আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শায়খুল কুল

আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী
উপাধিমুনাজেরে ইসলাম, মুজাহিদে আযম, অলিকুল শিরোমণি
ব্যক্তিগত তথ্য
জন্ম১৮৫০
মৃত্যু১৯০৫ (বয়স ৫৪–৫৫)
সমাধিস্থলমুন্সিপাড়া, খরণদ্বীপ, বোয়ালখালী
ধর্মইসলাম
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
পিতামাতা
  • জিন্নাত আলী (পিতা)
জাতিসত্তাবাঙালি
আখ্যাসুন্নি
ব্যবহারশাস্ত্রহানাফি
আন্দোলনদেওবন্দি
প্রধান আগ্রহহাদিস, ফিকহ, আকিদা, তাসাউফ, সমাজ সংস্কার
উল্লেখযোগ্য কাজহাটহাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা
যেখানের শিক্ষার্থীদারুল উলুম দেওবন্দ
মুসলিম নেতা
যার দ্বারা প্রভাবিত
যাদের প্রভাবিত করেন

আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী (১৮৫০ — ১৯০৫) ছিলেন একজন দেওবন্দি ইসলামি পণ্ডিত এবং সমাজ সংস্কারক। তিনি বাংলায় দেওবন্দ আন্দোলনের সূচনাকারীদের অন্যতম। তিনি এবং তার শিষ্যরা ওয়াজ-নসীহত ও তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে তৎকালীন ইসলামের নামে প্রচলিত শিরক-বিদআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালান। তারই প্রচেষ্টায় আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়। কঠোর সংগ্রাম ও বিতর্কে পারদর্শিতার কারণে তাকে মুজাহিদে আযম ও মুনাজেরে ইসলাম নামে স্মরণ করা হয়। তার প্রসিদ্ধ উপাধি শায়খুল কুল বা সর্ব শ্রদ্ধেয় মুরব্বি।

জন্ম ও বংশ[সম্পাদনা]

আব্দুল ওয়াহেদ ১৮৫০ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানাধীন খরণদ্বীপ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জিন্নাত আলী তদানীন্তন রাঙ্গুনিয়া থানার কাউখালী মুন্সেফ আদালতের মুন্সেফ ছিলেন।[১][২][৩]

শিক্ষাজীবন[সম্পাদনা]

পিতার কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ সমাপ্ত করেন। তারপর ভর্তি হন স্থানীয় সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়ে। ঐ সময় উর্দুআরবি ছিল ঐচ্ছিক বিষয়। তিনি এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় একটি উর্দু কিতাবে তিনি কুরআন, হাদিসআরবি শিক্ষার গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তারপর তিনি প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষায় আর শিক্ষিত না হয়ে আরবি শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এতে পরিচিত লোকজন তাকে উপহাস ও ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগলো। বাধ্য হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় পিতার এক বন্ধুর বাড়িতে চলে যান এবং তাকে আরবি শিক্ষার অভিলাষ প্রকাশ করেন। ওই ব্যক্তি তার পিতার কাছে ছেলের অবস্থা ও অভিলাষ জানিয়ে একটি পত্র লিখেন। পত্র পাওয়ার পর তার পিতা তাকে নিয়ে আসেন এবং চট্টগ্রামের মোহসেনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। মুন্সেফের ছেলের আরবি পড়া নিয়ে প্রতিবেশিরা নানারকম কথা বলতো। ফলে বাধ্য হয়ে তিনি সকলের অজান্তে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ চলে যান। দেওবন্দে তিনি ধর্মশিক্ষায় এমনভাবে আত্মনিয়োগ করলেন যে বাড়ি হতে আসা কোনো চিঠির প্রত্যুত্তর দিতেন না। দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি দেওবন্দে অধ্যয়ন করে ১৮৭৩ সালে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সমাপ্ত করেন।[৪][৫][৬]

তাসাউফ[সম্পাদনা]

বাংলাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবির ছাত্র ছিল দুই জন। একই গ্রামের ওবায়দুল হাকিম ও আব্দুল ওয়াহেদ। তারা দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার আনু. ৫ থেকে ৬ বছর পর ভর্তি হয়েছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর তারা নানুতুবির কাছে আধ্যাত্বিক দীক্ষা নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। নানুতুবি তাদের আধ্যাত্বিক দীক্ষা তার কাছে না নিয়ে অন্য কারো হাতে নিতে বলেন। উভয়ই নানুতুবিকে একজন সাধকের সন্ধান দিতে আবেদন করেন। তখন নানুতুবি তৎকালীন প্রসিদ্ধ আধ্যাত্বিক ব্যক্তিত্ব ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদীর সাথে তাদের আধ্যাত্বিক সম্পর্ক করে দেন। দুই বছর পর উভয়ই তার কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। এসময় পিতা বেঁচে নেই মর্মে মায়ের একটি চিঠি তার হস্তগত হয়। চিঠিতে বাড়িতে ফেরার জন্য তার মা জোর তাগিদ জানায়। চিঠি পেয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর পর তিনি বাড়িতে চলে আসেন।[৭]

বিবাহ[সম্পাদনা]

আবার বিদেশ চলে যেতে পারে এই আশঙ্কায় তার মা বিবাহের ব্যবস্থা করেন। তিনি রাউজান থানার অন্তর্গত কদলপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ সংসারে তার এক কন্যা শাকেরা খাতুন ও দুই ছেলে: সোলায়মান ও আইয়ুব জন্মগ্রহণ করেন। তার স্ত্রী ধর্মানুরাগী ছিলেন না। বারবার তাগিদের পরও ধর্মানুরাগী না হওয়ায় তিনি সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন এবং স্ত্রী সহকারে শ্বশুরালয়ে গমনপূর্বক সম্পর্কচ্ছেদ করেন। এরপর তিনি শ্বশুরালয় হতে বাড়িতে না গিয়ে ফটিকছড়ি থানার বাবুনগর নিবাসী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুফি আজিজুর রহমানের বাড়িতে চলে যান। সেখানে উভয়ই ধর্মীয় শিক্ষাদানে রত হন। সুফির প্রচেষ্টায় নাজিরহাটের এক কন্যার সাথে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর তিনি বাবুনগর গ্রামের ধুরং খালের পশ্চিম পার্শ্বে এক ব্যক্তি হতে ইজারা হিসেবে কিছু জমি নিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তাজবিদের শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং তার পাশে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। এ সংসারে তার একটি মেয়ে জন্ম লাভ করেছিল।[৭]


মৃত্যু[সম্পাদনা]

তিনি ১৯০৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর। হাবিবুল্লাহ কুরাইশির ইমামতিতে তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং পৈত্রিক কবরস্থান খরণদ্বীপ মুন্সিপাড়ায় তাকে দাফন করা হয়।

তার কবরের পূর্ব পার্শ্বে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার নাম ওয়াহেদিয়া মাদ্রাসা। তার জীবনীকারকদের মধ্যে মাওলানা জাফর সাদেক অন্যতম।[৮]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. হাফেজ আহমদুল্লাহ, মুফতি; হাসান, আহমদ (মে ২০১৬)। (বীর মুজাহিদে আযম শায়খুল কুল হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ রহ. - এর সংক্ষিপ্ত জীবনী)মাশায়েখে চাটগাম — ১ম খণ্ড (৩য় সংস্করণ)। ১১/১, ইসলামী টাওয়ার, বাংলাবাজার, ঢাকা ১১০০: আহমদ প্রকাশন। পৃষ্ঠা ২৯ — ৬৮। আইএসবিএন 978-984-92106-4-1 
  2. আমীরুল ইসলাম, মাওলানা (২০১২)। (হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব রহ.)সোনার বাংলা হীরার খনি ৪৫ আউলিয়ার জীবনী। ৫০, বাংলাবাজার, ঢাকা: কোহিনূর লাইব্রেরী। পৃষ্ঠা ২০৫—২১৩। 
  3. ওবাইদুল হক, মুহাম্মদ (২০১৭)। বাংলাদেশের পীর আওলিয়াগণ। বাংলাবাজার, ঢাকা: মদীনা পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ৩৯। আইএসবিএন 984-70099-0024-2 
  4. নিজামপুরী, আশরাফ আলী (২০১৩)। (মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ বাঙ্গালী রহ.)দ্যা হান্ড্রেড (বাংলা মায়ের একশ কৃতিসন্তান) (১ম সংস্করণ)। হাটহাজারী, চট্টগ্রাম: সালমান প্রকাশনী। পৃষ্ঠা ১৯ — ২৩। আইএসবিএন 112009250-7 
  5. বাবুনগরী, জুনায়েদ (২০০৩)। (হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব রহ.)দারুল উলুম হাটহাজারীর কতিপয় উজ্জ্বল নক্ষত্র (১ম সংস্করণ)। হাটহাজারী, চট্টগ্রাম: বুখারী একাডেমি। পৃষ্ঠা ১০। 
  6. জাফর, আবু (২০১৭)। ভারতীয় উপমহাদেশের সুফি-সাধক ও ওলামা মাশায়েখ। বাংলাবাজার, ঢাকা: মীনা বুক হাউস। পৃষ্ঠা ৬৮। আইএসবিএন 9789849115465 
  7. বিজনুরি, আজিজুর রহমান (১৯৬৭)। তাজকিরায়ে মাশায়েখে দেওবন্দ [দীপ্তিময় মনীষীগণের জীবনকথা]। ছফিউল্লাহ, মুহাম্মদ কর্তৃক অনূদিত। বিজনুর, ভারত; বাংলাবাজার, ঢাকা: ইদারায়ে মাদানি দারুত তালিফ; মাকতাবায়ে ত্বহা। পৃষ্ঠা ১১১—১২৭। ওসিএলসি 19927541 
  8. ফরিদ উদ্দিন আত্তার, মাওলানা (২০১৩)। শাহজাহান খান, মুহাম্মদ, সম্পাদক। তাযকিরাতুল আউলিয়া। বাংলাবাজার, ঢাকা: সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ৪৭৮—৪৮১। আইএসবিএন 9848910557 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]