সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: স্নায়ুযুদ্ধ, আফগানিস্তান–পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং আফগানিস্তান যুদ্ধ (১৯৭৮–বর্তমান)

১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানে একদল সোভিয়েত স্পেৎসনাজ সৈন্য অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে
তারিখ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৯ – ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯
অবস্থান
আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানইরানের আফগান সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহ
ফলাফল

সামরিক অচলাবস্থা

বিবাদমান পক্ষ

আফগানিস্তান আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র
সোভিয়েত ইউনিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন
সমর্থক:

সুন্নি মুজাহিদিন:

শিয়া মুজাহিদিন:

সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
সোভিয়েত ইউনিয়ন লিওনিদ ব্রেজনেভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরি আন্দ্রোপভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন কনস্তান্তিন চেরনেনকো
সোভিয়েত ইউনিয়ন মিখাইল গর্বাচেভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন দিমিত্রি উস্তিনভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন সের্গেই সকোলভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন দিমিত্রি ইয়াজভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্যালেন্তিন ভ্যারেন্নিকভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরি তুখারিনভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন বোরিস ৎকাচ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিক্তর এর্মাকভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন লিওনিদ জেনারেলভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ইগর রোদিয়োনভ
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভিক্তর দুবিনিন
সোভিয়েত ইউনিয়ন বোরিস গ্রোমোভ
আফগানিস্তান হাফিজুল্লাহ আমিন 
আফগানিস্তান বাবরাক কারমাল
আফগানিস্তান মুহম্মদ নাজিবুল্লাহ
আফগানিস্তান আব্দুল রাশিদ দোস্তাম
আফগানিস্তান আব্দুল কাদির
আফগানিস্তান শাহনওয়াজ তানাই
আফগানিস্তান মোহাম্মেদ রাফি

বুরহানউদ্দিন রাব্বানী
আহমদ শাহ মাসুদ
আবদুল্লাহ ইউসুফ আযযাম
ইসমাইল খান
জালালউদ্দিন হাক্কানী
গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার
আব্দুল হক
ইউনুস খালিস
আহমেদ গিলানি
নকিব আলীকোজাই
আব্দুল রহিম ওয়ারদাক
ফজল হক মুজাহিদ
ওসামা বিন লাদেন


মুহম্মদ আসিফ মুহসিনি
আসিফ কান্দাহারি
সৈয়দ আলী বেগেশতি
মোসবাহ সা'দে
শক্তি
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১,১৫,০০০ সৈন্য
আফগানিস্তান ৫৫,০০০ সৈন্য
২,০০,০০০–২,৫০,০০০
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৪,৪৫৩ সৈন্য নিহত
৫৩,৭৫৩ সৈন্য আহত
২৬৪ সৈন্য নিখোঁজ
১৪৭টি ট্যাঙ্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত
১,৩১৪টি আইএফভি/এপিসি ধ্বংসপ্রাপ্ত
৪৩৩টি কামান ও মর্টার ধ্বংসপ্রাপ্ত
১১,৩৬৯টি মালবাহী ও জ্বালানিবাহী ট্রাক ধ্বংসপ্রাপ্ত
১১৮টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত
৩৩৩টি হেলিকপ্টার ধ্বংসপ্রাপ্ত
আফগানিস্তান ১৮,০০০ সৈন্য নিহত
৭৫,০০০–৯০,০০০ যোদ্ধা নিহত
৭৫,০০০+ যোদ্ধা আহত
পাকিস্তান ৩০০+ সৈন্য নিহত
১টি যুদ্ধবিমান ধ্বংসপ্রাপ্ত
ইরান অজ্ঞাতসংখ্যক সৈন্য নিহত
২টি হেলিকপ্টার ধ্বংসপ্রাপ্ত
৫,০০,০০০–১৫,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ নিহত
প্রায় ৩০,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ আহত
প্রায় ৫০,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ আফগানিস্তানের বাইরে উদ্বাস্তু
প্রায় ২০,০০,০০০ বেসামরিক মানুষ আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু

সোভিয়েত–আফগান যুদ্ধ ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নআফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং আফগান মুজাহিদদের মধ্যে সংঘটিত হয়। ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য প্রবেশের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধ আরম্ভ হয়, আর ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে প্রায় ৬ থেকে ২০ লক্ষ আফগান প্রাণ হারায়, যাদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক নাগরিক।

সোভিয়েত সৈন্যদের প্রবেশের আগে ১৯৭৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিডিপিএ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং নূর মুহম্মদ তারাকী রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। দলটি দেশজুড়ে প্রচলিত ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করে কার্ল মার্কস এর কমিউনিজম আগ্রাসনের সূচনা করে, যা ধর্মপ্রাণ গ্রাম্য জনসাধারণ এবং প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার কাঠামোর অধিকারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ এর জন্ম দেয়। আফগান সরকার কঠোরভাবে বিরোধিতা দমন করে, হাজার হাজার লোককে গ্রেপ্তার করে এবং প্রায় ২৭,০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকগুলো সরকারবিরোধী সশস্ত্র দল গঠিত হয় এবং ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তানের বড় একটি অংশ জুড়ে বিদ্রোহ দেখা দেয়। তদুপরি, আফগান সরকার অন্তদ্বন্দ্বের কারণে অস্থিতিশীল ছিল এবং ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে হাফিজুল্লাহ আমিনের সমর্থকেরা তারাকীকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমিনকে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করে। আফগান কমিউনিস্ট শাসকদের দ্বারা কমিউনিজম এর স্বার্থ পুরোপরিভাবে উদ্ধার না হওয়ায় এবং আফগানিস্তানে ব্যাপক বিদ্রোহের কারণে লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত ৪০তম আর্মি মোতায়েন করে। এর মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ আগ্রাসনের সূচনা হয়। রাজধানী কাবুলে পৌঁছানোর পর সোভিয়েত সৈন্যরা একটি অভ্যুত্থানের নাটক করে রাষ্ট্রপতি আমিনকে হত্যা করে এবং একটি প্রতিদ্বন্দ্বী উপদলের সদস্য সোভিয়েতপন্থী বাবরাক কারমালকে ক্ষমতায় বসায়।

১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ৩৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ আফগানিস্তান থেকে "সোভিয়েত সৈন্যদের তাৎক্ষণিক, জরুরি এবং নি:শর্ত প্রত্যাহারের" দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করে, অন্যদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪–১৮ ভোটে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়। আফগান বিদ্রোহীরা প্রতিবেশী পাকিস্তানচীনে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পারস্য উপসাগরীয় আরব রাজ্যগুলো থেকে বিপুল আর্থিক সহায়তা প্রাপ্ত হয়।

সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানের শহর ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলো দখল করে, অন্যদিকে মুজাহিদিনরা আফগানিস্তানের যে ৮০ শতাংশ ভূমি আফগান সরকার ও সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল সেসব অংশে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করে। সোভিয়েতরা আফগান বিদ্রোহী ও বেসামরিক জনগণকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করার জন্য বিমানশক্তি ব্যবহার করে, মুজাহিদিনদের নিরাপদ আশ্রয় লাভের সুযোগ না দেয়ার উদ্দেশ্য গ্রামের পর গ্রাম মাটিতে মিশিয়ে দেয়, সেচ খালগুলো ধ্বংস করে এবং লক্ষ লক্ষ ভূমি মাইন ছড়িয়ে দেয়।

১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যসংখ্যা ১,০৮,০০০-এ বর্ধিত করা হয় এবং দেশব্যাপী সংঘর্ষ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিপুল সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝিতে সংস্কারপন্থী নেতা মিখাইল গর্বাচেভের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ১৯৮৮ সালের ১৫ মে আফগানিস্তান থেকে চূড়ান্তভাবে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহার আরম্ভ হয় এবং ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়। এই যুদ্ধের দীর্ঘ ব্যাপ্তির জন্য এটিকে কখনো কখনো পশ্চিমা গণমাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনাম যুদ্ধ বা ভল্লুকের ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করা হয়, এবং যুদ্ধটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

পটভূমি[সম্পাদনা]

১৮৮৫ সালে রুশ সৈন্যরা অক্সাস নদীর দক্ষিণ তীরে পাঞ্জদেহ অঞ্চলে একটি বিরোধপূর্ণ মরূদ্যান আফগান সৈন্যদের কাছ থেকে দখল করে নেয়, এবং এই ঘটনাটি পাঞ্জদেহ ঘটনা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৮৫–১৮৮৭ সালের ইঙ্গ-রুশ যৌথ আফগান সীমান্ত কমিশন রাশিয়া ও আফগানিস্তানের মধ্যবর্তী সীমানা নির্দিষ্ট করে। সোভিয়েত আমলেও এ অঞ্চলে রুশ আগ্রহ বজায় থাকে, এবং ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানকে শত শত কোটি ডলার সমমূল্যের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করে[১]

১৯৭৮ সালের সাউর বিপ্লবের পর ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নতুন সরকার দরিদ্র-অভিমুখী, কৃষক-অভিমুখী এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনার অধিকারী ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে নতুন আফগান সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ১৯৭৮ সালের ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়[২]

১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত অ্যাডলফ ডাবসকে সেতামি মিল্লি জঙ্গিরা অপহরণ করে এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত উপদেষ্টাদের সহযোগিতায় আফগান পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করলে গোলাগুলিতে তিনি নিহত হন। ডাবসের মৃত্যু মার্কিন–আফগান সম্পর্কের অবনতি ঘটায়।

আফগানিস্তানের ঘটনাবলি চলাকালে দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানি বিপ্লবের ফলে মার্কিন-সমর্থিত ইরানের শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন, যার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি অন্যতম শক্তিশালী মিত্ররাষ্ট্রকে হারায়। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারস্য উপসাগর ও আরব সাগরে ২টি বিমানবাহী রণতরীসহ ২০টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে অবিরত হুমকি-ধামকি চলতে থাকে। ১৯৭৯ সালের মার্চে ইসরায়েলমিসরের মধ্যে মার্কিন মধ্যস্থতায় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ এই চুক্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় সুবিধা বলে বিবেচনা করেন। তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের কাছে ৫,০০০ এরও বেশিসংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করে। এছাড়া ইরাকের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগেকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরও অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৭৮ সালের জুনে ইরাক পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে এবং ফরাসি ও ইতালীয় অস্ত্র ক্রয় করতে আরম্ভ করে, যদিও তখনও ইরাকের বেশিরভাগ অস্ত্রশস্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন, ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলো এবং চীন থেকেই আসত।

সাউর বিপ্লব[সম্পাদনা]

১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাদশাহ মুহম্মদ জহির শাহ আফগানিস্তান শাসন করেন। তার চাচাতো ভাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহম্মদ দাউদ খান ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এসময় মার্ক্সবাদী পিডিপিএ-এর শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। ১৯৬৭ সালে পিডিপিএ নূর মুহম্মদ তারাকীহাফিজুল্লাহ আমিনের নেতৃত্বাধীন খালক (জনতা) এবং বাবরাক কারমালের নেতৃত্বাধীন পারচাম (পতাকা) নামক দুইটি উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে[৩]

জহির শাহের সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টির অভিযোগ উঠলে ১৯৭৩ সালের ১৭ জুলাই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দাউদ এই সুযোগে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। দাউদ আফগানিস্তানে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটান এবং তার শাসন আফগান জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কিন্তু পিডিপিএ-এর সমর্থকদের নিতট দাউদের শাসন জনপ্রিয় ছিল না।

দাউদের সরকার কর্তৃক পিডিপিএ সদস্যদের ওপর চালানো নিপীড়ন এবং পিডিপিএ-এর একজন প্রথম সারির নেতা মীর আকবর খাইবারের রহস্যজনক মৃত্যু পিডিপিএ-র উভয় উপদলকে দাউদের সরকারের চরম বিরোধী করে তোলে[৪]। খাইবারে রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনার পর কাবুলে দাউদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে আফগান কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজন পিডিপিএ নেতাকে গ্রেপ্তার করে[৫]

১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল পিডিপিএ-এর প্রতি সহানুভূতিশীল আফগান সেনাবাহিনীর সদস্যরা দাউদের সরকারকে উৎখাত করে এবং দাউদ সপরিবারে নিহত হন[৬]। পিডিপিএ-এর মহাসচিব নূর মুহম্মদ তারাকী নবগঠিত আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বিপ্লবী পরিষদের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

পিডিপিএ-এর অভ্যন্তরে অন্তর্দ্বন্দ্ব[সম্পাদনা]

বিপ্লবের পর তারাকী আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী এবং পিডিপিএ-এর মহাসচিব পদে আসীন হন। আফগান সরকার রাষ্ট্রপ্রধান তারাকী ও উপ-প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিনের নেতৃত্বে 'খালক' এবং বাবরাক কারমালমুহম্মদ নাজিবুল্লাহর নেতৃত্বাধীন 'পারচাম' এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পিডিপিএ-র এই অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে পারচাম উপদলের সদস্যদের কেউ কেউ নির্বাসিত হন, কেউ কেউ দল থেকে বহিষ্কৃত হন এবং কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়[৭]

পিডিপিএ-এর শাসনকালের প্রথম ১৮ মাসে আফগান সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুকরণে একটি আধুনিকায়ন ও সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে, যেগুলোর বেশিরভাগই আফগান রক্ষণশীলরা ইসলামবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করেন[৮]। বিবাহ প্রথার পরিবর্তন এবং ভূমি সংস্কার সংক্রান্ত অধ্যাদেশগুলো কট্টর ইসলামপন্থী আফগান জনসাধারণের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি, এবং সুদপ্রথা নিষিদ্ধকরণ ও কৃষকদের ঋণ বাতিল করায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ক্ষমতাশালী জমিদাররাও সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হয় (যদিও খোদ ইসলামেই সুদপ্রথা হারাম)। নতুন সরকার নারীদের অধিকারও বৃদ্ধি করে, নিরক্ষরতা দূরীকরণে সচেষ্ট হয় এবং আফগানিস্তানের জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার প্রদান করে, যদিও এসব প্রকল্পের ফলাফল কেবল শহরাঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে প্রতীয়মান হয়[৯]। ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ শুরু হয়। পূর্ব আফগানিস্তানের নূরিস্তান প্রদেশে বিদ্রোহীরা স্থানীয় সেনানিবাস আক্রমণ করে এবং শীঘ্রই সমগ্র দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে উপ-প্রধানমন্ত্রী হাফিজুল্লাহ আমিন রাষ্ট্রপ্রধান তারাকীকে গ্রেপ্তার ও হত্যা করেন এবং শাসনক্ষমতা দখল করেন। আমিন পিডিপিএ-র অভ্যন্তরে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের এবং ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা বিদ্রোহীদের কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা চালান, যার ফলে তার শাসনামলে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য তীব্রতর হয়ে ওঠে।

আফগান–সোভিয়েত সম্পর্ক[সম্পাদনা]

১৯৫০-এর দশকে আফগানিস্তান স্কাউট অ্যাসোসিয়েশন

সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দরিদ্রতর ও ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। দেশটি আফগানিস্তানের সামরিক-বেসামরিক অবকাঠামো থেকে সমাজব্যবস্থা পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িত ছিল[১০]। ১৯৪৭ সাল থেকে আফগানিস্তান সোভিয়েত সরকারের প্রভাবাধীন ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রচুর পরিমাণে অনুদান, অর্থনৈতিক সহায়তা, সামরিক সরঞ্জাম এবং সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করে। অবশ্য রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৯ সালেই সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও অনুদান প্রদান করেছিল। তৃতীয় ইঙ্গ–আফগান যুদ্ধের সময় সোভিয়েত সরকার আফগানিস্তানকে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, কয়েকটি যুদ্ধবিমান এবং ১০ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা (স্বর্ণ রুবল) প্রদান করে। ১৯৪২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার আগ্নেয়াস্ত্র ও যুদ্ধবিমান সরবরাহ এবং তাসখন্দে প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আফগান সশস্ত্রবাহিনীকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হয়। ১৯৫৬ সাল থেকে নিয়মিতভাবে সোভিয়েত-আফগান সামরিক সহযোগিতা আরম্ভ হয় এবং ১৯৭০-এর দশকে দেশ দু'টির মধ্যে আরও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে সামরিক উপদেষ্টা ও বিশেষজ্ঞদের প্রেরণ করে।

১৯৭৮ সালে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার পর আফগান রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ দাউদ খান আফগান রাজনীতিতে পাকিস্তানইরানের প্রভাব হ্রাস করার জন্য একটি সামরিকীকরণ প্রকল্প আরম্ভ করেন। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত একটি চূড়ান্ত চুক্তি অনুযায়ী আফগান সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তা দাবি করার অধিকার লাভ করে[১১]