শকাব্দ
শকাব্দ বা শক সাল হল একটি ঐতিহাসিক পঞ্জিকা সাল (বর্ষ সংখ্যা গণনা পদ্ধতি), এর আদর্শ (শূন্য বর্ষ)[২] জুলীয় বর্ষপঞ্জিতে ৭৮ সাল। এটি ভারতীয় ভাষাগুলোতে শালিবাহন শক ("শালিবাহন সাল") বা আরটিজিএসে মহাশক্কারত ("মহাসাল") নামে পরিচিত যা বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী বর্ষপঞ্জিগুলোতে ব্যবহার অব্যাহত আছে।[১]
ইতিহাস
[সম্পাদনা]শকাব্দের উৎপত্তির বিষয়টি অত্যন্ত বিতর্কিত।[৩] পণ্ডিতগণ দুটো শকাব্দ ব্যবহার করে থাকেন, প্রথমটির নাম পুরনো শকাব্দ যা আদর্শ তারিখটি অস্পষ্ট, সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের দিকে কেননা প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন শিলালিপিগুলোয় এই সময়টি ব্যবহার করা হয় কিন্তু তা নিয়ে বিতর্ক বিদ্যমান। আরেকটির নাম ৭৮ খ্রিস্টাব্দের শকাব্দ বা শুধু শকাব্দ যার স্বপক্ষে দক্ষিণ ভারতে প্রমাণাদি পাওয়া যায়। এর সমান্তরাল উত্তর ভারতীয় পঞ্জিকা সালটি হচ্ছে বিক্রম সংবৎ যা বিক্রমী বর্ষপঞ্জিতে ব্যবহৃত হত।[৪]
শকাব্দের আদর্শ হিসেবে বহুলভাবে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা খস্তনের সিংহাসনে আরোহনের বছরকে ব্যবহার করা হয়।[৫] ১১ ও ৫২ বছর উল্লেখ করা তার শিলালিপিগুলো কচ্ছ অঞ্চলের আন্ধাউতে পাওয়া গেছে। উল্লেখিত দুটি সালকে ১১ (৮৯ খ্রিস্টাব্দ) ও ৫২ শকাব্দ (১৩০ খ্রিস্টাব্দ) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।[৬] একটি পুরনো সাধারণ তত্ত্ব ছিল যে শকাব্দের আদর্শ ছিলো ৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কণিষ্কের সিংহাসনে আরোহনের বছর।[৩] যদিও, হেনরি ফকের সর্নশেষ গবেষণা নির্দেশ করছে যে কণিষ্ক ১২৭ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আসেন।[৭] তাছাড়া, কণিষ্ক শক রাজা নন বরঞ্চ একজন কুষাণ শাসক।[৮] অন্যান্য ঐতিহাসিকরা সালটির আদর্শ হিসেবে ভীম কদফিসেস, দ্বিতীয় ভোনোনস এবং নাহাপনার সিংহাসনে আরোহনের বছর মনে করে থাকেন।[৮]
ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার মনে করেন যে শালিবাহনাব্দের সূচনার বছরটি শক রাজাদের উপর সাতবাহন রাজা গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর বিজয়ের বছরের সাথে মিলে যায়। তিনি আরও মনে করেন যে বিক্রমাদিত্যের সাথে বিক্রম সংবৎ এর সম্পর্ককরণ (যা ঐতিহাসিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ) দক্ষিণী পণ্ডিতদের একই প্রকারের কিংবদন্তি তৈরির করার পেছনে ধাবিত করতে পারে।[৯] আরেকটি অনুরূপ প্রাচীন দাবি হল সম্রাট শালিবাহন,[১০][১১] যিনি সম্রাট বিক্রমাদিত্যের পৌত্র, শকদের ৭৮ খ্রিস্টাব্দে পরাজিত করেছিলেন এবং শকাব্দের আদর্শ হিসেবে এই বছরটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এই কিংবদন্তিটি ব্রহ্মগুপ্ত (সপ্তম শতাব্দী), আল-বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮) এবং বকিদের লেখাপত্রে পাওয়া যায়।[৩] সময়ের সাথে সাথে শক শব্দটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং পঞ্জিকা সাল হিসেবে পরিচিত হতে থাকে যার ফলে এর নাম হয় "শালিবাহন শক"।[১২]
ব্যবহার
[সম্পাদনা]শকাব্দ ব্যবহারের প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে পশ্চিম সাট্রাপ উজ্জয়িনীর শাসক শকদের নাম জানা যায় (ইন্দো-সিথিয়ান)। প্রথম রুদ্রসিংহ (১৭৮-১৯৭) এর সময় থেকে তারা তাদের মুদ্রায় শকাব্দ ব্যবহার করত যা ব্রাহ্মী সংখ্যায় রাজার মাথায় পেছনে লেখা থাকতো।[১৩]
এই পঞ্জিকা সালের ব্যবহার গুপ্ত যুগে টিকে ছিল এবং ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্মের অবনতির পরে হিন্দু ঐতিহ্যের অংশ হয়। এর ব্যবহার ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে বিস্তৃত হয়, যেমন বরাহমিহির ও ব্রহ্মগুপ্তের লেখাপত্রে এবং এছাড়াও এটি হিন্দু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সূত্র-লিপি উৎকীর্ণবিদ্যায় পাওয়া যায়।
মধ্যযুগ পর্যন্ত এই পঞ্জিকা সাল সমগ্র ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবহৃত হতে থাকে, শকাব্দের হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যবাহী সময়রক্ষণ বিকল্প ছিলো বিক্রম সংবৎ (৫৬ খ্রিস্টপূর্ব)। এটি ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে জাভানীয় দরবারে জাভাব্দ নামক সংকর জাভানীয়-ইসলামি পঞ্জিকা ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়ে আসছিল।[১৪] এই পঞ্জিকা সালটি ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জির (শক পঞ্জিকা) পঞ্জিকা সাল হিসেবে গৃহীত হয় যদিও তা ভারতে বহুল ব্যবহৃত নয়।
শকাব্দ শুরু হয় ৭৮ খ্রিস্টাব্দের বিষুব দিবস থেকে। আনুষ্ঠানিক শক পঞ্জিকার বছর প্রতি গ্রেগরীয় বছরের ২২ মার্চের সাথে সম্পৃক্ত, তবে গ্রেগরীয় অধিবর্ষে তা ২১ মার্চে হয়ে থাকে। সৌরচান্দ্রিক শালিবাহন শক পঞ্জিকা দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় ও কৃষিজ উদ্দেশ্যে এখনো ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]উদ্ধৃতি
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ Government of India (১৯৫৫), "The Saka Era", Report of the Calendar Reform Committee, পৃষ্ঠা 255–256
- ↑ Like most Indian eras, the Śaka era uses expired, elapsed, or complete years, where a year must have elapsed before it can be counted. This is similar to the Western method of determining a person's age, whose first year must have been completed before that person reaches one year old. The uncounted first year of the era is numbered as year zero. This differs from Western eras which use current years.[১]
- ↑ ক খ গ Richard Salomon 1998, পৃ. 182–184।
- ↑ Richard Salomon 1998, পৃ. 181–183।
- ↑ Shailendra Bhandare (২০০৬)। "Numismatics and History: The Maurya-Gupta interlude in the Gangetic Plains"। Patrick Olivelle। Between the Empires : Society in India 300 BCE to 400 CE: Society in India 300 BCE to 400 CE। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 69। আইএসবিএন 9780199775071।
- ↑ Adalbert J. Gail; Gerd J. R. Mevissen; Richard Salomon, সম্পাদকগণ (২০০৬)। Script and Image: Papers on Art and Epigraphy। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 193। আইএসবিএন 9788120829442।
- ↑ Ladislav Stančo (২০১২)। Greek Gods in the East। Karolinum Press। পৃষ্ঠা 18। আইএসবিএন 9788024620459।
- ↑ ক খ Krishna Chandra Sagar (১৯৯২)। Foreign Influence on Ancient India। Northern Book Centre। পৃষ্ঠা 135–136। আইএসবিএন 9788172110284।
- ↑ D. C. Sircar (১৯৬৫)। Indian Epigraphy। Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 262–266। আইএসবিএন 9788120811669।
- ↑ kamlesh kapur (২০১০)। History of Ancient India। Sterling Publishers Pvt Ltd। পৃষ্ঠা 321। আইএসবিএন 978-81-207-5212-2।
- ↑ RajendraSingh Kushwaha (২০০৩)। Glimpses of Bhartiya History। Ocean books। পৃষ্ঠা 184। আইএসবিএন 9788188322404।
- ↑ P. V. Jagadisa Ayyar (১৯৮২)। South Indian Shrines: Illustrated। Asian Educational Services। পৃষ্ঠা 80–81। আইএসবিএন 978-81-206-0151-2।
- ↑ Rapson, "A Catalogue of Indian coins in the British Museum. Andhras etc." p. CCVIII
- ↑ Ricklefs, Merle Calvin (১৯৯৩)। A history of modern Indonesia since c. 1300 (2nd সংস্করণ)। Stanford University Press and Macmillans। পৃষ্ঠা 5 and 46। আইএসবিএন 9780804721950।
উৎস
[সম্পাদনা]- RajendraSingh Kushwaha (২০০৩)। Glimpses of Bhartiya History। Ocean books। পৃষ্ঠা 184। আইএসবিএন 9788188322404।