হাজী শরীয়তুল্লাহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
হাজী শরীয়তুল্লাহ
হাজী শরীয়তুল্লাহ
জন্ম১৭৮১
মৃত্যু১৮৪০
বাহাদুরপুর
ঢাকা জেলা
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
পরিচিতির কারণফরায়েজি আন্দোলন
সন্তানদুদু মিয়া (মুহাম্মদ মহসীন)
পিতা-মাতা
  • আব্দুল জলিল তালুকদার (পিতা)

হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) ধর্মীয় সংস্কারক, নীলকর ও সামন্তবাদ বিরোধী নেতা এবং ভারতবর্ষে সংঘটিত ফরায়েজি আন্দোলনের মুখপাত্র। তিনি শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং কৃষক, তাঁতি এং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি চেয়ে ছিলেন মুসলমানদের মাঝে দিনে দিনে যে ধর্মীয় কুসংস্কার প্রবেশ করেছে তা উচ্ছেদ করে তাদের ইসলামের মূল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। অনেকের মতে, তিনি ওয়াহাবি আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ইসলামের প্রধান করণীয় কাজকে বলে 'ফরজ'। এচিন্তা থেকেই তার সংস্কার আন্দোলনের নাম হয় 'ফরায়েজি আন্দোলন'।[১]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

শরীয়তুল্লাহর জন্ম ততৎকালীন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনাধীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ফরিদপুর জেলার চর শামাইল গ্রামের এক দরিদ্র তালুকদার পরিবারে। ছেলেবেলায় তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। তিনি তার গুরু মওলানা বাশারত আলীর সাথে ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় হজের উদ্দেশ্যে গমন করেন, এবং ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে দেশে ফিরে আসেন। তিনি আরবি ভাষায় পণ্ডিত ছিলেন।

ফরায়েজি আন্দোলন[সম্পাদনা]

বাংলার মুসলমানদের মাঝে বেশ কিছু সংখ্যক ছিল ধরমান্তরিত। তাই মুসলমান হওয়ার পরো স্বাভাবিক ভাবে তাদের মধ্যে পূর্বধরম ও সংস্কৃতির অনেক কিছুর প্রভাব থেকেই যায়। এগুলো প্রকট হয়ে দেখা দেয় বাংলায় ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে। মক্কায় তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ এবং সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে তিনি সংকল্পবদ্ধ হন যে, দেশে ফিরে তিনি সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হবেন। তাই তিনি মক্কা থেকে দেশে ফিরে সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন।উনিশ শতকের প্রথম দিকে এ অঞ্চলে তার নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা ফরায়েজি আন্দোলন নামে পরিচিত। তিনি দুই রকম পাপ থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার কথা বলেন। প্রথমটি 'শিরক' আর দ্বিতীয়টি হলো 'বেদাত'। এই লক্ষ্যে তিনি মুসলমানদের দুই দফা নির্দেশনা দেন-

(১) আত্মবিশ্বাস জাগ্রতকরণ : এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা। কারণ সে সময়ের মুসলমান সমাজ প্রবর্তিত পীর পূজা,কবর পূজা,মনসা পূজা,শীতলা পূজা ইত্যাদি নানা ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড দ্বারা গোটা বাংলার মুসলমান সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মুসলমানদের জীবন ব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কার গুলো বিদূরিত করে কুরআন ও সুন্নাহ মতে জীবন যাপনে উদ্ধুদ্ধ করা[২] এবং ইসলামের " ফরজ" কাজ গুলো অবশ্যম্ভাবী পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানান। আর এই "ফরজ" কথাটি থেকেই ফরায়েজি শব্দটি এসেছে।

(২)মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা: তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দূরবীক্ষণ দ্বারা অনুভব করেছিলেন যে, ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ছাড়া ভারতবর্ষের জনগণের মুক্তি অসম্ভব। আর এজন্য তিনি দরিদ্র কৃষক,তাতি শোষক শ্রেণীকে মহাজন,জমিদার নীলকর বণিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং আরবের ওয়াহাবী আন্দোলনের আদলে ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। নীলকর ও অত্যাচারী জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতেন। তার প্রবর্তিত ধর্মমত ছিল আধুনিক ও মানবতাবদী[৩] তৎকালীন সমাজের উৎপীড়নমূলক নিয়ম রদ করে ভন্ড মোল্লা মৌলবীদের হাত থেকে তার শিষ্যদের রক্ষা করেন। একারণে রক্ষণশীল ধনী মুসলমানগনেরা তাকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। ফরিদপুরঢাকা জেলার অসংখ্য কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিল। তার ছেলে দুদু মিয়াও একজন ঐতিহাসিক যোদ্ধা ও ফরায়েজি আন্দোলন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব।[৪] তিনি নীলকরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্রিটিশদের তাড়ানোতে ভূমিকা রেখেছিলেন।

হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন নি। বরং তিনি চেয়ে ছিলেন ধ্রমীয় জীবনে পরিশুদ্ধির মাধ্যমে মুসলমানরা যেন নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে।[১]

সম্মননা[সম্পাদনা]

শরীয়তুল্লাহ'র নামানুসারে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে।[৪][৫] এছাড়া তার নামে মাদারিপুরের শিবচরে আড়িয়াল খাঁ নদের উপরে নির্মিত সেতুটির নাম করণ করা হয়েছে হাজী শরীয়তউল্লাহ সেতু যা ৪৫০ মিটার দীর্ঘ।[৬] ১০ মার্চ ১৯৯৩ সালে তার নামে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ডাকটিকিট বের করে। তার জীবনী একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় এতে শরিয়তুল্লাহ চরিত্রে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন।[৭]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

হাজী শরীয়ত উল্লাহ ১৮৪০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বর্তমানে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃতদেহ জন্মস্থান চর শামাইলে সমাহিত করা হয়। আড়িয়াল খা নদীর ভাঙ্গনের ফলে হাজী শরীয়ত উল্লাহর কবর নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবে বাহদুরপুর মাদ্রাসা-মসজিদ প্রাঙ্গনে পারিবারিক কবরস্থানে পুত্র দুদু মিয়াসহ অন্যান্যদের কবর রয়েছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. প্রথম খন্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু (২০০২)। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। কলকাতা: সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ৫১৩। 
  2. Hua, Shiping। Islam and Democratization in Asia। Aligarh: Cambria Press। পৃষ্ঠা 160। আইএসবিএন 978-1621969006 
  3. Uddin, Sufia M. (২০০৬)। Constructing Bangladesh: Religion, Ethnicity, and Language in an Islamic Nation। University of North Carolina Press। পৃষ্ঠা 53–54। 
  4. "শরীয়তুল্লাহ, হাজী - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১১-০৪ 
  5. "Haji Shariatullah"Muslim Ummah of North America। Muslim Ummah of North America। ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  6. "Haji Shariatullah Bridge was inaugurated"Roads and Highways Department। ৮ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০১৫ 
  7. "Haji Shariat Ullah"Bangladesh Post Office। ১৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০১৫