বিষয়বস্তুতে চলুন

খিলাফত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(খলিফা থেকে পুনর্নির্দেশিত)

খিলাফত (আরবি: خِلَافَةْ [xi'laːfah]) একটি ইসলামি প্রতিষ্ঠান বা সরকারি দপ্তর, যেটি খলিফা (/ˈkælɪf, ˈk-/; خَلِيفَةْ khalīfa [xæ'liːfæh], উচ্চারণ) উপাধিধারী মুসলিম বৈশ্বিক বা কেন্দ্রীয় আমিরের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।[][][] খলিফা রাজনীতি-ধর্মীয়ভাবে ইসলাম ধর্মের নবি মুহাম্মাদের উত্তরসূরি ও সমগ্র মুসলিম বিশ্বের (উম্মাহ) নেতৃত্ব প্রদান করেন।[] ঐতিহাসিকভাবে, খেলাফতগুলি ইসলামের উপর ভিত্তি করে রাজনীতিতে ছিল, যেগুলি বহু-জাতিগত স্থানীয় রাষ্ট্রীয় সত্তার উর্ধ্বে গিয়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যে বিকশিত হয়েছিল।[][]

মধ্যযুগীয় সময়কালে তিনটি প্রধান খিলাফত ক্ষমতায় ছিল  খিলাফতে রাশিদা (৬৩২-৬৬১), উমাইয়া খিলাফত (৬৬১-৭৫০), এবং আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০-১৫১৭)। চতুর্থ প্রধান খিলাফত ছিল উসমানীয় খিলাফত, যেটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানরা ১৫১৭ থেকে ১৯২৪ সালে তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষকরণের অংশ হিসাবে উসমানীয় খিলাফত আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত খলিফার কর্তৃত্ব দাবি করেছিল। একই সময়ে শরিফীয় খিলাফত খিলাফত ও খলিফার উপাধি সংরক্ষণ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু এই খিলাফতটি নজদের সালতানাতের (বর্তমান সৌদি আরব) হাতে পরাজিত হওয়ার পর দ্রুত পতন ঘটে এবং দাবিটি সুপ্ত অবস্থায় চলে যায়। পুরো ইসলামের ইতিহাসে আরও কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র নিজেদেরকে খিলাফত বলে দাবি করেছিল, যার প্রায় সবকটিই বংশগত রাজতন্ত্র ছিল।

সব মুসলিম রাষ্ট্রে খেলাফত ছিল না। সুন্নি মুসলিমরা শর্ত দেন যে, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে খলিফাকে মুসলমান বা তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত হতে হবে।[] অপরদিকে শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, খলিফাকে আহলে বাইত ("নবি পরিবার") থেকে আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত ইমাম হওয়া উচিত। ইতিহাসে কিছু প্রভাবহীন খিলাফত শিয়া মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে, যেমন ফাতেমীয় খিলাফত (৯০৯-১১৭১)। ২০ শতকের শেষ থেকে ২১ শতকের গোড়ার দিকে, সোভিয়েত দ্বারা আফগানিস্তানে আক্রমণ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং আরব বসন্তের পরিপ্রেক্ষিতে, বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল খিলাফত দাবি করেছে। সাম্প্রতিক সময় মুসলিমদের মধ্যে খিলাফতের বিষয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।

ব্যুৎপত্তি

[সম্পাদনা]

ইসলামের আবির্ভাবের আগে, আরবীয় রাজারা ঐতিহ্যগতভাবে মালিক 'বাদশাহ' উপাধি ব্যবহার করতেন বা একই সেমিটিক মূল থেকে অন্য একটি উপাধি ব্যবহার করতেন।[] খলিফাহ (خَليفة, উচ্চারণ) আরবি শব্দ, যার অর্থ 'উত্তরাধিকারী', 'স্টুয়ার্ড', বা 'ডেপুটি'—এবং ঐতিহ্যগতভাবে খলিফা শব্দটিকে খলিফাতু রাসুলিল্লাহ (আল্লাহর রাসুলের উত্তরসূরি) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যাইহোক, প্রাক-ইসলামী গ্রন্থের অধ্যয়ন থেকে জানা যায় যে এই শব্দগুচ্ছটির আসল অর্থ ছিল 'ঈশ্বরের দ্বারা নির্বাচিত উত্তরাধিকারী'।[]

খলিফা হওয়ার শর্তাবলি

[সম্পাদনা]

শর্তগুলোর প্রধান কয়েকটি হলো:

  • মুসলিম হওয়া
  • প্রাপ্তবয়ষ্ক হওয়া
  • পুরুষ হওয়া
  • স্বাধীন হওয়া
  • ন্যায়পরায়ণ হওয়া
  • বিবেকসম্পন্ন হওয়া
  • কুরাইশ বংশীয় হওয়া
  • জ্ঞান (ইলম) থাকা

কুরআনে উল্লেখ

[সম্পাদনা]

কুরআনে নবি দাউদকে খিলাফত দেয়া প্রসঙ্গে বলা হয়েছে,

"হে দাউদ, নিশ্চয় আমি তোমাকে জমিনে খলিফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো, আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়, তাদের জন্য কঠিন আজাব রয়েছে। কারণ তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল।"

খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পদ্ধতি

[সম্পাদনা]
  1. শূরা পরিষদের পরামর্শের ভিত্তিতে নিযুক্ত হওয়া
  2. পূর্বের খলিফার একক সিদ্ধান্তে নিযুক্ত হওয়া

বাইআত

[সম্পাদনা]

ইসলামে বাই'আত হলো আল্লাহর অবাধ্যতা ছাড়া[টীকা ১] খলিফার আনুগত্য করার উপর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া।

খলিফাকে অপসারণ

[সম্পাদনা]

যেসব কারণে খলিফাকে অপসারণ করা হয়:

  1. কুফরী করলে বা ইসলাম পরিত্যাগ করলে
  2. সালাত পরিত্যাগ করলে বা সালাতের প্রতি আহ্বান পরিত্যাগ করলে
  3. আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন না করলে
  4. বিবেকবুদ্ধি লোপ পেলে বা শারীরিকভাবে অক্ষম হলে

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা খলিফাকে অপসারণ করে নতুন খলিফা নিযুক্ত করবেন।

বিদ্রোহ

[সম্পাদনা]

সুস্পষ্ট কুফরে লিপ্ত শাসকের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মাধ্যমে বিদ্রোহ করা ইসলামে বৈধ যদি সামর্থ থাকে, কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।[]

ইসলামি খিলাফাতের ইতিহাস

[সম্পাদনা]
খোলাফায় রাশিদুনের সময়ের সর্বোচ্চ বিস্তার
  ৬২২ থেকে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মহানবি হজরত মুহাম্মাদ -এর অধীনে ইসলামের সম্প্রসারণ।
   ৬৩২ থেকে ৬৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাশিদুন খিলাফতের অধীনে ইসলামের সম্প্রসারণ।
  ৬৬১ থেকে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উমাইয়া খিলাফতের অধীনে ইসলামের সম্প্রসারণ।

৬২২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলামের নবি ও রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)মদিনায় প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করে খেলাফতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। তার মৃত্যুর পর পরবর্তী খলিফা সাহাবি আবু বকর নির্বাচিত হন এবং ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে রাশিদুন খিলাফত প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর সাহাবি মুয়াবিয়া কর্তৃক উমাইয়া খিলাফত প্রতিষ্ঠা হয়। উমাইয়া খিলাফতের পর আব্বাসীয় খিলাফত ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা হয়।[][১০] ১২৫৮ সালে মঙ্গোলদের আক্রমণে খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস হয় ও খেলাফত বিলুপ্ত হয়। মিশরের মামলুক শাসকদের দ্বারা পুনরায় আব্বাসীয় খেলাফত পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৫১৭ উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান প্রথম সেলিমের কাছে মিশরের আব্বাসী খলিফা কর্তৃক খেলাফত হস্তান্তরিত হলে উসমানীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়।[১১] যদিও প্রথম মুরাদ (১৩৬২-১৩৮৯)[১২] সালে মামলুক সালতানাতের বৈধ দাবিদার না থাকায় খিলাফাতের দাবি করে। ১৯০৯ সালে তরুণ তুর্কি বিপ্লব এর মাধ্যমে খলিফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ অপসারণ এবং ১৯১৮ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ মিত্র বাহিনী ও আরব বিদ্রোহ জাতীয়তাবাদীদের হাতে উসমানী খেলাফত বিলুপ্তির মুখে পড়ে। ১৯২৪ সালে সর্বশেষ খলিফা দ্বিতীয় আবদুল মজিদকে নির্বাসিত করে কামাল আতাতুর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে খিলাফত বিলুপ্ত করে।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]
  1. খলিফা আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার আদেশ করলে তা মানা বৈধ নয়।

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Hassan, Mona (২০১৬)। "CONCEPTUALIZING THE CALIPHATE, 632–1517 CE"। Longing for the Lost Caliphate: A Transregional History। Princeton University Press। পৃ. ৯৮–১৪১। জেস্টোর j.ctt1q1xrgm.9
  2. March, Andrew F. (২০১৯)। The Caliphate of Man: Popular Sovereignty in Modern Islamic Thought। Cambridge, MA: Harvard University Press। ডিওআই:10.2307/j.ctvp2n3msআইএসবিএন ৯৭৮-০-৬৭৪-৯৮৭৮৩-৮জেস্টোর j.ctvp2n3msএস২সিআইডি 204443322
  3. টেমপ্লেট:The Abbasid Caliphate: A History
  4. 1 2 3 Bowering, Gerhard; Crone, Patricia; Mirza, Mahan (২০১৩)। "caliph, caliphate"। The Princeton Encyclopedia of Islamic Political Thought। Princeton University Press। পৃ. ৮৭। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৬৯১-১৩৪৮৪-০
  5. Al-Rasheed, Madawi; Kersten, Carool; Shterin, Marat (২০১২)। Demystifying the Caliphate: Historical Memory and Contemporary Contexts। Oxford University Press। পৃ. ৩। আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৯-৯৩২৭৯৫-৯
  6. Ringmar, Erik (২০২০)। "4. The Muslim Caliphates"History of International Relations। OBP collection। Open Book Publishers। পৃ. ৭৩–১০০। আইএসবিএন ৯৭৮-১-৭৮৩৭৪-০২৪-৬। ৭ এপ্রিল ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০২২
  7. "The Roots of Democracy in Islam"। Irfi.org। ১৬ ডিসেম্বর ২০০২। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জুন ২০১৪
  8. "শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার বিধান"ইসলামকিউএ.ইনফো
  9. Cavendish, Marshall (২০১০)। "6"Islamic Beliefs, Practices, and Cultures। পৃ. ১২৯। আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭৬১৪-৭৯২৬-০
  10. Blankinship, Khalid Yahya (১৯৯৪), The End of the Jihad State, the Reign of Hisham Ibn 'Abd-al Malik and the collapse of the Umayyads, State University of New York Press, পৃ. ৩৭, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭৯১৪-১৮২৭-৭
  11. "caliph – Islamic title"Encyclopædia Britannica
  12. Lambton, Ann; Lewis, Bernard (১৯৯৫)। The Cambridge History of Islam: The Indian sub-continent, South-East Asia, Africa and the Muslim west। খণ্ড ২। Cambridge University Press। পৃ. ৩২০। আইএসবিএন ৯৭৮০৫২১২২৩১০২

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]