ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান সাংস্কৃতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক শাখা যেখানে ভারতীয় জ্যোতির্বিদদের জ্ঞান দর্শায়। এটির সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত লম্বা ইতিহাস আছে। এটি বেদ বা বেদাঙ্গের সাথে পড়া হত। সবচেয়ে পুরোনো জ্যোতির্বিজ্ঞানের লেখা যা আজ পর্যন্ত পাওয়া গেছে হল বেদাঙ্গ জ্যোতিষ (৭০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্ব)।[১]

ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিকাশ ৫-৬ শতাব্দীতে ঘটেছিল। আর্যভট্টর এক বই আর্যভট্টীয় সেই সময়কার জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান দশায়, যেমন পৃথিবীর আবর্তন, কক্ষপথে ঘোরার সময়,গ্রহণের বৈজ্ঞানিক কারণ ইত্যাদি। ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্করাচার্য, বরামিহিরলল্লের মতন ব‍্যক্তি ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান অবদান করেছেন। কেরল গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিদ্যালয়ে ১৬-১৭ শতাব্দীতে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান শেখানো হত।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের শুরু হয়। বেদে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণা ও নক্ষত্রের ব্যাপারে লেখা আছে। আস্তে - আস্তে ধার্মিক কর্মের সাথে নক্ষত্রের গতিবিধির সম্পর্ক বাড়তে শুরু করল।বেদের শুল্ক সূত্রে উন্নত গণিত ও বুনিয়াদি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যাপারে লেখা আছে।বেদাঙ্গ জ্যোতিষে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ও পঞ্জিকার ব্যাপারে বিশদে লেখা আছে। এই সময়ে এই সময়ে (৫-৬ শতাব্দী) ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রকাশ ঘটে। সূর্যসিদ্ধান্ত (যেখানে পৃথিবীর আবর্তন করতে সময়, নক্ষত্র, মানিক আজও ইত্যাদির ব্যাপারে প্রায় আজকের মত হিসাব করে পঞ্জিকা তৈরী করা হয়েছে) লেখা হয়। বরামিহির পঞ্চসিদ্ধান্তে সূর্যঘড়ির সাহায্য পৃথিবীর মধ্যরেখা খুঁজেছিল। আর্যভট্ট বলেছিলেন যে গ্রহের কক্ষপথ ডিম্বাকার হয়, গোল না। অন্যান্য বিষয় যেমন সময় মাপার ইউনিট, বিভিন্ন গ্রহের মডেল, ইত্যাদি নিয়ে তখন গবেষণা হত।

পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার[সম্পাদনা]

সূর্যসিদ্ধান্তের তথ্যর উপর ভিত্তি করে ভারতীয় পত্রিকা তৈরী হয়। বেদাঙ্গ জ্যোতিষের মতে মকর বা পৌষ সংক্রান্তির পরে বছর শুরু হয়। ঋতুর ভিত্তিতে মাস তৈরী হয় (যেমন: এক ঋতু = ২ মাস)। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের মাস দেরীতে সময় শুরু হয়। (চৈত্র - বৈশাখ = বসন্ত)। কিন্তু ভারতবর্ষের সর্বত্র ছয় ঋতু(গীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত,শীত, বসন্ত)।

ভারতবর্ষে চার ধরনের পঞ্জিকা আছে:-

(১)শকাব্দ বা শকাব্দী: এটি ভারতের জাতীয় পঞ্জিকা এটিকে ভারতের গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা বলা যেতে পারে।এটি গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকাএর ৭৮ বছর পরে শুরু হয়।

(২)সূর্যসিদ্ধান্ত বা হিন্দু পঞ্জিকা: এর হিসাব সুর্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এর এক বছরে ৬৬৫/৩৬৬ দিন হয়। মাসের দিন আলাদা - আলাদা হয়।উৎসবের দিনক্ষণ চাঁদ বা অন্য নক্ষত্রের হিসাবে ঠিক করা হয়।

(৩)চান্দ্রিক পঞ্জিকা: এটি চাঁদের উপর ভিত্তি করে তৈরী হয়। বছরে ৩৫৪/৩৫৫ দিন থাকে।মাস ২৯/৩০ দিনের হয়।এর উদাহরণ হল বিক্রম সম্ভত ও হিজরি পঞ্জিকা।

(৪)গ্রেগোরিয়ান কালেন্ডার: এটির মাসের দিন ঠিক থাকে।যেই সালের সংখ্যা চার দিয়ে ভাগ যায়, সেটি লিপ ইয়ার আর এক দিন বেশি হয়। সালে ৩৬৫/৩৬৬ দিন থাকে। যেই লিপ ইয়ার ৪০০ দিয়ে ভাগ যায়,সেটি লিপ ইয়ার নয়"।

জে.এ.বি ভ্যান বুইটেনেন (২০০৮) সালে ভারতীয় পঞ্জিকার ব্যাপারে বলেন,

এটি পঞ্জিকার সবচেয়ে পুরোনো সিস্টেম। সময় নক্ষত্রমন্ডল ও চাঁদ দেখে বিচার করা হয়। রাতের বেলা সূর্যের স্থান জানার জন্য বিশেষ পদ্ধতি আছে।

আন্তর্জাতিক প্রচার, ব্যবহার ও সম্পর্ক[সম্পাদনা]

১) ভারতীয় ও গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞান: ডেভিড পিনগ্রীর মতে ভারতীয় ও গ্রীক সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক ছিল। পৌলিসা ও‌ গার্গী সংহিতা গ্রীকগ্রন্থের সংস্কৃত ভাষায় অনূবাদ।অ্যালেক্সান্ডারের রাজ্যবৃদ্ধির গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানী সিদ্ধান্ত পর ভারতে আসে। রোমক সিদ্ধান্ত ও ইয়ভনাজাতক গ্রীক লিপির সংস্কৃত অনুবাদ। সিন্ধু নদীর পাড়ে গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞান ব্যবহার করা হত। পঞ্চসিদ্ধান্তে পাঁচ সভ্যতার(গ্রীক ও ভারতীয় সভ্যতার ও) জ্যোতির্বিজ্ঞানী তথ্য আছে।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পর খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীতে গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণা ভারতে প্রবেশ করতে শুরু করে। সাধারণ যুগের প্রথমদিকে ব্জ্যোতির্বিদ্যার ঐতিহ্যের উপর ইন্দো-গ্রীক প্রভাব দৃশ্যমান, যেমন যবনজাতক এবং রোমাক সিদ্ধান্তের মতো গ্রন্থ। পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এই সময়কালে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন, তাদের মধ্যে একটি গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত নামে পরিচিত। এগুলি কোনো নির্দিষ্ট গ্রন্থ ছিলো না বরং জ্ঞানের একধরনের মৌখিক ঐতিহ্য ছিল এবং তাদের বিষয়বস্তু বিদ্যমান নয়। আজকে সূর্য সিদ্ধান্ত নামে পরিচিত পাঠটি গুপ্ত যুগের এবং আর্যভট্ট দ্বারা গৃহীত।

আফগানিস্তানে গ্রীক সূর্যঘড়ি

২)ভারতীয় ও চাইনিজ জ্যোতির্বিজ্ঞান: ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বৌদ্ধধর্মের সাথে চীনে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গ্রন্থগুলিরও অনুবাদ হয়েছিল।তাং সাম্রাজ্যর সময়ে ভারতীয় ও চাইনিজ জ্যোতির্বিজ্ঞান এক সাথে শেখা হত।

৩)ভারতীয় ও মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞান: ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার ধ্রুপদী যুগ শুরু হয় গুপ্ত যুগের শেষভাগে, ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে। বরাহমিহিরা (৫০৫ খ্রিস্টাব্দ) রচিত পঞ্চসিদ্ধান্তিকাতে একটি জিনোমন ব্যবহার করে ছায়ার যে কোনো তিনটি অবস্থান থেকে মেরিডিয়ান দিক নির্ধারণের পদ্ধতি অনুমান করা হয়েছে। আর্যভট্টের সময় গ্রহের ঘূর্ণন কক্ষপথ বৃত্তাকার না হয়ে উপবৃত্তাকার বলে ধরা হত। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সময়ের বিভিন্ন এককের সংজ্ঞা, গ্রহের গতির উদ্দীপক মডেল, গ্রহের ঘূর্ণনের এপিসাইক্লিক মডেল এবং বিভিন্ন পার্থিব অবস্থানের জন্য গ্রহের দ্রাঘিমাংশ সংশোধন অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ইরানে অনেক বই ফারসী ও আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। আরব অঙ্কবিদরা গ্রীকদের বৃত্তচাপের জ্যা ছেড়ে ভারতীয়দের সাইন ( চাপের এক প্রান্ত থেকে ব্যাম পর্যন্ত অঙ্কিত রেখা ) গ্রহণ করেছিল। মুঘল সাম্রাজ্যে ভারতীয় ও মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মুসলিম যন্ত্রগুলি ভারতীয় অঙ্কের সাথে চালানো হতে হত। ভারতীয় মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জিজ সিদ্ধান্ত আপডেট করেছিল। হুমায়ূন দিল্লিতে তারামন্ডল বানিয়েছিলেন।

৪)ভারতীয় ও ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান: ১৮ শতাব্দীতে দ্বিতীয় জয় সিং জেসাল্ট মিশনারীদের লা হীরে'র কাজ দেখে বুঝলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের মত প্রগতি করতে পারেনি। ডেকেছিলেন। তিনি তখনও ইউরোপীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আসার পর ছেড়ে ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান পড়ানো ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান শুরু হল। এর এক মতানুসারে, কেরল গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিদ্যালয় থেকে জেসল্টি মিশনারী দ্বারা অনেক তথ্য ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

ইসরো ও আধুনিক ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞান[সম্পাদনা]

ইসরো ভারতবর্ষের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র যা স্যাটেলাইট তৈরী করে ও তার তথ্য ভারতীয় সুরক্ষা দপ্তর ও মিডিয়াকে পাঠায়। যেমন: -টিভি, মোবাইল, সীমা সুরক্ষা, ইত্যাদি। ইসরো মঙ্গল গ্রহে ২০১৪ সালে মঙ্গলযান পাঠিয়েছিল এটিকে সফল করতে নাসার চেয়ে ১০ গুণ কম টাকা লেগেছে। ২০০৮ সালে ইসরো চন্দ্রযান পাঠিয়েছিল যা ভারতের প্রথম অমানবিক মহাকাশযান বানিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে, ভারত প্রথম স্যাটেলাইট (নাম:আর্যভট্ট )লঞ্চ করে( অসফল )। ভারত ৩৬ বিভিন্ন দেশের জন্য ৩৪৩ নিজের জন্য মোট মহাকাশযান লঞ্চ করেছে। ফেব্রুয়ারি ২০২২-এর মধ্য ভারত ১০১ টি সফল স্যাটেলাইট বানিয়েছে।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Subbarayappa, B. V. (১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯)। "Indian astronomy: An historical perspective"। Biswas, S. K.; Mallik, D. C. V.; Vishveshwara, C. V.Cosmic Perspectives। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 25–40। আইএসবিএন 978-0-521-34354-1 

টেমপ্লেট:ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান

টেমপ্লেট:Hindu calendar