মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীর প্রতীক
জন্ম২৬ অক্টোবর ১৯৪১
মৃত্যু৩১ মার্চ ২০০৮
জাতীয়তাবাংলাদেশী
নাগরিকত্ব পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ
পেশাসেনাবাহিনী অফিসার
পরিচিতির কারণবীর প্রতীক
দাম্পত্য সঙ্গীনাসিমা আক্তার
সন্তানবিগ্রেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইফ উল্লাহ
পিতা-মাতামাওলানা মোহাম্মদ মহিব উল্লাহ ও রাবেয়া খাতুন

মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ (জন্ম: ১৯৪১ - মৃত্যু: ২০০৮) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।[১]

জন্ম ও শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ’র জন্ম কুমিল্লা জেলার চান্দিনা উপজেলার কৈলাইন গ্রামে। তার বাবার নাম সাহেবউল্লাহ এবং মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। তার স্ত্রীর নাম নাসিমা আক্তার। তার এক ছেলে। [২]

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের বাংলার শিক্ষক ছিলেন মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন। পরে তিনি ৮ নম্বর সেক্টরের হাকিমপুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তাকে ক্যাপ্টেন উপাধি প্রদান করা হয়। তিনি বালিয়াডাঙ্গায় যু্দ্ধ করেন। এ যুদ্ধ এত ভয়াবহ, ল যে আজও সে কথা মনে করলে ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা শিউরে ওঠেন। ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার এম এ মঞ্জুর বীর উত্তমের মতে ‘বালিয়াডাঙ্গা যুদ্ধ ছিল যুদ্ধ-জগতের এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংঘর্ষ।’ মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ২৩। স্বাধীনতার পর মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে অবসর নেন।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা[সম্পাদনা]

১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার অন্তর্গত বালিয়াডাঙ্গার অবস্থান ছিলো পশ্চিমে ভারতের পশ্চিম বাংলা রাজ্যের সীমান্তে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সাতক্ষীরা-যশোর এলাকায় ভারত সীমান্ত বরাবর প্রতিরক্ষা অবস্থান সুদৃঢ় করতে থাকে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান দুর্বল করার জন্য আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এই পরিকল্পনার অংশহিসেবে মোহাম্মদ সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ১৬ সেপ্টেম্বর সীমান্ত অতিক্রম করে বালিয়াডাঙ্গায় অবস্থান নেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করে। সেদিন সারা দিন যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা মোহাম্মদ সফিকউল্লাহর নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। পাকিস্তানিরা বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করে। মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ সে সব উপেক্ষা করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যান। ১৮ সেপ্টেম্বর সকাল থেকে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের দলনেতা মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ সকালবেলা নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলো সুরক্ষিত করেন। এমন সময় শুরু হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণ। প্রথম গোলা এসে পড়ল মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ’র অবস্থান থেকে ২৫০-৩০০ গজ দূরে। ভয় না পেয়ে সহযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করার জন্য তিনি দাঁড়িয়ে নির্দেশ দিতে থাকলেন। দ্বিতীয় গোলা এসে পড়ল ঠিক তার ১০০ গজ সামনে। এক-দেড় মিনিটের মধ্যে তৃতীয় গোলা এসে পড়ল একদম তার কাছে। কোনো কিছু বোঝার আগেই বাতাসের প্রবল ধাক্কায় তিনি নিচে পড়ে গেলেন। তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গোলার স্প্লিন্টারের টুকরা লেগে যায়। তার গোটা শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায়। সফিকউল্লাহ ভয় পেলেন না, দমেও গেলেন না। একজন এসে তার ক্ষতস্থানে দ্রুত ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। তীব্র ব্যথা-জ্বালা উপেক্ষা করে তিনি সহযোদ্ধাদের নির্দেশ দিতে থাকলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলেন না। একসময় অচেতন হয়ে পড়লেন। [৩]

রচিত গ্রন্থাবলি[সম্পাদনা]

কর্নেল উল্লাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর বেশ কিছু বই প্রকাশ করেছেন । তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই গুলোর মধ্যে রয়েছে:


  1. মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টর [৪] । মুক্তিযুদ্ধে ৮ নং সেক্টর" হল একটি বই যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালিত একটি সেক্টরের কথা বলে। এই বইয়ে লেখক তার সমস্ত জিজ্ঞাসা এবং উত্তরগুলি লিখেছেন, সেখানে তিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন।
  2. মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারী [৫] । মুক্তিযুদ্ধ , মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস: শরণার্থী, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা, নারী ও শিশু , মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক
  3. একাত্তরের রণাঙ্গন: গেরিলা যুদ্ধ ও হেমায়েত বাহিনী [৬]। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গেরিলা যুদ্ধ একটি অতি পরিচিত নাম। কোনো শক্তিশালী বাহিনীকে মোকাবেলা করার মতো অনুরূপ বা ততোধিক শক্তিশালী বাহিনীর অভাবে গেরিলা যুদ্ধই একমাত্র অস্ত্র যার দ্বারা অতি শক্তিশালী বহিনীকেও পরাস্ত করা সম্ভব হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে ভিয়েতনাম যুদ্ধে শক্তিশালী আমেরিকান বাহিনীর পরাজয় তার অন্যতম উদাহরণ। ১৯৭১ সালে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল গেরিলাযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য হয়ে থাকবে। শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীকে গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমেই মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভয়াবহ পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছিল যে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের গত্যন্তর ছিল না।
  4. মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম [৭] মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সুপ্ত ও লুপ্ত অধ্যায়ের বিশেষ অংশ লুকিয়ে আছে পাহাড়-সমুদ্র ঘেরা চট্টগ্রামে। সীমিত অস্ত্রের সৈনিক জনতাকে উদ্দীপ্ত করে বিপুল সমরাস্ত্রের বিশাল পাক শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার বিদ্রোহ ঘোষণা করেন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম (পরবর্তীকালে মেজর, বীর উত্তম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)। চট্টগ্রাম-ফৌজদারহাট সিলিমপুর নৌ-বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী বহির্বিশ্বে সম্প্রচারিত হয় ২৬ মার্চ পূর্বাহ্ণে। পরদিন চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। এমনি বহুতর সঙ্গত কারণেই চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
  5. বালিয়াডাঙা যুদ্ধ [৮]। বালিয়াডাঙ্গার যুদ্ধ" কর্নেল শফিক উল্লাহ (অব.) এর লেখা একটি বই। বইটিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বালিয়াডাঙ্গার গ্রামবাসীদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কর্নেল শফিক উল্লাহ, যিনি নিজে মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধ, তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বালিয়াডাঙ্গার অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে বইটি লিখেছেন।


পুরস্কার ও সম্মাননা[সম্পাদনা]

কর্নেল (অব.) মোঃ শফিক উল্লাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান বীর প্রতীক লাভ করেন ।যুদ্ধের পরে তিনি কমিশন পেয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে , বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শিক্ষা ও প্রশাসন বিদ্যালয়ে কাজ করেন। তিনি কর্নেল হিসেবে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. দৈনিক প্রথম আলো, "তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না" | তারিখ: ২০-০১-২০১২[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. একাত্তরের বীরযোদ্ধাদের অবিস্মরণীয় জীবনগাঁথা, খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা স্মারকগ্রহন্থ। জনতা ব্যাংক লিমিটেড। জুন ২০১২। পৃষ্ঠা ৬০৪। আইএসবিএন 9789843351449 
  3. একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন। এপ্রিল ২০১২। পৃষ্ঠা ৩১৮। আইএসবিএন 9789843338884 
  4. মুক্তিযুদ্ধে আট নম্বর সেক্টর - কর্ণেল (অব:) মোহাম্মদ সফিকউল্লাহ বীরপ্রতীক। বাংলাদেশ: এশিয়া পাবলিকেশন্স। ২০২০। পৃষ্ঠা ৩৯৩। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০২৩ 
  5. মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নারী কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ বীর প্রতীক। বাংলাদেশ: আহমদ পাবলিশিং হাউজ। ২০১১। পৃষ্ঠা ১৯২। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০২৩ 
  6. একাত্তরের রণাঙ্গন গেরিলাযুদ্ধ ও হেমায়েতবাহিনী - কর্ণেল (অব) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ বীরপ্রতীক (২য় সংস্করণ)। বাংলাদেশ: আহমদ পাবলিশিং হাউজ। ২০০৯। পৃষ্ঠা ৫০৪। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০২৩ 
  7. মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম (২০১৯ সংস্করণ)। বাংলাদেশ: সূচীপত্র। পৃষ্ঠা ১৯২। ১৭ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০২৩ 
  8. বালিয়াডাঙা যুদ্ধ - কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ সফিক উল্লাহ (২০২০ সংস্করণ)। বাংলাদেশ: এশিয়া পাবলিকেশন্স। ২০২০। পৃষ্ঠা ১৪৫। সংগ্রহের তারিখ ১৭ এপ্রিল ২০২৩ 

পাদটীকা[সম্পাদনা]

বহি:সংযোগ[সম্পাদনা]