মুতাজিলা
| ইসলাম |
|---|
| বিষয়ক ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |
মুʿতাজ়িলা (আরবি: المعتزلة, প্রতিবর্ণীকৃত: al-Muʿtazila) বা আহলুত তওহ়ীদ ওয়াল ʿআদল (আরবি: أهل التوحيد و العدل, প্রতিবর্ণীকৃত: Ahl al-Tawḥīd wa al-ʿAdl) হল একটি ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক মজহব যা ইসলামের প্রারম্ভিক ইতিহাসে উদ্ভূত হয়েছিল এবং বসরা ও বাগদাদে সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এর অনুসারী মুতাজিলিরা তৃতীয় খলিফা উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর আলী ও তাঁর বিরোধীদের মধ্যে বিরোধে নিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত ছিল। ১০ম শতাব্দীর মধ্যে আল-মুʿতাজিলা শব্দটি একটি স্বতন্ত্র কালামশাস্ত্রীয় ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তামক্তবকে নির্দেশ করতে শুরু করে।[১][২][৩] এই ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ওয়াসিল ইবনে আতা।[৪]
পরবর্তী মুতাজিলা মতবাদ ইসলামি ধারার একপ্রকার যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটিয়েছিল, যা আংশিকভাবে প্রাচীন গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং তিনটি মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল: ঈশ্বরের একত্ববাদ (তওহীদ) ও ন্যায়বিচার (আদল),[৫] মানুষের কর্মের স্বাধীনতা এবং কুরআনের সৃষ্টিত্ববাদ (খলকুল কুরআন)।[৬] মুতাজিলিরা সর্বাধিক পরিচিত কুরআনকে অসৃষ্ট ও আল্লাহর সাথে সহ-শাশ্বত বলে গণ্য করার মতবাদ প্রত্যাখ্যান করার জন্য।[৭] এর পরিবর্তে তারা যুক্তি দেয় যে যদি কুরআন আল্লাহর বাণী হয়, তবে যৌক্তিকভাবে তাঁকে “নিজের কথার পূর্বে অস্তিমান” হতে হবে।[৮] এটি প্রচলিত সুন্নি অবস্থান, যা আশআরি ও মাতুরিদি মতাবলম্বীরা অনুসরণ করে, তার বিরোধিতা করেছিল, যেখানে বলা হয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ হওয়ায় কুরআন সম্পর্কিত তাঁর জ্ঞান শাশ্বত এবং তাই এটি তাঁর মতোই অসৃষ্ট।[৮][৯] এই মতবাদটি ধর্মতাত্ত্বিক “অশুভ সংকট” সমাধানের চেষ্টাও করেছিল[১০] এরূপ যুক্তি দেখিয়ে যে, যেহেতু আল্লাহ ন্যায়বান ও জ্ঞানী, তাই তিনি যুক্তিবিরোধী কোনও আদেশ দিতে পারেন না কিংবা তাঁর সৃষ্টির কল্যাণ উপেক্ষা করতে পারেন না; অতএব অশুভকে মানবকৃত কর্মের ভুল থেকে আসা হিসেবে গণ্য করতে হবে, যা মানুষের আল্লাহপ্রদত্ত স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থেকে উদ্ভূত।[১১][১২]
মুতাজিলিরা ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তিবাদের বিরোধিতা করলেও বিশ্বাস করত যে মানববুদ্ধি ও যুক্তি মানুষকে ধর্মীয় নীতিগুলি বোঝার ক্ষমতা দেয় এবং শুভ-অশুভ হল যৌক্তিক শ্রেণিবিন্যাস যা “বিচারবুদ্ধির মাধ্যমে প্রমাণ” করা যায়।[১০][১৩][১৪][১৫][১৬]
আব্বাসীয় খিলাফতামলে “মিহনা” (৮৩৩–৮৫১ খ্রী.) নামে পরিচিত একটি ১৮ বছরের ধর্মীয় নিপীড়নকালে এই আন্দোলন রাজনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছোয়। তখন আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন সুন্নি আলেমদের মুতাজিলা মতবাদের সাথে একমত হতে বাধ্য করেছিলেন, অন্যথায় তাঁদেরকে শাস্তি, কারাবাস, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হতো। পরবর্তীতে আল-মুতাওয়াক্কিল এটি বাতিল করেন।[১৭] আগালিবা রাজবংশও (শা. ৮০০–৯০৯) মুতাজিলা মতবাদ গ্রহণ করেছিল এবং এটিকে ইফ্রিকিয়ার রাষ্ট্রদর্শন হিসেবে আরোপ করেছিল।[১৮] অনুরূপভাবে, কর্ডোবার উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় আল-হাকামের শাসনামলে (শা. ৯৬১–৯৭৬) গ্রীক–আরবি অনুবাদ আন্দোলনের শীর্ষস্থানীয় অভিজাত ব্যক্তিরাও মুতাজিলা মতাবলম্বী ছিলেন।[১৯] বুয়ী শাসনামলে (শা. ৯৩৪–১০৬২) শাসনামলেও ইরাক ও পারস্যে মুতাজিলা মতবাদ কিছুটা বিকাশ লাভ করে।[২০]
বর্তমানে মুতাজিলা মতবাদ প্রধানত মাগরেব অঞ্চলে "ওয়াসিলিয়া" নামক গোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান।[২১][২২] মুতাজিলা মতবাদ কুরআনবাদী আন্দোলন এবং কুরআনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে “নব্য-মুতাজিলা” সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গির উপরও প্রভাব ফেলেছে।[২৩][২৪][২৫]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]উমাইয়া যুগে মুতাজিলা আন্দোলনের আবির্ভাব হয়। ওয়াসিল ইবনে আতাকে মুতাজিলা মতবাদের জনক হিসেবে ধরা হয়। তিনি ছিলেন হাসান বসরির শিষ্য, একটি মাসলাকে কেন্দ্রকরে তিনি হাসান বসরীর মতবাদ থেকে বের হয়ে নিজে একটি মতাদর্শ চালু করেন, যা মুতাজিলা মতবাদ নামে পরিচিতি পায়। মুতাজিলা শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় "নিজেকে আলাদা করে নেয়া বা কিছু থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া"।
আব্বাসীয় যুগে এটি রাজনৈতিকভাবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায় কারণ আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুন এই মতবাদ গ্রহণ করেন। কিন্তু এই মতবাদকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ধর্মীয় নিপিড়ন শুরু হয় শিয়া, সুন্নি আলেমদের উপর এবং অন্য যারা এই মতবাদ গ্রহণ করেনি। এই নীতি পনের বছর (৮৩৩-৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দ) ধরে চলে এবং এই সময়ের মধ্যে একজন বিখ্যাত ইসলামি ব্যক্তিত্ব শাইখুল ইসলাম ইমাম আহমদ বিন হাম্বল কারারুদ্ধ হন। মুতাজিলা মতবাদের আলেমরাও এই সকলের প্রতিবাদ না করে নিরব থাকেন। পরে আল-মুতাওয়াক্কিল (১০ম আব্বাসীয় খলিফা) ক্ষমতায় এলে বিন হাম্বল মুক্তি পান।
চিন্তাধারা
[সম্পাদনা]মুতাজিলাদের চিন্তাধারাকে পাঁচটি মূলনীতির মধ্যে সংক্ষিপ্ত করা যায়ঃ
১। তারা আল্লাহর নাম ও গুণাবলী তথা সিফতকে আল্লাহর সাথে অন্তর্ভুক্ত করতে স্বীকার করে না। তারা যুক্তি দেয় আল্লাহকে কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। তাই এগুলো আল্লাহর প্রতি দেওয়া যাবে না।
২। মুতাজিলারা কুরআনকে আল্লাহর অস্তিত্বের অংশ বলে মনে করে না, বরং আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মতই সংশোধনযোগ্য সৃষ্টি বলে মনে করে।
৩। প্রাচীন গ্রীকদের মত মুতাজিলারাও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় বিশ্বাস করে। তারা মনে করে যে আল্লাহ মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারণ করতে পারেন না। বরং মানুষ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরেও সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
৪। মুতাজিলারা তাদের যুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে আল্লাহর কোন দয়া বা অনুকম্পা হবে ন্যায়বিচারের লঙ্ঘন ও তার প্রকৃতির সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। মুতাজিলারা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার করতে বাধ্য।
৫। মুতাজিলারা মনে করে যে একজন মুসলিম যদি সর্বোচ্চ পাপ বা কবিরা গুনাহ করে তাওবা করা ছাড়াই মৃত্যুবরণ করে, তবে ঐ ব্যক্তিকে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী-এই দুইয়ের কোনটির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে না।
৬। ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ ধারণাকে মুতাজিলারা গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যে শক্তিপ্রয়োগকে তারা বৈধ মনে করে, যা মিহনা নামে নতুন এক ধারণার সাথে পরিচিত করায়।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Muʿtazilah ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৮-০৬-২১ তারিখে", এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা।
- ↑ NEAL ROBINSON (১৯৯৮)। "Ash'ariyya and Mu'tazila"। muslimphilosophy.com। ২০ নভেম্বর ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৫ নভেম্বর ২০১২।
- ↑ "Different views on human freedom – Mu'tazilites and Asharites – Authority in Islam – GCSE Religious Studies Revision – OCR"। BBC Bitesize (ব্রিটিশ ইংরেজি ভাষায়)। ২১ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুন ২০২১।
- ↑ Ellwood, Robert S.; McGraw, Barbara A. (৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২)। Many Peoples, Many Faiths: Women and Men in the World Religions। Taylor & Francis। আইএসবিএন ৯৭৮০৪২৯৮৪৪৫৮৪।
- ↑ Fakhry, Majid (১৯৮৩)। A History of Islamic Philosophy (second সংস্করণ)। New York: Columbia University Press। পৃ. ৪৬।
Almost all authorities agree that the speculation of the Muʿtazilah centers around the two crucial concepts of divine justice and unity, of which they claim to be the exclusive, genuine exponents.
- ↑ Campanini, Massimo (২০১২)। "The Mu'tazila in Islamic History and Thought"। Religion Compass। ৬: ৪১–৫০। ডিওআই:10.1111/j.1749-8171.2011.00273.x। ১৯ জুলাই ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ৯ জানুয়ারি ২০২১।
- ↑ Abdullah Saeed. The Qur'an: an introduction. 2008, page 203
- 1 2 Kadri, Sadakat (২০১২)। Heaven on Earth: A Journey Through Shari'a Law from the Deserts of Ancient Arabia to the Streets of the Modern Muslim World। macmillan। পৃ. ৭৭। আইএসবিএন ৯৭৮০০৯৯৫২৩২৭৭। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫।
- ↑ Watt, W. Montgomery (১৯৮৫)। Islamic philosophy and theology : an extended survey। Edinburgh। আইএসবিএন ০-৮৫২২৪-৪৮৭-৮। ওসিএলসি 13360530।
{{বই উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: অবস্থানে প্রকাশক অনুপস্থিত (লিঙ্ক) - 1 2 Fakhry, Majid (১৯৮৩)। A History of Islamic Philosophy (second সংস্করণ)। New York: Columbia University Press। পৃ. ৪৭।
...
- ↑ Al-Shahrastani, al-Milal, p.31 f
- ↑ Al-Baghdadi, Usul al Din, pp.150f
- ↑ Al-Baghdadi, A.Q.,Usul al Din, Istanbul, 1928, pp.26f
- ↑ Al-Shahrastani, M.,al-Milal wa'l-Nihal, London, 1892, p.31
- ↑ al-Ash'ari, Maqalat, p.356
- ↑ Oussama Arabi. Studies in Modern Islamic Law and Jurisprudence. page 27–28
- ↑ Muhammad Qasim Zaman। Religion and Politics Under the Early ?Abbasids...।
- ↑ Abun-Nasr, Jamil (১৯৮৭)। A history of the Maghrib in the Islamic period। Cambridge: Cambridge University Press। পৃ. ৫৭। আইএসবিএন ০৫২১৩৩৭৬৭৪।
- ↑ টেমপ্লেট:Cite book ...
- ↑ https://albert.ias.edu/...।
{{ওয়েব উদ্ধৃতি}}:|title=অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য) - ↑ Byrd, Anthony Robert। A Euro-American 'Ulama?...।
- ↑ Van Ess, Joseph (2005 ...)। Encyclopedia of Religion।
{{বই উদ্ধৃতি}}:|date=এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য) - ↑ Jafarli, D. "The rise of the quranist movement in Egypt..."
- ↑ Kersten, Carool। Contemporary Thought in the Muslim World...।
- ↑ Bihishtī, Nargis। "The Similarities and Differences Between Mu'tazila and Neo-Mu'tazila Literary Approaches..."।
{{সাময়িকী উদ্ধৃতি}}: উদ্ধৃতি journal এর জন্য|journal=প্রয়োজন (সাহায্য)