বিষয়বস্তুতে চলুন

আছারি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আছারি (আরবি: الأثرية, "আল-আছারিয়্যাহ"), অন্যান্য নাম: প্রথাবাদী ধর্মতত্ত্ব, ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্ব, পরম্পরাবাদী ধর্মতত্ত্ব বা মূলগ্রন্থবাদী ধর্মতত্ত্ব বা ইসলামী অক্ষরবাদী ধর্মতত্ত্ব, হলো একটি ইসলামি পাণ্ডিত্যনির্ভর আন্দোলন, যা ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে উদ্ভূত হয়, যারা কুরআনহাদিসের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে জাহির অর্থবাচকতার সমর্থনের ফলশ্রুতিতে ইলমুল কালামকে প্রত্যাখ্যান করে থাকে। [][] এই নামটি কৌশলগত দৃষ্টিকোণ হতে আরবি শব্দ "হাদিস"-এর অনুবাদ হিসেবে আছার (প্রথা বা ঐতিহ্য) নামক শব্দ থেকে এসেছে। একে মাঝেমধ্যে অন্যান্য নামেও ডাকা হয়। যেমন ছহীহ আকীদা, সালাফী আকীদা, আহলে হাদীস আকীদা, সালফে সালেহীনদের আকীদা ইত্যাদি।

ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্বের অনুসারীগণ কুরআনের জাহির (আক্ষরিক, প্রত্যক্ষ) অর্থে বিশ্বাস করে এবং হাদিস হলো তাদের বিশ্বাস ও আইনকানুনের সকল বিষয়ে বিধিবিধানের একমাত্র ভিত্তি এবং তাদের কাছে যৌক্তিক সমালোচনা হল নিষিদ্ধ, এমনকি যদি তা সত্য যাচাই করার জন্য হয় তবুও।[] তাঁরা কুরআনকে আক্ষরিক অর্থে পড়ে থাকে এবং তাঁরা কুরআনকে রূপকার্থে ব্যাখ্যা করার (তাউইল) বিরোধিতা করে। তাঁরা কুরআনের অর্থকে যুক্তির ভিত্তিতে ধারণা করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, তাদের বাস্তবতা শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা উচিত, যাকে তাফউইদ বলা হয়।[] মোটকথা, কুরআন ও হাদিসের লেখনীকে তাঁরা কোনো রকম প্রশ্ন করা ব্যতিরেকে গ্রহণ করে থাকে, যাকে বলা হয় "বি-লা কাইফা", যার ফলে এই মতবাদটিকে কুরআনীয় অক্ষরবাদী বা ইসলামী অক্ষরবাদী মতবাদও বলা হয়ে থাকে।

ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্ব বা আছারি মতবাদ মুহাদ্দিসদের মাঝে বিস্তৃতি লাভ করে, যারা পরবর্তীতে আহমদ ইবনে হাম্বলের (৭৮০-৮১৫) অনুসরণে "আহলুল হাদিস" নামে একটি আন্দোলনের মাধ্যমে সংগঠিত হন।[] ধর্মবিশ্বাসের বিষয়সমূহে, তাঁরা মুতাজিলা ও সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মতত্ত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, এবং তারা সেসকল ধর্মতত্ত্বের মূলনীতির বিভিন্ন বিষয়কে দোষারোপ করতো, যার মধ্যে অন্যতম ছিল অন্যান্যদের নিজস্ব আত্মরক্ষামূলক যুক্তিনির্ভর ব্যাখ্যাপদ্ধতি।[] ৪র্থ হিজরীর, আশআরীমাতুরিদি ধর্মতত্ত্ব মুতাজিলা যুক্তিবাদ ও হাম্বলি আক্ষরিকতাবাদের মাঝখানে মুতাজিলাদের যুক্তিনির্ভর ব্যখাপদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে মধ্যস্থতা তৈরি করে, যাকে মুতাজিলাগণ আছারীদের অধিকাংশ বিশ্বাসকে প্রতিহত করতে ব্যবহার করত।[] যদিও যে সকল হাম্বলি পণ্ডিত এই সংমিশ্রণকে প্রত্যাখ্যান করেছিল তাঁরা ছিল সংখ্যালঘু, তাদের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তাদের আবেগপ্রবণ ও বর্ণনা-ভিত্তিক পদক্ষেপ কিছু এলাকার শহুরে লোকজনের মধ্যে প্রভাবশালী অবস্থায় থেকে গিয়েছিল, আর তা ছিল প্রধানত আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনামলে বাগদাদ এলাকায়।[]

যদিও আশআরীমাতুরিদি মতবাদকে প্রায়শই সুন্নি "সনাতন ধারা" বলে ডাকা হয়, আছারি মতবাদও এদের পাশাপাশি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, যার অনুসারীরা একে সনাতন সুন্নি ধর্মবিশ্বাস বলে দাবি করে আসছে।[] আধুনিক যুগে, ইসলামী ধর্মতত্ত্বের উপর আছারি মতবাদের একটি ধারণাতীত প্রভাব রয়েছে, যা ওয়াহাবি ও অন্যান্য সমসাময়িক ঐতিহ্যবাদী (আছারি) সালাফি অনুসারীদের দ্বারা অনুসৃত হচ্ছে এবং তা হাম্বলি মতাদর্শের সীমা অতিক্রম করে আরও বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।[]

আছারি আকীদা সম্পর্কে ছালিহ ইবনে ফাউজান আল-ফাউজান বলেন, "যে ব্যক্তি শুধু ভালোবাসা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে সুফী বলে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে খারেজী। যে শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে মুর্জীয়া। আর যে ভালোবাসা, ভয়-ভীতি, এবং আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সেই প্রকৃত মুমিন।"[১০]

শব্দতত্ত্ব

[সম্পাদনা]

সনাতনবাদী ধর্মতত্ত্বকে বোঝাতে বেশ কয়েকটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। এগুলি অসঙ্গতভাবে ব্যবহার করা হয় এবং তাদের মধ্যে কিছু শব্দ সমালোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।


ইতিহাস

[সম্পাদনা]

ঐতিহ্যবাদী ধর্মতত্ত্ব খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শেষের দিকে মুহাদ্দিসদের মধ্যে প্রসার লাভ করে যারা কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদীসকে আইন ও ধর্মবিশ্বাসের একমাত্র গ্রহণযোগ্য উৎস হিসেবে গণ্য করেছিলেন।[]

বিশ্বাস

[সম্পাদনা]

কুরআন

[সম্পাদনা]

আছারীগণ বিশ্বাস করে যে, কুরআনের সকল অংশ হল অসৃষ্ট (গাইর মাখলুক)।[১১][১২] বর্ণিত আছে যে আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছেন, "কুরআন হল আল্লাহর বাণী, যা তিনি ব্যক্ত করেছেন; এটি অসৃষ্ট। যে এর বিপরীত দাবি করবে, সে একজন জাহমিয়া, একজন কাফির। আর যে বলে, 'কুরআন আল্লাহর বাণী,' কিন্তু এটা বলে না যে এটি 'অসৃষ্ট,' সে পূর্বোক্তের তুলনায় আরও জঘন্য কথা বলে।"[১৩]

কালাম ও মানবীয় যুক্তি

[সম্পাদনা]

আছারীদের কাছে, মানবীয় যুক্তির নির্ভুলতা হল সীমিত, আর ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়ের যৌক্তিক প্রমাণের উপর আস্থা রাখাও যায় না, বিশ্বাস করাও যায় না, তাই তাদের মতে, কালাম হল একটি নিন্দনীয় বিদআত।[]

আল্লাহর গুণাবলি

[সম্পাদনা]

আছারীগণ দৃঢ়ভাবে আল্লাহর গুণাবলির অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয় এবং এবং সেগুলোর সবগুলোকেই তারা সমানভাবে চিরন্তন হিসেবে গণ্য করে। তারা কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক আয়াতকে যেভাবে আছে সেভাবেই গ্রহণ করে, তাদের কোন যৌক্তিক বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যাকে বিবর্ধিত করার চেষ্টা করে না।[১৪]

আছারীগণ বিশ্বাস করে যে, ইসলামে নির্দেশিত রীতিনীতি ও কর্তব্য পালন করা ও না করার মধ্য দিয়ে ঈমান বৃদ্ধি ও হ্রাস পায়, যেমন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়।[১৫][১৬] তারা বিশ্বাস করে মানুষের ঈমান তার অন্তরে, মৌখিক স্বীকৃতিতে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজকর্মের মধ্যে নিহিত থাকে।[১৩]

তাওহীদের শ্রেণিবিভাগ

[সম্পাদনা]

কিছু আছারী ধর্মতত্ত্বের পণ্ডিত তাওহীদকে তিনটি শাখায় বিভক্ত করেছেন; তাওহীদ আল-রুবুবিয়াহ ("প্রভুত্বের একত্ববাদ", যে বিশ্বাসের অর্থ হল আল্লাহ পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্বের রক্ষক) ও তাওহীদ আল-উলুহিয়াহ ("ঈশ্বরত্বের একত্ববাদ", যার অর্থ হল আল্লাহকে একমাত্র ঈশ্বর হিসেবে উপাসনা করা বা ঈশ্বরকে এককভাবে উপাসনা করা) আর তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস সিফাত ("নামসমূহ ও গুণাবলির একত্ববাদ", যার অর্থ হল আল্লাহর কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলি আছে যেগুলো একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়)।[১৭] ইসলামী আলেমদের মধ্যে ইবনে তাইমিয়া সর্বপ্রথম এই পার্থক্যকে মানুষের কাছে স্বতন্ত্রভাবে সুপরিচিত করে তোলেন বলে মনে করা হয়।[১৭][১৮]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Abrahamov (2014)
  2. Halverson, Jeffry R. (২০১০)। Theology and Creed in Sunni Islam: The Muslim Brotherhood, Ash'arism, and Political Sunnism। Palgrave Macmillan। পৃ. ৩৬। আইএসবিএন ৯৭৮১১৩৭৪৭৩৫৭৮The Atharis can thus be described as a school or movement led by a contingent of scholars (ulama), typically Hanbalite or even Shafi'ite, which retained influence, or at the very least a shared sentiment and conception of piety, well beyond the limited range of Hanbalite communities. This body of scholars continued to reject theology in favor of strict textualism well after Ash'arism had infiltrated the Sunni schools of law. It is for these reasons that we must delineate the existence of a distinct traditionalist, anti-theological movement, which defies strict identification with any particular madhhab, and therefore cannot be described as Hanbalite.
  3. 1 2 Halverson, Jeffry R. (২০১০)। Theology and Creed in Sunni Islam: The Muslim Brotherhood, Ash'arism, and Political Sunnism। Palgrave Macmillan। পৃ. ৩৬আইএসবিএন ৯৭৮১১৩৭৪৭৩৫৭৮
  4. Halverson, Jeffry R. (২০১০)। Theology and Creed in Sunni Islam: The Muslim Brotherhood, Ash'arism, and Political Sunnism। Palgrave Macmillan। পৃ. ৩৬–৩৭। আইএসবিএন ৯৭৮১১৩৭৪৭৩৫৭৮
  5. 1 2 3 Lapidus (2014, p. 130)
  6. Blankinship (2008, p. 53); Lapidus (2014, pp. 123–124)
  7. Halverson (2010, p. 35)
  8. Brown (2009, p. 180): "The Ash‘ari school of theology is often called the Sunni ‘orthodoxy.’ But the original ahl al-hadith, early Sunni creed from which Ash‘arism evolved has continued to thrive alongside it as a rival Sunni ‘orthodoxy’ as well."
  9. Hoover (2014, p. 625)
  10. আল ফাওজান, সালিহ ইবনে ফাওজান। "১) الشرك في الخوف ভয়ের মধ্যে শিরক (প্রথম অংশ)"www.hadithbd.com। হাদওসনিডি.কম। সংগ্রহের তারিখ ১২ নভেম্বর ২০২২
  11. Agwan, A. R.; Singh, N. K. (২০০০)। Encyclopedia of the Holy Qur'an। Global Vision Publishing House। পৃ. ৬৭৮। আইএসবিএন ৮১৮৭৭৪৬০০৯
  12. Christopher Melchert, Ahmad Ibn Hanbal, Oneworld Publ., 2006, p 154
  13. 1 2 Halverson, Jeffry R. (২০১০)। Theology and Creed in Sunni Islam: The Muslim Brotherhood, Ash'arism, and Political Sunnism। Palgrave Macmillan। পৃ. ৪১আইএসবিএন ৯৭৮১১৩৭৪৭৩৫৭৮
  14. Ali Shah, Zulfiqar। Anthropomorphic Depictions of God: The Concept of God in Judaic, Christian, and Islamic Traditions: Representing the Unrepresentable। পৃ. ৫৭৩। আইএসবিএন ১৫৬৫৬৪৫৭৫৮
  15. Halverson, Jeffry R. (২০১০)। Theology and Creed in Sunni Islam: The Muslim Brotherhood, Ash'arism, and Political Sunnism। Palgrave Macmillan। পৃ. ২০আইএসবিএন ৯৭৮১১৩৭৪৭৩৫৭৮
  16. Herbert W. Mason, Humaniora Islamica, Volume 1, p 123.
  17. 1 2 David B. Burrell; Carlo Cogliati; Janet M. Soskice; William R. Stoeger, সম্পাদকগণ (২০১০)। Creation and the God of Abraham। Cambridge University Press। পৃ. ১১১।
  18. Asian Journal of Social Science (ইংরেজি ভাষায়)। খণ্ড Volume ৩৪, Issues ১-৪। Brill। ১ জানুয়ারি ২০০৬। পৃ. ১০৬। {{বই উদ্ধৃতি}}: |খণ্ড=-এ অতিরিক্ত লেখা রয়েছে (সাহায্য)

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]