শবে বরাত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শবে বরাত
ইরানে শবে বরাত
আনুষ্ঠানিক নামফারসি: شب برات
অর্থ: মুক্তি রজনী
পালনকারীমুসলিম
তাৎপর্যমুক্তির রাত (ক্ষমা প্রার্থনা বোঝানো হয়)
তারিখ১৪ ও ১৫ শা'বানের মধ্যবর্তী রাতে

শবে বরাত বা মধ্য-শা'বান (আরবি: نصف شعبان, প্রতিবর্ণীকৃত: নিসফে শাবান) বা লাইলাতুল বরাত হচ্ছে হিজরী শা'বান মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখের মধ্যবর্তী রাতে পালিত মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ রাত।[১][২] উপমহাদেশে এই রাতকে শবে বরাত বলা হয়। ইসলামী বিশ্বাস মতে, এই রাতে আল্লাহ তার বান্দাদেরকে বিশেষভাবে ক্ষমা করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অনেক মুসলমান নফল ইবাদাতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করেন। অনেক অঞ্চলে, এই রাতে তাঁদের মৃত পূর্বপুরুষদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।[৩] বারো শিয়া মুসলিমরা, এই তারিখে মুহাম্মদ আল-মাহদির জন্মদিন উদ্‌যাপন করে।[৪][৫] তবে সালাফিরা এর বিরোধিতা করে থাকেন।[৬]

শব্দতত্ত্ব[সম্পাদনা]

শাবান মাসের ১৫তম রাতকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। নামকরণগুলো দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকে:

  1. মধ্য শাবান বা অর্ধ শাবান, ইসলামী দিনপঞ্জির অষ্টম মাস শাবান মাসে দিনটির অবস্থান অনুসারে নামকরণ।
    1. ইরানআফগানিস্তানে নিম শা'বান।
    2. আরবী ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফ্ শা'বান।
    3. মালয় ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফু শা'বান; ইত্যাদি।
  2. বরাতের রাত, ফার্সিতে বরাত শব্দের অর্থ হল ভাগ্য, বণ্টন, নির্ধারিত।
    1. লাইলাতুন নিফসি মিন শা'বান
    2. লাইলাতুল দোয়া।
    3. তুর্কি ভাষাভাষীগণ বলেন বিরাত কান্দিলি।
    4. ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় শবে বরাত, নিসফু শাবান ইত্যাদি।

উৎস[সম্পাদনা]

শবে বরাত একটি ফার্সি শব্দ যার কারণে এই শব্দের ব্যবহার আরবিতে নেই। তবে শাবান মাসের গুরুত্ব রয়েছে। শাবান মাসের মধ্য তারিখের গুরুত্ব রয়েছে।

হাদিস[সম্পাদনা]

সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাদিসগুলোর সনদ বিভিন্ন মানের এবং এবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। হাদিস শাস্ত্রে 'শবে বরাত' বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো "নিসফ শাবান" বা "লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান" তথা "শা'বান মাসের মধ্য রজনী"। একটি হাদীসে বলা হয়েছে,

রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।

— (ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)[সনদ হাসান][৭][৮][৯]

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে, মুহাম্মাদ (সঃ) এ মাসে বেশি বেশি নফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,

“এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।”

— (নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪৭।[সনদ হাসান][৭])

হাদিস অনুসারে এই রাত দোয়া কবুল, ক্ষমা প্রার্থনা সহ আল্লাহ'র কাছে চাওয়ার রাত। যথা:

عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في هذا الحديث: إنه واه جداً)

অর্থ : আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন : আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্‌ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্‌ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)

আবূ হুরাইরা বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ হাদীস মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ পৃথিবীর আকাশে আসেন।

তাকি উসমানি বলেন, "এ কথা বলা একেবারেই ভুল যে, শবেবরাত কোন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং আসল সত্য হল, ১০ জন সাহাবি থেকে এই হাদিস বর্ণিত আছে। যে হাদিসগুলোয় নবী করীম (সা.) এই রাতের ফজিলত বর্ণনা করেছেন। সেই হাদিসগুলোর মধ্যে কিছু হাদিস সনদের দিক থেকে যদিও কিছুটা দূর্বল। যার কারণে কয়েকজন আলেম বলেছেন এই রাতের ফজিলতের কথা ভিত্তিহীন। কিন্তু এর স্বপক্ষে অন্য অনেক হাদিস পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে সেগুলোর দূর্বলতা দূর হয়ে যায়।"[১০]

সম্পর্কিত প্রথা[সম্পাদনা]

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, লেবানন, ইরান, আজারবাইজান, তুরস্ক, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তানকিরগিজস্তান-এ মধ্য শাবান উদযাপিত হয়। সালাফি আরবগণ এই দিনটি পালন করে না, তাদের মতে এইরাতে বিশেষ কোনো ইবাদাতের নির্দেশ নেই। আরব বিশ্বে, সুফি ঐতিহ্যের আরবেরা ও শিয়ারা এই উৎসব পালন করে।

ইরানে বারো ইমাম শিয়ারা শিয়া মতবাদের দ্বাদশ ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে এই দিনটি পালন করে। এই রাতে ইরানের সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা করা হয়, দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়।[১১] ইরাকে এই দিনে বাচ্চারা প্রতিবেশীর বাড়ি গেলে তাদেরকে মিষ্টিমন্ডা খেতে দেওয়া হয়। ইরাকি কুর্দিস্তান ও আফগানিস্তানের সুন্নি মুসলিমগণ রমযানের ১৫ দিন আগে এই পবিত্রদিন পালন করেন।[১২] বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন স্বাদের খাবার। এসবের মধ্যে রয়েছে রুটি, বিভিন্ন রুচির হালুয়া, সুজি, মিষ্টান্ন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় পাড়া প্রতিবেশিদের মাঝে এসব খাবার বিতরণ ও পরিবেশন করা হয়। শবে বরাত উপলক্ষে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বেতারটেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। জাতীয় পত্রিকাগুলো এ দিন বিশেষ ক্রোড়পত্র ও সাময়িকী প্রকাশ করে। শবে বরাতের পর আসন্ন দিনটি বাংলাদেশে সাধারণ ছুটির দিন হিসবে পালিত হয়।

ইন্দোনেশিয়ায় কিছু মুসলমান মসজিদে উস্তাদ বা জাভা ও মাদুরায় কায়ি নামে পরিচিত ধর্মীয় নেতার বক্তৃতা (সেরামাহ) শোনে ও দলীয়ভাবে জিকির করে। ইন্দোনেশিয়ায় এই প্রথা পালিত হয় না বললেই চলে, তবে আচেহ, পশ্চিম সুমাত্রা ও দক্ষিণ কালিমান্তা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পালিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমগণ মিষ্টান্ন বানায় (বিশেষত হালুয়া বা জর্দা) ১৫ই শাবান সন্ধ্যার সময় প্রতিবেশী ও দরিদ্রদের দেওয়ার জন্য।[১৩] বসনিয়াতেও শাবানের ১৫তম রাতে হালুয়া বিতরণের এই প্রথা পালিত হয়, এবং বাকি তিনটি পবিত্র দিনেও হালুয়া বিতরণ করা হয়: শবে কদর, শবে মেরাজ ও লাইলাতুল রাগাইব।

ইমাম আল-মাহদীর জন্মদিন[সম্পাদনা]

ইরানের কওমে জমকরন মসজিদে শবে বরাত উদ্‌যাপন।

বারো ইমাম শিয়াদের বক্তব্য অনুসারে, মুহাম্মাদ আল-মাহদী, সর্বশেষ শিয়া ইমাম ১৫ শাবানে জন্মগ্রহণ করেন। শিয়ারা এই দিনে মুহাম্মাদ আল-মাহদির জন্মদিন পালন করে এবং নামাজ, রোজা ও ইবাদত করে সময় কাটায়। মধ্য শাবানের রাতে ইরানি শহরগুলোকে সাজিয়ে তোলা হয়।[১৪][১৫]

তারিখ[সম্পাদনা]

যদিও ইসলামি পঞ্জিকায় মধ্য শা'বানের তারিখ সবসময় একই থাকে, তবে গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় প্রতি বছর তারিখটি আগের বছরের তারিখের থেকে প্রায় ১১ দিন আগে আসে, যেহেতু ইসলামি পঞ্জিকা হল চন্দ্রভিত্তিক এবং গ্রেগরীয় পঞ্জিকা সৌরভিত্তিক।

আসন্ন বছরগুলোর তারিখ
ইসলামি সাল উম্মা আল-কুরা-র অনুমান
১৪৪২ ২৯ মার্চ ২০২১
১৪৪৩ ১৯ মার্চ ২০২২
১৪৪৪ ৮ মার্চ ২০২৩
১৪৪৫ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
১৪৪৬ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. গনী, শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান। "শবে বরাতের তাৎপর্য ও ফজিলত"প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ৩০ মার্চ ২০২১ 
  2. "শবে বরাতের ফজিলত ও তাৎপর্য"দৈনিক ডেল্টা টাইমস 
  3. ইলিয়াস, জামাল জে. (২০০৩-০৯-০১)। Islam (ইংরেজি ভাষায়)। টেইলর এন্ড ফ্রান্সিস। আইএসবিএন 978-0-203-51660-7 
  4. "The great Shia scholar, Abu Ja'far Mohammad ibn Uthman al-Amri || Imam Reza (A.S.) Network"। ২০১৭-০৯-২৯। ২০১৭-০৯-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-২৯ 
  5. Shadhan, al-Fadl ibn (১৯৯৬-০১-০১)। The Return of al-Mahdi (ইংরেজি ভাষায়)। তানজানিয়ার বিলাল মুসলিম মিশন। আইএসবিএন 978-9976-956-96-2 
  6. মেমন, মুহাম্মদ উমর; ইবনে তাইমিয়া, আমাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আলমি (১৯৭৬)। Ibn Taimīya's Struggle Against Popular Religion: With an Annotated Translation of His Kitāb Iqtiḍāʼ Aṣ-ṣirāṭ Al-mustaquīm Mukhālafat Aṣḥāb Al-jaḥīm (ইংরেজি ভাষায়)। মৌটন। আইএসবিএন 978-90-279-7591-1 
  7. ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (২০১৭)। শবে বরাত : ফজিলত ও আমল (২য় সংস্করণ)। আস সুন্নাহ পাবলিকেশন। 
  8. টেমপ্লেট:Ihadis
  9. সুনানে ইবনে মাজাহ ভলিউম ১, বই ৫, হাদিস ১৩৯০, sunnah.com
  10. "শবে বরাতের করণীয় ও বর্জনীয়"যুগান্তর। ২১ এপ্রিল ২০১৯। 
  11. "ইরানের শবে বরাত উৎসব"প্রথম আলো। ১৪ মে ২০১৭। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  12. "Live Chennai: Shab-E-Barat – Festivals of India – Festivals in India – Muslim Festivals – Ramzan – Id-ul-fitr – Bakrid, Eid Mubarak"livechennai.com 
  13. "About: Shab-e-barat (شب برات)"Events In Karachi – Latest Event Updates- Articles – About Karachi। ৬ জুন ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ এপ্রিল ২০১৯ 
  14. "Iranians celebrate birth of Imam Mahdi"প্রেস টিভি। ২৬ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০১৫ 
  15. "A Dazzling Night in Iran Embellished with Spirituality"Real Iran। ২৬ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০১৫