মাক্কি সুরা
মাক্কী সূরা হল ইসলামি পরম্পরায় সূরা অবতীর্ণ হওয়ার সময় ও প্রেক্ষাপট (আসবাব আল-নুযূল) অনুযায়ী কুরআনের এমন অধ্যায় (সুরাহ্; বহুবচনে সুয়ার), যেগুলো ইসলামের নবী মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার আগে অবতীর্ণ হয়েছে বলে ধরা হয়। এই সময়ের পর যেসব সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলোকে মাদানী সূরা বলা হয়। মোট ৮৬টি সূরাকে মাক্কী সূরা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মাক্কী সূরাগুলো সাধারণত মাদানী সূরাগুলোর তুলনায় আকারে ছোট হয় এবং এর আয়াতগুলোও তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত। এই সূরাগুলো কুরআনের শেষ ভাগে বেশি দেখা যায়। (সাধারণভাবে কুরআনের সূরাগুলোর বিন্যাস দীর্ঘ থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে সাজানো হয়েছে।) অধিকাংশ মুকাত্তআত বা বিচ্ছিন্ন অক্ষরবিশিষ্ট সূরা মাক্কী, তবে এর ব্যতিক্রম ২, ৩ এবং ১৩ নম্বর সূরা।[ক][১]
সূরাগুলোকে মাক্কী ও মাদানী দুই বিভাগে ভাগ করার পেছনে মূলত শৈলী ও বিষয়বস্তুর পার্থক্য দায়ী। কোন সূরা কোন পর্বে অবতীর্ণ হয়েছে, তা নির্ধারণে বিভিন্ন উপাদান বিবেচনা করা হয়, যেমন—আয়াতের দৈর্ঘ্য, বিশেষ শব্দ বা ধারণার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি (যেমন: আল্লাহর নাম হিসেবে আল-রহমান ব্যবহৃত হয়েছে কি না)।[২][৩]
এই মাক্কী ও মাদানী সূরার প্রচলিত কালানুক্রমিক বিন্যাস ইবনে আব্বাসের প্রতি আরোপিত হয়েছে এবং ১৯২৪ সালের মিশরীয় সরকার কর্তৃক প্রকাশিত মানক কুরআন সংস্করণে সেটি গৃহীত হওয়ার পর তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়েছে।
মাক্কী সূরাগুলোর বৈশিষ্ট্য
[সম্পাদনা]নিম্নে মাক্কী সূরার কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হলো। এর মধ্যে ৭ ও ৮ নম্বর বৈশিষ্ট্য শৈল্পিক রূপের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং শেষ চারটি বৈশিষ্ট্য বিষয়বস্তু ও বিষয়ের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত:
- যেসব সূরায় আল্লাহর উদ্দেশে সেজদার আদেশ আছে (আয়াত আল-সাজদাহ), সেগুলো মাক্কী, তবে সূরা ১৩[৪] ও ২২ নম্বর সূরা এর ব্যতিক্রম।[৫]
- যেসব সূরায় كلا (কল্লা - "কখনো না") শব্দটি রয়েছে, সেগুলো মাক্কী। এই শব্দটি কেবল কুরআনের দ্বিতীয়ার্ধে পাওয়া যায়।
- যেসব সূরায় يَـٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ (হে মানুষ) বাক্য আছে, কিন্তু يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا (হে বিশ্বাসীগণ) বাক্য নেই, সেগুলো মাক্কী। তবে সূরা ২২ এর ব্যতিক্রম রয়েছে।
- যেসব সূরা মুকাত্তআত বা বিচ্ছিন্ন অক্ষর দিয়ে শুরু হয়েছে, সেগুলো মাক্কী, তবে সূরা ২, ৩ ও ১৩ ব্যতিক্রম।
- যেসব সূরায় আদম (আ.) ও ইবলিসের (অর্থাৎ শয়তান) কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো মাক্কী, তবে সূরা ২ এর ব্যতিক্রম।
- যেসব সূরায় পূর্ববর্তী নবী ও তাঁদের সম্প্রদায়ের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো মাক্কী, তবে সূরা ২ ব্যতিক্রম।
- সংক্ষিপ্ত আয়াত, শক্তিশালী ভাষা, এবং ছন্দোময় রীতি লক্ষ্য করা যায়।
- জোরালোভাবে উপদেশ, অনুরোধ, উপমা ও শপথের ব্যবহার।
- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, কিয়ামতের দিন এবং জাহান্নাম ও জান্নাতের (স্বর্গ) বর্ণনার ওপর গুরুত্বারোপ—এগুলো সূরা ২ বাদে অধিকাংশ মাক্কী সূরায় আছে।
- সত্যবাদিতা, আত্মীয়দের প্রতি সদাচরণ, বয়স্ক ও প্রতিবেশীর প্রতি দয়া ইত্যাদি নৈতিক ও সার্বজনীন গুণাবলির প্রতি আহ্বান।
- বহুঈশ্বরবাদীদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক এবং তাদের আল্লাহর সঙ্গে শরিক স্থাপন করার খণ্ডন।
- পূর্ববর্তী রাসূলদের সম্প্রদায় অবিশ্বাসের কারণে যে শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল, তার কাহিনির মাধ্যমে মুশরিকদের সতর্ক করা।
মাক্কী সূরাগুলোর কালানুক্রমিক ক্রম
[সম্পাদনা]আবু আল-কাসিম উমর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল-কাফি প্রস্তাবিত একটি কালানুক্রমিক ক্রম, যা "প্রচলিত ক্রম" হিসেবে বিবেচিত হয়,[৬] সেখানে ৮৬টি সূরা অন্তর্ভুক্ত, যেগুলোর ক্রম নিম্নরূপ:
- ৯৬, ৬৮, ৭৩, ৭৪, ১, ১১১, ৮১, ৮৭, ৯২, ৮৯,
- ৯৩, ৯৪, ১০৩, ১০০, ১০৮, ১০২, ১০৭, ১০৯, ১০৫, ১১৩,
- ১১৪, ১১২, ৫৩, ৮০, ৯৭, ৯১, ৮৫, ৯৫, ১০৬, ১০১,
- ৭৫, ১০৪, ৭৭, ৫০, ৯০, ৮৬, ৫৪, ৩৮, ৭, ৭২,
- ৩৬, ২৫, ৩৫, ১৯, ২০, ৫৬, ২৬, ২৭, ২৮, ১৭,
- ১০, ১১, ১২, ১৫, ৬, ৩৭, ৩১, ৩৪, ৩৯, ৪০,
- ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৫১, ৮৮, ১৮, ১৬,
- ৭১, ১৪, ২১, ২৩, ৩২, ৫২, ৬৭, ৬৯, ৭০, ৭৮,
- ৭৯, ৮২, ৮৪, ৩০, ২৯, ৮৩।
অন্যদিকে, থিওডোর নল্ডেকে একটি ভিন্ন কালানুক্রমিক ক্রম প্রস্তাব করেন, যা পরে নল্ডেকে-শভালি ক্রম নামে পরিচিত হয়।[৭] এই ক্রমে মোট ৯০টি সূরা অন্তর্ভুক্ত, যেগুলো তিনি মুহাম্মদের নবুয়তের সময় অনুযায়ী তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন:
- নবুয়তের প্রথম থেকে পঞ্চম বছর পর্যন্ত:
- ৯৬, ৭৪, ১১১, ১০৬, ১০৮, ১০৪, ১০৭, ১০২, ১০৫, ৯২,
- ৯০, ৯৪, ৯৩, ৯৭, ৮৬, ৯১, ৮০, ৬৮, ৮৭, ৯৫,
- ১০৩, ৮৫, ৭৩, ১০১, ৯৯, ৮২, ৮১, ৫৩, ৮৪, ১০০,
- ৭৯, ৭৭, ৭৮, ৮৮, ৮৯, ৭৫, ৮৩, ৬৯, ৫১, ৫২,
- ৫৬, ৭০, ১১২, ১০৯, ১১৩, ১১৪, ১
- নবুয়তের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বছর:
- ৫৪, ৩৭, ৭১, ৭৬, ৪৪, ৫০, ২০, ২৬, ১৫, ১৯,
- ৩৮, ৩৬, ৪৩, ৭২, ৬৭, ২৩, ২১, ২৫, ১৭, ২৭, ১৮
- সপ্তম বছর থেকে হিজরত পর্যন্ত:
- ৩২, ৪১, ৪৫, ১৬, ৩০, ১১, ১৪, ১২, ৪০, ২৮,
- ৩৯, ২৯, ৩১, ৪২, ১০, ৩৪, ৩৫, ৭, ৪৬, ৬।[৮]
প্রাথমিক মাক্কী সূরাগুলো
[সম্পাদনা]প্রথম মাক্কী পর্ব বলতে সেই সময়কালকে বোঝায়, যখন নবী মুহাম্মদ প্রথম ওহী লাভ করা শুরু করেন। এই সময়ে অবতীর্ণ সূরাগুলোকে প্রাথমিক মাক্কী সূরা বলা হয়। এগুলো এমন এক সামাজিক পরিবেশে প্রচারিত হয়েছে, যেখানে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে সহজভাবে মুখে মুখে প্রচার করা হতো। এর গঠন ও দৈর্ঘ্য এমনভাবে তৈরি যে, সহজেই মুখস্থ করা ও শ্রুতি মাধ্যমে প্রচার করা সম্ভব হতো।[৯] অনেক সূরা তখনকার প্রাথমিক উপাসনালয় কার্যক্রমেও ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
এই সূরাগুলো সাধারণত কুরআনের অন্যান্য সূরার তুলনায় সংক্ষিপ্ত, তবে গঠনের দিক থেকে বেশি বৈচিত্র্যময়। পরবর্তী সূরাগুলোর তুলনায় এই সূরাগুলোতে ছন্দ ও তালের ব্যবহার বেশি দেখা যায়, যদিও এগুলো আকারে ছোট।[১০]
এই সূরাগুলোর দৈর্ঘ্য খুবই ছোট হতে পারে—যেমন, পাঁচটি আয়াতেরও কম দৈর্ঘ্যের এক বা দুই অনুচ্ছেদবিশিষ্ট (যেমন: সূরা ৯৭, ১০৩, ১০৫, ১০৮ ও ১১১)। আবার কিছু সূরা একত্রে দুটি (যেমন: সূরা ৮১, ৯১), তিনটি (যেমন: সূরা ৮২, ৮৪, ৮৬, ৯০, ৯২), কিংবা চারটি সূরার (যেমন: সূরা ৮৫, ৮৯) গুচ্ছ আকারে সাজানো হয়েছে।[১০]
কিছু সূরায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ তিনভাগের কাঠামো (ত্রিপার্ত গঠন) লক্ষ্য করা যায়, যা একটি নির্দিষ্ট সূচনার মাধ্যমে শুরু হয়ে মিলনবিন্দুতে শেষ হয়।টেমপ্লেট:What
এই সূরাগুলোর প্রধান বিষয়বস্তু হলো—প্রকৃতির শক্তিকে শপথের রূপে উপস্থাপন করে জোরালো ভাষায় আল্লাহর অস্তিত্বকে মানবজাতির কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা।[১১] এ ধরনের সূরায় ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাদের ধ্বংস আল্লাহর ইচ্ছা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া আল্লাহকে পৃথিবী, আকাশ ও এদের মধ্যেকার সবকিছুর স্রষ্টা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এবং তাঁর উদারতা, যা কোনো সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয়, তা-ও জোর দিয়ে বলা হয়েছে।
কিছু সূরা মানবিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলে—বিশেষত: আল্লাহর শক্তির সামনে মানুষের বিনয়, অতিরিক্ত ভোগবিলাস না করা, দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা ও দানশীলতা ইত্যাদি গুণাবলি বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে।
সবশেষে, এই সূরাগুলোতে পরকাল বা কিয়ামতের দিন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।[১২] যদিও এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো পরবর্তী সূরার তুলনায় তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত, তবে এগুলো একটি হুঁশিয়ারিমূলক ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে যাতে মানুষ কিয়ামতের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়। যেমন—সূরা ১০৩, ৬৮ ইত্যাদিতে কিয়ামতের দিন ও জান্নাতের চিত্র বেশ দৃশ্যমানভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
দ্বিতীয় মাক্কী সূরাগুলো
[সম্পাদনা]দ্বিতীয় মাক্কী পর্বে মোট ২১টি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। এই সূরাগুলোর প্রতিটি আয়াতের দৈর্ঘ্য গড়ে বারো থেকে বিশ সিলেবলের মধ্যে। কিছু সূরায় পঞ্চাশটিরও কম আয়াত রয়েছে, আবার কিছু সূরায়—যেমন সূরা ২০ (ত্বা-হা)—একশোরও বেশি আয়াত রয়েছে।[১৩]
এই সূরাগুলোর মধ্যে প্রথম বা তৃতীয় মাক্কী পর্বের সূরার মতো কোনো স্পষ্ট স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নেই। বরং এগুলোতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মাক্কী সূরার বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ দেখা যায়। এই মধ্যবর্তী সূরাগুলো আয়াতের ত্রিভাগীয় কাঠামো বজায় রেখে আরও বিস্তৃত আকারে তা উপস্থাপন করে। Ernst-এর মতে[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]—এই কাঠামোটি প্রাক-ইসলামিক আরবি কবিতার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য[স্পষ্টকরণ প্রয়োজন]—যেখানে সূরার প্রথম ও তৃতীয় অংশ সংক্ষিপ্ত হয় এবং এদের বিষয়বস্তু ও শ্রোতার দৃষ্টিকোণ কাছাকাছি থাকে। তৃতীয় অংশ সাধারণত একটি জোরালো সমাপ্তির মাধ্যমে শেষ হয়। এই দুই অংশের মাঝে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ একটি মধ্যবর্তী অংশ থাকে, যা সাধারণত নবুয়তের বর্ণনা ও সংগ্রামের কাহিনি উপস্থাপন করে।[১৪]
এই পর্বের সূরাগুলোতে আগের মাক্কী সূরার তুলনায় শপথের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম হলেও, অবিশ্বাসীদের প্রতি ভাষা ও ভঙ্গি অধিকতর প্রত্যক্ষ ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে।[১৩] কিছু সূরায় ঐক্যবাদের প্রার্থনারূপ কাঠামো গৃহীত হয়েছে, যা পরবর্তী মাক্কী সূরায় বেশি দেখা যায়।[১৫] উদাহরণস্বরূপ, সূরা ২০ একটি অংশ দিয়ে শুরু হয় যেখানে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করা হয়েছে এবং এরপরই মূসার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। দীর্ঘ এই কাহিনি শেষে কিছু আয়াতের মাধ্যমে এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বিশেষ করে অবিশ্বাসীদের প্রতি প্রয়োগযোগ্য দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।[১৬]
এই সূরাগুলোতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মাক্কী সূরার বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি কুরআনের ওহী ধাপে ধাপে কীভাবে বিকশিত হয়েছে, তা স্পষ্ট করে। কারণ, এই সময়ে মুহাম্মদের অনুসারী সম্প্রদায় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং রূপান্তরিত হচ্ছিল।
এই সূরাগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল—এগুলোতে স্বউল্লেখ বা আত্ম-উল্লেখ দেখা যায়; অর্থাৎ, কুরআনের ভেতরেই "কুরআন" (অর্থ: পাঠ) এবং "কিতাব" (অর্থ: গ্রন্থ) শব্দ ব্যবহার করে কুরআনের নিজ অস্তিত্বকে তুলে ধরা হয়েছে (যেমন সূরা ৫৪, ৩৭, ১৫ ইত্যাদি)। এর মাধ্যমে স্পষ্ট করা হয়েছে যে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত এক পবিত্র বার্তা।[১৩]
তবে এই আয়াতগুলোর কারণে কিছু বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে—বিশেষ করে, "আল্লাহর কালাম" অনাদি ও চিরন্তন কি না, এই প্রশ্ন নিয়ে। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে কুরআন চিরকাল আল্লাহর সঙ্গে ছিল এবং থাকবে; অন্যদিকে কেউ মনে করেন, এটি মুহাম্মদের নবুয়তের সময় থেকে আরবদের জন্য প্রেরিত একটি বিশেষ বার্তা মাত্র।
তৃতীয় মাক্কী সূরাগুলো
[সম্পাদনা]এই পর্বটি শুরু হয় মুহাম্মদের জনসমক্ষে দাওয়াত কার্যক্রমের শুরু থেকে শুরু করে প্রথম হিজরত—অথাৎ আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) মুসলমানদের হিজরত পর্যন্ত। ইউসুফ আলীর অনুবাদ অনুযায়ী, তৃতীয় মাক্কী পর্ব ৬১৯ থেকে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে নির্দেশ করে। এই সময়ে কুরাইশরা মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদের উপর অত্যাচার শুরু করে এবং তা তাঁর গোত্র হাশেম বংশ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। মুহাম্মদ (সা.)-কে রক্ষার দায়িত্ব থেকে হাশেম গোত্রকে বিরত করতে, কুরাইশরা হাশেম বংশের উপর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে।[১৭]
এই পর্বে অবতীর্ণ সূরাগুলোতে পুনরুত্থান, জান্নাত এবং কিয়ামতের বর্ণনা প্রধানভাবে উঠে এসেছে।[১৮]
এই সময়ে সূরাগুলোর পূর্ববর্তী ত্রিভাগীয় কাঠামো পরিত্যক্ত হয় এবং পরিবর্তে দীর্ঘ, তবে তুলনামূলকভাবে কম জটিল গঠনের সূরা দেখা যায়—যা এখনো গবেষকদের কাছে রহস্যাবৃত সংগ্রহশৈলির ইঙ্গিত দেয়। এই সূরাগুলোতে সাধারণত ঈমানদারদের বৃহত্তর একটি সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে দীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করা হয়। তাছাড়া, এই সময়ে আল্লাহ সরাসরি মুহাম্মদ (সা.)-কে সম্বোধন করতে শুরু করেন, পূর্বের মত কেবল তাঁর মাধ্যমে বাণী পাঠানোর পরিবর্তে।[১৯]
এই সূরাগুলোতে এমন নির্দেশনা রয়েছে, যেখানে দেখানো হয়েছে—বিপদের মধ্যেও একজন ঈমানদারকে কীভাবে আচরণ করা উচিত।[১৭]
তৃতীয় মাক্কী পর্বে এসে পূর্ববর্তী সময়ে ব্যবহৃত ইন্দ্রিয়জাত চিত্র—যেমন বড়-বক্ষ, টলটলে চোখের কুমারী রমণীদের বর্ণনা—প্রতিস্থাপিত হয়েছে জোড়া বা সঙ্গী সংক্রান্ত ইঙ্গিত দ্বারা।[২০]
উদাহরণস্বরূপ, তৃতীয় মাক্কী পর্বের এক স্থানে বলা হয়েছে: “যাদের পিতা-মাতা, সঙ্গী ও সন্তানরা সৎকর্ম করেছিল…”
এই পর্যায়ে এসে মুহাম্মদ (সা.) এবং মুসলমানরা একটি শক্তিশালী ভিত্তি লাভ করেছিলেন। প্রাথমিক মাক্কী সূরায় ওইসব ইন্দ্রিয়ঘটিত বর্ণনার মাধ্যমে মক্কার মুশরিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করা হতো। কিন্তু তৃতীয় পর্বে এসে এই কৌশল থেকে সরে এসে মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে—একটি বিধিবদ্ধ, আল্লাহর বাণিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।[২০]
[২১] গ্রন্থে কুরআনের আয়াতসমূহের একটি পূর্ণাঙ্গ কালানুক্রমিক পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ http://textminingthequran.com/wiki/Makki_and_Madani_Surahs ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১০-১০-৩১ তারিখে
- ↑ Gerhard Böwering, "Chronology and the Quran", Encyclopaedia of the Qur'an, Vol. 1, Brill
- ↑ (in Reviews) Studie zur Komposition der mekkanischen Suren by Angelika Neuwirth, Review author[s]: A. Rippin, Bulletin of the School of Oriental and African Studies, University of London, Vol. 45, No. 1. (1982), pp. 149–150.
- ↑ "The Quran"।
- ↑ "The Quran"।
- ↑ Edgecomb, Kevin P. "Chronological Order of Quranic Surahs" ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১৮-০১-১৩ তারিখে। সংগ্রহের তারিখ: ১৪ জুলাই ২০১৩।
- ↑ Nöldeke Theodor, Bersträsser Gotthelf, Pretzl Otto, Geschichte des Qorans von Theodor Nöldeke ; bearbeitet von Friedrich Schwally, Hidesheim, G. Holms, 1981. 1. ISBN 3-487-00105-5. 1909-1938.।
- ↑ Koran - Original Catholic Encyclopedia ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১১-০৭-২৫ তারিখে
- ↑ McAuliffe, Jane Dammen. "The Cambridge Companion to the Quran". Cambridge: 2006. পৃ. ১১০
- ↑ ক খ Ernst, "How to Read the Quran", পৃষ্ঠা ৭৬
- ↑ Ernst, "How to Read the Quran", পৃষ্ঠা ৭৭
- ↑ McAuliffe, পৃ. ১০৮
- ↑ ক খ গ Robinson, Neal. Discovering the Qurʼan: A Contemporary Approach to a Veiled Text. Washington, D.C.: Georgetown UP, 2003.
- ↑ Ernst, পৃষ্ঠা ১০৫
- ↑ McAuliffe
- ↑ Haleem, Abdel. The Qur'an. New York: Oxford UP, 2010.
- ↑ ক খ "Chronological Koran Part III: Late Meccan Period: A.D. 619–622." Wolf Pangloss. N.p., n.d. Web. 31 Oct. 2013.
- ↑ "Koran." - Original Catholic Encyclopedia. N.p., n.d. Web. 31 Oct. 2013.
- ↑ McAuliffe, পৃ. ১১১
- ↑ ক খ Robinson, Neal. Discovering the Qurʼan: A Contemporary Approach to a Veiled Text. Washington, D.C.: Georgetown UP, 2003. পৃ. ৮৮–৯২।
- ↑ Nassourou, Mohamadou (2013), "The Qurʾanic verses: history, computer-supported reconstruction of the order of revelation, examining the concept of abrogation", AVM - Akademische Verlagsgemeinschaft, Munich, Germany, আইএসবিএন ৯৭৮-৩৮৬৯২৪৪৭৫৪
১। Makki and Madani Surahs General Rules
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |
উদ্ধৃতি ত্রুটি: "lower-alpha" নামক গ্রুপের জন্য <ref>
ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="lower-alpha"/>
ট্যাগ পাওয়া যায়নি