বিষয়বস্তুতে চলুন

মহাকরণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পুনর্নির্দেশিত)
মহাকরণ
রাইটার্স বিল্ডিংস
লালদিঘির উত্তরে বর্তমান মহাকরণ
মানচিত্র
সাধারণ তথ্যাবলী
স্থাপত্যশৈলীগথিক স্থাপত্য (করিন্থীয় শৈলীর সম্মুখভাগ)
শহরকলকাতা
দেশপশ্চিমবঙ্গ, ভারত
বর্তমান দায়িত্বপশ্চিমবঙ্গ সরকার
সম্পূর্ণ১৭৮০
নকশা ও নির্মাণ
স্থপতিটমাস লায়ন

মহাকরণ বা রাইটার্স বিল্ডিংস (ইংরেজি: Writers' Building) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সচিবালয় ভবন। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বিবাদীবাগ অঞ্চলে লালদিঘির উত্তরে এই ভবনটি অবস্থিত।

ইতিহাস

[সম্পাদনা]

১৭৮০ সালে স্থাপিত ঐতিহাসিক রাইটার্স বিল্ডিংসের নকশা প্রস্তুত করেছিলেন টমাস লায়ন।[] ১৭৭৬ সালে লায়ন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইউরোপীয় কেরানিদের বসবাসের জন্য উনিশটি পৃথক অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করেন; এগুলি দেখতে ছিল সারিবদ্ধ দোকানের মতো।[] কালের স্রোতে ‘করণিক’ হয়ে গেল ‘কেরানি’। লায়ন সাহেবের পরিকল্পনায় তৈরি সেই বাড়িতে বসে তাঁরা কাজ করতেন। তাই লাল ইটের সেই ভবনের নাম হল ‘মহাকরণ’।[] এই কেরানিদের বলা হত রাইটার; এদের নাম থেকেই ভবনের পূর্বতন নাম রাইটার্স বিল্ডিংস-এর উদ্ভব।

এই ভবন নির্মাণের জন্য যে জমি নির্ধারিত হয়েছিল, সেখানে আগে ছিল সেন্ট অ্যান চার্চ। ষোড়শ শতকের প্রথমে তৈরি এই গির্জা ছিল কলকাতায় ব্রিটিশদের তৈরি প্রথম উপাসনাস্থল। কিন্তু দু’দশকের বেশি স্থায়ী হয়নি তাঁর অস্তিত্ব।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে দ্রুত ভেঙে পড়তে থাকে গির্জাটি। শেষে কার্যত পরিত্যক্ত গির্জা এবং তার চারপাশের জমিই নির্ধারিত হল রাইটার্স বিল্ডিং তৈরির জন্য। পুরনো ফোর্ট উইলিয়মের কাছে ১৭৭৭ থেকে ১৭৮০, এই ৩ বছর ধরে তৈরি হল করণিকদের ভবন। কাজের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। নতুন ভবন এবং তার চারপাশের এলাকাকে সে সময় এর স্থপতির নামে বলা হত লায়ন্স রেঞ্জ, বর্তমানেও সেই নামই বহাল আছে।

২৪০ বছরের প্রাচীন এই ভবনে যুগে যুগে বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রশাসনিক প্রয়োজনে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ভবন। কিন্তু আড়ালে চলে গেলেও স্তিমিত হয়নি ব্রিটিশসহ অন্য ইউরোপীয় প্রভাব। কলেবরের সঙ্গে বদলেছে ভবনের নামও।

লালদীঘিকে মনে রেখে ঔপনিবেশিকদের কাছে এই চত্বর হয়ে গিয়েছিল ‘ট্যাঙ্কস স্কোয়্যার’। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই এলাকার সঙ্গে জড়িয়ে গেল তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নাম।

রক্তক্ষয়ী পর্বের মধ্যে দিয়ে নাম পরিচয় পাল্টে হয়ে গিয়েছে বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ হয়ে গিয়েছে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের গথিক বারান্দা কিন্তু মনে রেখেছে ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বরের কথা।

স্থাপন শৈলী

[সম্পাদনা]

বরাদ্দ করা জমির ৩৭,৮৫০ বর্গফুট জুড়ে তৈরি হয়েছিল ভবনের মূল অংশ। কলকাতায় এটাই নাকি প্রথম তিন তলা বাড়ি। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রথমে ১৯টি থাকার ভবন ছিল। তবে তার শৈলীতে হতাশ হয়েছিল সেকালের ব্রিটিশ সমাজ।

নতুন ভবনে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের জন্য সচেষ্ট ছিল ব্রিটিশরা। ইংল্যান্ড থেকে কাজ করতে আসা তরুণরা বাধা পাচ্ছিলেন ভাষা সমস্যার জন্য। সেই ভাষা প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। পরে কিছু জটিলতার জন্য সেই কলেজ উঠে আসে রাইটার্স ভবনে।কলেজের প্রয়োজনে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হল। ৩২ জন পড়ুয়ার জন্য ছাত্রাবাস, পরীক্ষার হল, লেকচার হল, চারটি লাইব্রেরি-সহ বেশ কিছু নতুন সংযোজন হল দু’দশক ধরে। পরে কলেজটি এখান থেকে আবার স্থানান্তরিত হয়ে যায়। কলেজ তৈরির মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাইটার্স বিল্ডিংয়ের জন্য দক্ষ কর্মী প্রস্তুত করা।

১৮৮৯ সালে ভবনটি গথিক স্থাপত্যে। ভবনের সম্মুখভাগে করিন্থীয় স্থাপত্য নব্য রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীর একটি উদাহরণ। প্রধান প্রবেশদ্বারের শীর্ষে ব্রিটিশ জাতীয় ব্যাক্তিত্ব ব্রিটানিয়ার একটি মূর্তিও স্থাপিত হয়।

এল গ্রেকো রোমান স্থাপত্যের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের নির্মাণশৈলিতে মিশে গিয়েছে ফরাসি নবজাগরণের প্রভাবও। ভবনের মাথায় রয়েছে প্রাচীন রোমান সভ্যতার জ্ঞান, যুদ্ধ ও ন্যায়ের দেবী মিনার্ভা-র মূর্তি। এ ছাড়াও এই ভবনে আছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার দেবদেবী জিউস, হার্মিস, অ্যাথিনা এবং দেমেতের-এর মূর্তি। তাঁরা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যথাক্রমে বিচার, বাণিজ্য, বিজ্ঞান এবং কৃষির উন্মেষের প্রতীক হয়ে।

রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান

[সম্পাদনা]
অলিন্দ যুদ্ধের স্মৃতিফলক

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিংসের নাম নানাভাবে জড়িত। ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বিনয় বসু, বাদল গুপ্তদীনেশ গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিংসে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে কারাবিভাগের প্রধান অত্যাচারী ইংরেজ অফিসার এন. জি. সিম্পসনকে হত্যা করেন।

পাশ্চাত্য পোশাকে সেজেগুজে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ঢুকেছিলেন বঙ্গের তিন তরুণ। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত। তাঁদের লক্ষ্য ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এন এস সিম্পসন। কারাবিভাগের ইনস্পেক্টর জেনারেল পদাধিকারী সিম্পসন কুখ্যাত ছিলেন জেলের ভিতরে বন্দিদের উপর অত্যাচারের জন্য। রাজবন্দিদের উপর তাঁর অকথ্য অত্যাচারের জন্য অনেক দিন ধরেই বিপ্লবীদের মনে পুঞ্জীভূত ছিল ক্ষোভ।

তিন সশস্ত্র বিপ্লবীর বুলেটে প্রাণ গিয়েছিল অত্যাচারী সিম্পসনের। বিগত রাজধানীতে ব্রিটিশদের প্রশাসনিক ভবনে ইনস্পেক্টর জেনারেলকে হত্যা করে তাঁরা ত্রস্ত করতে চেয়েছিলেন শাসকদের। তাঁদের সেই উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছিল। সিম্পসন-হত্যায় কেঁপে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসন। দেশকে স্বাধীন দেখার ইচ্ছের পাশাপাশি তাঁদের আরও একটি ইচ্ছে অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। সিম্পসন-হত্যার পরে তাঁরা কেউই ব্রিটিশদের হাতে ধরা দিতে চাননি।

এই ঘটনার অব্যবহিত পরে ভবনের অলিন্দে নিরাপত্তারক্ষী ও কমিশনার টেগার্টের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিপ্লবী-ত্রয়ীর যে সংঘর্ষ হয় তা "অলিন্দ যুদ্ধ" নামে প্রসিদ্ধ। রাইটার্সের অলিন্দে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধের পরে ধরা দেবেন না বলে বাদল গুপ্ত আত্মঘাতী হন পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে। বিনয় এবং দীনেশ নিজেদের বন্দুক থেকে নিজেদের গুলি করেন। হাসপাতালে কিছু দিন মরণপণ যুদ্ধের পরে ১৩ ডিসেম্বর মৃত্যু হয় বিনয়ের। বিচারে দিনেশের মৃত্যুদণ্ড ধার্য হয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই আলিপুর জেলে তাঁকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে অগ্নিযুগে মহাকরণের অলিন্দযুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। স্বাধীনতা লাভের পরে গোটা ডালহৌসি চত্বরের নামকরণ করা হয় বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ, সংক্ষেপে বিবাদী বাগ।[]

স্বাধীনোত্তর ভারতে

[সম্পাদনা]

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতালাভের পর রাইটার্স বিল্ডিংস পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রাজ্য সচিবালয়ে পরিণত হয়। এই সময় বাংলায় ভবনটির নামকরণ হয় "মহাকরণ"। যদিও ইংরেজি নাম হিসেবে "রাইটার্স বিল্ডিংস" কথাটিই প্রচলিত। দীর্ঘকাল মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহাফেজখানা সহ রাজ্য সরকারের একাধিক সরকারি বিভাগের প্রধান কার্যালয় মহাকরণে অবস্থিত ছিল। বর্তমান প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয় হাওড়ার নবান্ন (ভবন) তে স্থানান্তরিত করা হয়েছে ও ঐতিহ্যশালী মহাকরণের সংস্কার চলছে।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. কলকাতা: একাল ও সেকাল, রথীন মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃ. ৬৯
  2. কলকাতা: এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, অতুল সুর, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ২৮৮
  3. "Naming" 
  4. আধুনিক ভারত (১৯২০ – ১৯৪৭): দ্বিতীয় খণ্ড, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ১০৭

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]