তন্ত্র
হিন্দুধর্ম |
---|
ধারাবাহিকের অংশ |
তন্ত্র হলো ভারতে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পর প্রচলিত এক বিশেষ ধরনের উপাসনা ও সাধনপদ্ধতির নাম।[১] "তন্ত্র" বেদের শেষাংস থেকে সৃষ্টি যাকে আগম বলে আর বেদকে নিগম বলে।[২] হিন্দু, তিব্বতীয় বোন, দাও তথা জাপানের শিন্টো, বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদগুলিকে এবং পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রেশম পথে বৌদ্ধধর্মের সম্প্রসারণে তন্ত্র বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল।[৩]
তন্ত্র পরম্পরাগত মাধ্যমে যুক্ত একটি আগমশাস্ত্র। ভারতীয় পরম্পরায়, যে কোনো ব্যবস্থিত গ্রন্থ, সিদ্ধান্ত, বিধি, উপকরণ, কলাকৌশল বা কার্যপ্রণালীকেও তন্ত্র বলা হয়।[৪][৫]
হিন্দু ঐতিহ্যে, তন্ত্র প্রধানত শাক্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত, তারপর শৈব সম্প্রদায়, ও কিছু ক্ষেত্রে বৈষ্ণব পরম্পরার সাথেও সম্পৃক্ত।[৬] শৈব পরম্পরায় তন্ত্র গ্রন্থের বক্তা সাধারণত মহাদেব শিব, যেখানে তিনি দেবী পার্বতীর তন্ত্রসম্বন্ধীয় প্রশ্নের বিধিগত উপদেশমূলক উত্তর প্রদান করেন। বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান সম্প্রদায় তাঁদের তন্ত্র-সম্বন্ধিত নীতি, কর্মপদ্ধতি ও সাহিত্যের জন্য প্রসিদ্ধ।
তন্ত্র-এর আক্ষরিক উদ্ভব মনে করা হয় এরূপে - “তনোতি ত্রায়তি তন্ত্র”।
তন্ত্রশাস্ত্রকে উত্তর-বৈদিক যুগের রচনা বলে মনে করা হয়, যার বিকাশলাভ প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগের কাছাকাছি সময়ে ঘটেছিল। সাহিত্যরূপে যেভাবে পুরাণ গ্রন্থকে মধ্যযুগীয় দার্শনিক-ধার্মিক রচনা হিসাবে মান্য করা হয়ে থাকে, সেভাবেই তন্ত্রশাস্ত্রে প্রাচীন আখ্যান, কাহিনি ইত্যাদির সমাবেশ রয়েছে। বিষয়বস্তুগত দৃষ্টিতে একে ধর্ম, দর্শন, সৃষ্টিরচনা শাস্ত্র, প্রাচীন বিজ্ঞান ইত্যাদির বিশ্বকোষও বলা যেতে পারে। ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা তাঁদের ঔপনিবেশিকতাবাদী উদ্দেশ্যসাধনে তন্ত্রকে 'গুহ্য সাধনা' (esoteric practice) বা 'সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপ' আখ্যা দিয়ে দিগভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। [৭][৮][৯]
বস্তুত তন্ত্রগ্রন্থের সংখ্যা সহস্রাধিক, কিন্তু প্রধান-প্রধান তন্ত্র ৬৪টি বলা হয়ে থাকে। তন্ত্রের প্রভাব যে বিশ্বস্তরীয়, তার প্রমাণ হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, তিব্বতি ইত্যাদি ধর্মের তন্ত্র-সাধনার গ্রন্থসমূহ। ভারতে প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গ, বিহার ও রাজস্থান তন্ত্রের মুখ্যপীঠ ছিল।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]ব্যাকরণ শাস্ত্র অনুসারে, 'তন্ত্র' শব্দটি 'তন্' ধাতু নিষ্পন্ন যার অর্থ 'বিস্তার'। শৈব সিদ্ধান্তের 'কায়িক আগম' -এ এর অর্থ দেওয়া হয়েছে — তন্যতে বিস্তার্যতে জ্ঞানম্ অনেন্, ইতি তন্ত্রম্ (সেই শাস্ত্র যার দ্বারা জ্ঞানের বিস্তার করা হয়)। তন্ত্রের নিরুক্তি ‘তন’ (বিস্তার করা) এবং ‘ত্রৈ’ (রক্ষা করা), এই দুই ধাতুর সংযোগে সিদ্ধ হয়। অর্থাৎ, তন্ত্র সামগ্রিকভাবে জ্ঞানের বিস্তার করা ছাড়াও এর ব্যবহারকারীকে 'ত্রাণ' (রক্ষা) -ও করে থাকে।
তন্ত্রশাস্ত্রের আরেক নাম 'আগমশাস্ত্র'ও বটে। এই বিষয়ে বলা হয়েছে যে,
আগমাত্ শিববক্রাত্ গতং চ গিরিজা মুখম্।
সম্মতং বাসুদেবেন আগমঃ ইতি কথ্যতে।।
বাচস্পতি মিশ্র তাঁর যোগভাষ্যের তত্ববৈশারদী ব্যাখ্যায় 'আগম' শব্দের অর্থ করতে গিয়ে লিখেছেন যে, যার দ্বারা অভ্যুদয় (লৌকিক কল্যাণ) ও নিঃশ্রেয়স (মোক্ষ) -এর উপায় বুদ্ধিগোচর হয়, তাকে 'আগম' বলা হয়।
তন্ত্র বা আগমে ব্যবহারই মুুখ্য; তন্ত্রে ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানের প্রতি জোর দেওয়া হয়। তন্ত্রশাস্ত্রের যে সাতটি লক্ষণ রয়েছে, তাতে জ্ঞান, কর্ম ও উপাসনার ব্যবহারিক বা আচরণীয় উপায়ের রূপ বর্ণিত হয়েছে। এই সাতটি লক্ষণ হল:
- সৃষ্টি
- প্রত্যয়
- দেবার্চনা
- সর্বসাধন (সিদ্ধিসমূহ প্রাপ্ত করার উপায়)
- পুরশ্চরণ (মারণ, মোহন, উচাটন ইত্যাদি ক্রিয়াসমূহ)
- ষটকর্ম (শান্তি, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচাটন ও মারণের প্রক্রিয়া) তথা,
- ধ্যান (ইষ্টদেবতার স্বরূপ একাগ্র তল্লীন মনে চিন্তন)
তন্ত্রের দৃষ্টিতে শরীর প্রধান নিমিত্ত; শরীর ছাড়া চেতনার উচ্চস্তরে পৌঁছানো যায় না। এজন্য তন্ত্রের গূঢ়ার্থ নিজ 'তন' বা দেহের মাধ্যমে আপন আত্মার 'ত্রাণ' বা উদ্ধারও বলা হয়ে থাকে। বাস্তবক্ষেত্রে, তন্ত্রসাধনায় শরীর, মন ও কায়-কলেবরের সূক্ষতম স্তরের সুসমন্বিত ব্যবহার ঘটে। তবে এটি অবশ্যই সত্য যে, তন্ত্রে শরীরকে মন, বুদ্ধি ও চেতনার সমানই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]টীকা
[সম্পাদনা]পাদটীকা
[সম্পাদনা]- ↑ Einoo, Shingo (ed.) (২০০৯)। Genesis and Development of Tantrism। University of Tokyo। পৃষ্ঠা 45।
- ↑ Banerjee, S.C., 1988.
- ↑ White 2000, পৃ. 7।
- ↑ Ron Barrett (2008). Aghor Medicine. University of California Press. p. 12. ISBN 978-0-520-25218-9.
- ↑ Flood 2006, pp. 9–14.
- ↑ Flood 2006, pp. 7–8, 61, 102–103.
- ↑ Padoux 2002, পৃ. 17।
- ↑ White 2005, পৃ. 8984।
- ↑ Gray 2016, পৃ. 3-4।
- ↑ Richard K. Payne (২০০৬)। Tantric Buddhism in East Asia। Simon and Schuster। পৃষ্ঠা 130–131। আইএসবিএন 978-0-86171-487-2।
- ↑ Teun Goudriaan 1981, পৃ. 1-8।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- Avalon, Arthur (১৯১৮)। Sakti and Sakta। Ganesh and Co।
- Avalon, Arthur (১৯৭২)। Tantra of the great liberation – Mahanirvana Tantra। New York: Dover publications। আইএসবিএন 0-486-20150-3।
- Bhattacharyya, N. N. (১৯৯৯)। History of the Tantric Religion। New Delhi: Manohar। আইএসবিএন 81-7304-025-7। Second Revised Edition
- Bühnemann, Gudrun (১৯৮৮)। The Worship of Mahāgaṇapati According to the Nityotsava। Institut für Indologie। আইএসবিএন 81-86218-12-2। First Indian Edition, Kant Publications, 2003.
- Harper, Katherine Anne (ed.) (২০০২)। The Roots of Tantra। State University of New York Press। আইএসবিএন 0-7914-5306-5। অজানা প্যারামিটার
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য) - Norbu, Chögyal Namkhai (১৯৯৯)। The Crystal and The Way of Light: Sutra, Tantra and Dzogchen। Snow Lion Publications। আইএসবিএন 1559391359।
- Saraswati, Swami Satyananda (২০০০)। Sure Ways to Self Realization। Yoga Publications Trust। আইএসবিএন 8185787417।
- Urban, Hugh (২০০৩)। Tantra: Sex, Secrecy, Politics, and Power in the Study of Religions। University of California Press। আইএসবিএন 0520236564।
- Wangyal Rinpoche, Tenzin (১৯৯৮)। The Tibetan Yogas of Dream and Sleep। N.Y.: Snow Lion Publications। আইএসবিএন 1559391014। অজানা প্যারামিটার
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য) - White, David Gordon (ed.) (২০০০)। Tantra in Practice। Princeton University Press। আইএসবিএন 0-691-05779-6।
- Winternitz, Maurice (১৯৭২)। History of Indian Literature। New Delhi: Oriental Books Reprint Corporation। Second revised reprint edition. Two volumes. First published 1927 by the University of Calcutta.
- Yeshe, Lama Thubten (১৯৮৭)। Introduction to Tantra:The Transformation of Desire (2001, revised সংস্করণ)। Boston: Wisdom Publications। আইএসবিএন 0-86171-162-9।
আরও পড়ুন
[সম্পাদনা]- Anandamurti, Shrii Shrii (১৯৫৯)। Tantra and its Effect on Society। Ananda Marga Pubs।
- Anandamurti, Shrii Shrii (Ac. Vijayananda Avt. Editor) (১৯৯৪)। Discourses on Tantra। 1। AMPS-Ananda Printers। আইএসবিএন 978-8-172-52012-0।
- Anandamurti, Shrii Shrii (Ac. Vijayananda Avt. Editor) (১৯৯৪)। Discourses on Tantra, vol. 2। AMPS-Ananda Printers। আইএসবিএন 81-7252-022-0।
- Anandamurti, Shrii Shrii (Ac. Narayanananda Avt. Editor, Ac. Vijayananda Avt. transl. from Bengali)) (১৯৮৫)। Namah Shivaya Shantaya। AMPS-Ananda Printers। আইএসবিএন 81-7252-098-0।
- Tantric Hieroglyphics I (April 1960) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে by S. Srikanta Sastri, Quarterly Journal of Mythic Society
- Tantric Hieroglyphics II (July 1960) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৬ আগস্ট ২০১৪ তারিখে by S. Srikanta Sastri, Quarterly Journal of Mythic Society
- Tantric Hieroglyphics III (Dec 1974) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৯ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে by S. Srikanta Sastri, Quarterly Journal of Mythic Society
- Tantric Hieroglyphics IV (March 1975) ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখে by S. Srikanta Sastri, Quarterly Journal of Mythic Society
- Arnold, Edward A., সম্পাদক (২০০৯)। As Long As Space Endures: Essays on the Kalacakra Tantra in Honor of H.H. the Dalai Lama। Ithaca, NY: Snow Lion Publications। আইএসবিএন 978-1-55939-303-4।
- Avalon, Arthur (১৯২৮)। The Serpent Power। Ganesh & Co.। আইএসবিএন 81-85988-05-6।
- Bagchi, P.C. (১৯৮৬)। Kaulajnana-nirnaya of the School of Matsyendranath Varanasi: Prachya Prakashan। Michael Magee, transl।
- Davidson, Ronald M. (২০০৩)। Indian Esoteric Buddhism: A Social History of the Tantric Movement। New York: Columbia University Press। আইএসবিএন 81-208-1991-8।
- Davidson, Ronald M. (২০০৫)। Tibetan Renaissance: Tantric Buddhism in the Rebirth of Tibetan Culture। New York: Columbia University Press। আইএসবিএন 0-231-13471-1।
- Feuerstein, Georg (১৯৯৮)। Tantra: The Path of Ecstasy। Boston: Shambhala। আইএসবিএন 1-57062-304-X।
- Guenon, Rene (২০০৪)। Studies in Hinduism: Collected Works (2nd সংস্করণ)। Sophia Perennis। আইএসবিএন 978-0-900588-69-3।
- Gyatso, Geshe Kelsang (২০০৩)। Tantric Grounds and Paths। Tharpa Publications। আইএসবিএন 978-0-948006-33-3।
- Gyatso, Geshe Kelsang (২০০৫)। Mahamudra Tantra। Tharpa Publications। আইএসবিএন 978-0-948006-93-7।
- Gyatso, Tenzin (১৯৮৭)। Deity Yoga। Ithaca, NY: Snow Lion Publications। আইএসবিএন 0-937938-50-5। অজানা প্যারামিটার
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য) - Kane, Pandurang Vaman। History of Dharmashastra। Pune: Bhandarkar Oriental Research Institute।
- Magee, Michael, tr. (১৯৮৪)। Yoni Tantra।
- Mahendranath, Shri Gurudev (১৯৯০)। The Scrolls of Mahendranath। Seattle: International Nath Order।
- McDaniel, June (২০০৪)। Offering Flowers, Feeding Skulls: Popular Goddess Worship in West Bengal। New York: Oxford University Press।
- Mookerji, Ajit (১৯৯৭)। The Tantric Way: Art, Science, Ritual। London: Thames & Hudson।
- Rao, T. A. Gopinatha (১৯৮১)। Elements in Hindu Iconography। 1। Madras: Law Printing House।
- Smith, Frederick M. (2006). The Self Possessed: Deity and Spirit Possession in South Asian Literature. Columbia University Press, USA. আইএসবিএন ০-২৩১-১৩৭৪৮-৬.
- Urban, Hugh (২০০২)। "The Conservative Character of Tantra: Secrecy, Sacrifice and This-Worldly Power in Bengali Śākta Tantra"। International Journal of Tantric Studies। 6 (1)।
- Walker, Benjamin (১৯৮২)। Tantrism: Its Secret Principles and Practices। London: Acquarian Press। আইএসবিএন 0-85030-272-2।
- Wallis, Glenn (২০০২)। Mediating the Power of Buddhas: Ritual in the Mañjuśrīmūlakalpa। Albany: State University of New York Press।
- White, David Gordon (২০০৩)। Kiss of the Yogini: "Tantric Sex" in its South Asian Contexts। Chicago: University of Chicago Press।
- White, David Gordon (১৯৯৮)। The Alchemical Body: Siddha Traditions in Medieval India। Chicago: University of Chicago Press।
- Woodroffe, John (১৯১৩)। Mahanirvana Tantra: Tantra of the Great Liberation। Arthur Avalon, transl। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১৩, ২০১০।