বিষয়বস্তুতে চলুন

জিয়ারত

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

জিয়ারাত (ফার্সি: زیارت, "তীর্থযাত্রা"; তুর্কি: ziyaret, "ভ্রমণ") বা জিয়ারাহ (আরবি: زِيَارَة, "ভ্রমণ") হল ইসলাম ধর্মের শেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (স.), তাঁর পরিবারের (আহলে বায়াত) সদস্য এবং বংশধর (যাদের মধ্যে শিয়া ইমামরাও অন্তর্ভুক্ত), তাঁর সাহাবি এবং ইসলামের অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিত্ব যেমন নবী, সুফি আউলিয়া এবং ইসলামিক পণ্ডিতদের সাথে সম্পর্কিত স্থানগুলোতে তীর্থযাত্রার একটি ধরন।[১][২] তীর্থযাত্রার স্থানগুলির মধ্যে মসজিদ, মাজার, রওজা, সমাধি, মাকাম, যুদ্ধক্ষেত্র, পর্বত এবং গুহা অন্তর্ভুক্ত।

জিয়ারাত সুন্নী ও শিয়াদের দ্বারা তৈরি একটি প্রার্থনার ধরনকেও নির্দেশ করতে পারে, যেখানে তারা হযরত মুহাম্মদ (স.) এবং তাঁর পরিবারকে সালাম এবং শুভেচ্ছা জানায়।[৩][৪]

পরিভাষা[সম্পাদনা]

জিয়ারাত শব্দটি এসেছে আরবি: زَار, রোমান: zār "পরিদর্শন করা" থেকে। ইসলাম ধর্মে এটি একটি পবিত্র স্থান, কবরস্থান বা মাজার পরিদর্শনকে নির্দেশ করে।[৫] ইরান এবং দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানরা মক্কায় হজ তীর্থযাত্রার পাশাপাশি অন্যান্য পবিত্র স্থান পরিদর্শনের জন্যও জিয়ারাত শব্দটি ব্যবহার করেন।[৫] ইন্দোনেশিয়ায় পবিত্র স্থান বা কবরস্থান পরিদর্শনের জন্য এই শব্দটি জিয়ারাহ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যেগুলো বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, জিয়ারাত সম্পাদনের জন্য এই স্থানগুলির জন্য বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে[৫] :

  • জিয়ারাতগাহ – জিয়ারাতের স্থান বোঝাতে ফারসি শব্দ
  • ইমামজাদে – ইরানে, দ্বাদশ ইমামদের বংশধরদের কবর
  • দরগাহ – তুর্কি: Dergâh, উর্দু, ফারসি: درگاہ; হিন্দি: दरगाह; আক্ষরিক অর্থে: "চৌকাঠ, ধাপ [পবিত্র ব্যক্তির আধ্যাত্মিক পবিত্র স্থানের দরজার ধাপ]"; মাজারটি একটি আধ্যাত্মিক জগতের "দরজার ধাপ" হিসাবে বিবেচিত হয় - দক্ষিণ এশিয়া, তুরস্ক এবং মধ্য এশিয়ায় সুফি সাধকদের কবরের জন্য ব্যবহৃত
  • জিয়ারাত বা জিয়ারত – দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবহৃত
  • জিয়ারাতখানা – দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত (কম প্রচলিত)
  • গংবেই (চাইনিজ: 拱北) – চীনে ব্যবহৃত (ফারসি গোনবাদ "গম্বুজ" থেকে)
  • মাজার – একটি সাধারণ শব্দ যা একটি মাজার বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, সাধারণত একটি সুন্নি বা শিয়া সাধক বা মহৎ ব্যক্তির মাজার
  • মাকাম – এমন একটি মাজার যা কোনো মুসলিম সাধক বা ধর্মীয় ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত স্থানে নির্মিত।

দর্শন[সম্পাদনা]

সুন্নী মতাদর্শ[সম্পাদনা]

ইসলামিক বিশ্বের অন্য যেকোনো কবরের চেয়ে, হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজাকে জিয়ারতকারীদের জন্য দোয়ার অন্যতম উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়।[৬] A হযরত মুহাম্মদ (স.) এর একটি হাদিসে বলা হয়েছে, "যে আমার রওজা পরিদর্শন করে, সে আমার সুপারিশের অধিকারী হবে" এবং অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, "আমি তাদের জন্য সুপারিশ করব যারা আমাকে বা আমার রওজা জিয়ারত।"[৬][৭][৮] হজের পরে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজা জিয়ারত করা সুন্নি আইন বিশেষজ্ঞদের মতে সুপারিশ করা হয়েছে।[৬] সালাফের প্রাথমিক পণ্ডিতেরা, আহমাদ ইবনে হাম্বল (মৃ. ২৪১ হিজরি), ইসহাক ইবনে রহওয়াহ (মৃ. ২৩৮ হিজরি), আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (মৃ. ১৮৯ হিজরি) এবং ইমাম শাফিয়ী (মৃ. ২০৪ হিজরি) সবাই হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজা জিয়ারতের প্রথাকে অনুমতি দিয়েছিলেন।[৬]

হানবালি পণ্ডিত আল-হাসান ইবনে আলী আল-বারবাহারী (মৃ. ২৭৫ হিজরি) এর মতে, মুহাম্মদের প্রতি সালাম প্রেরণের পরে আবু বকর আল-সিদ্দিক এবং উমর ইবনে আল-খাত্তাবের প্রতি সালাম পাঠানোও বাধ্যতামূলক।[৯][১০]

হাদিস পণ্ডিত কাজী আইয়াদ (মৃ. ৫৪৪ হিজরি) বলেছেন যে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজাকে জিয়ারত করা "মুসলমানদের একটি সুন্নত ছিল, যা নিয়ে ঐক্যমত্য ছিল, এবং এটি একটি ভালো এবং কাম্য কাজ।"

ইবনে হাজর আল-আসকালানি (মৃ. ৮৫২ হিজরি) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজাকে জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করা "সেরা কাজগুলোর মধ্যে একটি এবং ধার্মিক কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মহৎ, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে পৌঁছাতে পারে, এবং এর বৈধতা ঐক্যমতের বিষয়।"

একইভাবে, ইবনে কুদামাহ (মৃ. ৬২০ হিজরি) হযরত মুহাম্মদ (স.) এর রওজা জিয়ারাতকে সুপারিশ করেছেন এবং তার কবরে সরাসরি সুপারিশ চাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। অন্যান্য ঐতিহাসিক পণ্ডিত যারা জিয়ারাতের সুপারিশ করেছেন তাদের মধ্যে ইমাম আল-গাজালি (মৃ. ৫০৫ হিজরি), ইমাম নববী (মৃ. ৬৭৬ হিজরি) এবং মুহাম্মদ আল-মুনাওয়ী (মৃ. ১০৩১ হিজরি) অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য মুসলিম ধর্মীয় ব্যক্তিদের কবরও সম্মানের সাথে দেখা হয়। আহমদ ইবনে হাম্বলের ছেলে আবদুল্লাহ, যিনি সুন্নি আইনশাস্ত্রের প্রধান বিচারকদের একজন, বলেছেন যে তিনি একজন পবিত্র ব্যক্তির মাজারের কাছে কবর হতে পছন্দ করবেন তার নিজের বাবার চেয়ে।

সালাফি মতাদর্শ[সম্পাদনা]

ইবনে তাইমিয়া মৃতদের থেকে সুপারিশ চাওয়ার বিষয়ে সমালোচনা করেছিলেন[১১], এবং বলেছিলেন যে মুহাম্মদের কবর পরিদর্শনের জন্য উৎসাহিত করে এমন সব হাদিস জাল (মাওদু) বলে বিবেচিত।[১২]

ইবনে তাইমিয়ার এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলধারার সুন্নি আলেমদের কর্তৃক, তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর উভয় সময়েই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। শাফেয়ি হাদিস বিশারদ ইবনে হাজর আল-আসকালানি বলেছেন যে, "এটি ইবনে তাইমিয়ার অন্যতম কদর্যতম অবস্থানগুলোর একটি।"[১৩] হানাফি হাদিস পণ্ডিত আলি আল-ক্বারি বলেছেন, "হানবালিদের মধ্যে, ইবনে তাইমিয়া মুহাম্মদ (স.) এর রওজা জিয়ারতেকে নিষিদ্ধ বলে চরমপন্থা অবলম্বন করেছেন।"[১৩] কাস্তাল্লানি বলেছেন, "শায়খ তাকী আল-দিন ইবনে তাইমিয়ার এই বিষয়ে কিছু জঘন্য এবং অদ্ভুত বক্তব্য রয়েছে যা নির্দেশ করে যে নবীকে পরিদর্শনের জন্য ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং এটি ধার্মিক কাজ নয়।"[১৩]

শিয়া মতাদর্শ[সম্পাদনা]

শিয়া মুসলমানদের জিয়ারাতে অংশগ্রহণ করার কিছু কারণ রয়েছে যা কবরে সমাহিত ব্যক্তিদের পূজার সাথে জড়িত নয়। আয়াতুল্লাহ বোরুজেরদি এবং আয়াতুল্লাহ খোমেইনি উভয়েই বলেছেন:

"আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি সিজদা করা হারাম। যদি নির্দোষ ইমামদের (আ.স.) মাজারের সামনে সিজদা করা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটি রূপ হয়, তবে কোনো আপত্তি নেই, অন্যথায়, এটি হারাম।"

— আয়াতুল্লাহ বোরুজেরদি[১৪]}}

তবে শিয়া মুসলমানরা জিয়ারত পালন করেন, বিশ্বাস করে যে কবরস্থ ব্যক্তিরা আল্লাহর চোখে মহান মর্যাদা বহন করেন এবং এই মানুষদের মাধ্যমে তাদের দোয়া কবুল হওয়ার আশা করেন (তাওয়াসুলের একটি রূপ) – সাইয়্যিদ মুহাম্মদ হাসান মুসাভি লিখেছেন:

“তারা (পবিত্র ব্যক্তিরা) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার জন্য অনুরোধ জানায়, যাতে প্রার্থনাকারীকে তার কষ্ট থেকে মুক্তি দেয়া যায়, কারণ এই পবিত্র ব্যক্তিদের প্রার্থনা আল্লাহর দ্বারা গৃহীত হয়।”

— সাইয়্যিদ মুহাম্মদ হাসান মুসাভি। এই বিষয়ে, দ্বাদশ শিয়াদের দশম ইমাম ইবনে শু'বা আল-হারানির একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন:

“আল্লাহর কিছু স্থান রয়েছে যেখানে তিনি প্রার্থনা করতে পছন্দ করেন এবং প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা (সেই স্থানগুলোতে) কবুল হয়; হুসাইন (আ.স.) এর পবিত্র স্থান এই স্থানগুলোর একটি।”

— ইবনে শু'বা আল-হারানি। শিয়া মুসলমানরা ইমামদের যিয়ারতও করেন, শুধুমাত্র তাদের পূর্বপুরুষদের শুভেচ্ছা ও সালাম জানানোর জন্য নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য ও আরো তার বরকত লাভের জন্যও। শিয়ারা আল-বুখারি কর্তৃক সংগ্রহীত হাদিসকে বিশুদ্ধ বলে মনে করে না, এবং তারা যুক্তি দেয় যে যদি যিয়ারত এবং তাওয়াসুলের মতো বিষয়গুলো বিদআত এবং শিরক হত, মুহাম্মদ নিজেই লোকদের কবর পরিদর্শন থেকে বিরত থাকার জন্য সতর্কতা হিসেবে নিষেধ করতেন, বা কাবার পবিত্র কালো পাথর চুম্বন করে বরকত লাভ করার চেষ্টা করতেন। শিয়া ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে যে ইমামদের কবরস্থানের কাছে কবর দেওয়া উপকারী। শিয়া পবিত্র গ্রন্থগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের (বারজাখ) মধ্যবর্তী সময়টি ইমামদের নিকট কাটানো উচিত।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Ziyarah"Oxford Islamic Studies Online (ইংরেজি ভাষায়)। আগস্ট ৭, ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-০৬ 
  2. "Popular Religion"Oxford Islamic Studies Online (ইংরেজি ভাষায়)। এপ্রিল ১৫, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৮-০৬ 
  3. "List of Supplication Ziyarats"। Duas.org। সংগ্রহের তারিখ ২০১৪-০২-২৩ 
  4. Nakash, Yitzhak (১৯৯৫)। "The Visitation of the Shrines of the Imams and the Shi'i Mujtahids in the Early Twentieth Century"। Studia Islamica। Brill (81): 153–164। জেস্টোর 1596023ডিওআই:10.2307/1596023 
  5. Gibb, H. A. R.; Kramers, J. H.; Lévi-Provençal, E.; Schacht, J.; Lewis, B.; Pellat, Ch., eds. (1960). The Encyclopaedia of Islam, New Edition, Volume I: W–Z. Leiden: E. J. Brill. pp. 524, 533–39. আইএসবিএন ৯০-০৪-০৮১১৪-৩.
  6. Diem, Werner; Schöller, Marco (২০০৪)। The Living and the Dead in Islam: Indices (ইংরেজি ভাষায়)। Otto Harrassowitz Verlag। পৃষ্ঠা 7–8, 23, 46, 55। আইএসবিএন 978-3447050838 
  7. Bayhaqi। SunanV। পৃষ্ঠা 245। 
  8. Iyyad, Qadi। ShifaII। পৃষ্ঠা 71। 
  9. Zargar, Cameron (২০১৪)। The Hanbali and Wahhabi Schools of Thought As Observed Through the Case of Ziyārah। The Ohio State University। পৃষ্ঠা 26। 
  10. al-Barbahārī, Sharḥ al-Sunnah, p. 108
  11. Ondrej, Beranek; Tupek, Pavel (জুলাই ২০০৯)। Naghmeh, Sohrabi, সম্পাদক। From Visiting Graves to Their Destruction: The Question of Ziyara through the Eyes of Salafis (পিডিএফ)। Crown Paper (Crown Center for Middle East Studies/Brandeis University)। Brandeis University. Crown Center for Middle East Studies.। পৃষ্ঠা 14। ১০ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। Ibn Taymiyya strongly rejects all kinds of mediation, intercession, and seeking help through the dead. He says that in the visitation of the dead is memento mori (i‘tibar, ‘ibra). 
  12. Ondrej, Beranek; Tupek, Pavel (জুলাই ২০০৯)। Naghmeh, Sohrabi, সম্পাদক। From Visiting Graves to Their Destruction: The Question of Ziyara through the Eyes of Salafis (পিডিএফ)। Crown Paper (Crown Center for Middle East Studies/Brandeis University)। Brandeis University. Crown Center for Middle East Studies.। পৃষ্ঠা 15। ১০ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। Ibn Taymiyya criticizes hadiths encouraging visitation of the Prophet’s grave, pronouncing them all forgeries (mawdu‘) and lies (kidhb). According to him, most famous are "He who performs the pilgrimage and does not visit me, has shunned me" and "Who visited my grave must ask me for intercession." Ibn Taymiyya notes that although some of these hadiths are part of Daraqutni’s collection, they are not included in the main hadith collections of Bukhari, Muslim, Abu Dawud, and Nasa’i, nor are they part of the Musnad of Ibn Hanbal. He observes that with regard to visiting the Prophet’s grave, ulama rely only upon hadiths according to which the Prophet must be greeted (al-salam wa al-salat alayhi). 56 As for the contents of hadiths encouraging visitation, they contradict the principle of tawhid al-uluhiya. 
  13. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Rapoport নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  14. Ayatollah Borujerdi, Tawdih al-Masa'il, p. 172 ; Imam Khumayni, Tahrir al-Wasilah, vol. 1, p. 150; Risalah-ye Novin, vol. 1, p. 148.