বিষয়বস্তুতে চলুন

ইনযিল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ইনযিল
তথ্য
ধর্মইসলাম
ভাষাহিব্রু বা অ্যারামাইক
যুগআনু.৪ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ হতে ৩০/৩৩ খ্রিষ্টাব্দ
অধ্যায়অজ্ঞাত

ইনজিল (আরবি: إنجيل, রোমানাইজড: ইঞ্জিল, ইনজিল বা ইনজিল ) হ'ল ঈসার সুসমাচারের (ঈশ্বর প্রদত্ত গ্রন্থ সুসমাচার) আরবি নাম। এই ইনজিলকে কুরআন দ্বারা চারটি ইসলামিক পবিত্র গ্রন্থের একটি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা আল্লাহর দ্বারা ঈসার উপর অবতীর্ণ হয়েছিল। অন্যগুলো হচ্ছে যাবুর (সম্ভবত গীতসংহিতা), তাওরাত (তোরাহ) এবং কোরআন । "ইনজিল" শব্দটি কুরআন, হাদীস এবং আদি মুসলিম দলিলগুলিতেও ব্যবহৃত হয়েছিল। []

প্রকৃতি

[সম্পাদনা]

ইসলামিক পণ্ডিত মতামত নির্বিশেষে, মুসলমানরা সাধারণত বিশ্বাস করে যে ইনজিল ঈসাকে প্রদত্ত সত্যিকারের সুসমাচারকে বোঝায়। অনেক মুসলমান বিশ্বাস করে, ইনজিল ঈশ্বরের দ্বারা ঈসা (আঃ) এর কাছে সেভাবে অবতীর্ণ হয়েছিলো, যেভাবে কুরআন মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল তার সাথে তুলনামূলকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।

তারপর তাদের পিছনে আমি আমার রাসূলদেরকে অনুগামী করেছিলাম এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকেও অনুগামী করেছিলাম। আর তাকে ইনজীল কিতাব দিয়েছিলাম এবং যারা তার অনুসরণ করেছিল তাদের অন্তরসমূহে করুণা ও দয়ামায়া দিয়েছিলাম।

ঈসা (আঃ) বা অন্য যে কোনো ব্যক্তি ইনজিল লিখেছিলেন, মুসলমানরা এই দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, পরিবর্তে ঈশ্বরকে এর লেখক হিসেবে দাবি করেছেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন, বাইবেলের সুসমাচারে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, শব্দ এবং শব্দের অর্থ বিকৃত হয়েছে, কিছু অংশকে মুছে ফেলা হয়েছে এবং অন্য কিছু যুক্ত করা হয়েছে।[] ঈশ্বরের একত্বের এক মূল নীতি (তাওহীদ) এবং ঈশ্বরের ঈশ্বরত্বের সম্পূর্ণতার অর্থ হ'ল ঈসা মাসিহের পক্ষে ঈশ্বর অবতার বা ঈশ্বরের পুত্র হওয়া অসম্ভব এবং বাইবেলের সুসমাচারের বিপরীতে দাবি অবশ্যই পরবর্তী সংযোজনের কারণে হওয়া উচিত। তবুও, বাইবেলটিকে মুসলমানরা ঐতিহাসিক উৎস হিসাবে ব্যবহার করেছে, যাতে এখনও আল্লাহর বাণীর কিছু অংশ আছে। ইবন জুরাইজ(র.) বলেনঃ

কুরআন পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সংরক্ষক। তাই পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের যে অংশ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সেইটুকু সত্য যেটুকু অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ দেখা যাবে তা বাতিল ও পরিত্যাজ্য হবে।

ইনজিলের বিকৃতি

[সম্পাদনা]

কুরআনে বলা হয়েছে :

(হে মুসলমানগণ) তোমরা কি এই আশা করছ যে, তারা তোমাদের প্রতি ঈমান আনবে? অথচ তাদের একটি দল ছিল যারা আল্লাহর বাণী শুনত অতঃপর তা বুঝে নেয়ার পর তা তারা বিকৃত করত জেনে বুঝে।

সুতরাং ধ্বংস তাদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে। তারপর বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’, যাতে তা তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতে পারে। সুতরাং তাদের হাত যা লিখেছে তার পরিণামে তাদের জন্য ধ্বংস, আর তারা যা উপার্জন করেছে তার কারণেও তাদের জন্য ধ্বংস।

এই আয়াতগুলো ব্যাখ্যায় মুসলমান আলেমরা বলেছেন, ইনজিলে পরিবর্তন করা হয়েছে, শব্দ এবং শব্দের অর্থ বিকৃত করা হয়েছে, কিছু অংশকে মুছে ফেলা হয়েছে এবং অন্য কিছু যুক্ত করা হয়েছে।[] যেমনঃ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রা.) এর ব্যাখ্যাঃ

ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, তোমরা কিভাবে আহলে কিতাবদেরকে কোন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর? অথচ তোমাদের কিতাব (আল-কুরআন) তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর এখন অবতীর্ণ হয়েছে, তা তোমরা পড়ছ যা পূত-পবিত্র ও নির্ভেজাল। এ কিতাব তোমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে, আহলে কিতাবরা আল্লাহর কিতাবকে পরিবর্তিত ও বিকৃত করে দিয়েছে। তারা নিজ হাতে কিতাব লিখে তা আল্লাহর কিতাব বলে ঘোষণা দিয়েছে, যাতে এর দ্বারা সামান্য সুবিধা লাভ করতে পারে।

তিনি আরও বলেছেন,

ইবন আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ঈসা ইবন মারয়াম (আঃ)-এর পর এমন কয়েকজন বাদশাহ ছিলেন, যারা তাওরাত এবং ইঞ্জিলে পরিবর্তন সাধন করেন। তাদের মধ্যে এমন কিছু ঈমানদার লোকও ছিলেন, যারা তাওরাত পাঠ করতেন। তখন তাদের বাদশাহদেরকে বলা হলো—এ সকল লোক আমাদেরকে যে গালি দিচ্ছে, এর চেয়ে কঠিন গালি আর কি হতে পারে? তারা পাঠ করেঃ “যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দ্বারা মীমাংসা করে না, তারা কাফির। ... ... ...

এ কারণেই মুহাম্মদ (স.) যে নির্দেশ দিয়েছেন,

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আহলে কিতাব তাওরাত হিব্রু ভাষায় পাঠ করত, আর মুসলিমদের জন্য আরবী ভাষায় এর ব্যাখ্যা করত। এ প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ কিতাবধারীদেরকে তোমার বিশ্বাস করো না আবার তাদেরকে মিথ্যেবাদী সাব্যস্তও করো না। বরং তোমরা আল্লাহর এ বাণীটি قُولُوا آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا (তোমরা বল, ’আমরা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছি এবং যা আমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে) বল।

ব্যুৎপত্তি

[সম্পাদনা]

ইসলামী গ্রন্থগুলিতে আরবি শব্দ ইনজিল (جينجيل) পাওয়া যায় এবং বর্তমানে এটি মুসলিম অ-আরব এবং আরব অমুসলিমদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, এটি সিরিয়াক আরামাইক শব্দ আওঙ্গালিয়েউন (ܐܘܢܓܠܝܘܢ) থেকে পাওয়া যায়, যা পশিতায় পাওয়া যায় (বাইবেলের সিরিয়াক অনুবাদ) , যা মূলত গ্রীক ভাষা নিউ টেস্টামেন্টের গ্রীক শব্দ ইওনজেলিওন (Εὐαγγέλιον) থেকে এসেছে, যেখানে এর অর্থ "সুসংবাদ" (গ্রীক "Εὐ αγγέλιον" থেকে; প্রাচীন ইংরেজী "গডস্পেল"; আধুনিক ইংরেজি) প্রতীক হিসাবে "গসপেল" বা "সুসমাচার", সিএফ। যেমন স্প্যানিশ "ইভানজেলিও"। ইনজিল শব্দটি কুরআনে বারোবার এসেছে।

সনাক্তকরণ

[সম্পাদনা]

মুসলিম আলেমরা, নিউ টেস্টামেন্টের সুসমাচারগুলোর মাঝে সঠিক কোনটি, তা চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, বার্নাবাসের সুসমাচার বা থমাসের সুসমাচার সঠিক হতে পারে। সাধারণভাবে ইসলামি বিশ্বাস অনুসারে, এখন যে ইনজিল পাওয়া যায় তা বিকৃত একটি পাঠ্য এবং আসল ইনজিল হারিয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, আবদুল্লাহ ইউসুফ আলী লিখেছেন:

কুরআন যে ইনজিলের কথা বলে তা বাইবেলের নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্টের চারটি সুসমাচার নয়। বরং এটি একক কিতাব, যা ঈসা (আ:) এর উপর নাজিল করা হয়েছিল এবং যা থেকে তিনি শিক্ষা দান করেছেন। খ্রিস্টানদের দাবিকৃত সুসমাচারগুলোতে এখনও আসল ইনজিলের কিছু অংশ আছে (যেমন: বার্নাবাসের সুসমাচারে থাকতে পারে)।

ইনজিল সম্পর্কিত কুরআনের বিভিন্ন আয়াতকে অমুসলিম পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যাযুক্ত বলে মনে হয়েছে। যেমন:

আর আমি তাদের পেছনে মারইয়াম পুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্মুখে বিদ্যমান তাওরাতের সত্যায়নকারীরূপে এবং তাকে দিয়েছিলাম ইনজীল, এতে রয়েছে হিদায়াত ও আলো এবং (তা ছিল) তার সম্মুখে অবশিষ্ট তাওরাতের সত্যায়নকারী, হিদায়াত ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ। আর ইনজীলের অনুসারীগণ তাতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে যেন ফয়সালা করে আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক।

এর ব্যাখ্যায় তাফসির তাবারিতে আছে, 'সত্যায়নকারী' অর্থ হল সত্যতার মানদন্ড। অর্থাৎ, আল্লাহর বাণী এবং ইসলামের সাথে মিল থাকলে তা সত্য; অন্যথায় তা সত্য নয়।

ইবন জুবায়র (র.) বলেন, অন্যদের মতে কুরআন অন্যান্য কিতাবের মানদণ্ড। কিতাবীগণ তাদের কিতাবের কোন বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে জানালে তা যদি কুরআনে থাকে তবে বুঝতে হবে তারা সত্য বলেছে, অন্যথায় তারা মিথ্যাবাদী। আবার কেউ কেউ বলেন وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ অর্থ তার সত্যতার মানদন্ড (أمين)।

— তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

ইবন আব্বাস(রা.) وَمُهَيْمِنًا عَلَيْهِ এর ব্যাখ্যায় বলেন,

এর অর্থ বিশ্বস্ত তথা সত্যতা নির্ণয়ের মানদণ্ড । তিনি বলেন, কুরআন তার পূর্ববর্তী সকল কিতাবের সত্যতা নির্ণয়ের মানদণ্ড। ইবন ওয়াকী(র.) এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, ইবন 'আব্বাস(রা.) বলেন, সত্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠি।

— তাফসির তাবারী, ৯ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)

আরোও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "কুরআন-বর্ণিত ইঞ্জিল ও প্রচলিত ইঞ্জিল - মাসিক আলকাউসার"www.alkawsar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-১৮ 
  2. "প্রচলিত 'ইঞ্জিল শরীফ' কুরআনে বর্ণিত ইঞ্জিল নয় - মাসিক আলকাউসার"www.alkawsar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৩ 
  3. ইবনে কাসির। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া। ২য় খণ্ড। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ২৯২–২৯৩।