ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী

শ্রীল প্রভুপাদ
শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ, আনু. ১৯৩০ দশক
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম
বিমলা প্রসাদ দত্ত

(১৮৭৪-০২-০৬)৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৪
মৃত্যু১ জানুয়ারি ১৯৩৭(1937-01-01) (বয়স ৬২)
ধর্মহিন্দুধর্ম
জাতীয়তাভারতীয়
আখ্যাবৈষ্ণব সম্প্রদায়
সম্প্রদায়গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়
স্বাক্ষর
এর প্রতিষ্ঠাতাগৌড়ীয় মঠ
দর্শনঅচিন্ত্য ভেদ অভেদ
ধর্মীয় জীবন
গুরুগৌরকিশোর দাস বাবাজী
শিষ্য
সাহিত্যকর্মভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গ্রন্থপঞ্জি
সম্মানসিদ্ধান্ত সরস্বতী প্রভুপাদ ("প্রজ্ঞার শিখর");
গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের প্রচারক;
গৌড়ীয় মঠের প্রতিষ্ঠাতা;
আচার্য-কেশরী (সিংহ-গুরু)
শ্রীশ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ

ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী (আইএএসটি: Bhakti-siddhānta Sarasvatī) একজন গৌড়ীয় বৈষ্ণব হিন্দু আধ্যাত্মিক গুরু, আচার্য (দর্শন প্রশিক্ষক) এবং বিংশ শতাব্দীর ভারতে পুনরুজ্জীবনবাদী ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম ও গৌড়ীয় মঠ এর প্রতিষ্ঠাতা। তার আসল নাম "বিমলা প্রসাদ দত্ত"।[১] তিনি বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী প্রচার করেছিলেন। তিনি জাতিভেদ এবং অ-ব্যক্তিসত্ত্বার বদ্ধমূল প্রভাবের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রচার চালিয়েছিলেন। জ্ঞান হিসেবে কৃষ্ণভাবনার উচ্চমূল্য প্রদান হেতু পণ্ডিত, শিক্ষক এবং অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে বৈঠকপূর্বক এবং ১০৮ টি রচনা ও গ্রন্থ লিখে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি ভারতের অভ্যন্তরে ও বাইরে ৬৪ টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা গৌড়ীয় মঠ নামে পরিচিত।

জীবন[সম্পাদনা]

১৮৭৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর (কেদারনাথ দত্ত) ও শ্রীমতী ভগবতী দেবীর পুত্র হিসাবে চৈতন্য মহাপ্রভুর শিষ্য মহান বৈষ্ণব আচার্য পুরীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।[২] গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের আচার্য বাবার কাছ থেকে কৃষ্ণ ভক্তি পেয়েছিলেন।[৩] শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ স্বভাবতই অত্যন্ত মেধাবী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি কোন সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন শুদ্ধ ভক্ত। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে সুন্দরভাবে পরিচালিত করেন, প্রশিক্ষিত করেন এবং গড়ে তোলেন। যখন তাঁর বয়স মাত্র ৬ বছর তখন শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর তাঁকে নৃসিংহ মন্ত্র প্রদান করেন। যখন তার বয়স আট, তখন কূর্মদেবের পূজার্চনা পদ্ধতি শেখান, কূর্ম মন্ত্র প্রদান করেন।ভগবত গীতা ও চৈতন্য মহাপ্রভুর পবিত্র জীবন চরিত্র তাকে কৃষ্ণ ভক্তি ছড়িয়ে দিতে উৎসাহ দিয়েছিল।

১৮৮৫ সনে তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহ প্রকাশনার জন্য একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ১১ বছর বয়সে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ তাঁর রচনাসমূহ সম্পাদনা করতেন। সেই ১১ বছর বয়সেই তিনি সম্পাদনা, ভুল সংশোধন এবং সেই অপ্রাকৃত গ্রন্থসমূহ ছাপানোর কাজে তাঁর পিতা ভক্তিবিনোদ ঠাকুরকে সাহায্য করতে শুরু করলেন। ১৮৯১ সনে ১৭ বছর বয়সে তিনি ‘‘দি অগাস্ট এ্যাসেম্বলী’’ নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অগাস্ট এ্যাসেম্বলীর উদ্দেশ্য ছিল তরুণ কিশোরদের একত্রিত করা যাতে তারা আজীবন ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করতে পারে।তিনি যুবক অবস্থাতেই ইংরেজিবাংলাতে কার্যকরী বক্তা ছিলেন। তরুণ প্রজন্ম বিশেষ করে তার বক্তৃতা শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। [২] তিনি দক্ষিণেশ্বর মন্দির যেতেন ও প্রায়ই রামকৃষ্ণ পরমহংসস্বামী বিবেকানন্দ এর ধর্মতত্ত্ব নিয়ে কথা বলতেন। তিনি সেই ব্রহ্মচারীদের সমাবেশ তথা অগাস্ট এ্যাসেম্বলী শুরু করেছিলেন কিন্তু কেবলমাত্র একজনই সমগ্রজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের প্রতিজ্ঞা পালনে সক্ষম হয়েছিলেন, তিনি হলেন শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রবুপাদ। ১৭ বছর বয়সে অগাস্ট এ্যাসেম্বলী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের যে সংকল্প করেছিলেন তা তিনি সমগ্রজীবনব্যাপি পালন করেছিলেন। তার পরের বছরই শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর “স্নানন্দ সুখদা কুঞ্জ” প্রতিষ্ঠা করেন যা ছিল তাঁর বাসস্থান এবং ভজন কুঠির। এটি ছিল অত্যন্ত সুন্দর আবাসগৃহ। ১৮৯৮ সনে শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের সাক্ষাৎ লাভ করেন। তিনি তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হন। ১৯০০ সনে বহু প্রচেষ্টা এবং অনেক বাধারপরীক্ষা অতিক্রম করে তিনি শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজের নিকট দীক্ষা প্রাপ্ত হন। গৌর কিশোর দাস বাবাজী কোন শিষ্য গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর তাকে দীক্ষা প্রদান করতে বাধ্য করেছিলেন। ১৯০৫ তিনি শতকোটি হরিনাম জপের আরেকটি মহা সংকল্প গ্রহণ করেন। শত কোটি নাম যজ্ঞ। সে যজ্ঞ সম্পাদন কল্পে তাকে তিন লক্ষ নাম জপ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ তাকে দশ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন অন্তত ৬৪*৩ = ১৯২ মালা জপ করতে হয়েছিল। সেসময় মায়াপুরে কিছুই ছিল না, তার নাম জপের যে সংকল্প তিনি এই মায়াপুরেই সম্পাদন করতে চেয়েছিলেন। তখন এখানে কিছুই ছিল না। তিনি গঙ্গার তীরে একটি ছোট্ট কুঠিরে থাকতেন। বর্ষার সময় যখন বৃষ্টি হতো তখন সেখানে জল চুয়ে চুয়ে পড়ত অথবা ছাদ বেয়ে ভেতরে জল গড়িয়ে পড়ত। তিনি একটি ছাতা নিয়ে বসে থাকতেন এবং হরিনাম জপ করতেন। তারপর ১৯১৮ সাল থেকে, তিনি তার প্রচারের মিশন শুরু করেন। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নবদ্বীপের মায়াপুরে থেকে যাবেন এবং কলকাতায় গিয়ে প্রচার শুরু করবেন সারাবিশ্বকে কৃষ্ণভাবনার জোয়ারে প্লাবিত করতে। তিনি কলকাতা গিয়েছিলেন, আমি শুনেছি যে, যখন তিনি কলকাতা যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করেন, তখন গৌর কিশোর দাস বাবাজী মহারাজ কিছুটা উদ্বিগ্ন হন। তিনি বলেছিলেন, “না, কলকাতায় যেও না, সেটি কলির আস্থানা।’ তখন ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর বলেছিলেন, “আপনার শ্রী পাদপদ্ম আমার মস্তকে ধারণ করে, আমি কলির যে কোনো আক্রমণ প্রতিহত করতে পারব এবং এভাবে তিনি কলি বা কলির প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করব।” এভাবে তিনি তার প্রচার মিশনে অগ্রসর হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে, গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ এবং ভক্তিবিনোদ ঠাকুর উভয়ই প্রকট হলেন, ভক্তবিনোদ ঠাকুর অপ্রকট হন ১৯১৪ সালে এবং গৌরকিশোর দাস বাবাজী মহারাজ অপ্রকট হন ১৯১৫ সালে ১৯১৮ সালে, শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ তাঁর প্রচার আন্দোলন শুরু করেন। তিনি কলকাতায় যান। আপনারা সবাই জানেন যে, তার প্রথম মঠ বা প্রচার কেন্দ্র স্থাপিত হয় এক উল্টোদাঙ্গা প্রধান সড়কে। যেখানে শ্রীল ভক্তি বেদান্ত স্বামী ১৯২২ সালে তার সাথে সাক্ষাত করেছিলেন। সেসময় প্রভুপাদ ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর শ্রীল ভক্তি বেদান্ত স্বামী তাঁর প্রথম নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করেছিলেন। শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ এভাবে ১৯১৮ সালে তার প্রচার মিশন শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯১৩ সাল পর্যন্ত খুব সুন্দরভাবে কৃষ্ণভাবনা প্রচার করেন। ভারতজুড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ৬৪টি মঠ এবং সে সময়ের কাছ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তিনি প্রভাবিত করেন। তিনি তাদেরকে আকর্ষণ করতেন। তিনি কৃষ্ণভাবনা প্রচারের এক বিশেষ ও অদ্বিতীয় পন্থার সূচনা করেছিলেন। কৃষ্ণভাবনামৃত প্রচারের এই নীল নকশাটি প্রদান করেছিলেন ভক্তিবিনোদ ঠাকুর। প্রচার আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূল লক্ষ্যটি ছিল: কৃষ্ণভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করা এবং এই কলিযুগে অধর্মের প্রভাব চিরতরে নির্মূল করা। অতএব আমরা দেখি যে, ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর সংকীর্তন আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করেছিলেন। সাধারণভাবে সংকীর্তনের অর্থ হল সম্মিলিত কীর্তন। কিন্তু এখানে তার সংকীর্তন আন্দোলন মানে ছিল গ্রন্থ ছাপানো এবং বিতরণ। এই সংর্কীন আন্দোলনে মৃদঙ্গ হল বৃহৎমৃদঙ্গ। কৃষ্ণভাবনা প্রচারের ক্ষেত্রে তার সংযোজিত এই নতুন মাত্রাটি ছিল অদ্বিতীয়। শুধু তাই নয়, তিনি আরেকটি অত্যন্ত অদ্বিতীয় একটি মাত্রা প্রদান করে গেছেন। প্রথমদিকে তিনি উল্টাদঙ্গ প্রধান সড়কে একটি দো-তলা ঘরে থাকতেন। তখন কিছু ধনী লোক তার প্রচারে আকর্ষিত হয়ে নিজেদেরকে তার কাছে উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের একজন বাগবাজারে একটি বড় মন্দির তৈরি করেন। তাই তিনি উল্টাডাঙ্গা থেকে বাগবাজার গৌড়ীয় মঠে প্রস্থান করেন সেখানে বিগ্রহ অভিষেকের সময় তিনি একটি গান গেয়েছিলেন। গানটি ছিল এরকম :

পুজালা রাগ-পঠ গৌরব ভঙ্গে মতাাল সাধু-জন বিশ্ব-রঙ্গে।

‘গৌরব’ অর্থ শ্রদ্ধা এবং ভক্তি।

‘গৌরব ভঙ্গে’ অর্থ শ্রদ্ধা ও ভক্তির এই পন্থা পরিত্যাগ করে রাগ-মার্গ গ্রহণ করা। রাগ-মার্গ পূজিত এবং প্রতিষ্ঠিত। তার ফল সাধু ব্যক্তিদান বিশ্ব রঙ্গে যিুক্ত হয়েছেন। যা দৃশ্যত জড় কার্যকলাপ বলে প্রতিভাত হয়।


শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর প্রভুপাদ, মহাপ্রভুর সংকীর্তন আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং অত্যন্ত যথাযথভাবে শ্রীল ভক্তি বেদান্ত স্বামী সেটিকে বহন করেছিলেন এবং সারাবিশ্বে তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

১৯৩৬ সালের ১লা জানুয়ারি ভোরে ৫ টা ৩০ মিনিটে তিনি পরলোক গমন করেন।

স্মৃতি[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আবির্ভাব তিথি ও ব্যাস পূজা"Eibela। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৫-১২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. Sardella, Ferdinando (২০১৩-০১-১০)। Modern Hindu Personalism: The History, Life, and Thought of Bhaktisiddhanta Sarasvati (ইংরেজি ভাষায়)। OUP USA। আইএসবিএন 9780199865901 
  3. Jacobsen, Knut A.; Basu, Helene; Malinar, Angelika; Narayanan, Vasudha (২০০৯)। Brill's Encyclopedia of Hinduism (ইংরেজি ভাষায়)। Brill। আইএসবিএন 9789004178960 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]