কামাল উদ্দিন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কামাল উদ্দিন বা কামাল পাশা
জন্ম(১৯০১-১২-০৬)৬ ডিসেম্বর ১৯০১ দিরাই উপজেলা
মৃত্যু
জাতীয়তা বাংলাদেশ
নাগরিকত্ব ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত)
 পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে)
 বাংলাদেশ
পেশামরমী সাধক গীতিকার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক

বাউল কামাল উদ্দিন বা কামাল পাশা; (জন্ম- ৬ ডিসেম্বর, ১৯০১—মৃত্যু, ৬ মে ১৯৮৫) বাংলাদেশী মরমী কবি, গীতিকার, সুরকার, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। ভাটি বাংলার বিখ্যাত গায়ক হিসেবে দেশ বিদেশে সমাদৃত স্মরণীয়।[১][২]

পরিচিতি[সম্পাদনা]

প্রায় ছয় হাজার গানের রচয়িতা, ভাটি বাংলার মরমী ভূবনের কালজয়ী সাধক কামাল উদ্দিন বা কামাল পাশা ১৯০১ সালের ৬ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বাউল কবি আজিজ উদ্দিন ও মাতার নাম আমেনা খাতুন। কামাল উদ্দিন বাংলাদেশের প্রান্তিক অঞ্চল সিলেট বিভাগের, সুনামগঞ্জ জেলায়, দিরাই উপজেলার, ভাটিপাড়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে তালুকদার বাড়িতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মরমী পরিবারে জন্ম নেয়া এই সাধক ছোট বেলা থেকেই তার পিতার কাছে হতে সঙ্গীত চর্চা করেন।[২]

শিক্ষা[সম্পাদনা]

কামাল উদ্দিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন ও সঙ্গীত রচনা করতেন।[৩] লেখা-পড়ার হাতেখড়ি ভাটি পাড়া গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরবর্তীতে নিজ গ্রাম থেকে দূরবর্তী রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এমই, সুনামগঞ্জ জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সিলেটের এমসি কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন তিনি। এক পর্যায়ে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় হাদিস শাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেন। লেখা পড়ায় উচ্চ মানের ডিগ্রী অর্জন করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি এমএ পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারেননি। এ হতাশার কথাটি তিনি স্বরচিত একটি আঞ্চলিক গানে প্রকাশ করে গিয়েছেন এভাবে,

বলো মোদের সিলেটবাসীর কিসের ভয়
যে জায়গাতে জালাল বাবা শুইয়ে আছেন সব সময়।
আদা হলদি পিঁঁয়াজ রসুন ঐ সিলেটে সব আছে
স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ভাই জায়গায় জায়গায় বসেছে
এ কামাল কয় দুঃখের বিষয় এম.এ পড়ার সুযোগ নয় ।[৪]

আন্দোলনে অংশগ্রহন[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ আমলের জমিদাররা গরিব অসহায় মজুরদের প্রতি বিনা মজুরিতে কাজ করাতো এবং জমিদারের সামনে জুতো পায়ে ও ছাতা টাঙিয়ে কোন গরিব মজুররা চলা ফেরা করলে অসাধারণ জুলুম অত্যাচার করত। জমিদারদের এই প্রথার বিরোদ্ধে কৃষক শ্রমিক সমিতির নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে ১৯২২ ইংরেজি থেকে ১৯৪৯ ইংরেজি সাল পর্যন্ত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এই আন্দোলন সংগঠিত হয়। ঐতিহাসিক এই আন্দোলন নানকার বিদ্রোহ নামে অবহিত। ১৯২২ ইংরেজিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন ১৯৩৮ ইংরেজি সালে সিলেট, বড়লেখা, বিয়ানিবাজার সহ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় জমিদারদের আগ্রাসনের উতলে উঠেছিল মজুর সম্প্রদায়। তখন দিরাই উপজেলার রফিনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের নানকার প্রজারা একত্রিত হয়ে ভাটি পাড়া জমিদারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মাঠে মানে।[৩] সে সময় স্থানীয় নেতা সুবল দাশ, হাফিজ তালুকদার ও লইট্টা হাফিজ প্রমুখ্যদের সঙ্গ বাউল কামাল উদ্দিনও এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আসাম পার্লামেন্টে প্রজাস্বত্ত আইন পাস হয়। পরবর্তিতে প্রজাস্বত্ত আইন জনগণের কাছে পৌছানোর উদ্দেশ্যে কামাল উদ্দিন যে সব সঙ্গীত রচনা করে গেয়ে ফিরেছেন তার একটি;

ভাইট্টার জমিদার পরের জায়গা জমিন পরার
ফিরিঙ্গি বানাইলো তোদের তাবেদার
খুটগাড়ি প্রথা আইনে কৃষক কুল ধরছে ডাইনিয়ে
সাবদান হুশিয়ার । [৩]
এছাড়া সাধক কামাল উদ্দিন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ৪৭-এর রেফারেন্ডাম ও ৫২ এর ভাষা আন্দোলনে। ৫২ ইংরেজি সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দিরাই থানার রাজানগর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। ৫৪ ইংরেজির যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ আসনে মুসলীমলীগের বিরুদ্ধে নৌকার প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদ এর বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় তিনি পরিবেশন করেন তার স্বরচিত দেশাত্ববোধক গান।
“নৌকা বাইয়া যাওরে বাংলার জনগণ
যুক্তফ্রন্টের সোনার নাও ভাসাইলাম এখন
নৌকা বাইয়া যাওরে”

দেশে আইলো নতুন পানি ঘুচে গেল পেরেশানী
মাছের বাড়লো আমদানী দুঃখ নাইরে আর ।
শীর্ষক ৫৪ লাইনের রোমান্টিক গান গেয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা স্বায়ত্বশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলে। ১৯৭০ ইংরেজির সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে হাওরাঞ্চলে নির্বাচনী প্রচারাভিযানে আগত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ৫টি নির্বাচনী জনসভায় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও নৌকা প্রতীকের পক্ষে নির্বাচনী সঙ্গীত পরিবেশন করে।

১৯৭১ ইংরেজি সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৫নং সেক্টরের অধীনস্থ টেকেরঘাট সাবসেক্টর মুক্তিফৌজের ক্যাম্পে জাগরনী গান পরিবেশন এর মধ্যে দিয়ে ছাত্র যুবকদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে যেতে। প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে গড়ে তুলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ[১][৩][৪][৫]

তিনি ১৯২৮ সালে সিলেটে মুসলিম ছাত্র সম্মিলনী উপলক্ষ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংবর্ধনা মঞ্চে গান পরিবেশন করেন। সুনামগঞ্জ মহকুমা কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে ১৯৩৭ সালের আসাম প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রজাবন্ধু করুনা সিন্ধু রায় এর পক্ষে গণসংযোগ করেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু উপস্থিতিতে সুনামগঞ্জ স্টেডিয়ামে কংগ্রেস প্রার্থীর নির্বাচনী সভায় গান পরিবেশন করেন। ১৯৭৩ইংরেজি সনে সুনামগঞ্জ ষ্টেডিয়াম মাঠে জাতির জনকের সংবর্ধনা মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন।[৪]

সম্মাননা[সম্পাদনা]

  • অপ্রতিদ্বন্দ্বি গীতিকার ও সুরকার হিসেবে ১৯৬৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ মহকুমা প্রশাসন ও আর্টস কাউন্সিল কর্তৃক শ্রেষ্ঠ বাউল শিল্পীর পদকসহ গানের সম্রাট কামাল পাশা উপাধিতে ভূষিত হন।
  • বাউল কল্যাণ পরিষদ সুনামগঞ্জ আয়োজিত সাংস্কৃতিক উত্সবে লোক সংস্কৃতিতে গৌরবোজ্বল অবদানের জন্য এই মহাসাধককে মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করা হয় ।
  • নানকার আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদানের জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সুনামগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ড কর্তৃক দেওয়া হয় মরনোত্তর সম্মাননা পদক ।
  • ভোরের কাগজ বিভাগীয় প্রতিনিধি সম্মেলন ২০১১ ইংরেজি সনে মরমী সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য মরণোত্তর সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। [৩]

গানের ভুবনে[সম্পাদনা]

দ্বীন দুনিয়ার মালিক খোদা দ্বীন কে দয়া হয় না.....

প্রেমের মরা জলে ডুবেনা ওপ্রেম করতে দুদিন ভাঙ্গতে...

আমার কাঙ্কের কলসী জলে গিয়াছে ভাসি.......

সাজিয়ে গুছিয়ে দে মোরে সজনী তরা

সহ হাজার হাজার গানের রচয়িতা

কামাল গীতি সংগ্রাহক[সম্পাদনা]

সাধক কামাল উদ্দিন রচিত সঙ্গীত নিয়ে নতুন প্রজন্মের সাহসি কিছু তরুণ সেচ্ছা-সেবি সংগ্রাহক কয়েটি বই প্রকাশ করেছেন । তার মধ্যে;

  • আল - হেলাল কর্তৃক গানের সম্রাট, কামাল উদ্দিন
  • ফারুকুর রহমান চৌধুরী কর্তৃককালনী তীরের লোকগীতি
  • মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাউল কামাল পাশা গীতিসমগ্র
  • মরমী গানে সুনামগঞ্জ গ্রন্থ, লোকসাহিত্যে জালালাবাদ গ্রন্থ ছাড়াও বিভিন্ন বইতে বাউল কামালের জীবন দর্শন আলোচনা অথবা গান এবং অনলাইন পত্রিকা সমূহে বাউল কামালের জীবন দর্শন নিয়ে আলোচনা ছাপা হচ্ছে ।[৩]

মৃত্যু[সম্পাদনা]

এলাকার নির্বাচিত সাংসদ সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ছাড়াও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে রাজধানীর পিজি হাসপাতালে তাঁকে চিকিত্সাসেবা দেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি আলহাজ্ব হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর সাথেও এই কবি প্রতিভার পরিচয় ছিল। প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী এই বাউল সাধক ১৯৮৫ ইং সনের ৬ এপ্রিল মোতাবেক ১৩৯২ বাংলার ২০ বৈশাখ শুক্রবার রাত ১২ টায় নিজ বাড়ীতে মৃত্যুবরণ করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "দৈনিক সুনামগঞ্জের খরব"। ২২ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ২০১৭ 
  2. বৈশাখী নিউজ ২৪ ডটকম
  3. একজন কিংবনন্তি মরমী সাধকের কথা[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  4. চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গানের সম্রাট কামাল পাশা[১][স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]<
  5. "জেলা তথ্য বাতায়ন দিরাই উপজেলা"। ২০ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২১ ডিসেম্বর ২০১৭