বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক
এই নিবন্ধে একাধিক সমস্যা রয়েছে। অনুগ্রহ করে নিবন্ধটির মান উন্নয়ন করুন অথবা আলাপ পাতায় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
|
পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা যিনি দিয়েছিলেন তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক।[১][২][৩][৪][৫][৬][৭][৮][৯][১০][১১] বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান এবং তৎকালীন সময়ের মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেন। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে দাবি করা হয় যা ইতিহাস বিকৃতি হিসেবে সমালোচিত।[১২][১৩][১৪][১৫][১৬][১৭] বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৭১ এর তৎকালীন রিচার্ড নিক্সনের শাসনামলের সকল কূটনৈতিক গোপন নথিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়েছে।[১৮]
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
[সম্পাদনা]স্বাধীনতার ঘোষণা
[সম্পাদনা]২৬শে মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা
[সম্পাদনা]পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন ধানমণ্ডির ৩২ নং বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন:
(ইংরেজি)
«This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.[১৯]» |
(বাংলা)
«এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।» |
(শেখ মুজিবুর রহমান) |
একই সময়ে আরো একটি বার্তা পাঠানো হয় যা ছিল:
(ইংরেজি)
«"To-day Bangladesh is a sovereign and independent state. On Thursday night West Pakistani armed forces suddenly attacked the police barracks at Rajarbagh and the EPR Headquarters at Peelkhana in Dacca. Many innocent and unarmed people have been killed in Dacca city and other places of Bangladesh. Violent clashes between the East Pakistan Rifles and Police on the one hand and the armed forces off Pindi on the other, are going on. The Bengalis are fighting the enemy with great courage for an independent Bangladesh. Resist the treacherous enemy in every corner of Bangladesh. May God aid us in our fight for freedom." "JOY BANGLA"» |
(বাংলা)
«আজ বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী হঠাৎ ঢাকার পিলখানার রাজারবাগ এবং ইপিআর সদর দপ্তরে হামলা চালায়। ঢাকা শহর এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে, অনেক নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়েছে। একদিকে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং পুলিশের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ এবং অন্যদিকে পিন্ডি থেকে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ চলছে। বাঙালিরা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সাহসের সাথে শত্রুর সাথে লড়াই করছে। বাংলাদেশের প্রতিটি কোণায় বিশ্বাসঘাতক শত্রুদের প্রতিরোধ করুন। ঈশ্বর আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সাহায্য করুন। "জয় বাংলা"» |
ঘোষণা দুটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার করা হয়েছিল বলে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত ঘোষণাগুলোর মধ্যে কিছুটা শাব্দিক তারতম্য দেখা যায়। এই ঘোষণাগুলো পূর্বপ্রস্তুতকৃত এবং অনেক আগেই টেপ করে রাখা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।
২৬শে মার্চের মার্কিন ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডি আই এ) রিপোর্টে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার উল্লেখ করা হয়,[২০]
“ | Pakistan was thrust into civil war today when Sheikh Mujibur Rahman proclaimed the east wing of the country to be the sovereign independent people's republic of Bangla Desh (শেখ মুজিবুর রহমান দেশের পূর্ব শাখাকে সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলা দেশ হিসাবে ঘোষণা করে পাকিস্তানকে আজ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।) | ” |
ওয়্যারলেসে ইংরেজিতে স্বাধীনতার যে ঘোষণা দেওয়া হয় এ বিষয়ে লন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপনডেন্ট ডেভিড লোশাক লিখেছেন,
ঘোষণাকারীর গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল। খুব সম্ভবত ঘোষণাটি আগেই রেকর্ড করা ছিল।
উল্লেখ্য যে, ডেভিড লোশাক সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।[২১]
এই ঘোষণার পরপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। ঘোষণার স্মৃতিচারণ করে গণপরিষদে মুজিব বলেন,[২২]
“ | ...যখন আমি বুঝতে পারলাম, আর সময় নেই এবং আমার সোনার দেশকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তখন আমার মনে হলো, এই বুঝি আমার শেষ। তখন আমি চেষ্টা করেছিলাম কেমন করে বাংলার মানুষকে এ খবর পৌছিয়ে দেই এবং আমি তা পৌছিয়ে দিয়েছিলাম তাদের কাছে। সেদিন আমি লাশ দেখেছি, রক্ত আমি দেখেছি। সেই রক্তের ওপর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় - সেই রক্তাক্ত মানুষের লাশের পাশ দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। [তিনি কেঁদে ফেলেন] সে আগুন আমি দেখেছি। শুধু বলেছিলাম আমাকে তোমরা হত্যা করো, আমার মানুষকে মেরো না...। | ” |
অধ্যাপক আবু সাইয়িদ লিখেছেন,[১০]
“ | তখন আমি পাবনার নির্বাচনী এলাকা হতে নির্বাচিত তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পদ্মা-যমুনার বাঁকে জড়ানাে এই অঞ্চলটি তখন উদ্বেল এবং উত্তাল অস্থির উত্তেজনা। প্রতিরােধ মানসিকতা প্রজ্জ্বলিত। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় কি ঘটেছে জানিনা। সকালে ঢাকা বেতারে ভিন্ন কণ্ঠ , উর্দু বয়ান শুনে মনে হলাে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে। বুঝলাম অসহযােগ আন্দোলন নেই। আন্দালন সশস্ত্র। লড়াই আসন্ন। থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে নিলাম। দুপুরে সিরাজগঞ্জ থেকে লােক এলাে , সিরাজগঞ্জ ওয়ারলেস স্টেশন থেকে পাঠানাে একটি মেসেজ পেলামঃ
“ পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানায় ইপিআর ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে... আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ , ১৯৭১।" এই ঘোষণাটি হাতে পেয়েই নগরবাড়ি সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরােধ শুরু হয়ে গেলাে। পাকবাহিনীর মােকাবিলা করে অর্ধ শত মুক্তিযােদ্ধা নগরবাড়ীর নিকট ডাববাগানে প্রাণ দিয়েছেন। একটি জাতির স্বাধীনতার পটভূমি বিরাট এবং বিস্তীর্ণ। হাজার লােকের আত্মদান , ত্যাগ তিতিক্ষা , জেল জুলুম , রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার মুকুর মুঞ্জরিত হয়। |
” |
মুজিবনগর সরকারের বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্রে বলা হয়,
“ | …যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান;… | ” |
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের গণহত্যা ও অপারেশন সার্চলাইটের অন্যতম পরিকল্পনাকারী টিক্কা খান বলেন,[১০]
“ | মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছিলাে, কেননা আমি নিজে মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণার স্বকণ্ঠ বাণী শুনেছি। | ” |
২৬শে মার্চ, ১৯৭১ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার এবং সি.আই.এ. প্রধান রিচার্ড হেলমস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে আলোচনা করেন:[১৮]
- হেনরি কিসিঞ্জার: Yesterday it looked as though an agreement were in sight. (গতকাল দেখে মনে হচ্ছিল একটা চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেছে।)
- মিঃ হেলমস: Yes, an agreement appeared near on March 24. The breakdown may have been because of Mujibur Rahman’s insistence on the immediate lifting of martial law. A clandestine radio broadcast has Mujibur Rahman declaring the independence of Bangla Desh. There are 20,000 loyal West Pakistani troops in East Pakistan. There are also 5,000 East Pakistani regulars and 13,000 East Pakistani paramilitary troops, but their loyalty is doubtful. (হ্যাঁ, ২৪ শে মার্চ একটি চুক্তির কাছাকাছি পৌছেছিল। মুজিবুর রহমান, অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহারের উপর জোর দেওয়ার কারণে এই ভাঙ্গন হতে পারে। একটি গোপন রেডিও সম্প্রচারে মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে ২০,০০০ অনুগত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য রয়েছে। এছাড়াও ৫,০০০ পূর্ব পাকিস্তানি নিয়মিত এবং ১৩,০০০ পূর্ব পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনী রয়েছে, কিন্তু তাদের আনুগত্য সন্দেহজনক।)
ঘোষণার প্রচার
[সম্পাদনা]শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাটি তিনটি মাধ্যম থেকে প্রচারিত হয়।[২১] স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের উদ্দেশ্যে অনেক পূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান লোকচক্ষুর অগোচরে ট্রান্সমিটার স্থাপন করিয়েছিলেন।[২১] স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তা চট্টগ্রাম পাঠিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনৈক ওয়ার করেসপন্ডেনটের মতে,[২৩]
২৫ মার্চ সারা দিন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে রাত ১১টার দিকে কাজেম আলী রোডের বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে আমার বড় ভাই ও আমি দৈনিক আজাদী অফিসে গেলাম রাত ১টার দিকে। আমাদের বাড়ি থেকে ১০-১২টা বাড়ি পরেই দৈনিক আজাদী অফিস। আমরা সেখানে হেঁটে গেলাম। দৈনিক আজাদী অফিসের দোতলায় আমরা সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এমপির কাছে গেলে তিনি 'ঢাকা থেকে তৎক্ষণাৎ টেলিপ্রিন্টারে আসা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা' সংবলিত ইংরেজি টেক্সট দেখালেন এবং বললেন : 'জাফর সাহেব, দেখুন ঢাকায় ম্যাসাকার (গণহত্যা) হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এখন আমাদের সামনে আলজিরিয়া-ভিয়েতনামের মতো দীর্ঘ স্বাধীনতার যুদ্ধ।' রাত তখন ১টা ১০ মিনিট। অর্থাৎ 'সেটা তখন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর। আমিও পড়লাম সেই টেলেক্স মেসেজ'। টেলেক্স মেসেজটি আমি সঙ্গে সঙ্গে লিখে নিলাম। মেসেজটি ছিল নিম্নরূপ :
“This may be my last message,… final victory is achieved. Sheikh Mujibur Rahman. (এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা,... চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হোক। শেখ মুজিবুর রহমান।)”
২৬ মার্চ রাত ২টার দিকে বাসায় ফিরে এলাম। রাত ৪টায় মাইকের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের কাজেম আলী রোডের বাড়ির তিনতলা থেকে আমার বড় ভাই, আমি, আমার ছোট দুই ভাই ইসা ও মহীউদ্দিন নিচে নেমে এলাম মাইকে কী বলা হচ্ছে শোনার জন্য। আমি ও বড় ভাই দৈনিক আজাদী অফিসের দিকে পা বাড়ালাম, তখনো অন্ধকারের রেশ কাটেনি। সেখানে গিয়ে 'দেখলাম মিউনিসিপ্যালিটির সামনে আন্দরকিল্লায় মাইকিং হচ্ছে যে 'ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। আপনারা স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্রদের হত্যা করেছে। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বাঙালি রুখে দাঁড়াও।' মাইকের এই ঘোষণা শুনে আমাদের মতো ঘর ছেড়ে বহু লোক দলে দলে আন্দরকিল্লার রাস্তায় নেমে আসে এবং গগনবিদারী 'জয়বাংলা' স্লোগান দিয়ে উল্লাস করতে থাকে'। সকাল ৯টার দিকে আন্দরকিল্লা ও লালদীঘি মানুষে ভরে যায়। তাদের অনেকের হাতে বন্দুক, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, দেশি বল্লম ও লাঠিসোঁটা। ছাত্র-জনতার মধ্যে অনেক পুলিশ ও বাঙালি ইপিআরকেও দেখলাম। লালদীঘি থেকে আন্দরকিল্লায় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফিরে দেখলাম অধ্যাপক ড. অনুপম সেনের শ্বশুরবাড়ির সামনের হোটেল ডি. সিটিতে প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের মধ্যে দেখলাম 'সাইক্লোস্টাইল করা বাংলায় লেখা একটি কাগজ বিলি করা হচ্ছে। খুব কষ্ট করে একটা কাগজ নিলাম, দেখলাম, কাল রাতে দৈনিক আজাদী অফিসে দেখা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ইংরেজি টেক্সটের বঙ্গানুবাদ'।
পাক-বাহিনীর গণসংযোগ অফিসার সিদ্দিক সালিক তার বিতর্কিত বই উইটনেস টু সারেন্ডার-এ বলেন,
“…When the first shot had been fired, “the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like, a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed east Pakistan to be People’s Republic of Bangla Desh. (যখন প্রথম গুলি চালানো হয়, "শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বরটি সরকারি পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্য দিয়ে অস্পষ্টভাবে এসেছিল। যা অবশ্যই ছিল, এবং একটি প্রাক-রেকর্ড করা বার্তার মতো শোনাচ্ছিল যে, শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসাবে ঘোষণা করেছেন।)
জনৈক কলামিস্ট স্বাধীনতার ঘোষণার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন,[২৪]
“ | একাত্তরে মার্চের ২৫ তারিখ রাতে সেই ধ্বংসতাণ্ডবের মধ্যে ইত্তেফাক অফিসের প্রায়ান্ধকার বার্তাকক্ষে বসে ট্রানজিস্টারের নব ঘুরাচ্ছিলেন অগ্রজ সাংবাদিক সৈয়দ শাহজাহান। আমরা ক’জন সেই অবরুদ্ধভাবে শোনার চেষ্টা করছিলাম বিভিন্ন স্টেশনের সংবাদ। তখনই আমরা চাপা উল্লাসে ফেটে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার অস্ফুট শব্দ শুনে। আমাদের সেই উল্লাস চাপা পড়েছিল স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দে। | ” |
মুজিবনগর সরকার কর্তৃক আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র
[সম্পাদনা]মুজিবনগর মুজিবনগর সরকার গঠিত হবার পর তাজউদ্দীন তাজউদ্দীন আহমেদের নির্দেশে একটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হয়:
বাংলাদেশ গণপরিষদ দ্বারা ঘোষণা[২৫] |
---|
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল; এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিল; এবং যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন; এবং যেহেতু তিনি আহূত এই অধিবেশন স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারষ্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান; এবং যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনও বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্য এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনার দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করে তুলেছে; এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাদের কার্যকরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে; সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারষ্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি; এবং এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন; ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী থাকবেন; এবং তার কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকবে; এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হবেন। বাংলাদেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করতে না পারেন অথবা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যদি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসাবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তেছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করব। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকর বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করলাম। স্বাক্ষর: অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের |
মার্কিন গোপন নথিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
[সম্পাদনা]আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ এশিয়া সংকট ১৯৭১ এই শিরোনামের সকল গোপন নথি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বিষয়ক। ২ মার্চ থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সকল রিপোর্ট এবং মিটিং এর বিস্তারিত পাওয়া যায় এই সংকলনে।
৬ মার্চ ১৯৭১
[সম্পাদনা]১৯৭১ সালের মার্চ ৬ এ হোয়াইট হাউজ সিচুয়েশন রুমে একটি হাই প্রোফাইল মিটিং হয় সেখানে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার , সি আই এ ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ মিটিং ওয়াশিংটন, ৬ মার্চ ১৯৭১[২৬] থেকে কে কিছু লাইন তুলে ধরা হোল । এই সভায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের এলক্সিস জনসন বলেন
আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে আজ বিকেলে ব্রিটিশ সঙ্গে কথা বলা হবে। মুজিব ১৬২ আসন থেকে ১৬০ টি গত নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন, এটি তার অনুপম রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আছে। তিনি মার্কিন দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ। পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টো প্রায় মার্কিনদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ নয় । আমরা হয়ত এই দুই দেশকে এক সাথে রাখতে তাদের সাথে সমঝোতার ব্যবস্থা করতে পাড়ি , কিন্তু তা হবার সম্ভবনা খুবই কম । এখন শুধু প্রশ্ন তারা কীভাবে বিভক্ত হবে এবং টা কত বড় আকারে বিভক্ত হবে" ৬ মার্চের মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর বাসভবন হোয়াইট হাঊসে হয়ে যাওয়া এই টপ সিক্রেট মিটিং এ পাকিস্তানের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয় । রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে মার্কিন গোয়েন্দাদের নিশ্চিত হন পাকিস্তান ভাগ হবেই, কিন্তু কীভাবে ভাগ হবে বা এর কোন রাজনৈতিক সমঝোতা আমেরিকা করতে পাড়ে কি না তা নিয়ে আলোচনা হয় । সাত মার্চের শেখ মুজিবুর এর ভাষণের বিষয়বস্তু কি হবে তা নিয়ে আমেরিকানরা অনেকটাই জানতেন।
অর্থাৎ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তখন ধারণা করে ৭ মার্চ ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এবং এই সাত মার্চের ঘোষণা আসলে ইয়াহিয়া কি ব্যবস্থা নিতে পারে এই মিটিং-এ তার ব্যাখ্যা করা হয়।
যদি মুজিব আমাদের কাছে আসে এবং একটি সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণার কথা বলে এবং আমাদের মতামত জানতে চায় তখন আমরা (আমেরিকা ) তাকে কি বলব সেটা অনেক বড় ব্যাপার । আর ইয়াহিয়া যদি তার মতে থেকে এই স্বাধিনতা ঘোষণার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে তখন আমরা ( আমেরিকা ) কি করবে তাও চিন্তা করতে হবে । এখন ইয়াহিয়ার ২০০০০ হাজার কমব্যাট ট্রুপ্স রেডি আছে এবং তার বিপক্ষে রিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন জনতা
১৩ মার্চ ১৯৭১ – হোয়াইট হাউজ
[সম্পাদনা]৬ মার্চের এই মিটিং এর পড় ১৩ই মার্চ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) ব্যাপারে রিপোর্ট প্রদান করেন যার নাম ছিল ন্যাশনাল সিকিউরিটি এফেয়ার্সের রাষ্ট্রপতির সহকারীর পক্ষ থেকে স্মারকলিপি। কিসিঞ্জার থেকে রাষ্ট্রপতি নিক্সনের প্রতি।[২৭] তাতে লেখা হয়:
দেখা যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার পূর্ব পরিকল্পিত স্বাধীনতার ঘোষণার থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসেছেন। ৭ মার্চের ভাষণের পূর্ণ কপি তে দেখা যায় অনেক কঠিন কথা বলেছেন তিন, এবং এটা মনে হচ্ছে তার এই পিছিয়ে পড়া তার একটি স্ট্রাটেজিক কৌশল হতে পারে। উনি ব্যাপারটা পরিস্কার করেছেন তারা স্বাধীনতার খুব কাছাকাছি।
১৩ মার্চের মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্টের মিটিং এর প্রধান বিশয়বস্তু ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের দেয়া ৭ মার্চের ভাষণ। এই হাই প্রোফাইল সিক্রেট মিটিং এ তৎকালীন সময়ের গুরত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পালা পরিবর্তনের ব্যাপার গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে। ৬ মার্চে ভূট্টোর দেওয়া ভাষণে স্বাধীনতার বিপক্ষে অনেক কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিলে হয়ত শেখ মুজিব সম্পূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে পিছিয়ে আসেন বলে মোমেরান্ডাম এ বলা হয়।
আমাদের ইসলামাবাদ এমব্যাসি বিশ্বাস করে রহমানের উদ্দেশ্য অপরিবর্তিত পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চিম পাকিস্তানি প্রভাব থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা চান । এটা এখন মনে হচ্ছে এক পাকিস্তান থেকেও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন সম্ভব। কিন্তু তা হবার সম্ভবনা খুবই কম, যদি তা না হয় রহমান বিশ্বাস করেন যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা তিনি চাইছেন তা কেবল পূর্ণ স্বাধীনতার মাধ্যমেই অর্জিত হতে পাড়ে। গত রবিবারের ভাষণে এটাই স্পষ্ট যে উনি সামরিক বাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে ধীরে ধীরে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে চাইছেন যা হয়ত আনফিসিয়াল স্বাধীনতার ঘোষণা হতে পারে।
২৬শে মার্চ ১৯৭১
[সম্পাদনা]১৩ মার্চের এই প্রতিবেদনের পড় ২৬ শে মার্চ থেকে প্রতিনিয়ত একদিন দুইদিন পরপর হোয়াইট হাউজে রিপোর্ট এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিষয় নিয়ে মিটিং হতে থাকে। মার্চের ২৯ তারিখে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাথে কিসিঞ্জারের আলাপে নিক্সনের ইয়াহিয়ার প্রতি সমর্থন এর কথা প্রকাশ্যে উঠে আসে। ২৬ মার্চের ইমারজেন্সি মিটিং ওয়াশিংটন বিশেষ কর্মসূচি গ্রুপ মিটিং[২৮] এ বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে।
২৬ মার্চ ওয়াশিংটনে স্পেশাল একশন গ্রূপ মিটিং এ উপস্থিত ছিলেন হেনারি কিসিঞ্জার, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কমিটি ও সি আই এর প্রতিনিধিবৃন্দ। যারা ২৫ ও ২৬ মার্চ ঘোটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জরুরী বৈঠক করছিলেন। সেখানে সি আই এর মিস্টার রিচারড হেলমস বলেন,
মার্চের ২৪ তারিখের আলোচনায় একটি সমোঝোতা আসলেও সেই চুক্তি ভেঙ্গে যায় কারণ মুজিবুর রহমান সম্পূর্ণ সামরিক শাসন প্রত্যাহার চাইছিলেন। একটি ক্ষীণ ও গোপনীয় রেডিও ব্রডকাস্টে শেখ মুজিবুর রহামান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেখানে প্রায় ২০০০০ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য রয়েছে। বিপক্ষে রয়েছে ৫০০০ পূর্ব পাকিস্তানি সৈন্য ও ১৩০০০ আধা সামরিক বাহিনী কিন্তু তারা কোন পক্ষে থাকবে তা নিশ্চিত নয়।[২৯]
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা
[সম্পাদনা]বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ঢাকার পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবকে আটকের ঘটনা ২৭শে মার্চেই বিশ্বের অন্তত ২৫টি দেশের পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার খবরে প্রকাশিত হয়।
'বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা: ফ্যাক্টস অ্যান্ড উইটনেস (আ.ফ.ম সাঈদ)' বইতে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে বিদেশী সংবাদপত্র ও সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে।
ওই সংকলন অনুযায়ী বিবিসির খবরে তখন বলা হয়েছে,
".....কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।..."
ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়েছিলো:
"....ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন..."।
দিল্লির দি স্টেটসম্যানের খবর ছিলো:
"বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।"
দি ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন: ২৭শে মার্চ দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় 'সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট'শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীন ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়।
দি গার্ডিয়ান: গার্ডিয়ানের ২৭শে মার্চ সংখ্যায় এক খবরে বলা হয়,
"...২৬শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দি ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।"
এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।
আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭শে মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, "বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।"
৭ই মার্চের এই ভাষণের পরই বোঝা যাচ্ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি কোন দিকে এগুচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমসেও শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়েছিলো। পাশেই বলা হয়েছে 'স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিব আটক'
বার্তা সংস্থা এপির একটি খবরে বলা হয়,
"ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।"
আয়ারল্যান্ডের দি আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিলো - পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা আর সাথে ছিলো শেখ মুজিবের ছবি।
দিল্লি থেকে রয়টার্সের খবরে ১০ হাজার মানুষের নিহত হবার ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবকে সম্ভবত আটক করা হয়েছে, এমন কথা বলা হয়।
ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়,
"শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।"
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ
[সম্পাদনা]এম এ হান্নান
[সম্পাদনা]২৬শে মার্চ দুপুর ২টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিব কর্তৃক প্রেরিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি প্রথম ও পরবর্তীতে একাধিকবার পাঠ করেন। সে ঘোষণাটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দীপ। [৯]
বেতারের জনৈক টেকনিশিয়ান
[সম্পাদনা]আবদুল করিম খন্দকারের মতে, পূর্ব বাংলা বেতারের এক টেকনিশিয়ান ২৬শে মার্চ বেতার বার্তায় সর্বপ্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
আবুল কাশেম সন্দীপ
[সম্পাদনা]কোন কোন বর্ণনায় জানা যায়, আবুল কাশেম সন্দীপ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাটি প্রথম সংবাদ আকারে পাঠ করেছিলেন।[৩১]
মেজর জিয়া
[সম্পাদনা]২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে ও ২৭শে মার্চ পুনরায় চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে থেকে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।[৩২][৩৩][৩৪]
রাজনৈতিক মতভেদ
[সম্পাদনা]বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি জিয়াউর রহমান কে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করে থাকে।[৩৫] ইতিহাসবিদদের মতে এটি ইতিহাস বিকৃতির পর্যায়ভুক্ত। [১২][১৩][১৪][১৫][১৬][১৭]
ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ
[সম্পাদনা]জিয়াউর রহমানকে ঘোষক দাবি
[সম্পাদনা]শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে বিবেচিত[১][২][৩][৪][৫][৬][১১] হলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে থাকে।[৩৫] ইতিহাসবিদদের মতে এটি ইতিহাস বিকৃতির পর্যায়ভুক্ত।[১২][১৩][১৪][১৫][১৬][১৭] জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত হওয়া[কখন?] ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ড হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই খণ্ডটি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ প্রদান করা হয়। হাইকোর্ট প্রদত্ত নির্দেশনা:[১২]
‘যারা এরকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। যারা বিকৃত ইতিহাস রচনা করেছেন সেই প্রত্যয়ন কমিটির বিরুদ্ধে ধোঁকাবাজি ও সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে সরকার চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে’
একে খন্দকারের সমালোচিত উদ্ধৃতি
[সম্পাদনা]মুক্তিযুদ্ধকালীন সামরিক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী বীর উত্তম আবদুল করিম খন্দকার ২০১৪ সালে লিখিত ১৯৭১ : ভেতরে বাইরে গ্রন্থে লেখেন, শেখ মুজিব ৭ই মার্চ থেকে শুরু করে গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত স্বাধীনতার কোন ঘোষণা দিয়ে যান নি, কোন লিখিত চিরকুট বা রেকর্ডকৃত কণ্ঠবার্তাও রেখে যান নি এবং পূর্বনির্ধারিত কোন দিকনির্দেশনাও দিয়ে যান নি।[৩৬] তার মতে:
দেশের এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ ভাষণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু কী বলেন তা শোনার জন্য দেশের মানুষ অপেক্ষা করছিল। ইয়াহিয়া খান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে সাতই মার্চ যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তাহলে এই আন্দোলনকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। তাই তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, "তুমি এমন কিছু করো না, যা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়। আমি আলোচনা করার জন্য ঢাকায় আসছি।" সাতই মার্চের ভাষণের দিন ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক ছিল, সবাই ব্যস্ত ছিল নিজ নিজ কাজে। এদিন বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিলেন, তা খুবই তির্যক ছিল। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাঙালিরা ভাবতে আরম্ভ করল, সত্যিই কি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, আমরা কি যুদ্ধে নামব, নাকি গ্রামে চলে যাব। সাতই মার্চের ভাষণটি আমি শুনেছি। এর মধ্যে যে কথাগুলো আমার ভালো লেগেছিল, তা হলো: “দুর্গ গড়ে তোলো", 'তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো", 'শত্রর মোকাবিলা করতে হবে", “এবারের সংগ্রাম আমাদের যুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এ সময় সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ তার কাছ থেকে এ ধরনের কথা আশা করছিল। ওই কথাগুলো শক্তিশালী ছিল বটে, তবে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের নেতাদের ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, কীভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, তা তিনি পরিষ্কার করেননি। তা ছাড়া জনগণকে যুদ্ধ করার জন্য যেভাবে প্রস্তুত করা প্রয়োজন, তা করা হয়নি। ভাষণে চূড়ান্ত কোনো দিকনির্দেশনা পাওয়া গেল না। ভাষণটির পর মানুষজন ভাবতে শুরু করল--এরপর কী হবে? আওয়ামী লীগের পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় যুদ্ধ শুরু করার কথা বলাও একেবারে বোকামি হতো। সম্ভবত এ কারণেই বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন। তা ছাড়া ইয়াহিয়া খান নিজেও ওই ধরনের ঘোষণা না দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হয়তো ঢাকায় ইয়াহিয়ার উপস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল "জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান"। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, "জয় পাকিস্তান"! এটি যে যুদ্ধের ডাক বা স্বাধীনতার আহ্বান, তা প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং তর্কাতীতও নয়। যদি আওয়ামী লীগের নেতাদের কোনো যুদ্ধ-পরিকল্পনা থাকত, তাহলে মার্চের শুরু থেকে জনগণ এবং সরকারি, বেসরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাদের স্বল্প সময়ে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যেত। সেটা করা হলে আমার মনে হয় যুদ্ধটি হয়তো-বা খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যেত এবং আমাদের বিজয় নিশ্চিত হতো। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সেটা করা হয়নি ।... মুক্তিযুদ্ধের সময় থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে ঘরে থাকতেন তার পাশের ঘরেই আমি মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে থাকতাম । একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “স্যার, বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আপনি কি তার কাছ থেকে কোনো নির্দেশ পেয়েছিলেন?' উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'না, আমি কোনো নির্দেশ পাইনি ।' ওই রাতে বঙ্গবন্ধু সবাইকে আত্মগোপন করার কথা বলেন, অথচ তিনি কোথায় যাবেন, সে কথা কাউকে বলেননি। যদি তিনি গ্রেপ্তার হন, তাহলে দলের নেতৃত্ব কী হবে, তা-ও তিনি কাউকে বলেননি। এ ছাড়া মঈদুল হাসান, উইং কমান্ডার এস আর মীর্জা এবং আমার মধ্যকার আলোচনাভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপরঃ কথোপকথন গ্রস্থটিতে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ ও শেখ মুজিবের সাক্ষাতের বিষয়ে সাংবাদিক মঈদুল হাসান বলেন : ২৫-২৬ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান যে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী হবেন, তিনি যে বাড়িতেই থাকবেন--এই সিদ্ধান্তটা তিনি দলের নেতৃস্থানীয় কারও সঙ্গে আলাপ করেননি । তেমনি বলে যাননি যে তিনি না থাকলে কে বা কারা নেতৃত্ব দেবেন এবং কোন লক্ষ্যে কাজ করবেন। নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কি কোনো আলাদা কমিটি করতে হবে? তাদের কৌশলটা কী হবে? এঁদের কি কোনো কর্মসূচি থাকবে? সেখানে দলের প্রবীণদের কী ভূমিকা হবে, তরুণদেরই বা কী ভূমিকা হবে-এসব কোনো প্রশ্নের উত্তরই কারও জানা ছিল না।...মুক্তিযুদ্ধকালে আমিও একদিন তাজউদ্দীন আহমদকে ২৫ মার্চের রাতের ঘটনা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাজউদ্দীন আহমদ স্বীকার করেছিলেন, সেই খসড়া ঘোষণাটি তার নিজের লেখা ছিল এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে খসড়া ঘোষণাটি পাঠ করার প্রস্তাব করেছিলেন । লেখাটা ছিল সম্ভবত এই রকম : “পাকিস্তানি সেনারা আমাদের আক্রমণ করেছে অতর্কিতভাবে। তারা সর্বত্র দমননীতি শুরু করেছে। এই অবস্থায় আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলাম।" তাজউদ্দীন সাহেব আরও বলেন, এই খসড়া ঘোষণাটা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়ার পর সেটা তিনি পড়ে কোনো কিছুই বললেন না, নিরুত্তর রইলেন। অনেকটা এড়িয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে মঈদুল হাসানের কাছ থেকে জানতে পারি, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে। কেননা কালকে কী হবে, যদি আমাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়? তাহলে কেউ জানবে না যে আমাদের কী করতে হবে? এই ঘোষণা কোনো গোপন জায়গায় সংরক্ষিত থাকলে পরে আমরা ঘোষণাটি প্রচার করতে পারব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাও করা হবে।' বঙ্গবন্ধু তখন প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, 'এটা আমার বিরুদ্ধে একটা দলিল হয়ে থাকবে। এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের বিচার করতে পারবে।' এ কথায় তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে সম্ভবত রাত নয়টার পরপরই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীকালে মঈদুল হাসান এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তিনিও ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন। আবদুল মোমিন বলেন, তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকছিলেন, তখন দেখেন যে তাজউদ্দীন আহমদ খুব রাগান্বিত চেহারায় ফাইলপত্র বগলে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আবদুল মোমিন তাজউদ্দীনের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি রেগে চলে যাও কেন? তখন তাজউদ্দীন আহমদ তার কাছে আগের ঘটনাটি বর্ণনা করে বলেন, 'বঙ্গবন্ধু একটু ঝুঁকিও নিতে রাজি নন। অথচ আমাদের ওপর একটা আঘাত বা আক্রমণ আসছেই।'[৩৬]
কিন্তু প্রকাশের পরপর সমসাময়িক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দর মাঝে এবং সংসদ অধিবেশনে এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় এবং লেখক ও বইটির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক তথ্য বিকৃতির অভিযোগে মামলা করা হয়[৩৭], এবং লেখক বইটির উক্ত অংশ ও তৎসংশ্লিষ্ট আরও কিছু অংশ প্রত্যাহার করেন[৩৮] ও ২০১৯ সালের ১১ই আগস্ট এর জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবের ব্যপারে ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য জাতির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ঘোষণা করেন।[৩৯]
তিনি বলেন,
বইটি প্রকাশের পর এর ৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখিত বিশেষ অংশ ও বইয়ের আরও কিছু অংশ নিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদ হয়। ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে উল্লেখিত অংশটুকু হলো, বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না। এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল, জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান। তিনি (বঙ্গবন্ধু) যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন, জয় পাকিস্তান! এই অংশটুকুর জন্য দেশপ্রেমিক অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এই অংশটুকু যেভাবেই আমার বইয়ে আসুক না কেন, এই অসত্য তথ্যের দায়ভার আমার এবং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে কখনোই ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বলেননি। আমি তাই এই অংশ সংবলিত পুরো অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।...আমার বয়স এখন ৯০ বছর। আমার সমগ্র জীবনে করা কোনো ভুলের মধ্যে, এটিকেই আমি একটা বড় ভুল মনে করি। আমি আজ বিবেকের তাড়নায় দহন হয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মার কাছে, জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।
এই প্রসঙ্গে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন:[৪০]
৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘‘জয় পাকিস্তান’’ বলেছিলেন বলে এ কে খন্দকারের প্রকাশিত বইয়ে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভুল। ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যপদের শপথ নেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেছিলেন। তবে ৭ মার্চের ভাষণে নয়। এমনকি ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যেখানে ‘‘পাকিস্তান’’ শব্দটি ব্যবহারের দরকার ছিল, সেখানে ‘‘পূর্ব পাকিস্তান’’ অথবা ‘‘বাংলাদেশ’’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। এ কে খন্দকারকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ "স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১: বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কতটা এসেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা?"।
- ↑ ক খ "সে রাতে যেভাবে মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠান"। ২২ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ "বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা: গণপরিষদ ও সংবিধান"। দৈনিক ইত্তেফাক। ২২ মার্চ ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ "১০ এপ্রিল, ১৯৭১: স্বাধীনতার ঘোষণা ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র"।
- ↑ ক খ "স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ "আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস"। The Daily Star।
- ↑ সালিক, সিদ্দিক। Witness to Surrender।
- ↑ সিদ্দিকি, কাদের। স্বাধীনতা ৭১।
- ↑ ক খ মিয়া, ড. এম এ ওয়াজেদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ।
- ↑ ক খ গ সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু। জেনারেল জিয়ার রাজত্ব।
- ↑ ক খ "স্বাধীনতার ৪৯তম বার্ষিকী আজ"। ১৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ গ ঘ "ইতিহাস বিকৃতি; বিচারহীনতার ঔদ্ধত্য"। ২৫ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ ক খ গ "ইতিহাস বিকৃতি থেকে সরে আসুক বিএনপি"। সমকাল।
- ↑ ক খ গ "স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক"।
- ↑ ক খ গ "মহান বিজয় দিবস: ফিরে দেখা, সামনে দেখা"।
- ↑ ক খ গ "মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধে আইন: কিছু ভাবনা"।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ ক খ গ "মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নির্মাণ, ইতিহাস বিকৃতি ও শেখ মুজিব"।
- ↑ ক খ "Nixon-Ford Administrations"। history.state.gov।
- ↑ "বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার যত দলিলপত্র"।
- ↑ "Defense Intelligence Agency Report" (পিডিএফ)।
- ↑ ক খ গ "সে রাতে মুজিব যেভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠান"। ২৮ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ হাসিনা, শেখ। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু।
- ↑ "বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা যেভাবে চট্টগ্রাম পৌছায়"।
- ↑ খান, আবেদ (ডিসেম্বর ৪, ২০১৯)। "এক রহস্যময় মুক্তিযোদ্ধা"। দৈনিক জাগরণ।
- ↑ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র, তৃতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ৪।
- ↑ "Minutes of Senior Review Group Meeting1 Washington, March 6,"।
- ↑ "Memorandum From the Presidentʼs Assistant for National Security Affairs (Kissinger) to President Nixon1 Washington, March 13,"। United States Department of State।
- ↑ "Minutes of Washington Special Actions Group Meeting1 Washington, March 26,"। United States Department of State।
- ↑ "FOREIGN RELATIONS OF THE UNITED STATES, 1969–1976, VOLUME XI, SOUTH ASIA CRISIS, 1971"।
- ↑ "স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১: বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কতটা এসেছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা?"। বিবিসি বাংলা। ২৬ মার্চ ২০১৯।
- ↑ সাইয়িদ, অধ্যাপক আবু। মুক্তিযুদ্ধ: সত্যের মুখোমুখি।
- ↑ "বাংলাদেশ প্রতিদিন ৬ এপ্রিল ২০১৪"। সংগ্রহের তারিখ ৬ নভেম্বর ২০১৭।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ "'ক্যারিশমেটিক' জিয়া সেনাবাহিনীর রাজনীতিকীকরণ করেছেন - প্রথম আলো"। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ নভেম্বর ২০১৭।
- ↑ https://docs.google.com/viewer?a=v&q=cache:VeKkDBAqEzcJ:www.fhiredekha.com/gallery/albums/documents/declassifieddoc_march26_1971b.pdf+on+march+27+the+clandestine+radio+announced+the+formation+of+a+revolutionary&hl=en&gl=bd&pid=bl&srcid=ADGEEShEAKibidOlOBQev7vnIxsI447K2zd4q_Cs0PLUpUChcQWkoEbBbdX4XlY4ggzWCbi-Pn9B_l3E0malX1XI3aVuFEXYMzDOs05InKeaCVyvNwY_N8mTAcX3r8K7pfB2LhQD60DD&sig=AHIEtbSTu_IbFd5XL2SDPNWjSsqPaBVNTQ
- ↑ ক খ "দেশে এখন শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা: ফখরুল"।
- ↑ ক খ খন্দকার, এ কে (২০১৪)। ১৯৭১: ভেতরে বাইরে। প্রথমা প্রকাশন। পৃষ্ঠা ৩১–৫৬। আইএসবিএন 978-984-90747-4-8। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০২০।
- ↑ "Court summons AK Khandaker"। banglanews24.com। ১১ জুন ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০২০।
- ↑ "AK Khandker revises his book"। ঢাকা ট্রিবিউন। ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০২০।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "জাতির কাছে ক্ষমা চাইলেন এ কে খন্দকার"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ১৪ অক্টোবর ২০২০।
- ↑ "তারেক রহমান 'জীবন্ত উন্মাদ': আবদুল গাফফার চৌধুরী"। দৈনিক প্রথম আলো। ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪।