আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান
রয়াল বোটানিক গার্ডেন, কলকাতা
আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান
মানচিত্র
ধরনপাবলিক
অবস্থানশিবপুর, হাওড়া,  ভারত
নিকটবর্তী শহরকলকাতা, হাওড়া
আয়তন১০৯ হেক্টর (২৭০ একর)
অনুমোদিতব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
প্রতিষ্ঠাতাকর্নেল রবার্ট কিড
নকশাকারীকর্নেল রবার্ট কিড, উইলিয়াম রক্সবার্গ
শাসিতবোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া
গাছপালা১৭,০০০
প্রজাতি১,৪০০
সংগ্রহ২৫,০০,০০০ (শুকনো গাছের সংগ্রহশালায়)
পাবলিক ট্রানজিট এক্সেসBGN or L16 or D6/1 বোটানিক্যাল গার্ডেন (East Gate)
T1 লাল কুঠি
K7 বি গার্ডেন নিউ গেট (West Gate)
বি.গার্ডেন ফেরি ঘাট
নাজিরগঞ্জ ফেরি ঘাট
ওয়েবসাইটhttp://bsi.gov.in
বিশাল বটবৃক্ষ, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বোটানিক্যাল গার্ডেন
বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুকুর
উদ্যানের পুকুরে পদ্ম পাতা

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ভারতীয় উদ্ভিদ উদ্যান (পূর্বনাম ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন)[১][২] কলকাতার সন্নিকটে হাওড়ার শিবপুরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক উদ্ভিদ উদ্যান। সাধারণভাবে এটি কলকাতা বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে প্রচলিত হলেও প্রতিষ্ঠাকালে এই উদ্ভিদ উদ্যানটি ক্যালকাটা রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন নামে পরিচিত ছিল। ২৭৩ একর আয়তনবিশিষ্ট এই উদ্যানে বর্তমানে মোট ১৪০০ প্রজাতির প্রায় ১৭,০০০টি গাছ রয়েছে।[৩] এই উদ্যানটি সাধারণ মানুষের কাছে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন নামেও পরিচিত।

প্রাক-কথা[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনা আধিকারিক কর্নেল রবার্ট কিড ১৭৮৬ সালে তৎকালীন ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সি-র দ্বিতীয় গভর্নর জেনারেল স্যর জন ম্যাকফারসন-এর কাছে পেশ করলেন একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের পরিকল্পনা। রবার্ট কিড তাঁর আর্জিতে লিখলেন, শুধুমাত্র কৌতূহল মেটানো কিংবা বিলাসের সামগ্রী হিসেবে বিরল গাছপালা সংগ্রহ এই বাগানের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য হবে বাগান থেকে উপযোগী চারাগাছ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা। যাতে ভারত ও গ্রেট ব্রিটেনের মানুষ উপকৃত হয় এবং সঙ্গে-সঙ্গে জাতীয় ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার ও সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে।[৪] মূলত বাণিজ্যিক স্বার্থের কথা ভেবে তাঁর পরিকল্পনাকে সমর্থন করে ১৭৮৭-র ৩১ জুলাই বিলেতের কর্মকর্তারা সিংহলের মতো বাংলাতেও দারচিনি গাছ ব্যাপক ভাবে উৎপন্ন করা যায় কি না, তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন ।

জমিতে এক সময় মুঘলদের একটা ছোটখাটো কেল্লা ছিল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছ থেকে কলকাতা উদ্ধারের সময় ক্লাইভ সেই কেল্লা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন কামানের গোলায়। জমিটা ছিল বুনো গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ভরা একটা পরিত্যক্ত স্থান। গঙ্গায় জোয়ার এলে ভেসে যেত , এতটাই নিচু। এই জমির সংলগ্ন ছিল কিডের নিজস্ব বাগান ও বাড়ি। তবে সেই জমি ছিল বর্ধমান রাজার সম্পত্তি। তাই কোম্পানির দখলে থাকা অন্য এক জমির বিনিময়ে রাজার কাছ থেকে পাওয়া গেল সেই জমি। জমিতে বাস করত রাজার কিছু প্রজা। কোম্পানি তাদের অন্যত্র ১৪৮ বিঘা ৯ কাঠা জমি ও ৩,১৬৬ টাকা ৪ আনা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বাধ্য করল সেই জমি ছেড়ে দিতে।

১০৯ জন মজুর লাগিয়ে জমির চারপাশে একটা খাল খনন করে, পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেললেন জমিটা। পাঁচিল দেওয়ার কারণ, বুনো মোষের উপদ্রব। খরচ হল ৩৮৪ টাকা। কয়েকটা মাস লাগল জমি সুরক্ষিত করতে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

১৭৮৮ সালে কর্নেল কিড এই উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৮৭ সালে বাগানের সূচনা ৩১০ একর জমি নিয়ে। পরে ৪০ একর জমি— যা কিড সাহেবের সম্পত্তি ছিল— দিয়ে দেওয়া হয় বিশপ’স কলেজকে। সে কলেজ আর নেই। সেই জমিতে এখন ভারতীয় প্রকৌশল বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যা প্রতিষ্ঠান, শিবপুর (পূর্বের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি)। আঠারো শতকে বিশ্বের কোনও বাগান এমন বিশাল পরিধি নিয়ে জন্ম নেয়নি। এমনকি ১৮৪০ সালের আগে বিলেতের বিখ্যাত ‘কিউ গার্ডেনস’ ছিল মাত্র এগারো একর জমি নিয়ে। কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন বিশ্বের বৃহত্তম গার্ডেনের শিরোপা পরে ছিল বহু বছর ধরে। ভারতে কোম্পানির আমলে এটা দ্বিতীয় প্রাচীনতম বাগান । এর আগে ১৭৮০ সালে উইলিয়াম রক্সবার্গ— যিনি রবার্ট কিডের পর বাগানের কর্তা হন— তৎকালীন মাদ্রাজের কাছে একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

উদ্যান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ থেকে গাছপালা সংগ্রহ করে এনে সেগুলির পরীক্ষানিরীক্ষা।[৫] এই উদ্দেশ্যে কলকাতার অদূরে হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে কিছু জলাজমি তক্রয় করে এই উদ্যান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা এই উদ্যানটি গড়ে তুলেছিলেন বলে লোকমুখে এটি কোম্পানির বাগান নামে পরিচিত লাভ করে।[৩] জোসেফ ডালটন হুকার এই উদ্যানটি সম্পর্কে লেখেন-

Amongst its greatest triumphs may be considered the introduction of the tea-plant from China ... the establishment of the tea-trade in the Himalaya and Assam is almost entirely the work of the superintendents of the gardens of Calcutta and Seharunpore (Saharanpur).[৬]

রবার্ট কিড ১৭৮৭ সাল থেকে ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেনের সাম্মানিক সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। ১৭৯৩ সালে উদ্ভিদবিদ উইলিয়াম রক্সবার্গ উদ্যানের সুপারিনটেনডেন্ট হলে, উদ্যানের নীতিপ্রণয়নে একটি বড়োসড়ো পরিবর্তন আনা হয়। রক্সবার্গ সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে নানা প্রজাতির গাছ কিনে এনে এই উদ্যানে একটি বড়ো হার্বেরিয়াম গড়ে তোলেন।[৭] হুকার উদ্যানের প্রথম কুড়ি বছরের ইতিহাস, বিশেষত যে সময় নাথানিয়েল ওয়ালিচ এর সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন, সেই সময়টি সম্পর্কে লিখেছেন,

... contributed more useful and ornamental tropical plants to the public and private gardens of the world than any other establishment before or since. ... I here allude to the great Indian herbarium, chiefly formed by the staff of the Botanic Gardens under the direction of Dr. Wallich, and distributed in 1829 to the principal museums of Europe.[৮]

২,৫০০,০০০ শুষ্ক গাছের এই সংগ্রহ বর্তমানে বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অধীনে সেন্ট্রাল ন্যাশানাল হার্বেরিয়াম নামে পরিচিত।

মূল উদ্যানটির আয়তন ছিল ৩০০ একর। প্রতিষ্ঠার অল্পকাল পরে ২৭ একর জমি একটি খ্রিষ্টান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য দান করা হয়। এই কলেজটিই বর্তমানে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি নামে পরিচিত।[৩] ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া এই উদ্যানটি সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন বলে জানা যায়। সেই সময় এই উদ্যানের নাম ছিল রয়্যাল ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন। স্বাধীনতার পর ১৯৬৩ সালে এই উদ্যানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন। ২০০৯ সালের ২৫ জুন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর জন্মসার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে তার নামানুসারে এই উদ্যানের নামকরণ করা হয় আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বোটানিক্যাল গার্ডেন

স্বাধীনতার পর বোটানিক্যাল গার্ডেন ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের অধীনে বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৫ সদস্যের একটি পরিচালক পর্ষদ নিয়মিত উদ্যানের কাজকর্ম দেখাশোনা করছেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একাধিক প্রতিনিধিও নিয়মিতভাবে প্রশাসনিক সভায় যোগ দিয়ে থাকেন। বর্তমানে উদ্ভিদ গবেষক সহ প্রায় ৪০০ কর্মী চাকরিসূত্রে এই উদ্যানের সঙ্গে যুক্ত।[৩]

বিশাল বটবৃক্ষ[সম্পাদনা]

বোটানিক্যাল গার্ডেনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্য বস্তু হল বিশাল বটবৃক্ষ নামে একটি ২৫০ বছরের প্রাচীন বটগাছ। গাছটির পরিধি ৩৩০ মিটার। বর্তমানে এই সুবিশাল বটগাছটি দেড় একর জমির উপর শত শত ঝুরি নিয়ে বিরাজমান।[৩] এই বটগাছটি ছাড়াও বোটানিক্যাল গার্ডেনে রয়েছে মেহগনি, সাল, সেগুন, বট, অশ্বত্থ, শিমূল, পিয়াল ও নানা প্রজাতির পাম গাছ। রয়েছে দারুচিনি, লবঙ্গ, জায়ফল, তেজপাতা, রবার ও নানা প্রকার ঔষধি বৃক্ষও। উদ্যানের মধ্যে যাতায়াতের জন্য রয়েছে ১৭ কিলোমিটার পাকা রাস্তাও।[৩]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "BSI renamed as Acharya Jagadish Chandra Bose Botanical Garden"news.webindia123.com। ২০০৯-০৬-২৪। ২০২১-০২-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০২-১০ 
  2. http://www.thestatesman.net/page.news.php?clid=22&theme=&usrsess=1&id=258973[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  3. ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলার ঐতিহ্য কলকাতার অহংকার, পল্লব মিত্র, পারুল প্রকাশনী, কলকাতা, ২০১০, পৃ. ৭৪-৭৭
  4. "কিড সাহেবের বাগান" 
  5. "Oxford dictionary of national biography"। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১০ 
  6. Joseph Dalton Hooker, Himalayan Journals, or Notes of a Naturalist ..., Kew (1854), vol. I, p. 5.
  7. Roxburgh, W (1814) Hortus Bengalensis or a catalogue of the plants growing in the Honourable East India Company's botanic garden at Calcutta. Mission Press : Serampore. 105pp.
  8. Joseph Dalton Hooker, Himalayan Journals, or Notes of a Naturalist ..., Kew (1854), vol. I, p. 4.

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]