পীর গোরাচাঁদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পীর গোরাচাঁদ বা হজরত পীর গোরাচাঁদ বা গোরাই পীর হলেন মধ্যযুগে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব থেকে বাংলায় আগত এক সুফি সন্ত। চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে গুরু শাহজালাল-এর নির্দেশে আরও একুশজন পীরভাইকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ বাংলার সাবেক চব্বিশ পরগণার (এখনকার উত্তর চব্বিশ পরগণা) বালাণ্ডা পরগনায় (এখনকার বেড়াচাঁপাবসিরহাট অঞ্চল) তিনি ধর্মপ্রচারে আসেন। লোককথা অনুসারে, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন এই পীরের স্থানীয় হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে এবং লড়াইয়ে তিনি নিহত হন। বসিরহাটের হাড়োয়ায় বিদ্যাধরী নদীর তীরে তার সমাধি দরগাহ বর্তমান। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ তাকে আজও শ্রদ্ধাভক্তি করে।[১][২][৩]

জন্ম-বৃত্তান্ত[সম্পাদনা]

পীর গোরাচাঁদের আসল নাম হল পীর হজরত শাহ সৈয়দ আব্বাস আলী রাজী। তার পিতার নাম হজরত করিম উল্লাহ এবং মাতার নাম মায়মুনা সিদ্দিকা। আনুমানিক ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে আরবের মক্কা নগরে জমজম মহল্লায় বিখ্যাত কোরায়েশ বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পীর হজরত শাহজালাল এঅমনির কাছে তরীকা সুফীমতে দীক্ষাগ্রহণের পর গুরুর নির্দেশে ভারতবর্ষে ধর্মপ্রচারে আসেন। [১][২][৪]

গোরাচাঁদ (সৈয়দ আব্বাস আলী) ছোটবেলা থেকে খুবই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি সাধনের জন্য অতি অল্প বয়সেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। এরপর হজরত শাহ জালালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পীরভ্রাতাদের সঙ্গে ভারতে ইসলাম ধর্ম প্রচারে আসতে মনস্থ করেন। পিতা করিমউল্লাহ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সুদূর ভারতে ধর্মপ্রচারে যেতে দিতে রাজি হন; সঙ্গে নিজের পালকপুত্র মাহতাবউদ্দীনকে তার দেখাশুনার জন্য প্রেরণ করেন। [৫]

ভারতে আগমন[সম্পাদনা]

শাহ জালাল ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষে সশিষ্য তৎকালীন ভারত-রাজধানী দিল্লিতে উপস্থিত হন এবং ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে তাদের নিয়ে বাংলার শ্রীহট্ট (বর্তমানে সিলেট) অভিমুখে রওনা হন। ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে সর্বমোট ৩৬০ শিষ্যসহ শ্রীহট্টে পৌঁছে তিনি শিষ্যবর্গকে ভিন্ন ভিন্ন দলে ভাগ করে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ইসলাম ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন।

বিভক্ত একটি দলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করে গোরাচাঁদ ২১ জন পীরভ্রাতাকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ বাংলায় ধর্মপ্রচারে আসেন। তার আদেশে ২১ জন পীর-আউলিয়া এতদাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন; যেমন: শাহ সুকি পাণ্ডুয়ায়, দারাফ খাঁ গাজী ত্রিবেণীতে, শাহ আব্দাল্লা সিসিনীতে, একদিল শাহ বারাসতের কাজীপাড়ায়, শাহ ছকুদেওয়ান খামারপাড়ায়, শাহ-সইদ আকবর সোহাইয়ে। গোরাচাঁদ নিজে 'ভাটিমুল্লুক' বালাণ্ডা পরগনায় হাজির হন। মাহতাবউদ্দীন ওরফে শাহ সোন্দল গোরাচাঁদের মৃত্যুকাল পর্যন্ত সঙ্গে থাকলেও শেষপর্যন্ত 'খেলাফৎ' প্রাপ্ত হয়ে তার হুকুমে বীরভূমে গমন করেন। উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাত মহকুমার রায়কোলা নামক গ্রামে আজও "বাইশ আউলিয়ার দরগাহ" নামে একটি দরগাহ আছে। [৫]

স্থানীয় রাজাদের সাথে বিরোধ ও মৃত্যু[সম্পাদনা]

গোরাচাঁদ ও চন্দ্রকেতু[সম্পাদনা]

লোককথা অনুসারে, তিনি দেউলিয়ার ('দেবালয়') হিন্দুরাজা চন্দ্রকেতুকে (যার নামে সম্পর্কীত চন্দ্রকেতুগড় প্রত্নস্থলটি আবিষ্কৃত হয়েছে) ইসলামধর্ম গ্রহণের অনুরোধ করলে রাজা তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তিনি একজন প্রকৃত পীর-ফকির কিনা তা পরীক্ষা করতে নানারকম কৌশল অবলম্বন করেন। গোরাচাঁদ নিজের অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দিতে রাজার লোহার কলাকে সত্যিকারের পাকা কলায় রূপান্তরিত করেন এবং রাজপ্রাসাদের চারিদিকে লোহার বেড়ায় চাঁপাফুল ফুটিয়ে তোলেন (যা থেকে পরবর্তীকালে ঐ স্থানের নাম হয় 'বেড়াচাঁপা')। রাজা তাতেও নতি স্বীকার করলেন না। শেষে গোরাচাঁদের কথায় গৌড় বাদশাহ চন্দ্রকেতুকে ধর্মান্তরিত হওয়ার আদেশ দিলে বিরোধ চরমে ওঠে এবং যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

যুদ্ধের আগে রাজা তার রাণী ও নগরবাসীদের বলে যান তিনি যুদ্ধে জিতলে রাজধানীর দিকে সাদা পায়রা উড়ে আসবে কিন্তু পরাজিত হলে উড়ে আসবে কালো পায়রা। গৌড়ের সুলতানের প্রেরিত পাঠান শাসক পীর গোরাচাঁদের পক্ষ নিয়ে রাজা চন্দ্রকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধটি হয়েছিল চাঁপাতলার রণখেলার প্রান্তরে যেখানে রাজা চন্দ্রকেতুর দুই প্রিয়পাত্র হামা ও দামা যুদ্ধানুশীলন করতেন। যুদ্ধে রাজা চন্দ্রকেতু জয়ী হবার সমীপে চলে এসেছিলেন; এমন সময় পীরের অলৌকিক ক্ষমতার আশ্রয় নিয়ে রাজধানীর দিকে উড়িয়ে দেওয়া হয় কালো পায়রা। সেটা দেখে নগরবাসীগণ বিমর্ষ হয়ে পড়েন এবং রানী পদ্মদহে ডুবে আত্মহত্যা করেন। এই খবর রাজার কাছে পৌঁছাতেই রাজা মনোবল হারিয়ে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন। পরাজিত রাজা চন্দ্রকেতু রাজ্যে ফিরে পদ্মদহে প্রাণ বিসর্জন দেন। [৫]

এরপর গোরাচাঁদ স্থানীয় অনেক লোকজনকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা দিয়ে আরও দক্ষিণে অগ্রসর হন।[২][৬]

অকানন্দ-বকানন্দের হাতে মৃত্যু[সম্পাদনা]

সুন্দরবনের হাতিয়াগড় পরগনার শিবভক্ত অনার্য রাজা মহিদানন্দের দুই পুত্র অকানন্দ (মতান্তরে অক্ষয়ানন্দ[২]) ও বকানন্দ (বিনয় ঘোষের মতে, এরা ছিলেন স্থানীয় চাষী-ধীবরদের সর্দার[১]) গোরাচাঁদের ধর্মান্তরকরণ অভিযান প্রতিরোধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধে পীরসাহেব ভীষণরকম আহত হন; প্রতিপক্ষের বাণাঘাতে তার অর্ধেক গ্রীবা কাটা যায়। তবুও, শিরস্ত্রাণের কাপড় দিয়ে আহত স্কন্ধ বেঁধে তিনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। স্থানীয় ফকিরদের লোকায়ত গানে এই লড়াইয়ের বিবরণ পাওয়া যায়:

গোরাচাঁদ একদিল রহিল অনেক দূর।
গোরা গেল বালাণ্ডায়, একদিল আনারপুর।।
হেতেগড়ে যেতে গোরার মা দিয়েছে বাধা।
হেতেগড়ে যায় না গোরা আছে হারামজাদা।।
মায়ের বাধা গোরাচাঁদ না শুনিল কাণে।
আকনের সঙ্গে যুদ্ধ হইল হেনকালে।।
আকানন্দ বাকানন্দ রাবণের শালা।
তার সঙ্গে যুদ্ধ হইল আড়াইপক্ষ বেলা।।
কি জানি আল্লার মর্জি নসিবের ফের।
চেকোবাণে গোরাচাঁদের কাটা গেল ছের।।[৬]

অবশেষে, ১৩৪৫ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ফাল্গুন প্রায় আশি বছর বয়সে বালাণ্ডা পরগনার ভার্গবপুরের জঙ্গলে অবসন্ন শরীরে মুমূর্ষু অবস্থায় এসে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শোনা যায়, কালু ঘোষ নামে এক ব্যক্তি নিজ গাভীর অনুসন্ধানে জঙ্গলে প্রবেশ করলে তার মৃতদেহ দেখতে পেয়ে তাকে বিদ্যাধরী নদীর তীরে সমাধিস্থ করেন। উল্লেখ্য, গোরাচাঁদের হাড় এখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল বলেই এই অঞ্চলের নাম হয় 'হাড়োয়া'।[১][২]

পীর গোরাচাঁদের দরগাহ ও নজরগাহ[সম্পাদনা]

সমাধি দরগাহের বাৎসরিক উৎসব[সম্পাদনা]

হাড়োয়ার পীর গোরাচাঁদের সমাধি দরগাহের নামফলক

বসিরহাটের হাড়োয়ায় পীর গোরাচাঁদের সমাধি দরগাহে ১২ই ফাল্গুন তার মৃত্যুর দিন স্মরণ করে প্রতি বছর বিশেষ উৎসব ও মেলা শুরু হয়। গোরাচাঁদের মাজার চত্বরে চলে ধর্মীয় অনুষ্ঠান। সেই উপলক্ষে এক মাস ধরে মেলা চলে। দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ আসেন এখানে। মেলায় কাওয়ালি তরাণা, মানিকপীরের গান, নানারকম বাজনা, সার্কাস, ম্যাজিক প্রদর্শনী ও বাউল গানের হাট বসে। 'সোন্দল' বা শোভাযাত্রা করে আনীত ভক্তদের উপহার খাদিমদাররা পীরের সমাধির উপর সাজিয়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দেন। বারগোপপুরের গোপদের আনা গোদুগ্ধ সর্বপ্রথম পীরের সমাধিতে ঢেলে দেওয়া হয়।[১][৪]

ভাষাবিদ পণ্ডিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর বাবা মাফিজুদ্দিন আহ্‌মেদ ছিলেন গোরাচাঁদের একজন সেবায়েত।

বিভিন্ন নজরগাহ বা স্মৃতিসৌধ[সম্পাদনা]

  • সেরপুরের দরগাহ (অশোকনগরের কাছে)।
  • বারাসতের চন্দনহাটি গ্রামের পুরাতন তেঁতুলতলা (কথিত, গোরাচাঁদ তার ঘোড়ায় চেপে পীরভাই একদিল শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এখানে আসতেন)।
  • বারাসতের কামদেবপুরের নজরগাহ (হিন্দু সেবায়েত নির্মিত পীরের স্মৃতিমন্দির বিদ্যমান)।
  • হাসনাবাদ থানার অন্তর্গত খুড়র গ্রামের নজরগাহ।
  • বসিরহাট থানার অন্তর্গত ঘোড়ারাশ ও নেহালপুর গ্রামের নজরগাহ।
  • বামনপুকুর গ্রামের নজরগাহ (হিন্দু সেবায়েত দ্বারা স্থাপিত; উৎসবের সময় এখানে পীরের প্রসাদ হিসাবে ক্ষীর বিতরণ করা হয়)।
  • দেগঙ্গা থানার অন্তর্গত গাঙ্গুলিয়া, নারায়ণপুর, হাসিয়া, গাংধুলোট, সাতহাটিয়া, গোসাইপুর, এয়াজপুর, সুহাই, ভাসলিয়া প্রভৃতি স্থানের নজরগাহ।[১]

এছাড়া, পীর গোরাচাঁদের দরগাহ আছে খাস কলকাতা শহরেও; পার্ক সার্কাস অঞ্চলের গোরাচাঁদ দরগা রোড এখন দরগা রোড নামে সমধিক পরিচিত। কাছাকাছি অঞ্চলেই রয়েছে গোরাচাঁদ রোড এবং গোরাচাঁদ লেন

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ১৬৪-১৬৮
  2. Mitra, Satish Chandra. Jashor Khulnar Itihash Volume I. Deys Publishing, p. 482.
  3. "Lal Masjid - The Red Mosque"। www.historyofbengal.com। ৮ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১৭ 
  4. নির্মল বসু (১৯ মে ২০১৫)। "উন্নতমানের সংগ্রহশালা চান স্থানীয় মানুষ"। আনন্দবাজার পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  5. Dr. Gaurishankar de & Prof. Subhradip de, Prasanga: Pratna-Prantar Chandraketugarh, First Edition: 2013, আইএসবিএন ৯৭৮-৯৩-৮২৪৩৫-০০-৬
  6. দাস, গিরীন্দ্রনাথ, বাংলা পীর-সাহিত্যের কথা, বারাসত, সাল ১৯৭৬