পীর ঠাকুরবর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পীর ঠাকুরবর হলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ইছাপুর-গোবরডাঙা-খাঁটুরা অঞ্চলের চারঘাটের মুসলমান সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট পীর। এই পীর ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীর বেশে থাকতেন বলে সাধারণ মানুষ তাকে 'ঠাকুর' বলত এবং তার বরলাভ করে রোগীরা আরোগ্যলাভ করত বলে তার নাম 'ঠাকুরবর' হয়েছে। ইনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পীর মোবারক বড়খাঁ গাজীর সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।[১]

পীর সম্পর্কিত কিংবদন্তি[সম্পাদনা]

কিংবদন্তি অনুযায়ী, পীর ঠাকুরবরের আসল নাম কামদেব বন্দ্যোপাধ্যায় (রায়)। তিনি ছিলেন বৃহত্তর যশোর জেলার লাউজানির (প্রাচীন নাম ব্রাহ্মণনগর) হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বী রাজা মুকুট রায়ের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। ষোড়শ শতাব্দীতে ইসলাম প্রচারক পীর বড়খাঁ গাজীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর রাজা মুকুট রায়, তার পুত্র ও কন্যা চম্পাবতী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিয়ে হয়। গাজীর সঙ্গে কামদেব ও চম্পাবতী তৎকালীন খুলনা জেলার লাবসা গ্রামে চলে যান; কিন্তু মনোমালিন্য হওয়ায় চম্পাবতী আত্মহত্যা করেন আর কামদেব বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাট মহকুমার চারঘাট গ্রামে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি সাধনাবলে পীর পর্যায়ে উন্নীত হন এবং স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে যথাযোগ্য সম্মান অর্জন করেন।[২][৩]

কথিত আছে, ইনি বুকে হাড়ি নিয়ে নিকটস্থ যমুনা নদী পার হয়ে চারঘাট গ্রামে উপস্থিত হন; এজন্য তার পারের ঘাটটিকে 'হেড়ের ঘাট' বলা হয়। তিনি চারঘাট বাঁওড়ের কাছে এসে একটি কুটির নির্মাণ করে বাস করতে থাকেন। তিনি একটি বাঘ এবং একটি কুমির পুষেছিলেন, যারা গভীর রাতে তার সঙ্গে দেখা করতে আসত। তিনি ছিলেন বাকসিদ্ধ পুরুষ; যে কোনো ব্যাধিগ্রস্ত রোগীকে তিনি সুস্থ করতে পারতেন। শোনা যায়, তিনি নাকি যশোহরের মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সংস্পর্শেও এসেছিলেন। প্রতাপাদিত্য তার আস্তানায় নিয়মিত আসতেন ও শ্রদ্ধানিবেদন করতেন।[২]
চারঘাটের পাশে কাঁচদহ গ্রামের হরি শুঁড়ি নামক এক ব্যক্তির পীরের কৃপায় খুব উন্নতি হয়ে এখানে এসে বসতি স্থাপন করে। প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়ে সে পীরকে উপেক্ষা করতে থাকে; এমনকি, প্রতাপাদিত্যের বিরাগভাজন হাওয়ায় হরি নানা বিপজ্জনক পরিস্থিতে পড়ে। শেষপর্যন্ত পীরের অভিশাপে হরি সপরিবারে যমুনায় প্রাণত্যাগ করে ধ্বংস হয়; সেজন্য, যমুনার এই স্থানকে লোকে আজও 'হরে শুঁড়ির দহ' বলে।[১]

পীর ঠাকুরবরের দরগাহ[সম্পাদনা]

দরগাহের সেবায়েতরা বংশপরম্পরায় মুসলিম। তারা প্রতিদিন ধূপ-বাতি জ্বালিয়ে নানা উপচারে শিরনি দিয়ে পীরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পীরের সমাধিস্তম্ভটি উপবীত-বেষ্টিত ছিল কিছুকাল আগে (১৯৬০-এর দশক) পর্যন্তও[২]; সমাধির পাশে একটি জপমালা রাখা আছে। দরগাহের দুটি ইটের উপর আরবি হরফে খোদিত লিপি আছে, যার পাঠোদ্ধার করা আজও সম্ভব হয়নি৷ ঠাকুরবরের এই দরগাহে ফুল-বেলপাতা দিয়ে নিত্যপূজার রীতি প্রচলিত আছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেকে বিবাহাদি অনুষ্ঠানের সময় দরগাহে পীরের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নেন।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২১৪-২১৫
  2. চক্রবর্তী, বরুণ, "লোকসংস্কৃতি কোষ", প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ১৫৯
  3. যশোর খুলনার ইতিহাস-২য় খণ্ড, সতীশচন্দ্র মিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশ: ২০১১, পৃষ্ঠা: ৪৪, ISBN 984715143