কলকাতার অর্থনীতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
কলকাতার অর্থনীতি
হাওড়া থেকে কলকাতার কেন্দ্রীয় ব্যবসায়িক অঞ্চলের দৃশ্য
মুদ্রাভারতীয় টাকা বা রুপি
পরিসংখ্যান
জিডিপি$190 billion(Nominal, 2023[১]
$524 billion [(PPP)], 2022 )
জিডিপি ক্রম৩য় (ভারত)
মাথাপিছু জিডিপি
$37209, (PPP, 2023[১])
কগনিজ্যান্ট টেকনোলজি সলিউশন ভবন, সেক্টর ৫, বিধাননগর, ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স
এইচএসবিসি ভবন, শহরের প্রধান টেলিযোগাযোগ পরিষেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এইচএসবিসি-এর মতো বহু বহুজাতিক সংস্থা কলকাতার আর্থিক পুনরুজ্জীবনের জন্য দায়ী

কলকাতার অর্থনীতি ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থব্যবস্থা। কলকাতা পূর্ব ভারতের প্রধান ব্যবসায়িক, বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র এবং এবং উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলির যোগাযোগের প্রধান বন্দর। কলকাতা ভারতে মুম্বাইদিল্লি পরে তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। ১৯০.১ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি সহ কলকাতা ভারতের ভারতের প্রাচীনতম স্টক এক্সচেঞ্জ (বোর্স)[২]কলকাতা স্টক এক্সচেঞ্জ – এর শহরেই আবাসস্থল। কলকাতা মহানগর অঞ্চলের জিডিপি পিপিপি পরিমাণ ২০২৩ সালের হিসাবে ৫২৪ বিলিয়ন ডলার, যা মহানগর অঞ্চলটিকে বিশ্বের ৩১তম বৃহৎ আর্থিক কেন্দ্রে পরিণত করে।[৩]

বৃহৎ সরকারী ও বেসরকারী-খাতের কর্পোরেশনগুলি দ্বারা পরিচালিত বহু শিল্প ইউনিটের ব্যবসাকেন্দ্র কলকাতায় অবস্থিত। প্রধান খাতগুলির মধ্যে ইস্পাত, ভারী প্রকৌশল, খনি, খনিজ, সিমেন্ট, ফার্মাসিউটিক্যালস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, কৃষি, ইলেকট্রনিক্স, বস্ত্র ও পাট রয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত। যেমন – আইটিসি লিমিটেড, বাটা ইন্ডিয়া, হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল লিমিটেড, বিড়লা কর্পোরেশন, মার্লিন প্রজেক্টস লিমিটেড, বেঙ্গল পিয়ারলেস, ওরিয়েন্ট ফ্যানস, এক্সাইড, বার্জার প্রিন্টস, কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড ও ন্যাশনাল ইনসিওরেন্স কোম্পানি। কয়েকটি ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও কলকাতায়। যেমন – ইউকো ব্যাংকইউনাইটেড ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। এছাড়া স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড ব্যাংকের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দফতর কলকাতায় অবস্থিত।[৪]

কলকাতার অধিকাংশ বস্তিবাসীই শহরের ঘরোয়া অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত।[৫] সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত দেখা ট্রেন্ড অনুসারে নমনীয় উৎপাদন কলকাতার একটি বৈশিষ্ট্য। ঘরোয়া সেক্টরগুলি মোট শ্রমশক্তির ৪০% সরবরাহ করে থাকে।[৬] উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, কলকাতার ২,৭৫,০০০ হকার মোট ৮,৭৭২ কোটি ভারতীয় টাকার (প্রায় ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) লেনদেন করেন।[৭]

অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক উন্নয়ন[সম্পাদনা]

ইংরেজদের বসতি পত্তনের আগে থেকেই আদি কলকাতা অঞ্চলটি শেঠ, বসাক প্রভৃতি তন্তুবায় ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। পরে তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ইংরেজ বণিকরা এই অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেন। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ থেকে দেখা যায় বাঙালি ব্যবসায়ীরা কৌলিক পেশার বদলে নতুন যুগের সঙ্গে সায্যজ্যপূর্ণ ব্যবসায় নামতে শুরু করেছেন। সেযুগের বিশিষ্ট বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে লক্ষ্মীকান্ত ধর, বৈষ্ণবচরণ শেঠ, মতিলাল শীল, প্রাণকৃষ্ণ লাহা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা জাতিতে ছিলেন তাঁতি, সুবর্ণবণিক অথবা কায়স্থ। ঊনবিংশ শতকে ব্রাহ্মণরাও এই পেশায় আসেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন সেযুগের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ বণিক।[৮]কলকাতা ভারতের অন্যতম প্রাচীন শহর ।

বিংশ শতাব্দীর ষাট থেকে নব্বই দশকের মধ্যবর্তী সময়কাল কলকাতার অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক অবক্ষয়ের যুগ। ভারত বিভাগ, তারসঙ্গে আগত শরণার্থীর স্রোত, ট্রেড-ইউনিয়নগুলির বাড়বাড়ন্ত, মূলধনের অভাব, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল আন্দোলন, ঘন ঘন ধর্মঘট ও বনধ্, পাট শিল্পে মন্দা, পরিকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার অবনতি কলকাতার অর্থব্যবস্থাকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। আশির দশকে এই তীব্র অবক্ষয়ের কারণে কলকাতাকে বলা হত ‘মৃত্যুপথযাত্রী নগরী’।[৯] কিন্তু এর পর থেকেই কলকাতায় সুদিন একটু একটু করে ফিরতে থাকে। ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় উদারীকরণ কলকাতার ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়। তারাতলা, কল্যাণী, উলুবেড়িয়া, ডানকুনি, কসবা, হাওড়া প্রভৃতি বৃহত্তর কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটো বড় নানা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট গড়ে ওঠে। বানতলায় গড়ে ওঠে সুবিশাল চর্মনগরী। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্র গড়ে ওঠে ফলতায়। এছাড়াও কিছু বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান, যেমন দেশের প্রথম খেলনা পার্ক, রত্ন ও গহনা পার্কও স্থাপিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গের সরকার প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের সপক্ষে। এই পুঁজি মূলত আসে সফটওয়্যার ও ইলেকট্রনিক্স-এর ক্ষেত্রে।[১০] কলকাতা দেশের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী বিধাননগরের সম্প্রসারিত অংশ সেক্টর-ফাইভ ও রাজারহাট নিউ টাউন আজ দেশের প্রধানতম আইটি গন্তব্যগুলির মধ্যে একটি।[১১] আইবিএম, এইচএসবিসি, এবিএন অ্যামরো ইত্যাদি একাধিক বহুজাতিক সংস্থা সহ বহু ব্যবসাক্ষেত্র আজ কলকাতায় তাদের অফিস স্থাপন করেছে। স্কাইটেক, টেল আইটি নেটওয়ার্ক, ডব্লিউডিসি, গ্রেট মিডিয়া টেকনোলজিস, ভিসন কম্পটেক ও পোলারিস নেটওয়ার্কের মতো বহু কলকাতা-ভিত্তিক সংস্থাগুলি স্থাপিত হয়। এগুলি ছাড়াও অন্যান্য বড় বড় ভারতীয় সফটওয়্যার ফার্ম যেমন উইপ্রো, টিসিএস, এমবিটি, কগনিজ্যান্ট প্রভৃতি কলকাতাকে ব্যবসাকেন্দ্র করে তোলেন।

কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের এই সাম্প্রতিক আর্থিক উন্নতির আজ একে দেশের তৃতীয় বর্ধনশীল অর্থব্যবস্থায় পরিণত করেছে।[১২] শহরের আইটি সেক্টরগুলির বার্ষিক বৃদ্ধির হার আজ ৭০%, যা সারা ভারতের তিনগুণ।[১৩] দুর্গাপুরের অন্ডালে প্রস্তাবিত এয়াট্রোপোলিস বা বিমাননগরী; গভীর সমুদ্র বন্দর; পুরুলিয়া, মালদহ, কোচবিহার ইত্যাদি স্থানে একাধিক নতুন বিমানবন্দর; কলকাতা বিমানবন্দরের আধুনিকীকরণ ও দ্বিতীয় বিমানবন্দর; নিউ টাউনে অত্যাধুনিক শহর; শিলিগুড়ি, হাওড়া প্রভৃতি স্থানে আধুনিক উপনগরী; বর্ধমান শহরের ব্যাপক উন্নতি; মেট্রো রেলওয়ের সম্প্রসারণ ইত্যাদির পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন রাজ্যের তথা কলকাতার অর্থনৈতিক মানচিত্রকে খোলনলচে বদলে দিয়েছে এই একবিংশ শতকে।[১৪]

ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা[সম্পাদনা]

কলকাতা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। বর্তমানে, শহরটি বৃহৎ জাতীয়করণকৃত ইউকো ব্যাঙ্ক এবং একটি বেসরকারি তফসিলি ব্যাঙ্ক বন্ধন ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করে। ম্যাগমা ফিনকর্প, বন্ধন ব্যাঙ্ক, এসআরইআই ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সহ বেশ কয়েকটি বড় আর্থিক কোম্পানি ও বীমা কোম্পানির সদর দফতর কলকাতায় রয়েছে। অনেক ভারতীয় ব্যাঙ্ক, বহুজাতিক ব্যাঙ্ক এবং বিশ্ব ব্যাঙ্ক শহরে তাদের শাখা কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ভারতের সমস্ত প্রধান ব্যাঙ্কের শাখা কার্যালয় কলকাতায় রয়েছে। এছাড়াও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক, ব্যাঙ্ক অব আমেরিকা এবং এইচএসবিসি ব্যাঙ্কের মতো বড় আর্থিক ব্যাঙ্কগুলির কলকাতায় কার্যালয় ও শাখা রয়েছে। বন্ধন ফাইন্যান্সিয়াল হল কলকাতা ভিত্তিক ভারতের বৃহত্তম ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী গোষ্ঠী, সংস্থাটি সমগ্র ভারত জুড়ে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা স্থাপনের জন্য আরবিআই-এর অনুমোদন পেয়েছে। বন্ধন ব্যাঙ্কের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় রয়েছে, যা স্বাধীনতার পরে শহরে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র ব্যাঙ্ক।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

চিত্রকক্ষ : কলকাতার অর্থনীতি[সম্পাদনা]

পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. "Global Metro Monitor"। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০২৩ 
  2. CSE Factbook ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৯ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে. Calcutta Stock Exchange Association Ltd.
  3. "The 150 richest cities in the world by GDP in 2020"www.citymayors.com। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০২৩ 
  4. "Standard Chartered Bank website"। ২২ মার্চ ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০০৮ 
  5. Thomas, 1997, pp. 113-114
  6. Globalizing Cities: A New Spatial Order, Mark D. Bjelland et al.
  7. Ganguly, Deepankar। "Hawkers stay as Rs. 265 crore talks"The Telegraph, 30 November 2006। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-১৬ 
  8. কলকাতা: এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, অতুল সুর, সুরজিৎচন্দ্র দাস প্রকাশিত, ১৯৮১, পৃষ্ঠা ২০৮-২২৬
  9. Spiegel online article
  10. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Dasgupta, 2002 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  11. "Frontline article"hinduonnet.com। ১৮ জুন ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০০৮ 
  12. "Remarks of Consul General Henry V. Jardine to The Indo-American Chamber of Commerce "INDO-U.S. RELATIONS – RISING TO NEW HEIGHTS" October 19, 2005"। ১৫ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ডিসেম্বর ২০০৮ 
  13. Datta, T."Rising Kolkata's winners and losers". BBC Crossing Continents article. 22 March, 2006
  14. Bengal on IT highway. The Telgraph. 31 March 2006.