজ্ঞানে যেসকল ইসলামিক পন্ডিতেরা অবদান রেখেছিলেন তাদের প্রায় সবাই এরিস্টোটলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত ছিল এবং ইসলামিক স্বর্ণযুগে তারা এরিস্টোটলিয়ান পদার্থবিজ্ঞানকে আরও উন্নত করে। যাই হোক, নিজেদের প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামিক বিশ্বের জ্ঞানার্জনের প্রতি আলাদা একটি স্পৃহা বজায় ছিল এবং তারা বিশ্বাস করতো যে এই দুনিয়া কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে৷ এই প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণের প্রভাবেই তাঁরা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যাপারে আগ্রহী হয় এবং ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তিসমূহ তৈরি হয়৷ [৪]পদার্থবিজ্ঞান বা প্রকৃতিবিদ্যা নিয়ে সর্বপ্রথম যে ইসলামিক দেশের জ্ঞান আগ্রহীরা পড়াশোনা করে তা হলো ইরাকমিশর[৫]সেসময় ইসলামিক বিশ্বে আলোকবিজ্ঞান, বলবিদ্যা (যার অন্তর্ভুক্ত আছেঃ স্থিতিবিদ্যা, গতিবিদ্যা, চলন্ত বস্তুর গতি) ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতো পদার্থবিজ্ঞানের শাখাসমূহ সাধারণ অধ্যয়ন করা হতো।

পদার্থবিজ্ঞান[সম্পাদনা]

মধ্যযুগের ইসলামিক পন্ডিতেরা এরিস্টোটলীয় পদার্থবিজ্ঞান হতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ও পরবর্তীতে তাঁর তত্ত্বের পর্যবেক্ষণের সত্যতার উপর জোর দিয়ে তাঁর তত্ত্বসমূহের প্রসার ঘটান যার ফলে প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিসমূহের ভিত গঠিত হয়। [৬] এরিস্টোটলীয় পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে, পদার্থবিজ্ঞান প্রমানিত গাণিতিক বিজ্ঞানের চেয়ে নিচু মানের কিন্তু তত্ত্বের দিক দিয়ে পদার্থবিজ্ঞান জ্যোতির্বিজ্ঞান এর চেয়ে বিশাল। এরিস্টটল এর মতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক বিষয় হচ্ছে গতি কিংবা অবস্থান পরিবর্তন। এ অবস্থান পরিবর্তনের সাথে তিনটি বিষয় সংশ্লিষ্ট এবং সেগুলো হলো কোনো কিছুর নিম্নাবস্থা, অভাব বোধ করা ও এর দরুন কোনো নতুন অবস্থার তৈরি করা। এরিস্টটলের দর্শনে তিনি ইঙ্গিত দেন যে মহাবিশ্বের চলনে অটল গতিশীল কোনো বস্তু ভূমিকা রাখে। কিন্তু পরবর্তীতে নিওপ্লেটোনিস্টরা প্রমান করে যে মহাবিশ্ব অসীম। এরও পরে আরব দার্শনিক আল কিন্দি যুক্তি দিয়ে দেখান যে মহাবিশ্ব অসীম এটি একটি অযৌক্তিক কথা। কারন কোনো কিছু অসীম হতে হলে তার একটি শুরু অবশ্যই থাকতে হবে। শুরু ছাড়া কোনো কিছু কখনো অসীম হতে পারে না।

এরিস্টটলের দার্শনিকতার অন্যতম প্রাচীন একটি মন্তব্য দেন আল ফারাবি। এরিস্টটলের দার্শনিকতার লক্ষ্যে আল ফারাবি মতামত দেন যে দার্শনিকতা শুধু প্রাকৃতিক সত্তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বরং এটি বিশ্বজনীন। [১]

আলোকবিজ্ঞান[সম্পাদনা]

ইবনে হায়থাম এর লিখিত বই Book of Optics এর কভার

পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম একটি ক্ষেত্র, আলোকবিজ্ঞান, এসময় দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হয়। নবম শতকের দিকে আলোকবিজ্ঞানে বিশেষত আয়নায় প্রতিফলন, জ্যামিতিক ও ভৌত আলোকবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। [৭]এগারো শতকে ইবনে হায়থাম কোনো কিছু দেখার ব্যাপারে গ্রিকের যে তত্ত্ব তাতে শুধু দ্বিমতই পোষণ করেননি বরং কীভাবে কোনো কিছু কেউ দেখে সেটি নিয়ে নতুন তত্ত্ব নিয়ে আসেন। [৮]

গণিতবিদ ও পদার্থবিদ ইবনে সাহল (৯০০-১০০০) ৯৮৪ সালে বার্নিং মিরোর্স এন্ড লেন্সেস নামক একটি বই লিখেন যাতে তিনি নিজের গবেষণা ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে বক্র আয়না ও লেন্স আলোকরশ্মিকে বাঁকায় ও ফোকাস করে। আলোর প্রতিসরণ সূত্র, যা বর্তমানে স্নেলের সূত্র নামে পরিচিত, সেই সূত্রটি আবিষ্কারের পেছনে মূল ভূমিকা ছিল ইবনে সাহলের এবং এজন্য তাঁকে যথেষ্ট কৃতিত্বও দেওয়া হয়েছিল।[৯][১০] সূত্রটি কাজে লাগিয়ে তিনি বিশেষ ধরনের লেন্স প্রস্তুত করেন যা আলোর জ্যামিতিক দিককে বাঁকিয়ে দেয় না। এ লেন্সের নামকরণ করা হয় অ্যানাক্লাস্টিক লেন্স।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Classical Arabic Philosophy An Anthology of Sources, Translated by Jon McGinnis and David C. Reisman. Indianapolis: Hackett Publishing Company, 2007. pg. xix
  2. Bakar, Osman. The History and Philosophy of Islamic Science. Cambridge: Islamic Texts Society, 1999. pg. 2
  3. Al-Khalili, Jim। "The 'first true scientist'"। ৫ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০০৯ 
  4. I.A., Ahmad (১৯৯৫)। "The Impact of the Qur'anic Conception of Astronomical Phenomena on Islamic Civilization" (পিডিএফ)Vistas in Astronomy। পৃষ্ঠা 395–403। ডিওআই:10.1016/0083-6656(95)00033-Xবিবকোড:1995VA.....39..395A 
  5. Thiele, Rüdiger (আগস্ট ২০০৫), "In Memoriam: Matthias Schramm, 1928–2005", Historia Mathematica, 32 (3): 271–274, ডিওআই:10.1016/j.hm.2005.05.002 
  6. . Islam, Science, and the Challenge of History. New Haven:Yale University Press. pg 57
  7. Dallal, Ahmad. Islam, Science, and the Challenge of History. New Haven: Yale University Press, 2010. pg. 38
  8. Dallal, Ahmad. Islam, Science, and the Challenge of History. New Haven:Yale University Press. pg 39
  9. K. B. Wolf, "Geometry and dynamics in refracting systems", European Journal of Physics 16, p. 14-20, 1995.
  10. R. Rashed, "A pioneer in anaclastics: Ibn Sahl on burning mirrors and lenses", Isis 81, p. 464–491, 1990.