বিষয়বস্তুতে চলুন

জাহান্নাম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মহান আল্লাহ ঈমানদার জাহান্নামীদেরকে মাফ করে দিবেন

জাহান্নাম (আরবি: جهنم) বা দোজখ ইসলামের পরিভাষায় পরকালের আবাসস্থল যা এমন পাপিদের জন্য নির্দিষ্ট যারা আল্লাহর ক্ষমা লাভ করবে না। এই ধারণাটি ইসলামি ধর্মতত্ত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ,[] এবং মুসলিম বিশ্বাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।[] ইসলামি মতবাদে জাহান্নামের গুরুত্ব হলো এটি বিচার দিবসের একটি অপরিহার্য উপাদান। আর বিচার দিবস হলো ছয়টি মূল বিশ্বাসের (আল্লাহ, ফেরেশতা, কিতাবসমূহ, নবীগণ, পুনরুত্থান দিবস এবং তকদিরে বিশ্বাস) মধ্যে অন্যতম, যার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বাস ঐতিহ্যগতভাবে সংজ্ঞায়িত হয়।[]

কুরআনে বর্ণিত জাহান্নামের অপর নামগুলো হলো (অথবা নরকের নাম)[]): "আগুন" (النار, আন-নার), "জ্বলন্ত আগুন" (جحيم, জাহিম)[]), "চূর্ণবিচূর্ণকারী"(حطمة, হুতামাহ)[]), অতল গহ্বর (هاوية, হাবিয়াহ)[]), "উজ্জ্বল অগ্নিকাণ্ড" (سعير, সা'ঈর)[]), "দহনের স্থান" (سقر, সাকার)।[][] এই নামগুলো প্রায়শই জাহান্নামের বিভিন্ন প্রবেশদ্বারের নাম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।[১০]

ইসলামের রাসুল মুহাম্মাদ(ﷺ)-এর হাদিসে এবং পরবর্তী সময়ের ইসলামি পণ্ডিতদের লেখাতেও জাহান্নামের বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে। জাহান্নাম শব্দটি শাব্দিকভাবে হিব্রু גיהנום গেহেন্নমের সাথে সম্পর্কিত। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী জাহান্নামের স্তর সাতটি এবং দরজাও সাতটি।

জাহান্নামের সাতটি দরজা ও স্তর (কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী)
ক্রম দরজার নাম বর্ণনা সূত্র
جَهَنَّم (জাহান্নাম) সাধারণ শাস্তির স্থান, কাফেরদের প্রথম স্তর সূরা আত-তাওবা: ৬৮, সূরা আল-হিজর: ৪৩
لَظَى (লাযা) প্রচণ্ড অগ্নিশিখা, অহংকারী ও সম্পদপ্রীত মানুষের জন্য সূরা আল-মাআরিজ: ১৫, সূরা আল-লাইল: ১৪-১৫
الحُطَمَة (হুতামা) ধ্বংসাত্মক আগুন, পরনিন্দাকারী ও অপবাদদাতার জন্য সূরা আল-হুমাযাহ: ৪
السَّعِير (সাঈর) প্রচণ্ড জ্বলন্ত আগুন, জ্বিন ও মানুষ যারা আল্লাহকে অমান্য করেছে তাদের জন্য সূরা আল-মুলক: ১০-১১, সূরা আল-হাজ্জ: ৪
سَقَر (সাকার) চরম শাস্তি, নামাজ ত্যাগকারী ও অসত্য অস্বীকারকারীর জন্য সূরা আল-মুদ্দাসসির: ৪২-৪৬
الجَحِيم (জাহিম) প্রচণ্ড অগ্নি, অহংকারী, গর্বিত ও মিথ্যাবাদীদের জন্য সূরা আস-সাফফাত: ৫৫-৫৭, সূরা আশ-শু’আরা: ৯১
السِّجِّين (সিজ্জিন) সর্বনিম্ন স্তর, কাফের ও মুনাফিকদের জন্য চূড়ান্ত শাস্তির স্থান সূরা আল-মুতাফফিফীন: ৭-৯[১১]

মূলধারার ইসলামি বিধান অনুযায়ী, জাহান্নামের শাস্তি ও ভোগান্তি শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক—সব ধরনেরই হয়ে থাকে, এবং তা দণ্ডিত ব্যক্তির পাপের তারতম্য অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হয়।[১২][১৩] কুরআনে বর্ণিত জাহান্নামের চরম যন্ত্রণা ও ভয়াবহতা প্রায়শই জান্নাতের আনন্দ ও সুখ-ভোগের সাথে তুলনামূলকভাবে উপস্থাপিত হয়।[১৪][১৫] সাধারণত মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে মুমিনদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি হবে সাময়িক, কিন্তু অবিশ্বাসীদের (অন্যদের) জন্য তা নয়।[১৬][Note ১] তবে এই ধারণা নিয়ে মতভেদ রয়েছে, এবং মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যেও বিতর্ক আছে যে জাহান্নাম কি অনন্তকাল থাকবে (যা সংখ্যাগরিষ্ঠের মত)[১৮][১৯] নাকি আল্লাহর দয়ার কারণে অবশেষে এর বিলুপ্তি ঘটবে।[২০]

মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস হলো, জান্নাতের মতোই জাহান্নামও (কেয়ামতের দিনের পর সৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে) এই পার্থিব জগতের সঙ্গে বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে।[২১] ইসলামি সাহিত্যে বিভিন্ন উৎসে জাহান্নামকে ভৌত বা জাগতিকভাবে বিভিন্ন উপায়ে বর্ণনা করা হয়। এটি আকারে বিশাল[২২][২৩] এবং জান্নাতের নিচে অবস্থিত।[২৪] এর সাতটি স্তর রয়েছে, প্রতিটি স্তরই তার উপরের স্তরের তুলনায় অধিক ভয়াবহ,[২৫] তবে এটিকে এক বিশাল গহ্বর হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে, যার উপর দিয়ে পুনরুত্থিত মানুষরা পুলসিরাত অতিক্রম করবে।[২৬] বলা হয়, জাহান্নামে পাহাড়, নদী, উপত্যকা এবং "এমনকি সমুদ্রও" রয়েছে যা ঘৃণ্য তরলে পূর্ণ;[২৭] এবং এটিকে (লাগাম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে) হাঁটা[২৮] ও প্রশ্ন করার ক্ষমতা সম্পন্ন এক বুদ্ধিমান সত্তার মতোই বর্ণনা করা হয়।[২৯]

উৎসসমূহ

[সম্পাদনা]

ইসলামে ব্যবহৃত (বা এর সাথে সম্পর্কিত) বিভিন্ন উৎস জাহান্নাম, এর শাস্তি, অবস্থান, অধিবাসী এবং তাদের পাপসমূহ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়।

প্রাক-ইসলামি যুগ: হিব্রু বাইবেল, নূতন নিয়ম এবং ব্যাবিলনীয় তালমুদ

[সম্পাদনা]
হিন্নোম উপত্যকা (অথবা গেহেন্না), আনুমানিক ১৯০০ সালের চিত্র। প্রাচীনকালে এটি ছিল শিশু বলিদান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের মৃতদেহ ফেলার স্থান। যিরমিয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এটি একসময় “বধের উপত্যকা” ও সমাধিস্থলে পরিণত হবে। পরবর্তী সাহিত্যকর্মে এর সঙ্গে নরকের ধারণা যুক্ত হয়—এক ভয়ঙ্কর স্থান, যেখানে পাপীদের শাস্তি প্রদান করা হবে।[৩০]

হিব্রু বাইবেলে, গেই-হিন্নোম বা গেই-বেন-হিন্নোম, অর্থাৎ "হিন্নোম [পুত্রের] উপত্যকা" হলো জেরুজালেমের একটি অভিশপ্ত উপত্যকা যেখানে শিশু বলি দেওয়া হতো। ক্যানোনিকাল গসপেল বা স্বীকৃত সুসমাচারগুলোতে, যিশু গেহেন্না সম্বন্ধে বলেছেন যে এটি এমন একটি স্থান "যেখানে কীট কখনও মরে না এবং আগুন কখনও নেভে না" (মার্ক ৯:৪৮)। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকের দিকে রচিত অপ্রামাণিক গ্রন্থ ৪ ইজরা-তে, গেহেন্নমকে শাস্তির এক অতিলৌকিক স্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই পরিবর্তনটি প্রায় ৫০০ খ্রিস্টাব্দে রচিত ব্যাবিলনীয় তালমুদে এসে পূর্ণতা লাভ করে।[৩১]

ধারণা করা হয় যে, ইসলামে জাহান্নামের বিবরণটি মোলেক দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলিকে আগুনের উপর দিয়ে চালনা করে বা আগুনে পুড়িয়ে উৎসর্গ করার প্রথা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত, যার বর্ণনা তোরাহ অনুসারে গেহেন্নাতে সংঘটিত হতো (যিরমিয় ৭; ৩২-৩৫)। একদিকে যেমন গেহেন্না থেকে জাহান্নাম নামটি এসেছে,[৩২] তেমনি বলিদানের জন্য ব্যবহৃত আগুন জাহান্নামের আগুনে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং মোলেক দেবতা কুরআনের বর্ণনায় জাহান্নামের প্রহরী মালিক-এ পরিণত হয়েছেন। (কুরআন ৪৩:৭৭)[৩৩]

কুরআন

[সম্পাদনা]

আইনার থমাসেন-এর মতে, মুসলিমরা যেভাবে জাহান্নামকে কল্পনা ও চিন্তা করে, তার অধিকাংশই কুরআন থেকে এসেছে। তিনি এতে প্রায় ৫০০ বার জাহান্নামের উল্লেখ পেয়েছেন, যা বিভিন্ন নামে ব্যবহৃত হয়েছে।[৩৪][Note ২]

নিম্নে জাহান্নাম সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতের একটি উদাহরণ[৩৮] দেওয়া হলো:

নিশ্চয়ই নির্ধারিত আছে মীমাংসার দিন:
সেদিন সিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, আর তোমরা দলে দলে আসবে,
এবং আসমান খুলে দেওয়া হবে, ফলে তা হবে বহু দরজাবিশিষ্ট,
আর চলমান করা হবে পর্বতসমূহকে, ফলে তা মরীচিকার মতো হয়ে যাবে।
নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে,
সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তনস্থল রূপে-
সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে।
সেখানে তারা আস্বাদন করতে পাবেনা কোন ঠান্ডা কিংবা (অন্য) কোনো পানীয়,
উত্তপ্ত পানি ও পুঁজ ব্যতীত;
(এটা তাদের কর্মের) উপযুক্ত প্রতিফল।
নিশ্চয়ই তারা কখনও হিসাবের আশংকা করতো না,
এবং তারা দৃঢ়তার সাথে আমার নিদর্শনাবলী মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
আর সব কিছুই আমি লিখিতভাবে সংরক্ষণ করেছি,
অতএব স্বাদ গ্রহণ করো, আমি তোমাদের জন্য কেবল শাস্তিই বৃদ্ধি করবো (অন্য আর কিছু নয়)।[৩৯]
সূরা নাবা, আয়াত: ১৭–৩০

কুরআনে জাহান্নামকে বোঝাতে ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দ ও বাক্যাংশের মধ্যে, 'আগুন' (আন-নার) শব্দটি ১২৫ বার, 'জাহান্নাম' শব্দটি ৭৭ বার, এবং 'জ্বলন্ত আগুন' (জাহিম) শব্দটি ২৬ বার[৪০] (বা অন্য হিসাব অনুযায়ী ২৩ বার) ব্যবহৃত হয়েছে।[৪১]

কুরআনে জাহান্নামের বর্ণনা সম্পর্কিত প্রায় প্রতিটি আয়াতেই এটিকে জলন্ত আগুনের স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৪২] কুরআনে জাহান্নামের বর্ণনার একটি সংকলনে[৪৩] "আগুনের শাস্তির সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত" মেলে: গর্জনরত ও মটমট শব্দকারী অগ্নিশিখা;[৪৪] প্রবল উষ্ণ, ফুটন্ত জল;[৪৫] দাহক বাতাস এবং কালো ধোঁয়া,[৪৬] যা যেন ক্রোধে ফেটে পড়ার উপক্রম হয়ে ক্রমাগত গর্জন ও স্ফুটন করতে থাকে।[৪৭]

জাহান্নামকে জান্নাতের নিচে অবস্থিত বলে বর্ণনা করা হয়, যার সাতটি দরজা রয়েছে[৪৮][২৪] এবং "প্রত্যেকটি দরজার জন্য (পাপীদের) একটি নির্দিষ্ট দল থাকবে" (কুরআন ১৫:৪৩-৪৪)।[৪৯][][৫০] কুরআনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, অপরাধীদের "তাদের কর্ম অনুসারে বিভিন্ন স্তর (বা পদমর্যাদা) থাকবে",[৫১] (যাকে কিছু পণ্ডিত প্রতিটি দরজার জন্য নির্ধারিত "নির্দিষ্ট দল" বলে মনে করেন);[৪০] এবং সেখানে "সাতটি আসমান স্তরে স্তরে এবং পৃথিবীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ" (কুরআন ৬৫:১২) রয়েছে,[৫২] (যদিও এটি ইঙ্গিত করে না যে পৃথিবীর সাতটি স্তরই জাহান্নাম)। জাহান্নামের স্তর সম্পর্কে একটিমাত্র উল্লেখ হলো এই যে, মুনাফিকরা এর সর্বনিম্ন স্তরে থাকবে।[৪০][৫৩]

শব্দ ব্যবহার

[সম্পাদনা]

কিছু আলেমে দ্বীন মূল ইসলামী আরবি শব্দ "জাহান্নাম" (جهنم‎‎)-এর ব্যবহারকে অধিক উৎসাহিত করে থাকেন, যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, জাহান্নাম শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই শব্দটি বলার সময় প্রতি হরফে দশ নেকি করে ৪ হরফে মোট ৪০ নেকি সাওয়াব পাওয়া যাবে, যা দোযখ বা অন্যান্য প্রতিশব্দ উচ্চারণে পাওয়া যাবে না। কুরআনিয় শব্দ বলায় প্রতি হরফে দশ নেকির ক্ষেত্রে তারা বিশ্ব নবী মুহাম্মদ (ﷺ) এর উক্ত হাদীসটি পেশ করেন,

রাসূল (সা.) বলেছেন,

مَنْ ‌قَرَأَ ‌حَرْفًا ‌مِنْ ‌كِتَابِ ‌اللَّهِ ‌فَلَهُ ‌بِهِ ‌حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ

‘আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সওয়াব আছে। আর সওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’

[সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ২৯১০]

জাহান্নামের গভীরতা

[সম্পাদনা]

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা একদা রাসূল (ﷺ) এর সাথে ছিলাম। এমন সময় একটি বিকট শব্দ শোনা গেল। রাসূল (ﷺ) বললেন, "তোমরা কি জানো এটা কিসের শব্দ?" আমরা বললাম, "আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলই এ ব্যাপারে ভাল জানেন।" তিনি বললেন, "এটি একটি পাথরের শব্দ, যা আজ থেকে সত্তর বছর পূর্বে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, আর তা তার তলদেশে যাচ্ছিলো এবং এত দিনে সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে।" (সহীহ মুসলিম)[৫৪]

আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত। তিনি রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছেন, তিনি বলেন, "বান্দা মুখ দিয়ে এমন কথা বলে ফেলে, যার ফলে সে জাহান্নামে আকাশ ও জমিনের দূরত্বের চেয়েও গভীরে চলে যায়।"(সহীহ মুসলিম-কিতাবুয যুহদ)[৫৫]

জাহান্নামের পরিবেশ

[সম্পাদনা]

বিশ্বাস করা হয়, জাহান্নামীরা যখন খাবার চাইবে তখন তাদের দেয়া হবে যাক্কুম নামক কাটা যুক্ত ফল, আর তাদেরকে দেয়া হবে জাহান্নামীদের উত্তপ্ত রক্ত ও পুঁজ। মূলে গাস্সাক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।[৫৬] এর অর্থ হয়ঃ পুঁজ, রক্ত, পুঁজ মেশানো রক্ত এবং চোখ ও গায়ের চামড়া থেকে বিভিন্ন ধরনের কঠোর দৈহিক নির্যাতনের ফলে যেসব রস বের হয়, যা প্রচণ্ড দুৰ্গন্ধযুক্ত। চারিদিকে শোনা যাবে শুধু চিৎকার।

জাহান্নামীদের অবস্থা

[সম্পাদনা]

হযরত আনাস রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু সূত্রে নবী করিম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, 'হে লোক সকল ! তোমরা (আল্লাহর আযাবের ভয়ে) বেশি করে কাঁদ । আর যদি তোমরা এরূপ করতে না পার (কান্না যদি না আসে) , তাহলে অন্তত (ভয়ে) কান্নার ভান কর । কেননা, জাহান্নামীরা জাহান্নামে গিয়ে এমনভাবে কাঁদবে যে, তাদের অশ্রু তাদের মুখের উপর এভাবে গড়িয়ে পড়বে , মনে হবে এটা পানির নালা । এভাবে কাঁদতে কাঁদতে তাদের অশ্রু শেষ হয়ে যাবে এবং এর স্হলে রক্ত প্রবাহিত হতে শুরু করবে । তারপর (এ রক্ত ক্ষরণের দরুন) তাদের চোখে ক্ষতের সৃষ্টি হয়ে যাবে । ( এরপর এই ক্ষত স্থান থেকে আরো বেশি রক্ত বের হবে, তখন জাহান্নামীদের এই অশ্রু এবং রক্তের পরিমাণ এমন হবে যে,) সেখানে যদি অনেকগুলো নৈাকা চালিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অনায়াসে চলতে পারবে । - শরহুস সুন্নাহ ।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত , রাসূলূল্লাহ (ﷺ) এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, 'তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় কর এবং এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর যে, মুসলিম না হয়ে তোমরা মরবে না ।' এরপর তিনি (আল্লাহকে এবং আল্লাহর আযাবকে ভয় করা প্রসঙ্গে ) বললেনঃ যাককুম (যার প্রসঙ্গে কুরআনে বলা হয়েছে এটা জাহান্নামে উৎপন্ন এক প্রকার গাছ এবং এটা জাহান্নামীদের খাবার হবে ) এর একটি ফোটা যদি এই দুনিয়ায় ছিটকে পড়ে, তাহলে পৃথিবীতে বসবাসকারী সবার জীবনোপকরণ বিনষ্ট করে দিবে । অতএব, ঐ ব্যক্তির কি অবস্হা হবে যার খাবারই হবে যাক্কুম ?' - তিরমিযি ।

জাহান্নামীদের মধ্যে সবচেয়ে কম শাস্তি হবে আবু তালিবের। তার পায়ে দু’খানা আগুনের জুতা পরিয়ে দেয়া হবে, ফলে তার মাথার মগজ ফুটতে থাকবে। বুখারী- ইবনে আব্বাস দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুনে ঢুকিয়ের বের করা হবে। তাকে বলা হবে, তুমি দুনিয়াতে কখনো সুখ ভোগ করেছিলে? সে বলবে না, আমি কখনো সুখ ভোগ করিনি। মুসলিম- আনাস জাহান্নামের সবচেয়ে কম ও সহজতর শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি পৃথিবী পরিমাণ সম্পদ থাকলেও তার বিনিময়ে এ আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতো। বুখারী, মুসলিম- আনাস

জাহান্নামে অবস্থানকাল

[সম্পাদনা]

জাহান্নামকে কখনো ধ্বংস করা হবেনা। এটি বর্তমানে অস্তিত্বশীল এবং এর অধিবাসীরা একের পর এক আগমনকারী দীর্ঘ সময় সেখানে অবস্থান করবে। এমন একটি ধারাবাহিক যুগ যে, একটি যুগ শেষ হবার পর আর একটি যুগ শুরু হয়ে যায়। এমন কোন যুগ হবে না যার পর আর কোন যুগ আসবে না। কুরআনের ৩৪ জায়গায় জাহান্নামবাসীদের জন্য ‘খুলুদ’ (চিরন্তন) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তিন জায়গায় কেবল ‘খুলুদ’ বলেই শেষ করা হয়নি বরং তার সাথে “আবাদান” (চিরকাল) শব্দও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।[৫৭] "উপযুক্ত প্রতিফলস্বরূপ"[৫৮] অর্থাৎ জাহান্নামে তাদেরকে যে শাস্তি দেয়া হবে, তা ন্যায় ও ইনসাফের দৃষ্টিতে তাদের বাতিল বিশ্বাস ও কুকর্মের অনুরূপ হবে। এতে কোন বাড়াবাড়ি হবে না।[৫৯]

আরোও দেখুন

[সম্পাদনা]

পাদটীকা

[সম্পাদনা]
  1. "একথা লক্ষ্যণীয় যে, পরবর্তী যুগের মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রায় সর্বসম্মত মত ছিল যে, গুরুতর পাপী মুসলিমদের জন্য শাস্তি কেবল অস্থায়ী হবে; অবশেষে জাহান্নামের উপরিস্তরে এক ধরনের পরিশোধনমূলক অবস্থান শেষে তাদের জান্নাতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে।"[১৭]
  2. কুরআনে উল্লিখিত উল্লেখের সংখ্যার বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ. জোন্স জাহান্নাম সম্পর্কে ৯২টি "গুরুত্বপূর্ণ অংশ" এবং জান্নাত সম্পর্কে ৬২টি অংশ গণনা করেছেন।[৩৫] অপরদিকে ল্যাং প্রায় ৪০০টি আয়াতকে "অর্থবহভাবে জাহান্নামের সাথে সম্পর্কিত" এবং প্রায় ৩২০টি আয়াতকে জান্নাতের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।[৩৬] অন্যান্য কিছু গবেষক দাবি করেছেন, কুরআনে জান্নাতকে জাহান্নামের তুলনায় "উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি স্থান" দেওয়া হয়েছে।[৩৭]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. 1 2 Thomassen, "Islamic Hell", Numen, 56, 2009: p.401
  2. Lange, "Introducing Hell in Islamic Studies", 2016: p.3
  3. 1 2 Rustomji, Nerina (২০০৯)। The Garden and the Fire: Heaven and Hell in Islamic Cultur। Columbia University Press। পৃ. ১১৮–। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪
  4. কুরআন ২:১১৯
  5. কুরআন ১০৪:৪
  6. কুরআন ১০১:৯
  7. কুরআন ৬৭:৫
  8. "A Description of Hellfire (part 1 of 5): An Introduction"Religion of Islam। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪
  9. "The Names of Hell-Fire"IslamCan.com। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪
  10. রুস্তমজি, নেরিনা (২০০৯)। বাগান ও অগ্নি: ইসলামি সংস্কৃতিতে জান্নাত ও জাহান্নাম। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস। পৃ. শবাব ১১৮–১১৯। আইএসবিএন ৯৭৮০২৩১১৪০৮৫০। সংগ্রহের তারিখ ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪
  11. কুরআন ১৫:৪৩–৪৪
  12. এমেরিক, ইয়াহিয়া (২০১১)। দ্য কমপ্লিট ইডিয়টস গাইড টু ইসলাম (৩য় সংস্করণ)। পেঙ্গুইন। আইএসবিএন ৯৭৮১১০১৫৫৮৮১২
  13. টম ফুলকস, হেরেসি? দ্য ফাইভ লস্ট কমান্ডমেন্টস, স্ট্র্যাটেজিক বুক পাবলিশিং, ২০১০ আইএসবিএন ৯৭৮-১-৬০৯-১১৪০৬-০, পৃ. ৭৪
  14. Thomassen, "Islamic Hell", Numen, 56, 2009: p.405
  15. Smith & Haddad, Islamic Understanding, 1981: p.86
  16. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ReferenceA নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  17. Lange, "Introducing Hell in Islamic Studies", 2016: p.7
  18. ল্যাঙ্গে, ক্রিশ্চিয়ান (২০১৬)। "Introducing Hell in Islamic Studies"। Locating Hell in Islamic Traditions। BRILL। পৃ. ১২। আইএসবিএন ৯৭৮-৯০-০৪-৩০১২১-৪জেস্টোর 10.1163/j.ctt1w8h1w3.7যদিও, উপরোক্তভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, কিছু ধর্মতাত্ত্বিকের মতে কেবল জান্নাতই অনন্তকাল টিকে থাকবে আর জাহান্নাম শেষ পর্যন্ত বিনষ্ট হবে (ফানাআন-নার), তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে জাহান্নামও অনন্তকাল অনন্তকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, অর্থাৎ আ পার্তে পোস্ট (আবদ) (তুলনা করুন: কুরআন ৪:১৬৯, ৫:১১৯, ইত্যাদি)।
  19. "জাহান্নামের বিবরণ (পর্ব ১/৫): ভূমিকা"Religion of Islam। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১৪কেউ জাহান্নাম থেকে বের হবে না, তবে সেই পাপী মুমিনেরা বের হবে যারা এই দুনিয়ায় আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের নিকট প্রেরিত নির্দিষ্ট নবীতে বিশ্বাস করেছে (মুহাম্মাদের আগমনের পূর্বে)।
  20. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ETISN2009:413 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  21. ক্রিশ্চিয়ান, ল্যাঙ্গে (২০১৬)। "ইসলামি অধ্যয়নে জাহান্নামের ভূমিকা"। ইসলামি ঐতিহ্যে জাহান্নামের অবস্থান। ব্রিল। পৃ. ১২। আইএসবিএন ৯৭৮-৯০-০৪-৩০১২১-৪জেস্টোর 10.1163/j.ctt1w8h1w3.7
  22. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; discover নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  23. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; 500-years নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  24. 1 2 আলি, আবদুল্লাহ ইউসুফ (২০০১)। আল-কুরআন। এল্‌মহার্স্ট, নিউ ইয়র্ক: তাহরিকে তারসিলে কুরআন, ইনক.। পৃ. ৩৫৩–৩৫৪।
  25. কুরআন ১৫:৪৪
  26. Bukhārī, Ṣaḥīḥ, k. al-riqāq 52; Muslim, Ṣaḥīḥ, k. al-īmān 299; quoted in |Lange, "Introducing Hell in Islamic Studies", 2016: p.12
  27. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; CLLHiIT2016:15 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  28. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; reins-Qurtubi নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  29. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; qaf-50:30-AYAli নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  30. Berlin 2011, পৃ. 285
  31. বার্নস্টাইন, অ্যালান ই. (২০১৭)। নরক ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা: প্রাথমিক মধ্যযুগে খ্রিস্টান, ইহুদি ও মুসলমানদের মধ্যে মৃত্যু ও প্রতিদান (১ সংস্করণ)। কর্নেল ইউনিভার্সিটি প্রেস। জেস্টোর 10.7591/j.ctt1qv5q7k
  32. Richard P. Taylor (2000). Death and the Afterlife: A Cultural Encyclopedia. "JAHANNAM From the Hebrew ge-hinnom, which refers to a valley outside Jerusalem, Jahannam is the Islamic word for hell."
  33. "কুরআনের বিদেশি শব্দভাণ্ডার"। ওরিয়েন্টাল ইনস্টিটিউট বারোদা। ১৯৩৮।
  34. Thomassen, "ইসলামিক হেল", Numen, 56, 2009: পৃ. ৪০২
  35. Jones, Paradise and Hell, পৃ. ১১০
  36. Lange, Paradise and Hell অধ্যায় ১, (প্রকাশিতব্য)
  37. Lange, "Introducing Hell in Islamic Studies", 2016: পৃ. ৫
  38. "সূরা আন-নাবা - ১-৪০"
  39. শাকির অনুবাদ, উদ্ধৃত হয়েছে Thomassen, Einar (২০০৯)। "ইসলামিক হেল"Numen৫৬ (২–৩): ৪০৩। ডিওআই:10.1163/156852709X405062জেস্টোর 27793798। সংগ্রহের তারিখ ৬ জানুয়ারি ২০২২
  40. 1 2 3 উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; ItQ নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  41. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Islamicity নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  42. আলি, আবদুল্লাহ ইউসুফ (২০০১)। আল-কুরআন। এল্‌মহার্স্ট, নিউ ইয়র্ক: তাহরিকে তারসিলে কুরআন, ইনক.। পৃ. ২১।
  43. Smith & Haddad, Islamic Understanding, 1981: p.85-86
  44. "কুরআন ২৫:১৪"
  45. "কুরআন ২২:১৯"। সংগ্রহের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  46. "Surah Al-Waqi'ah – 42–43"quran.com। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২১
  47. "Surah Al-Mulk – 7–8"quran.com। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২১
  48. আয়াত ৭:৫০-এ বলা হয়েছে: "আগুনের সঙ্গীরা জান্নাতের সঙ্গীদেরকে ডাক দেবে: 'আমাদের উপর কিছু পানি ঢেলে দাও, অথবা আল্লাহ তোমাদের যা কিছু দান করেছেন তার কিছু আমাদের দাও'।" কুরআন ৭:৫০
  49. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Surah Al-Hijr - 43-44 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  50. Thomassen, "Islamic Hell", Numen, 56, 2009: p.407
  51. কুরআন ৬:১৩২
  52. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Christian Lange p. 12-13 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  53. "কুরআন ৪:১৪৫"
  54. সহীহ মুসলিম, জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত পাথর
  55. সহীহ মুসলিম, কিতাবুয যুহদ
  56. "Tafsir Ahsanul Bayaan - 78:25 - bengali"quran.com। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০২১
  57. "Tafsir Abu Bakr Zakaria - 78:23 - bengali"quran.com। সংগ্রহের তারিখ ২৪ আগস্ট ২০২১
  58. "Tafsir Ahsanul Bayaan - 78:26 - bengali"quran.com। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০২১
  59. "Tafsir Abu Bakr Zakaria - 78:26 - bengali"quran.com। সংগ্রহের তারিখ ২২ আগস্ট ২০২১

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]