আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা
আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা (পূর্বনাম কলিকাতা পুস্তকমেলা) পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় আয়োজিত একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক বইমেলা। এই মেলাটি কলকাতা বইমেলা নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৭৬ সালে প্রবর্তিত এই বইমেলা ১৯৮৪ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করে।[১] বর্তমানে জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার বারোদিনব্যাপী এই বইমেলার উদ্বোধন হয়। মেলার বর্তমান আয়োজনস্থল বিধাননগরের সেন্ট্রাল পার্ক।
কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অবাণিজ্যিক বইমেলা।[২] ফ্রাঙ্কফুর্ট বা লন্ডন বইমেলার মতো কলকাতা বইমেলায় গ্রন্থপ্রকাশনা, পরিবেশনা ও অনুবাদ সংক্রান্ত চুক্তি বা ব্যবসাবাণিজ্য চলে না। বরং প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতারা সাধারণ মানুষের কাছে তাদের প্রকাশিত অথবা পরিবেশিত বইয়ের প্রচার ও বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এই মেলায় যোগ দিয়ে থাকেন। কলকাতার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এই মেলা একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। বর্তমানে বইমেলাকে ‘বাঙালির চতুর্দশ পার্বণ’ বলে অভিহিত করা হয়।[৩]
কলকাতা বইমেলা আন্তর্জাতিক বইমেলা হলেও মেলার সিংহভাগ জুড়ে বাংলা বইয়ের বিক্রিই বেশি হয়। তবে প্রচুর ইংরেজি গ্রন্থ প্রকাশক ও বিক্রেতাও এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত ইত্যাদি অন্যান্য ভারতীয় ভাষার বইও এই মেলায় পাওয়া যায়। বিদেশি দূতাবাসগুলিও স্টল বা প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে নিজ নিজ দেশে প্রকাশিত বইপত্রের প্রদর্শনী করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারত সরকারের বাংলা প্রকাশনা বিভাগগুলিও এই মেলায় অংশ নিয়ে থাকে। এছাড়াও ফ্রাঙ্কফুট বইমেলার আদলে প্রতি বছর মেলায় অংশগ্রহণকারী একটি বিদেশি রাষ্ট্র ‘ফোকাল থিম’ ও অপর একটি রাষ্ট্র ‘সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র’ নির্বাচিত হয়। ২০১০ সালের ৩৪তম আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলার ফোকাল থিম ও সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্র হল মেক্সিকো।
কলকাতা বইমেলায় বই ক্রয়বিক্রয়ের সঙ্গে সঙ্গে আয়োজিত হয় বিভিন্ন অণুষ্ঠান, সেমিনার, পদযাত্রা, প্রতিযোগিতা ও গ্রন্থ প্রকাশ অণুষ্ঠান। উল্লেখ্য, বইমেলার সময়ই প্রকাশকেরা তাদের নতুন বই প্রকাশ করে থাকেন।[৩] গ্রন্থসম্ভারের পাশাপাশি চিত্রশিল্পী, শিশু, তথ্যপ্রযুক্তি ও লিটল ম্যাগাজিনের জন্য বিশেষ চত্বর নির্ধারিত থাকে। কলকাতা বইমেলা বর্তমানে কলকাতার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি মেলা। এই মেলার সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও ভারতের অন্যান্য স্থানে বাংলা বইয়ের মেলা চালু হয়েছে।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]ন্যাশানাল বুক ট্রাস্টের বইমেলা, ১৯৭৪
[সম্পাদনা]১৯৭২ সালে নয়াদিল্লিতে আয়োজিত বিশ্ব বইমেলা ছিল কলকাতা বইমেলার আদি অণুপ্রেরণা।[৪] এরপর ১৯৭৪ সালে ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট (এনবিটি) কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটি জাতীয় বইমেলার আয়োজন করে।[৩][৫] ১৯৬০-এর দশকে মুম্বইয়ের চার্চ গেট ময়দানে এনবিটি প্রথম জাতীয় বইমেলার আয়োজন করেছিল। এরপর দিল্লি, মুম্বই ও চেন্নাইতে জাতীয় বইমেলার আয়োজন করলেও কলকাতায় বইমেলার সাফল্য সম্পর্কে তারা সন্দিহান ছিলেন। এই কারণে এনবিটি নিজ উদ্যোগে কলকাতায় জাতীয় বইমেলা আয়োজনের উৎসাহ দেখাননি। ইউ. এন. ধর অ্যান্ড সনস প্রকাশন সংস্থার সত্ত্বাধিকারী বিমল ধর[৩] এনবিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে অ্যাকাডেমি চত্বরে একটি ছোটোখাটো বইমেলার আয়োজন করেন।[৫] এই বইমেলায় বাংলা বই বিক্রির সাফল্যে কলকাতার পাঠক সম্পর্কে এনবিটির ধারণা পরিবর্তিত হয়। এরপরই কলকাতায় বার্ষিক বইমেলা আয়োজনের চিন্তাভাবনা শুরু হয়।[৩][৫]
পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের প্রতিষ্ঠা
[সম্পাদনা]১৯৭৫ সালে কলকাতার চোদ্দোটি প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতা সংস্থাকে নিয়ে বিমল ধরের উদ্যোগে গঠিত হয় পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল কলকাতায় বার্ষিক বইমেলার আয়োজন। বিমল ধরের সঙ্গে ছিলেন এম. সি. সরকার অ্যান্ড সনস সংস্থার সুপ্রিয় সরকার, দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানির প্রবীর দাশগুপ্ত, সাংবাদিক অতীন রায়, জিজ্ঞাসা প্রকাশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশকুমার কুণ্ডা ও সুশীল মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।[৩] প্রথমে এই সংস্থার নাম ছিল ‘পাবলিশার্স গিল্ড’। কিন্তু গিল্ড সংবিধান তৈরি হওয়ার পর সংস্থার নাম বদলে রাখা হয় ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’।[৫] সুশীল মুখোপাধ্যায় গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি নির্বাচিত হন।[৩] ১৯৭৫ সালেই কলকাতা তথ্যকেন্দ্রে গিল্ড ‘ওয়ার্ল্ড অফ পেপার ব্যাকস’ নামে একটি বইসংক্রান্ত প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এরপরই শুরু হয় কলকাতা বইমেলার চিন্তাভাবনা।[৫] সর্বভারতীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে কলকাতা বইমেলার পোশাকি নামকরণ হয় ‘কলিকাতা পুস্তকমেলা’ বা ইংরেজিতে ‘ক্যালকাটা বুক ফেয়ার’। ১৯৭৬ সালে প্রথম কলকাতা বইমেলার আয়োজন করা হয়।[৩]
কলিকাতা পুস্তকমেলার প্রবর্তন
[সম্পাদনা]১৯৭৬ সালের ৫ মার্চ প্রথম কলিকাতা পুস্তকমেলা আয়োজিত হল। মেলা চলেছিল ১৪ মার্চ অবধি। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল-বিড়লা তারামণ্ডলের উলটো দিকের মাঠে (বর্তমানে মোহরকুঞ্জ উদ্যান) এই মেলা আয়োজিত হয়েছিল। কলকাতার ডিসি হেডকোয়ার্টার্স অর্চিষ্মান ঘটক মাঠের ভাড়া মকুব করে দেন। প্রবেশদ্বারের নকশা অঙ্কণ করেছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। মেলা উদ্বোধন করেন পশ্চিমবঙ্গের তদনীন্তন রাজ্যপাল এ. এল. ডায়াস।[৫] প্রথম মেলার সভাপতি ছিলেন জিজ্ঞাসা প্রকাশনের কর্ণধার শ্রীশকুমার কুণ্ডা। গিল্ডের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি সুশীল মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিয় সরকার, প্রবীর দাশগুপ্ত, বিমল ধর প্রমুখ বিশিষ্ট প্রকাশকেরা মেলার আয়োজনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।[৪] প্রথম বইমেলায় কলকাতার সব প্রকাশক সংস্থা যোগ দেননি। তাদের অনেকেই মেলার সাফল্য নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।[৩] তাই মেলার মাঠ ছোটো হলেও তা ভরতি হওয়ার মতো স্টল পাওয়া যায়নি। তখন এনবিটি একটি বিরাট অংশ জুড়ে বইয়ের প্রদর্শনী করে এবং রূপা অ্যান্ড কোম্পানি একটি বিরাট প্যাভিলিয়ন দেয়।[৫] কিন্তু এই বইমেলায় যথেষ্ট জনসমাগম হওয়ায় পরের বছর থেকে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ফলে বইমেলার আয়তনও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে এই বইমেলা আয়োজনের সুবাদে সেই বছর নয়াদিল্লিতে বিশ্ব বইমেলায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায় গিল্ড এবং জিতে নেয় মাঝারি স্টলের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি। সুপ্রিয় সরকার তার ‘প্রকাশকের ডায়েরি’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, “এই মেলায় সবকিছুই আলাদা, বিদেশি মেলার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই শুধু আইডিয়াটি ছাড়া।” [৪]
কলিকাতা পুস্তকমেলা ১৯৭৭-১৯৮৪
[সম্পাদনা]১৯৭৭ সালে আয়োজিত দ্বিতীয় বইমেলায় ১,৯৬,০০০ দর্শকসমাগম হয়; বই বিক্রি হয় এক কোটি টাকারও বেশি।[৪] তবে বইমেলার যে বিপুল জনপ্রিয়তা আজ চোখে পড়ে, তার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে আয়োজিত তৃতীয় কলকাতা বইমেলা থেকে। এই বছর মোট ১১২টি প্রকাশক সংস্থা বইমেলায় অংশ নিয়েছিলেন।[৪] মেলা আয়োজিত হয়েছিল রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে ভিক্টোরিয়া-সংলগ্ন অপেক্ষাকৃত বৃহদায়তন মাঠটিতে (এই মাঠটিও বর্তমানে ‘মোহরকুঞ্জ’ উদ্যানের অংশ)। ১৯৮৩ সালে মেলায় যোগ দিয়েছিলেন ২৮৫টি প্রকাশক ও পুস্তকবিক্রেতা সংস্থা।[৪] সেবার বিড়লা তারামণ্ডল থেকে রবীন্দ্রসদনের বিপরীতে অবস্থিত অধুনা ‘মোহরকুঞ্জ’ উদ্যানের সম্পূর্ণ অংশটিই মেলার জন্য পেয়ে যায় গিল্ড। ১৯৮৩ সালেই একটি গ্রন্থপ্রকাশ অণুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে অকস্মাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মেলাপ্রাঙ্গণেই প্রয়াত হন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অশোককুমার সরকার। তার স্মৃতিতে ১৯৮৪ সাল থেকে বইমেলায় চালু হয় সম্মানজনক ‘অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতা’। ১৯৮৪ সালে মেলা আয়োজিত হয়েছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে। সেবার অংশগ্রহণকারী প্রকাশকের সংখ্যা ছিল ৩৬৩।[৪] এই বছরই জেনেভার ইন্টারন্যাশানাল পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হয়ে বইমেলার আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারে স্থান করে নেয় কলকাতা বইমেলা।[১]
পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা
[সম্পাদনা]১৯৮০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগ কলকাতা বইমেলার আগে ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে ১০-১২ দিন সময় নিয়ে অপর একটি বইমেলার আয়োজন করেন।[৩] ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত দশ বছর নিয়মিত এই বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল।[৫] এই বইমেলাটির নাম ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা’। লোকমুখে মেলাটি ‘সরকারি বইমেলা’ নামে পরিচিত ছিল। প্রথম গ্রন্থমেলা আয়োজিত হয়েছিল পার্কসার্কাস ময়দানে। পরে এই মেলা আয়োজিত হতে থাকে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের উলটো দিকের মাঠে। এই বইমেলায় ভিন রাজ্যের প্রকাশকেরাও অংশ নিতেন। কিন্তু তবুও এই মেলাটি কলকাতা বইমেলার মতো জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়।[৫] এই বইমেলার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী জেলার গ্রন্থাগারগুলির বই কেনায় বিশেষ সুবিধা দান। এই মেলার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ন্যাশানাল বুক এজেন্সির সুনীল বসু। তিনি মারা যাওয়ার পর এই মেলা আয়োজনের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ কমে আসে। এছাড়া যে বঙ্গীয় প্রকাশক সভা এই মেলা আয়োজনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত, তারাও পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক প্রকাশন সংস্থা হয়ে পড়ায় উদ্যোগের অভাবে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে অবশ্য আর একবার বঙ্গীয় প্রকাশক সংস্থা ও পশ্চিমবঙ্গের তদনীন্তন যুবকল্যাণ ও ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর উদ্যোগে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে বিদেশি মডেলে একটি ছোটো বাংলা বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল।[৩] পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কলকাতা বইমেলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের থেকে নানা সুযোগসুবিধা পেতে শুরু করে।[৫]
কলিকাতা পুস্তকমেলা, ১৯৯৭
[সম্পাদনা]১৯৯৭ সাল কলকাতা বইমেলার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বছর। এই বছর বইমেলার থিম ছিল ফ্রান্স; থিম প্যাভিলিয়নটি সাজানো হয়েছিল প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের আদলে। বইমেলার উদ্বোধন করেছিলেন স্বনামধন্য ফরাসি সাহিত্যিক জাঁক দেরিদা।[৫] কিন্তু মেলাচলাকালীন একদিন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুরো মেলা অগ্নিদগ্ধ হয়ে। ফলে প্রচুর টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং ঘটনার ভয়াবহতায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে একজন দর্শনার্থীর মৃত্যু ঘটে। কিন্তু সরকার ও উদ্যোক্তাদের তৎপরতায় তিন দিন পরেই আবার নতুন করে বইমেলা শুরু করা হয়।[৩][৫] এরপর থেকেই মেলার মাঠে ধূমপান ও আগুন জ্বালানো নিষিদ্ধ হয়ে যায়। খাবারের স্টলকে মূল মেলাপ্রাঙ্গণের এক কোণে স্থান দেওয়া হয়।[৫] অগ্নিকাণ্ডে সময় নিহত দর্শনার্থী যতীন শীলের স্মরণে প্রতি বছর মেলায় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণীর পূর্বে দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।[৪]
কলকাতা পুস্তকমেলা ২০০১-বর্তমান
[সম্পাদনা]২০০১ সালে কলকাতা মহানগরীর ইংরেজি নাম "ক্যালকাটা" ("Calcutta") থেকে "কলকাতা" ("Kolkata") করা হলে, "কলিকাতা পুস্তকমেলা" বা "ক্যালকাটা বুক ফেয়ার"-ও নাম বদলে পরিণত হয় "কলকাতা পুস্তকমেলা" বা "কলকাতা বুক ফেয়ার"-এ। ২০০৭ সালে পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ময়দানের পরিবর্তে বিধাননগরের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণ-সংলগ্ন একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো মেলাপ্রাঙ্গণে বইমেলার আয়োজন করা হয়। ২০০৮ সালে একই ধরনের একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্বোধনের আগের দিন মেলা বন্ধ হয়ে যায়। মেলার প্রাথমিক আয়োজন সেবার করা হয়েছিল পার্কসার্কাস ময়দানে। আনুষ্ঠানিকভাবে মেলার উদ্বোধন করা হলেও, সেবার প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘কলকাতা পুস্তকমেলা’র আয়োজন করা হয়নি। বরং মার্চ মাসে ‘বইমেলা ২০০৮’ ব্যানারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ বিভাগের উদ্যোগে ও গিল্ডের সহযোগিতায় একটি মেলার আয়োজন করা হয়। কলকাতা পুস্তকমেলার ইতিহাসে এটি ছিল এক নজিরবিহীন ঘটনা। ২০০৯ সালে কলকাতা পুস্তকমেলা স্থানান্তরিত হয় সায়েন্স সিটির বিপরীতে সেই বহুপ্রস্তাবিত মিলন মেলা নামক অত্যাধুনিক মেলাপ্রাঙ্গণে। ২০০৯ সালেই "কলকাতা পুস্তকমেলা" নাম বদলে হয় "আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা"।[১]
বিতর্ক
[সম্পাদনা]২০০৭ সালের বইমেলা বিতর্ক
[সম্পাদনা]পরিবেশ দূষণের প্রশ্নে কলকাতা হাইকোর্ট ‘কলকাতার ফুসফুস’ বলে অভিহিত ময়দানে যে কোনো রকমের মেলার আয়োজন নিষিদ্ধ করে দেন। ২০০৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার আদালতকে জানিয়েছিলেন ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে একটি সুসংহত মেলাপ্রাঙ্গণ তৈরি করে সব মেলা ময়দান থেকে সেখানেই স্থানান্তরিত করা হবে। এরপর ২০০৫ সালে একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এক বছরের জন্য ময়দানে বইমেলার বিশেষ অণুমতি দিয়েছিলেন। ২০০৬ সালেও ময়দানে মেলার এক বিশেষ অণুমতি এই মর্মে আদালত দেন, যে এর পর থেকে আর সেখানে মেলার আয়োজন করা যাবে না। কলকাতার ময়দান একত্রিশ বছর কলকাতা পুস্তকমেলার স্থায়ী ঠিকানা হওয়ার সুবাদে এই মাঠটি অনেকের কাছেই স্মৃতিমেদুরতার কারণ ছিল। তাছাড়া, কলকাতার কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক মানের এত বড় অণুষ্ঠান আয়োজনের বিকল্প কোনো জায়গা না থাকায় মেলা কর্তৃপক্ষ ময়দান থেকে বইমেলাকে স্থানান্তরিত করতে চাইলেন না। ফলে বিকল্প মেলাপ্রাঙ্গণ খোঁজার দুই বছরের প্রয়াস নিষ্ফলাই থেকে যায়।
২০০৭ সালে গিল্ড কর্তৃপক্ষ পুনরায় ময়দানে কলকাতা পুস্তকমেলার আয়োজন করলে “ময়দান বাঁচাও” প্রভৃতি পরিবেশপ্রেমী সংগঠন সেই উদ্যোগের প্রতিবাদ জানায়। বিষয়টি আদালতের কর্ণগোচর হলে, আদালতও গিল্ডকে ময়দানে বইমেলার আয়োজন করতে নিষেধ করেন।[৬]
কলকাতার লেখক-বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক, সাংবাদিক ও বইপ্রেমীদের একাংশ হাইকোর্টের এই নির্দেশিকার বিরোধিতা করেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বুদ্ধদেব গুহ, মৃণাল সেন এবং কলকাতার মহানাগরিক (মেয়র) বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ৩১ জানুয়ারি ময়দানে এই রায়ের বিরুদ্ধে ময়দানে এক প্রতীকী বইমেলা উদ্বোধনী অণুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এই অণুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, বইমেলার প্রাণশক্তি যে ফুরিয়ে যায়নি, তা জানান দেওয়া।
পরিবর্তিত সময়সূচি অনুযায়ী সেই বছর কলকাতার উপকণ্ঠে বিধাননগরের যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণ সংলগ্ন মাঠে মেলার আয়োজন করা হয়। মাঠটি তুলনামূলকভাবে ছোটো হওয়ায়, মেলার আয়োজন যথাযথভাবে করা সম্ভব হয়নি।
বইমেলা ২০০৮
[সম্পাদনা]২০০৮ সালেও মেলা শুরুর চব্বিশ ঘণ্টারও কম সময় আগে পরিবেশ রক্ষণের প্রশ্নে হাইকোর্টের একটি রায়ে পার্কসার্কাস ময়দানে আয়োজিত মেলাটি বন্ধ করে দিতে হয়। মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে ও গিল্ডের সহযোগিতায় কলকাতা পুস্তকমেলার বদলে আয়োজন করা হয় ‘বইমেলা ২০০৮’-এর। এটি সরকারিভাবে ‘কলকাতা পুস্তকমেলা’ না হলেও, প্রকাশক ও গ্রন্থবিক্রেতাদের ক্ষতি ঠেকাতে আয়োজিত এই মেলা কলকাতার চিরন্তন বইমেলার আমেজই বয়ে আনে। গিল্ড কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে সমালোচিত হন, আইনি জটিলতার দিকটি যথাযথভাবে বিচার না করে পার্কসার্কাস ময়দানে বইমেলা আয়োজনের জন্য।
অংশগ্রহণকারী
[সম্পাদনা]কলকাতা পুস্তকমেলার অধিকাংশ স্টলেই বাংলা ও ইংরেজি বই পাওয়া যায়। বাংলা বই বিক্রেতাদের মধ্যে আনন্দ পাবলিশার্স, দে'জ পাবলিশিং, দেব সাহিত্য কুটির, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, অভিযান পাবলিশার্স, রিভিউ প্রিভিউ, প্রতিভাস, পুনশ্চ, সাহিত্য সংসদ ও শিশু সাহিত্য সংসদ, দীপ প্রকাশন, তুলি কলম, ভাষা ও সাহিত্য, মণ্ডল বুক হাউস, সারস্বত লাইব্রেরি, অপর্ণা বুক ডিস্টিবিউটার্স, আত্মজা, বাণীশিল্প, করুণা প্রকাশনী, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, গ্রন্থনিলয়, পিপলস বুক সোসাইটি, চর্চাপদ, কবিতা পাক্ষিক, তুলসী প্রকাশনী, ভাষাবন্ধন প্রকাশনী, বিকল্প, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, এম সি সরকার অ্যান্ড সনস প্রাঃ লিঃ, রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন, এবং মুশায়েরা, ভারবি, প্রকাশ ভবন, সাহিত্যম, বাউলমন প্রকাশন, নির্মল বুক এজেন্সি, তালপাতা, ক্যাম্প, উর্বী প্রকাশনী, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, শশধর প্রকাশনী, প্যাপিরাস, কামিনী প্রকাশালয়, লালমাটি, জ্ঞানবিচিত্রা (ত্রিপুরা), অণুষ্টুপ, সাহিত্য তীর্থ, অমর ভারতী, পত্রলেখা, পারুল প্রকাশনী, উদবুশ, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, অণীক, রত্নাবলী, মনফকিরা, নাট্যচিন্তা ফাউন্ডেশন, অক্ষর পাবলিকেশানস (ত্রিপুরা), সেরিবান, নান্দীমুখ সংসদ, দে বুক কনসার্ন, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, পুস্তক বিপণি, নারায়ণ পুস্তকালয়, একুশ শতক, কৃত্তিবাস, প্রাইমা পাবলিকেশন, প্রতিক্ষণ, কবিতীর্থ, কম্পিউট্রনিক্স প্রকাশনী, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, নবপত্র প্রকাশন, পত্র ভারতী, বিশ্ববঙ্গীয় প্রকাশন, কোরক, জয়দুর্গা লাইব্রেরি ও একবিংশ, মৌলিক লাইব্রেরি, কোরক, হরফ প্রকাশনী, গাঙচিল ও দোয়েল, সপ্তর্ষি প্রকাশন, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ডি এম লাইব্রেরি, মৌসুমী প্রকাশনী, নাথ পাবলিশিং, একালের রক্তকরবী ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি গ্রন্থবিক্রেতাদের মধ্যে টাইমলি বুকস, সিগাল বুকস, রূপা অ্যান্ড কো, পেঙ্গুইন ইন্ডিয়া, টাটা ম্যাকগ্রিউ হিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ইউরোপের প্রায় প্রত্যেক বিজ্ঞানগ্রন্থ প্রকাশকই কলকাতা পুস্তকমেলায় স্টল দেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ক্লুয়ার, স্প্রিঞ্জার ভারল্যাগ ইত্যাদি। বিভিন্ন বৈদেশিক দূতাবাস নিজ নিজ দেশের গ্রন্থসম্ভার নিয়ে কলকাতা পুস্তকমেলায় অংশগ্রহণ করে। ব্রিটিশ কাউন্সিল, ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস ও আলিয়াঁজ ফ্রাঁস সাধারণত স্টল দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ মেলায় স্টল দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকার দরুন এবং পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডে কমিউনিস্ট প্রভাব বেশি থাকার জন্য কিউবা দূতাবাস মেলায় অধিক গুরুত্ব পায়। চে গেভারা পোস্টার বিক্রি হয় ও তার ছবি সংবলিত টি-শার্ট পরার প্রবণতা দেখা যায়।
সংবাদ প্রতিদিন, আজকাল, দ্য স্টেটসম্যান, দ্য টেলিগ্রাফ ইত্যাদি কলকাতা-ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম বইমেলায় স্টল দেয়। দেশ পত্রিকার এক বিরাট মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র মুখপত্র গণশক্তি পত্রিকাও স্টল দেয়। ২০০৯ সাল থেকে স্টল দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস মুখপত্র জাগো বাংলা পত্রিকা।
বিভিন্ন কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ ভিত্তিক সংস্থাও স্টল দেয় কলকাতা পুস্তকমেলায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় সংগ্রহশালা, এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা, জুওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ইত্যাদি সমীক্ষাসংস্থা এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়।
পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, শিশু কিশোর আকাদেমি, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আকাদেমি ও গবেষণা সংস্থাগুলি পশ্চিমবঙ্গ নামাঙ্কিত একটি সুবৃহৎ মণ্ডপে স্টল দেয়।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বার্ষিক স্টলগুলি হল:
- বিখ্যাত শান্তিনিকেতন-ভিত্তিক পুরনো বইয়ের বিক্রেতা সুবর্ণরেখার স্টল।
- কলকাতার বিখ্যাত শিল্পী রথীন মিত্রের স্টল। এখানে শিল্পীর কলকাতাকেন্দ্রিক বিখ্যাত ছবিগুলি পাওয়া যায়।
- বেনফিস (বেঙ্গল ফিসারিজ)-এর স্টল।
একসময় কলকাতা পুস্তকমেলায় নিয়ম ছিল কেবলমাত্র প্রকাশকরাই মেলায় অংশ নেবে। পুস্তক বিক্রেতা বা পরিবেশকরা অংশ নিতে পারবেন না। এই নিয়ম ২০০০-এর দশকে তুলে নেওয়া হয়েছে। কারণ অনেক সময়েই দেখা যেত, মেলায় অংশ নেবার জন্য ছোটো ছোটো পুস্তকবিক্রেতারাও জোর করে বই প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সময়
[সম্পাদনা]আন্তর্জাতিক পুস্তকমেলা ক্যালেন্ডার অনুসারে জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার সূচনা হয় কলকাতা পুস্তকমেলার। শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় রবিবার। সাধারণত বারো দিন ধরে চলে এই মেলা। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, রাজনৈতিক ধর্মঘট বা অন্য কোনো কারণে মেলার স্বাভাবিক কর্মদিবস নষ্ট হলে নষ্ট দিনসংখ্যার হিসেবে মেলার মেয়াদ বাড়ানো হয়ে থাকে। মেলা চলাকালীন অনেক সময়ই নেতাজি জয়ন্তী (২৩ জানুয়ারি), সাধারণতন্ত্র দিবস (২৬ জানুয়ারি) এবং হিন্দু উৎসব সরস্বতী পূজা এই সময়কালের মধ্যে পড়ে যায়। সাধারণত দেখা যায় এই ছুটির দিনগুলিতে মেলায় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি মানুষ ভিড় জমাতে আসেন।
বইমেলার থিম
[সম্পাদনা]সাল | ফোকাল থিম |
---|---|
১৯৯১ | আসাম |
১৯৯২ | ত্রিপুরা |
১৯৯৩ | ওড়িশা |
১৯৯৪ | জিম্বাবোয়ে |
১৯৯৫ | পশ্চিমবঙ্গ |
১৯৯৬ | বিহার |
১৯৯৭ | ফ্রান্স |
১৯৯৮ | গ্রেট ব্রিটেন |
১৯৯৯ | বাংলাদেশ |
২০০০ | ব্রাজিল |
২০০১ | ভারত |
২০০২ | নেদারল্যান্ডস |
২০০৩ | কিউবা |
২০০৪ | চিলি |
২০০৫ | ফ্রান্স |
২০০৬ | স্পেন |
২০০৭ | অস্ট্রেলিয়া |
২০০৮ | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
২০০৯ | স্কটল্যান্ড |
২০১০ | মেক্সিকো |
২০১১ | মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র[৮] |
২০১২ | ইতালি[৯] |
২০১৩ | বাংলাদেশ |
২০১৪ | পেরু |
২০১৫ | গ্রেট ব্রিটেন |
২০১৬ | বলিভিয়া |
২০১৭ | কোস্টারিকা |
২০১৮ | ফ্রান্স |
২০১৯ | গুয়েতেমালা |
২০২০ | রাশিয়া |
২০২১ | কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে বাতিল |
২০২২ | বাংলাদেশ |
২০২৩ | স্পেন |
২০২৪ | গ্রেট ব্রিটেন |
ফ্রাঙ্কফুট পুস্তকমেলার গেস্ট অফ অনার ধারণাটির আদলে কলকাতা পুস্তকমেলায় ‘ফোকাল থিম’ ধারণাটির সূত্রপাত ১৯৯১ সালে। থিম দেশ ধারণাটির প্রবর্তনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্তরে কলকাতা পুস্তকমেলার বিশিষ্ট স্থান নির্ধারণ ও বিভিন্ন জাতি ও ভাষার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ তথা বাংলা ভাষার যোগসূত্রটি সুদৃঢ় করা হয়। প্রথমবার কলকাতা পুস্তকমেলার ফোকাল থিম ছিল ভারতীয় রাজ্য অসম। এরপর দুই বছর ভারতের অপর দুই রাজ্য ত্রিপুরা ও ওড়িশা ফোকাল থিম নির্বাচিত হয়। ১৯৯৪ সালে জিম্বাবুয়ে ছিল বইমেলার প্রথম বিদেশি ফোকাল থিম। ১৯৯৭ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে ফোকাল থিম নির্বাচিত করা হতে থাকে। মাঝে কেবল একবার ফোকাল থিম হয় ভারত (২০০১)। পশ্চিমবঙ্গ (১৯৯৫) একবার ও বাংলাদেশ (১৯৯৯, ২০২২) দুইবার করে বইমেলার ফোকাল থিম নির্বাচিত হয়েছিল। সর্বশেষ যে ভারতীয় রাজ্যটি শেষবারের মতো ফোকাল থিম নির্বাচিত হয়, সেটি হল বিহার (১৯৯৬)।
থিম রাষ্ট্রের মণ্ডপটি মেলার কেন্দ্রে স্থাপিত হয়। অনেক প্রকাশকই তাদের বইয়ের সংগ্রহ এই থিম দেশটির কথা স্মরণে রেখে সাজান। মেলার মূল প্রবেশদ্বারগুলি থিম দেশের কোনো না কোনো সৌধের আদলে গড়ে ওঠে। একটি প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এই প্রবেশপথগুলি অবশ্য তৈরি করেন কলকাতার ছাত্ররাই। থিম দেশের কোনো অগ্রণী সাহিত্যিক মেলার প্রধান অতিথির আসনটি অলংকৃত করেন। আজ অবধি শামসুর রহমান, গুন্টার গ্রাস, রিচার্ড ডাওকিন্স, মারিয়া ফার্নান্দো স্যান্তিগো প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা এই আসনটি অলংকৃত করেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থিম দেশের রাষ্ট্রদূত বা রাষ্ট্রপ্রধান সম্মানিত অতিথিরূপে উপস্থিতও থাকেন।
২০০৫ সাল থেকে নতুন অংশগ্রহণকারী বিদেশি রাষ্ট্রগুলির একটিকে গেস্ট অফ অনার বা সাম্মানিক অতিথির আসন দেওয়ার প্রথা চালু হয়। এই দেশটি মেলায় দ্বিতীয় থিম রাষ্ট্রের সম্মান পায়। কলকাতা পুস্তকমেলার সম্মানিত অতিথি রাষ্ট্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অস্ট্রেলিয়া (২০০৭)।
ফ্রান্স এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুইবার বইমেলার থিম নির্বাচিত হয়েছে। এছাড়া কোনো দেশ একের অধিকবার থিম নির্বাচিত হয়নি। প্রত্যেকবারই এই দেশের প্যাভিলিয়নটি বিদেশি প্যাভিলিয়নগুলির মধ্যে থেকে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বহু মানুষ এই মণ্ডপে ভিড় জমান। প্যাভিলিয়নটি বাংলাদেশের কোনো ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সৌধের আদলে নির্মিত হয়। মণ্ডপের ভিতরে ছোটো ছোটো স্টলে বাংলা একাডেমী সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রকাশন সংস্থার গ্রন্থসমাবেশ ঘটে। এছাড়া অনেক কলকাতাভিত্তিক প্রকাশক ও গ্রন্থবিক্রেতা কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের পাশাপাশি নিজস্ব উদ্যোগে বাংলাদেশী গ্রন্থের প্রচার ও বিক্রয় করে থাকেন।
বিশেষ প্রাঙ্গণ
[সম্পাদনা]কলকাতা পুস্তকমেলায় প্রকাশক ও গ্রন্থবিক্রেতাদের নিজস্ব স্টল ও প্যাভিলিয়ন ছাড়াও বেশ কয়েকটি বিশেষ প্রাঙ্গণ ও মণ্ডপ দেখা যায়। এগুলি হল :
- মেলায় সদ্যপ্রকাশিত ও নবপ্রকাশিত বইগুলির প্রথম সংস্করণ একটি বিশেষ গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়।
- প্রথম বছর থেকেই কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ এমনকি বহির্বঙ্গেরও বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনস্থল হল কলকাতা পুস্তকমেলা। মেলায় লিটল ম্যাগাজিন ক্রয়বিক্রয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র থাকে। এই লিটল ম্যাগাজিন চত্বরে প্রত্যেক ম্যাগাজিন একটি করে টেবিল পেয়ে থাকে।
- ১৯৯০-এর দশক থেকে বইমেলায় শিল্পীদের জন্য একটি বিশেষ চত্বরের ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। প্যারিসের মমার্তের আদলে এই চত্বরের নামকরণ করা হয়েছিল ‘মমার্ত’। বর্তমানে অবশ্য এই চত্বরটি শিল্পগ্রাম নামে পরিচিত এবং শুধুমাত্র শহুরে নাগরিক চিত্রশিল্প নয়, এখানে স্থান পাচ্ছে পটচিত্র প্রভৃতি লোকশিল্পকলাও।
- ২০০০-এর দশকে শিশুদের জন্য বিশেষ শিশু চত্বরের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।
- ২০০০-এর দশক থেকে মেলায় সংযোজিত হয়েছে বিশেষ তথ্যপ্রযুক্তি চত্বরও। এখানে ই-বই, সিডিরম ইত্যাদি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রাপ্য বই ও অন্যান্য জ্ঞান ও শিক্ষাসংক্রান্ত সফটওয়্যার ক্রয়বিক্রয় হয়। এটি মেলার একটি মুখ্য আকর্ষণ। ২০০১ সালে এই তথ্যপ্রযুক্তি চত্বরেই নবনীতা দেবসেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম ই-বইটির উদ্বোধন করেছিলেন।
- ১৯৯৭ সালের অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে মেলার সমস্ত খাদ্যসামগ্রী বিক্রয়ের স্টল একটি পৃথক চত্বরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়ে আসছে। এই চত্বরটি সাধারণভাবে ফুড পার্ক নামে পরিচিত।
অনুষ্ঠান
[সম্পাদনা]কলকাতা বইমেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বেশ কিছু অনুষ্ঠানের, যেগুলির মধ্যে অনেকগুলিই ঐতিহ্যবাহী :
- বইমেলা একটি বহুআলোচিত ও জনপ্রিয় উৎসব হওয়ায় অনেক প্রকাশনী এখন বইমেলায় নতুন বই প্রকাশ করে থাকেন। এই উপলক্ষে পাঠকরা তাদের প্রিয় লেখকদের বইটির প্রথম সংস্করণটি সংগ্রহ করে লেখককে দিয়ে সই করিয়ে নেন। উল্লেখ্য, এই অনুষ্ঠানটি আগে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে উদযাপিত হত।
- বিদগ্ধ লেখক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের নিয়ে আয়োজন করা হয় একগুচ্ছ সেমিনার ও সভার।
- প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সৃজনশীল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় স্কুলপড়ুয়াদের জন্য।
- ‘বইয়ের জন্য হাঁটা’ পদযাত্রা আয়োজিত হয়। আবার শিশুদের সাক্ষরতা প্রকল্পের জন্য চাঁদা তোলার মতো শিক্ষামূলক জনহিতকর কাজও করা হয়।
- ১৯৮৪ সাল থেকে “অশোককুমার সরকার স্মৃতি বক্তৃতা’র আয়োজন করা হচ্ছে। ডব্লিউ ব্র্যাডলে উইলির মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বরা এই বক্তৃতা দিয়েছেন।
- আগে বইমেলার শেষ দিনে ‘বইবাজার’ নামে একটি নিলাম আয়োজিত হত। সেখানে বিক্রি হত পুরনো বই। এখন সেটি বন্ধ। ‘বইবাজার’ এখন এপ্রিল মাসে বাংলা আকাদেমি চত্বরে আয়োজিত হয়।
গ্যালারি
[সম্পাদনা]-
কলকাতা বইমেলা ২০২০-এ বাংলাদেশ প্য্যাভিলিয়ন; শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের আদলে নির্মিত।
-
কলকাতা বইমেলা ২০০৯, বাংলাদেশ প্য্যাভিলিয়ন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের আদলে নির্মিত।
-
কলকাতা বইমেলা, মেক্সিকো প্যাভিলিয়ন
-
কলকাতা বইমেলা ২০১০
-
কলকাতা বইমেলা ২০১০, লিটল ম্যাগাজিন স্টল
-
কলকাতা বইমেলা ২০১০
-
কলকাতা বইমেলা ২০১১ মার্কিন
-
মিলন মেলা ২০১৪
-
মিলন মেলা ২০১৪
-
মিলন মেলা ২০১৪
-
মিলন মেলা ২০১৪
-
মিলন মেলা ২০১৪
-
মিলন মেলা ২০১৪
-
প্রথম উইকিপিডিয়া স্টল
-
কলকাতা পুস্তকমেলায় (২০০৯) শিল্পগ্রামের একাংশ
-
কলকাতা পুস্তকমেলা ২০০৬-এর বিশেষায়িত লোগো, থিম দেশ স্পেনের প্রতিভূ।
-
কলকাতা পুস্তকমেলা, ২০০৯-এর থিম প্যাভিলিয়ন স্কটল্যান্ড
পাদটীকা
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ মিলন দত্ত: "কলকাতার বইমেলা কতটা আন্তর্জাতিক", আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ জুলাই ২০০৯ তারিখে
- ↑ "High court cancels Kolkata book fair"। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ সবিতেন্দ্রনাথ রায়; কলকাতা পুস্তকমেলা: উত্থান সাফল্য ও বিচ্যুতি, আমার সময়, জানুয়ারি ২০১০ সংখ্যা
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ অরুণ মুখোপাধ্যায়: বইমেলার এখন তখন, সাপ্তাহিক বর্তমান, ৩১ জানুয়ারি, ২০০৯, পৃষ্ঠা ১৭
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড বইমেলার পরম্পরা, জয়ন্ত দে; কলকাতা বইমেলা ও নতুন বই; সাপ্তাহিক বর্তমান, ৩১ জানুয়ারি, ২০১০ সংখ্যা
- ↑ Anusuya Basu; Fair’s first pullout[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]; The Telegraph, January 20, 2007; Kolkata
- ↑ অরুণ মুখোপাধ্যায়: বইমেলার এখন তখন, সাপ্তাহিক বর্তমান, ৩১ জানুয়ারি, ২০০৯
- ↑ USA to be next year's book fair theme
- ↑ "Italy is Kolkata Book Fair's theme country"। ২০১৩-০৬-১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১২-০২-০৫।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- কলকাতা পুস্তকমেলার প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট (বহিঃসংযোগ বিভাগ দ্রষ্টব্য)
- সাপ্তাহিক বর্তমান, ৩১ জানুয়ারি, ২০০৯ (প্রচ্ছদ কাহিনি: কলকাতা বইমেলায় এত মানুষের ঢল কেন?)