বিষয়বস্তুতে চলুন

মিষ্টি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(মিঠা থেকে পুনর্নির্দেশিত)
রসগোল্লা

মিষ্টি হলো চিনির বা গুড়ের রসে ভেজানো ময়দার গোলা কিংবা দুধ- চিনি মিশিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকৃতির ছানার অথবা ময়দার টুকরো করা খাবার। বাঙালির খাওয়া-দাওয়ায় মিষ্টি একটি অতি জনপ্রিয় উপকরণ। বাঙালির কোন উপলক্ষ-অনুষ্ঠানই মিষ্টি ছাড়া পূর্ণতা পায় না। মিষ্টির নাম শুনলেই জিভে জল আসে। বাংলাদেশে মিষ্টিকে পণ্য করে গড়ে উঠেছে অগণিত নামী-দামী মিষ্টি-বিক্রয়কেন্দ্র। সেই আদিযুগের লাড্ডু থেকে শুরু করে সন্দেশ, কালোজাম পেরিয়ে আজ মিষ্টির প্রকারভেদ শিল্পের পর্যায়ে চলে গেছে। বিভিন্ন রকমের মিষ্টি স্বাদ, আকারে এমনকি নামকরণে ভিন্নতা নিয়ে জনপ্রিয়। বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা নেপাল মায়ানমার এই অঞ্চলে মিষ্টির প্রচুর ব্যবহার করা হয় সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে মিষ্টির ব্যবহার অত্যন্ত প্রবল ।এই অঞ্চলে যে পরিমাণ মিষ্টি মানুষ ব্যবহার করে এমন এই পরিমাণ মিষ্টি কখনো বিশ্বের অন্য দেশে ব্যবহার করা হয় না[]

মিষ্টির প্রকারভেদ

[সম্পাদনা]
পাত্র ভর্তি রসমালাইচাঁদপাড়া বাজার থেকে ১ কিমি দূরে চাঁদপাড়া-পাল্লা রোডের পাশে একটি ছোট মিষ্টির দোকানে। দুধ, দুধের সর, ছানা ও ময়দা দিয়ে তৈরি হয় এই রসমালাই
কালোজাম

বাংলার মিষ্টিকে দু'ভাগে ভাগ করেছেন সুকুমার সেন। প্রথম ভাগে আছে একক উপাদানে তৈরি মিষ্টি। এ ধরনের মিষ্টিতে গুড় বা চিনির সাথে আর কিছু মিশ্রিত থাকে না। যেমনঃ গুড় বা চিনির নাড়ু ও চাকতি, পাটালি, বাতাসা, খাজা, ছাঁচ ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধরনের মিষ্টিকে আরো দু' রকমে ভাগ করা চলে। গুড় বা চিনির সাথে দুগ্ধজাত কোন উপকরণ ছাড়া অন্য দ্রব্য সহযোগে তৈরিকৃত মিষ্টান্ন। যেমনঃ নারকেল, তিল এসবের নাড়ু, চিঁড়া, মুড়ি, খৈ-এর মোয়া ইত্যাদি। দুগ্ধজাত দ্রব্যযোগে তৈরি নানান ধরনের মিষ্টি রসিক ও মিষ্টিপ্রিয় বাঙালির সুপরিচিত। চিনির সাথে ছানার সংযোগে তৈরি হয় সন্দেশমণ্ডা। আবার এই ছানা রসে মাখিয়ে তৈরি হয় রসগোল্লা, দুধে ডোবালে রসমালাইবেসনের ছোট ছোট দানা ঘিয়ে ভেজে তৈরি হয় বুন্দিয়া, যা দেখতে ছোট বিন্দুর মতো। কড়া পাকে প্রস্তুতকৃত বুন্দিয়াই মতিচুর লাড্ডুর কাঁচামাল।[]

কয়েকপ্রকারের মিষ্টি

ভারতীয় উপমহাদেশের মিষ্টির ইতিহাস

[সম্পাদনা]

ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি মতিচূর লাড্ডু[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বয়স প্রায় দুই হাজার বছরেরও বেশি। আধুনিক সন্দেশ-রসগোল্লার বয়স মাত্র দুই-আড়াই'শ বছর। বাঙালিরা ছানা তৈরি করতে শিখেছে পর্তুগিজদের থেকে। তাদের কাছ থেকে বাঙালি ময়রারা ছানা ও পনির তৈরির কৌশল শেখে। ভাস্কো দা গামা কালিকট বন্দরে এসেছিলেন ১৪৯৮ সালে, ভারত ত্যাগ করেন ১৫০৩ সালে। উপমহাদেশে ছানা তৈরির শিক্ষাবিস্তার অনেক পরের ঘটনা।

প্রথম দিকে ছানা ও ছানার মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে। বৈদিক যুগে দুধ ও দুধ থেকে তৈরি ঘি, দধি, মাখন ইত্যাদি ছিল দেবখাদ্য। বিশেষ করে ননি ও মাখন অত্যন্ত প্রিয় ছিল শ্রীকৃষ্ণের। এ জন্য দুধ থেকে রূপান্তরিত ওই সব খাদ্য শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু ছানা তৈরি হয় দুধ বিকৃত করে, এ জন্য মনুর বিধানমতে, ছানা ছিল অখাদ্য।

এ সম্পর্কে সুকুমার সেন তার কলিকাতার কাহিনী বইয়ে লিখেছেন, "ক্ষীর-মাখন-ঘি-দই—এগুলো কাঁচা দুধের স্বাভাবিক পরিণাম, কৃত্রিম অথবা স্বাভাবিক। কিন্তু কোনোটিই দুধের বিকৃতি নয়। ‘ছানা’ কিন্তু ফোটানো দুধের কৃত্রিম বিকৃতি। বাঙালি অন্য দ্রব্য সংযোগ করে দুধ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে, যাতে সারবস্তু ও জলীয় অংশ পৃথক হয়ে যায়। এভাবে দুধ ছিন্নভিন্ন করা হয় বলেই এর নাম হয়েছিল বাংলায় ‘ছেনা’, এখন বলা হয় ‘ছানা’। সংস্কৃত ভাষায় ছানার কোনো রকম উল্লেখ নেই। অন্য ভাষাতেও ছিল না। আগে অজ্ঞাত ছিল বলেই শাস্ত্রসম্মত দেবপূজায় ছানা দেওয়ার বিধান নেই।"

সন্দেশ ছানা আবিষ্কারের আগে ছিল। আগের দিনে সন্দেশ তৈরি করা হতো বেসন, নারকেল ও মুগের ডালের সঙ্গে চিনির সংযোগে। এ ছাড়া শুধু চিনি দিয়ে তৈরি এক ধরনের চাকতিকেও অনেক সময় সন্দেশ বলা হতো। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙালির ইতিহাস বইয়ে বাঙালির মিষ্টিজাতীয় যে খাদ্যের বিবরণ দিয়েছেন, তাতে সংগত কারণেই ছানার কোনো মিষ্টির উল্লেখ নেই। দুধ থেকে তৈরি মিষ্টির মধ্যে আছে দই, পায়েস ও ক্ষীরের কথা। সন্দেশের উল্লেখ আছে, তবে সেই সন্দেশ ছানার নয়। তিনি বলেছেন, ‘কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয়-বান্ধবদের চিপিটক বা চিঁড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানা প্রকারের সন্দেশ পরিতৃপ্ত করিতে হইত এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়।’

চিনির সঙ্গে ছানার রসায়নে আধুনিক সন্দেশরসগোল্লার উদ্ভাবন অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে। এই আধুনিক সন্দেশ রসগোল্লার আবিষ্কর্তা হুগলির হালুইকররা। পরে তারা কলকতায় এসে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একে জগদ্বিখ্যাত করে তোলেন। প্রথম দিকে ছানার সন্দেশকে বলা হতো ‘ফিকে সন্দেশ’। কারণ, এ সন্দেশে আগের দিনের সন্দেশের চেয়ে মিষ্টি কম। শাস্ত্রসম্মত নয় বলে ছানার সন্দেশ অনেকে খেতে চাইত না। কলকাতার ময়রাদের সৃষ্টিতে মুগ্ধ শঙ্কর তার বাঙালির খাওয়া দাওয়া বইয়ে কড়াপাক, নরমপাক, কাঁচাগোল্লা, চন্দন সন্দেশসহ হাজার রকম সন্দেশের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘এঁরা আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মতো পাইকিরি হারে মিষ্টি শাস্ত্রে নোবেল জয়ী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন।’ তিনি জানিয়েছেন, সন্দেশ এত বৈচিত্র্যময় যে শীতকালের সন্দেশ আর গ্রীষ্মের সন্দেশে তো পার্থক্য আছেই, এমনকি সেপ্টেম্বর আর অক্টোবরের সন্দেশও নাকি এক রকম নয়।

রসগোল্লার নাম আদিতে ছিল গোপাল গোল্লা। রসের রসিক বাঙালি চিনির সিরায় ডোবানো বিশুদ্ধ ছানার গোল্লাকে নাম দিয়েছে রসগোল্লা। পরে ছানা ও চিনির রসায়নে নানা আকৃতি ও স্বাদে নানা নামে মিষ্টির সম্ভার হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময়। এর মধ্যে আছে লেডিকেনি, চমচম, পানিতোয়া, কালোজাম, আমৃতি, রসমালাই—হরেক রকম। রসগোল্লার মতোই গোলাকার লাল রঙের লেডিকেনি নামে মিষ্টিটি তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর সম্মানে। লোকমুখে এর চলতি নাম লেডিকেনি। আর রসগোল্লার সর্বশেষ নিরীক্ষাধর্মী সংস্করণ হলো স্পঞ্জ রসগোল্লা। এটি এখন উভয় বাংলায় বেশ জনপ্রিয়। ছানার মিষ্টি এপার-ওপার উভয় বাংলায় বিপুল জনপ্রিয় হলেও বঙ্গের বাইরে, বিশেষত ভারতের অন্যত্র এখনো ছানার মিষ্টি তেমন তৈরি হয় না। বহির্বঙ্গের মিষ্টি প্যাড়া, মেওয়ার শুকনো মিষ্টি। এ কারণেই দিল্লির মসনদ এখনো লাড্ডুর দখলে।

বাংলাদেশের বিখ্যাত মিষ্টি

[সম্পাদনা]
পোড়াবাড়ির চমচম, টাঙ্গাইল
রসগোল্লা
মন্ডা, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ মিষ্টির ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন সেখানকার ময়রারা। তাদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে সেসব মিষ্টি। এর মধ্যে আছে-

পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ মিষ্টি

[সম্পাদনা]

মিষ্টি নির্মাতা, মিষ্টির দোকান

[সম্পাদনা]
ভীম চন্দ্র নাগ, কলকাতার প্রসিদ্ধ সন্দেশ-প্রস্তুতকারক, যার গোড়াপত্তন হয় ১৮২৬ সালে।
মাতৃ ভান্ডার, রসমালাইর উৎপত্তি স্থল।

মিষ্টি নির্মাণ একটি বিশেষ কলা। যারা মিষ্টি তৈরী করে তাদের বলা হয় ময়রা

এলাকাভিত্তিক মিষ্টির প্রসিদ্ধি ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবেও অনেক মিষ্টিশিল্পী খ্যাতিমান হয়েছেন বিশেষ কোনো মিষ্টি তৈরির জন্য।

মিষ্টির উদ্ভাবক হলেন হারাধন ময়রা।

মিষ্টি খেতে বারণ

[সম্পাদনা]

ডায়াবেটিস রোগীদেরকে মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে ডাক্তাররা মানা করে থাকেন। তবে, এ ধরনের রোগীদের যখন গ্লুকোজের মাত্রা খুব কমে যায় তখন মিষ্টি কিংবা মিষ্টিজাতীয় খাবার অল্প পরিমাণে দেয়া যেতে পারে।

গ্যালারি

[সম্পাদনা]

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ এপ্রিল ২০১৬ 
  2. "eProthomAlo"। ২০০৯-১১-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১১-২২