দীনেশ গুপ্ত
দীনেশচন্দ্র গুপ্ত | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | |
মৃত্যু | ৭ জুলাই ১৯৩১ | (বয়স ১৯)
মৃত্যুর কারণ | ফাঁসি |
মাতৃশিক্ষায়তন | ঢাকা কলেজ |
পরিচিতির কারণ | রাইটার্স বিল্ডিংসে অলিন্দ যুদ্ধ |
দীনেশচন্দ্র গুপ্ত (৬ ডিসেম্বর ১৯১১ – ৭ জুলাই ১৯৩১) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী একজন স্বনামধন্য বাঙালি বিপ্লবী। তিনি দীনেশ গুপ্ত নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি ঢাকা ও মেদিনীপুরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। মেদিনীপুরে তার সংগঠন পরপর তিন জন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যা করেছিল।[১][২] ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিপ্লবী বিনয় বসুর নেতৃত্বে তিনি ও বাদল গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং (বর্তমান মহাকরণ) ভবনে অভিযান চালিয়ে, বিভাগের অত্যাচারী ইন্সপেক্টর জেনারেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দে পুলিশের সঙ্গে তাদের খণ্ডযুদ্ধে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ ইউরোপীয় কর্মচারী গুরুতরভাবে আহতও হন। এরপর তারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। অপর দুই বিপ্লবী বিনয় বাদল আত্মহত্যায় সমর্থ হলেও মৃতপ্রায় দীনেশকে পুলিশ বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়। বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়। মৃত্যুর পূর্বে জেলে বসে তিনি কয়েকটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিগুলি ভারতের বিপ্লবী ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং সাহিত্যিক বিচারেও অত্যন্ত মূল্যবান।[২] স্বাধীনতার পর তার ও তার অপর দুই সহবিপ্লবীর সম্মানার্থে কলকাতার প্রসিদ্ধ ডালহৌসি স্কোয়ারের নাম বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ (সংক্ষেপে বিবাদীবাগ) রাখা হয়।
প্রাথমিক জীবন
[সম্পাদনা]বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তের জন্ম হয় ১৯১১ সালের ৬ ডিসেম্বর (বাংলা ১৩১৮ সালের ২০ অগ্রহায়ণ) তদনীন্তন ঢাকা জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সীগঞ্জ জেলা) যশোলঙে। তার পিতার নাম সতীশচন্দ্র গুপ্ত ও মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু।[২] চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। চাকরির সূত্রে তিনি কিছুকাল গৌরীপুরে অবস্থান করেন। গৌরীপুরের পাঠশালাতেই দীনেশের শিক্ষারম্ভ। পরে নয় বছর বয়সে ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। প্রথম দিকে দীনেশ ঢাকার গ্যান্ডারিয়া অঞ্চলে দাদুর বাড়িতে বাস করতেন, পরে উয়াড়িতে পৈত্রিক বাসভবনে চলে আসেন। বাল্যকাল থেকেই দীনেশ ছিলেন নির্ভীক, বেপরোয়া ও বাগ্মী। এই সময় থেকেই তার মনে স্বদেশ চেতনা ও ব্রিটিশ বিরোধিতার আদর্শ সঞ্চারিত হয়েছিল।[৩]
বিপ্লবী জীবনের সূচনা
[সম্পাদনা]কৈশোরে দীনেশ বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সদস্য হন।[৪] ১৯২৬ সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি মেদিনীপুরে কর্মরত তার বড়োদাদা যতীশচন্দ্র গুপ্তের কাছে বেড়াতে আসেন। এই সময় থেকেই মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার সুপ্ত বাসনা তার মনে জাগে। কিন্তু দলের নির্দেশে সেবার তাকে ঢাকায় ফিরে আসতে হয়েছিল বলে তিনি মেদিনীপুরে বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারেননি।[৫]
১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দেন। কিন্তু এই পরীক্ষায় তিনি কৃতকার্য হতে পারেননি। এরপর তিনি মেদিনীপুরে গিয়ে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেন। দলের তরফ থেকে দীনেশকে মেদিনীপুরে বিভির শাখা স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেদিনীপুরে এসে দল সংগঠন ও সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান তিনি। [৬]
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় ১৯২৮ সালে দীনেশ 'ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস'-এর কলকাতা সেশনের প্রাক্কালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস সংগঠিত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে যোগদান করেন। শীঘ্রই বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স একটি সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠনে পরিবর্তিত হয় এবং কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদেরকে হত্যা / নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করে। স্থানীয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালনা শেখানোর জন্য দিনেশ গুপ্ত কিছু সময় মেদিনীপুরেও ছিলেন। তার প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ডগলাস (Douglas), বার্জ (Burge) এবং পেডি (Peddy)-এই তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রটকে পরপর হত্যা করেছিল।
রাইটার্স ভবনে হামলা
[সম্পাদনা]
সংগঠনটি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসনকে টার্গেট করেছিল যে কিনা জেলখানার বন্দীদের উপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল।এই বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা শুধু সিম্পসনকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হবেন না, বরং কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় রাইটার্স ভবনে আক্রমণ করে ব্রিটিশ অফিস পাড়ায় ত্রাস সৃষ্টি করবেন। ১৯৩০ সালের ৮ই ডিসেম্বর দীনেশ তার দুই সঙ্গী বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্তসহ ইউরোপীয় পোশাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেন এবং সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। ব্রিটিশ পুলিশ গুলি শুরু করে। যার ফলশ্রুতিতে এই তিন তরুণ বিপ্লবীর সাথে পুলিশের একটি সংক্ষিপ্ত বন্দুকযুদ্ধ হয়। টোয়াইনাম (Twynum), প্রেন্টিস (Prentice) এবং নেলসন (Nelson)-এর মত অন্য কিছু অফিসার গোলাগুলিতে আহত হয়। পুলিশ দ্রুতই তাদেরকে পরাভূত করে ফেলে। কিন্তু এই তিনজনের গ্রেফতার হওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না। বাদল গুপ্ত পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিয়েছিলেন, অন্যদিকে বিনয় এবং দীনেশ নিজেদের রিভলবার দিয়ে নিজেদেরকেই গুলি করেছিলেন। বিনয়কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে তিনি ১৯৩০ সালের ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ মৃত্যুবরণ করেন।
বিচার এবং ফাঁসি
[সম্পাদনা]দীনেশ কোনোরকমে এ চরম আঘাত থেকে বেঁচে ওঠেন।তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল এবং বিচারের রায় ছিল সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং খুনের জন্য ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু। ১৯৩১ সালের ৭ই জুলাই আলিপুর জেলে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর।
গুরুত্ব
[সম্পাদনা]বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অংশে বিনয়, বাদল এবং দিনেশকে শহীদ হিসেবে সম্মান করা হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারের নাম পালটে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ রায়, প্রকাশ (২০২১)। বিস্মৃত বিপ্লবী। চেন্নাই: নোশনপ্ৰেস, চেন্নাই, তামিলনাড়ু।
- ↑ ক খ গ বাঙালি চরিতাভিধান প্রথম খণ্ড, সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, সংশোধিত চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৮, পৃ. ২০৭
- ↑ শহীদ দীনেশ গুপ্তের জীবন, সাহিত্য ও পত্রাবলী, অসিতাভ দাস, রচয়িতা, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ২-৩
- ↑ শহীদ দীনেশ গুপ্তের জীবন, সাহিত্য ও পত্রাবলী, পৃ. ৪
- ↑ শহীদ দীনেশ গুপ্তের জীবন, সাহিত্য ও পত্রাবলী, পৃ. ৬
- ↑ শহীদ দীনেশ গুপ্তের জীবন, সাহিত্য ও পত্রাবলী, পৃ. ৮-১০
গ্রন্থপঞ্জি
[সম্পাদনা]- হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, ভারতের বিপ্লব কাহিনী, ২য় ও ৩য় খন্ড, কলকাতা, ১৯৪৮।
- রমেশচন্দ্র মজুমদার, History of the Freedom Movement in India, III, কলকাতা, ১৯৬৩।
- গঙ্গানারায়ণ চন্দ্র, অবিস্মরণীয়, কলকাতা, ১৯৬৬।
- ১৯১১-এ জন্ম
- ১৯৩১-এ মৃত্যু
- বাংলাদেশী বিপ্লবী
- পূর্ব বাংলা থেকে ভারতীয় স্বাধীনতা কর্মী
- পূর্ববঙ্গে জন্ম
- বিক্রমপুরের ব্যক্তি
- ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের শহীদ
- মুন্সীগঞ্জের বিপ্লবী
- ভারতীয় স্বাধীনতার বিপ্লবী আন্দোলন
- ভারতীয় ব্যক্তি যার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে
- ব্রিটিশ ভারত দ্বারা ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত
- মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিপ্লবী
- ২০শ শতাব্দীতে যুক্তরাজ্য দ্বারা মৃত্যুদণ্ড
- পূর্ববঙ্গের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ বিরোধী বিপ্লবী
- ঢাকা কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
- বাঙালি বিপ্লবী
- ভারতীয় স্বাধীনতা কর্মী
- ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন কর্মী
- ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলার বিপ্লবী
- মুন্সীগঞ্জ জেলার ব্যক্তি
- ভারতীয় বিপ্লবী
- কলকাতার ব্যক্তি
- পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় স্বাধীনতা কর্মী