মধ্যযুগীয় ইসলামে চক্ষুরোগ-চিকিৎসা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আরবী অক্ষরে লেখা একটি পান্ডুলিপি যার শিরোনাম "চোখের গঠনতত্ত্ব"

চক্ষুবিদ্যা মধ্যযুগীয় ইসলামিক রোগশাস্ত্র শাখার অন্যতম পুরোনো একটি শাখা। গ্রিক ডাক্তার ক্লডিয়াস গ্যালেনাস এর জীবদ্দশায় চক্ষু ডাক্তারির (আরবি উচ্চারণঃ কাহহাল)পেশাকে তেমন গুরুত্বসহকারে দেখা হতো না। মধ্যযুগের ইসলামিক চিকিৎসকগণ তখনকার সময়ের ডাক্তারি যন্ত্র, চিকিৎসা পদ্ধতি ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণ করে নিত্য নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন ও চোখের রোগ সারানোর জন্য তা সঠিকভাবে গড়ে তুলেছিলেন।[১] এগারো শতকের ইরাকের চক্ষু চিকিৎসকের আবিষ্কৃত ইঞ্জেকশন চোখের ছানি হতে নির্গত তরল নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহার করা হতো।

প্যানাস, ফ্লাইক্টেনুলা, গ্লুকোমার(গ্লুকোমাকে পিউপিলের মাথাব্যাথা হিসেবেও ডাকা হয়)মত বিভিন্ন চক্ষু রোগের ব্যাপারে সর্বপ্রথম মুসলিম চক্ষু চিকিৎসকেরা ধারণা দেন। এছাড়াও তারা সর্বপ্রথম কনজাংক্টিভা অপারেশন করেন এবং রেটিনা, ক্যাটারাক্টের(চোখের ছানি) মত শব্দ সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন।

শিক্ষা ও ইতিহাস[সম্পাদনা]

তখনকার সময়ে চিকিৎসাবিদ্যা অনুশীলনের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি ছিল না। এমনকি ওষুধের বিভিন্ন শাখার মধ্যেও ছিল না আশানুরূপ কোনো শ্রেণিবিভাগ। তবে কিছু কিছু ছাত্র বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নির্দিষ্ট কিছু রোগ ও তার ওষুধবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠত।

তবুও পূর্বপুরুষ বা গুরুদের চিকিৎসা পদ্ধতি জানা ও বোঝা যথেষ্ট প্রয়োজনীয় ছিল। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন উহানা ইবনে মাসাওয়াহ যিনি দ্য আল্টারেশন অফ দ্য আই বইটি লিখেছিলেন যা চক্ষুবিদ্যার অন্যতম পুরোনো ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। এরকমই আরেকটি বই লিখেছিলেন আরবের অন্যতম প্রভাবশালী শারীরবিদ হুনায়ুন ইবনে ইশাক, তাঁর বইয়ের নাম হলো দ্য টেন ট্রিটিসাইজেস অফ দ্য আই। তিনি বর্ণনা দিয়েছিলেন কেন মানুষের চোখের স্বচ্ছ লেন্স একেবারে চোখের মাঝামাঝি থাকে। [২]

চোখের ছানি[সম্পাদনা]

চক্ষুরোগবিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার হলো চোখের ছানি অপারেশন যার পদ্ধতি সম্পর্কে সর্বপ্রথম বলেন আরব চক্ষু চিকিৎসক আম্মার ইবনে আলি আল-মাওসিলি তাঁর লিখিত বই "দ্য চয়েজ অফ আই ডিজিসেস"-এ। তিনি চোষক পদ্ধতি ব্যবহার করে ছানি অপারেশন করেন। তিনি একটি ফাঁপা ধাতব সিরিঞ্জ তৈরি করেন ও সফলভাবে এটির চোষক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে চোখের ছানি অপসারণে সফল হন। তিনি তাঁর আবিষ্কারের বর্ণনা দেনঃ এরপরে আমি একটি ফাঁপা সুই তৈরি করি, কিন্তু তিবারিয়াসে আসার আগে পর্যন্ত আমি এটি কারো উপরে প্রয়োগ করিনি। সেখানে একটি রোগী আমার কাছে আসে এবং বলে "আমার সাথে যা খুশি করুন তবে আমি শুধু শুতে পারবো না।" এরপরে আমি তাকে আমার সেই সুঁই দিয়ে অপারেশন করি এবং ছানি অপসারণ করি। এবং সে তৎক্ষণাৎ চোখে পরিষ্কার দেখতে পায়, তাকে শোয়ানোর প্রয়োজনও পড়েনি তবে সে ঘুমিয়েছিল যেভাবে সে চেয়েছিল। আমি শুধু তার চোখ ৭ দিনের জন্য ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলাম। আমাকে এই সুঁইয়ের জন্য কেউ কিছু বলেনি। এটি দিয়ে আমি মিসরে অনেক অপারেশন করেছি। [৩]}}

অন্যান্য অবদান[সম্পাদনা]

ইবনে সিনা (আভিসেনা) ১০২৫ সালে তার লিখিত বই দ্য ক্যানন অফ মেডিসিনে দৃষ্টিকে পঞ্চইন্দ্রিয়ের এক ইন্দ্রিয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। "রেটিনা" শব্দটিও তিনি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। তবে রেটিনা হিসেবে নয়, শব্দটির আরবি মূল শব্দ থেকে পরবর্তীতে শব্দটিকে রেটিনা হিসেবে উচ্চারণ করা হয়। [৪]

বিখ্যাত আরব পণ্ডিত ইবনে রুশদ (এভেরোস) রেটিনার ফটোরিসেপ্টর কোষ আবিষ্কার করেন। এছাড়াও তিনি সর্বপ্রথম ধারণা করেন দৃষ্টির প্রধান দর্শন অঙ্গ হলো আরাকনইড মেমব্রেন বা আরেনিয়া। ষোল শতকে সমগ্র ইউরোপে এ নিয়ে আলোচনা চলে যে দর্শনের প্রধান অঙ্গ গ্যালেনিক ক্রিস্টালাইন হিউমার নাকি আরেনিয়া। অবশেষে গবেষণার ফলাফলে বের হয়ে আসে যে, দুইটি ধারণাই ভুল। প্রধান দর্শন অঙ্গ হলো রেটিনা। [৫]

ইবনে আল নাফিস চক্ষুবিদ্যার উপরে বিশাল একটি পাঠ্যবই লিখে গেছেন যার নাম দ্য পলিশড বুক অন এক্সপেরিমেন্টাল অপথালমোলজি। বইটি দুইটি শাখায় বিভক্তঃ চক্ষুরোগবিদ্যার তত্ত্ব এবং সংশ্লিষ্ট রোগের মৌলিক ও যৌগিক ওষুধের বর্ণনা। এছাড়াও মধ্যযুগের আরো কিছু চক্ষুরোগবিদ্যা বিষয়ক ইসলামি পণ্ডিত কর্তৃক লিখিত বই রেজেসের কন্টিনেন্স, আলি ইবনে ইসা আল কাহহালের নোটবুক অফ দা অকিউলিস্টস, জিব্রাইল বুখতিসুর মেডিসিন অফ দ্য আই উল্লেখযোগ্য।

অটোমান সাম্রাজ্য[সম্পাদনা]

অটোমান সাম্রাজ্যে, বিশেষ করে তুর্কিতে সন্স অফ দ্য সোয়ালো দলের কয়েকজন শল্যচিকিৎসক বিশেষ ধরনের ছুরি নিয়ে চোখের ছানি অপারেশন করত। সমসাময়িক উৎস থেকে ধারণা পাওয়া গেছে যে উক্ত শল্যচিকিৎসক দলের অপারেশন সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ ছিল না।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

  • উইয়ুন আল আন্বা ফি' তাবাক্বাত আল আতিবা [অ্যা লিটারারি হিস্ট্রি অব মেডিসিন] (ইংরেজি ভাষায়)। লেইডেন:ব্রিল পাবলিশার্স। ২০০১। আইএসবিএন 978-9004410312 

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. David C. Lindberg (১৯৮০), Science in the Middle Ages, University of Chicago Press, পৃষ্ঠা 21, আইএসবিএন 0-226-48233-2 
  2. Leffler CT, Hadi TM, Udupa A, Schwartz SG, Schwartz D (২০১৬)। "A medieval fallacy: the crystalline lens in the center of the eye"Clinical Ophthalmology2016 (10): 649–662। ডিওআই:10.2147/OPTH.S100708পিএমআইডি 27114699পিএমসি 4833360অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  3. Finger, Stanley (১৯৯৪), Origins of Neuroscience: A History of Explorations Into Brain Function, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 70, আইএসবিএন 0-19-514694-8 
  4. Finger, Stanley (১৯৯৪), Origins of Neuroscience: A History of Explorations Into Brain Function, Oxford University Press, পৃষ্ঠা 69, আইএসবিএন 0-19-514694-8 
  5. Lindberg, David C. (১৯৮১), Theories of Vision from Al-Kindi to Kepler, University of Chicago Press, পৃষ্ঠা 238, আইএসবিএন 0-226-48235-9