সাংস্কৃতিক বিপ্লব

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সাংস্কৃতিক বিপ্লব
পিপলস লিবারেশন আর্মির একদল সৈন্যের উপরে মাও সেতুংকে চিত্রিত করা প্রোপাগান্ডা পোস্টার। শিরোনামে লেখা, "চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি হচ্ছে মাও সেতুঙের চিন্তাধারার মহান বিদ্যালয়"।
অবস্থানগণপ্রজাতন্ত্রী চীন
উদ্দেশ্যপুঁজিবাদী ও প্রথাগত উপাদানগুলোকে নির্মূল করে সাম্যবাদ সংরক্ষণ এবং মাওবাদী ও বাস্তববাদীদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই।
ফলাফলঅর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থগিত, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানের ধ্বংস।
মৃতদশ হাজার থেকে কয়েক লক্ষ বেসামরিক নাগরিক, রেড গার্ড এবং সৈন্যের মৃত্যু (সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি)
সংগঠকমাও সেতুং
(চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি)
ক্ষয়ক্ষতিকনফুসিয়াসের সমাধি, স্বর্গমন্দির, মিং সমাধিসমূহ
গ্রেপ্তারচিয়াং চিং, চাং ছুনছিয়াও, ইয়াও ওয়েনইউয়ান, এবং ওয়াং হংওয়েন
সাংস্কৃতিক বিপ্লব
চীনা 文化大革命
আক্ষরিক অর্থ"সাংস্কৃতিক বিপ্লব"
Formal name
ঐতিহ্যবাহী চীনা 無產階級文化大革命
সরলীকৃত চীনা 无产阶级文化大革命
আক্ষরিক অর্থ"মহান প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব"

সাংস্কৃতিক বিপ্লব, আনুষ্ঠানিক নাম মহান প্রলেতারীয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব, ১৯৬৬ সালে মাও সেতুং দ্বারা সূচিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের (গণচীন) একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল যা ১৯৭৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।[১] এই বিপ্লবের উল্লিখিত লক্ষ্য ছিল চীনা সাম্যবাদকে রক্ষা করা এবং চীনা সমাজ থেকে পুঁজিবাদীপ্রথাগত উপাদানের অবশিষ্টাংশ নির্মূল করা। বিপ্লবটি মাও-নেতৃত্বাধীন গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড বিপর্যয় এবং চীনের মহাদুর্ভিক্ষের (১৯৫৯-১৯৬১) পর আত্মসংযম এবং স্বল্প উগ্র নেতৃত্বে অর্পণের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে মাও-এর কার্যকর নেতৃত্বস্থানীয় প্রত্যাবর্তনকে নির্দেশ করে–যিনি তখনও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) সভাপতি ছিলেন। যাইহোক, বিপ্লবটি তার মূল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।

১৯৬৬ সালের মে মাসে সাংস্কৃতিক বিপ্লব দলের সহায়তায় আন্দোলনটির সূচনা করে, মাও অভিযোগ তোলেন যে পুঁজিবাদ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে বুর্জোয়া উপাদানগুলো সরকার ও সমাজে অনুপ্রবেশ করছে। মাও যুবকদেরকে "সদরদপ্তরে বোমাবর্ষণ" করার আহ্বান জানান এবং ঘোষণা করেন যে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে "বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত"। যুবকরাও সারা দেশে বিভিন্ন রেড গার্ড গঠন করে সাড়া প্রদান করে। মাও-এর বাণীগুলোর একটি নির্বাচিন লিটল রেড বুক-এর মধ্যে সংকলিত হয়, যা মাও-এর ব্যক্তি পূজার জন্য একটি পবিত্র পাঠ্য হয়ে উঠে। রেড গার্ড নিয়মিত সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে "নিন্দা সমাবেশ" করে এবং স্থানীয় সরকার ও সিসিপি শাখা থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়, অবশেষে ১৯৬৭ সালে বিপ্লবী কমিটিগুলো প্রতিষ্ঠা করে। কমিটিগুলো প্রায়শই প্রতিদ্বন্দ্বী দলে বিভক্ত হয়ে "হিংসাত্মক সংগ্রাম" নামে পরিচিত সশস্ত্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়তো এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনী পাঠাতে হতো। পিপলস লিবারেশন আর্মির একজন কর্মকর্তা লিন পিয়াও সামরিক হস্তক্ষেপের পর সহ-সভাপতি এবং মাও-এর উত্তরসূরি হিসেবে পদোন্নতি পান, কিন্তু মাওয়ের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত হন, পালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত। ১৯৭২ সালে, গ্যাং অফ ফোর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৬ সালে মাও-এর মৃত্যু ও গ্যাং অফ ফোর গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত সাংস্কৃতিক বিপ্লব অব্যাহত ছিল।

সাংস্কৃতিক বিপ্লব কেবল সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা দ্বারা বৈশিষ্ট্যযুক্ত। বিপ্লবে মৃতের সংখ্যার দাবি নিয়ে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে, যাঁরা প্রাণ হারান তাঁদের সংখ্যা দশ হাজার থেকে কয়েক লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। বেইজিংয়ের রেড আগস্ট থেকে শুরু করে দেশব্যাপী গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে গুয়াংশি গণহত্যা, যেখানে ব্যাপক নরমাংস ভক্ষণের ঘটনাও ঘটেছিল; আন্তঃমঙ্গোলিয়ার ঘটনা; গুয়াংদং গণহত্যা; ইউনান গণহত্যা; এবং হুনান গণহত্যা। রেড গার্ডরা ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ ও শিল্পকর্ম ধ্বংস করে ফেলে, সেইসাথে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় স্থানগুলোতেও লুটপাট করে। ১৯৭৫ সালের বানছিয়াও বাঁধ ধ্বস বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তিগত বিপর্যয়গুলোর মধ্যে একটি, যা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ই ঘটেছিল। অপরদিকে, বিপ্লবে এক লক্ষাধিক মানুষ নির্যাতিত হয়: বিশেষ করে চীনা রাষ্ট্রপতি লিউ শাওছি, তেং শিয়াওফিং, ফেং তেহুয়াই এবং হে লং-এর মতো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্মূল বা দেশছাড়া করা হয়; লক্ষাধিক মানুষকে পাঁচটি কালো শ্রেণীর সদস্য হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, যাঁরা জনসাধারণের অবমাননা, কারাবাস, নির্যাতন, কঠোর শ্রম, সম্পত্তি দখল, এবং কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ড বা হয়রানিতে আত্মহত্যার শিকার হয়; বুদ্ধিজীবীদের "নবম দুর্গন্ধযুক্ত বৃদ্ধ" হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং ব্যাপকভাবে নির্যাতনের শিকার হত–লাও শে, ফু লেই, ইয়াও থোংপিন এবং চাও চিউহাং-এর মতো উল্লেখযোগ্য পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীরা নির্যাতনের ফলে নিহত হন বা আত্মহত্যা করেন। কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। ডাউন টু দ্য কান্ট্রিসাইড আন্দোলনে ১ কোটিরও বেশি শহুরে বুদ্ধিজীবী যুবকদের গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে, হুয়া কুওফেং-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে তেং শিয়াওফিং চীনের নতুন সর্বপ্রধান নেতা হন এবং "পোলুয়ান ফানচেং" কার্যক্রম চালু করেন যা ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত মাওবাদী নীতিগুলোকে চূর্ণ করে দেয় এবং দেশটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে।[২][৩] অতঃপর তেং তাঁর মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে ঐতিহাসিক সংস্কার ও উন্মুক্তিকরণ কার্যক্রম চালু করে চীনে একটি নতুন যুগের সূচনা করেন। ১৯৮১ সালে, সিসিপি ঘোষণা করে এবং স্বীকার করে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ভুল ছিল এবং এটি চীনে "গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনগণ, দেশ ও দলের জন্য সবচেয়ে গুরুতর আঘাত এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতির জন্য দায়ী।"[৪][৫][৬] সমসাময়িক চীনে, সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত বিদ্যমান। কেউ কেউ একে "বিশৃঙ্খলার দশ বছর" (চীনা: শি নিয়ান তোংলুয়ান, 十年动乱; অথবা শি নিয়ান হাওচিয়ে, 十年浩劫) হিসেবে উল্লেখ করেন।[৭]

প্রেক্ষাপট[সম্পাদনা]

গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

১লা অক্টোবর ১৯৪৯-এ মাও সেতুং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ঘোষণা করেন, যার ফলে প্রতীকীভাবে কয়েক দশক যাবত চলয়া চীনের গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। অবশিষ্ট প্রজাতন্ত্রী বাহিনী তাইওয়ানে পলায়ন করে এবং বিভিন্ন উপায়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে প্রতিহত করতে থাকে। চীনা প্রজাতন্ত্রীদের অনেক সৈন্যকে চীনের মূল ভূখণ্ডে রয়ে যায়, এবং এই অবশিষ্ট সৈন্যদের ও সেইসাথে চীনা সমাজের উপাদানগুলিকে মাও সেতুং-এর নতুন সরকারের জন্য সম্ভাব্য বিপদ হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিবিপ্লবীদের দমন করার জন্য মাও অভিযান শুরু করেন। এটি ছিল সমগ্র চীন জুড়ে গণগ্রেফতার, আটক ও হত্যার প্রথমদেকে উদাহরণগুলোর একটি যা পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মাঝে প্রতিফলিত হয়।

গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড[সম্পাদনা]

নবনির্মিত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে একটি শিল্প পরাশক্তিতে পরিণত করার জন্য মাও সেতুং-এর প্রস্তাব অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়নের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অনুরূপ চীনে গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড বা সম্মুখগামী মহালম্ফ গৃহীত হয়। ১৯৫৮ সালের শুরুতে গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড অন্তত বাহ্যিকভাবে অবিশ্বাস্য শিল্পায়ন ঘটিয়েছিল, তবে আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে দুর্ভিক্ষের কারণও হয়েছিল, যদিও প্রত্যাশিত লক্ষ্যগুলো অর্জনে ব্যর্থ হয়। শীঘ্রই অনেকেই গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডকে মাও-এর অন্যতম বড় ভুল হিসেবে দেখতে শুরু করে, অবশেষে তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁর কিছু প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার মূল্য দিতে হয়।

গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের সময় রাতের বেলায় গ্রামাঞ্চলে লোকেরা ইস্পাত উৎপাদনে কাজ করছে, ১৯৫৮
এই যুগে চীনের গ্রামীণ জীবনের প্রধান যে পরিবর্তনগুলো ঘটে, তাঁর মধ্যে একটি ছিল ক্রমাগতভাবে বাধ্যতামূলক কৃষি সমবায়ীকরণের অবতারণা। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খামার করা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। যাঁরা ব্যক্তিগত খামার করত তাঁদেরকে নিপীড়ন করা হয়ে এবং "প্রতিবিপ্লবী" আখ্যা দেওয়া হয়। গ্রামীণ জনগণের উপর সামাজিক চাপ, জোড়পূর্বক শ্রম, কিংবা জনসম্মক্ষে প্রহসনমূলক বিচার ও সম্মানহানির মাধ্যমে নিয়মের কড়াকড়ি প্রয়োগ করা হয়।[৮] গ্রামীণ শিল্পায়ন, যা ছিল অভিযানের মূল লক্ষ্যগুলোর একটি, "সম্মুখগামী মহালম্ফের ত্রুটিগুলির জন্য...ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়"[৯] সম্মুখগামী মহালম্ফের বছরগুলোতে চীনে অর্থনৈতিক সংকোচন ঘটে। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কেবল এই পর্বেই চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল।[১০] রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ ডোয়াইট পার্কিন্স যুক্তি দেন যে "বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগের পরে উৎপাদনে অত্যন্ত অল্প কিংবা শূন্য বৃদ্ধি ঘটেছিল...সংক্ষেপে বলতে গেলে, সম্মুখগামী মহালম্ফ ছিল খুবই খরুচে একটি বিপর্যয়।"[১১]

আন্তর্জাতিক প্রভাব ও সংশোধনবাদ-বিরোধিতা[সম্পাদনা]

১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে গণচীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বিশ্বের দুটি বৃহত্তম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। যদিও প্রাথমিকভাবে তারা পরস্পর আন্তরিক ছিল, নিকিতা ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৬ সালে ক্রুশ্চেভ তাঁর পূর্বসূরি জোসেফ স্তালিন ও তাঁর নীতিসমূহের নিন্দা করেন এবং অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন শুরু করেন। মাও ও অন্যান্য অনেক সিসিপি সদস্য এই পরিবর্তনগুলোর বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে এসব কর্মকাণ্ড বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।[১২]:৪–৭

মাও বিশ্বাস করতেন যে ক্রুশ্চেভ একজন সংশোধনবাদী, যিনি মার্কসবাদী–লেনিনবাদী ধারণাগুলোকে পরিবর্তন করে ফেলেছেন, যার ফলে মাও দাবি করেছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুঁজিবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এর ফলে উভয় দেশের মাঝে সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনের জাতিসংঘে যোগদানের বিষয়টিকে সমর্থন করতে অস্বীকার করে এবং চীনকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহ করার অঙ্গীকার থেকে সরে আসে।[১২]:৪–৭

১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে মাও প্রকাশ্যে সংশোধনবাদের নিন্দা করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ইঙ্গিত না করে মাও সোভিয়েতদের বলকান মিত্র যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট লিগের সমালোচনা করেছিলেন। পরিবর্তে, সোভিয়েত ইউনিয়নের চীনের বলকান মিত্র আলবেনিয়ার শ্রমিক দলের সমালোচনা করে।[১২]:৪–৭ ১৯৬৩ সালে সিসিপি নয়টি সমালোচনামূলক রচনাবলি প্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিন্দা করতে শুরু করে। তন্মধ্যে একটির শিরোনাম ছিল ক্রুশ্চেভের জাল সাম্যবাদ এবং এ থেকে বিশ্বের ঐতিহাসিক শিক্ষার প্রতি, যেখানে মাও অভিযোগ করেছিলেন যে ক্রুশ্চেভ একজন সংশোধনবাদী এবং তাঁর কারণে পুঁজিবাদ পুনরুদ্ধারের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।[১২]:৪–৭ ১৯৬৪ সালে একটি অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থানের ফলে ক্রুশ্চেভের পদচ্যুতিতে মাও ভীত হন, মূলত গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের পর তাঁর ক্ষয়প্রাপ্ত প্রতিপত্তির কারণে।[১২]:৪–৭

অন্যান্য সোভিয়েত পদক্ষেপ চীনে সম্ভাব্য পঞ্চম বাহিনীর উত্থান সম্পর্কে উদ্বেগ বৃদ্ধি করছিল।[১৩](p141) চীন–সোভিয়েত বিভক্তি পরবর্তী উত্তেজনার ফলে সোভিয়েত নেতারা চীনে রেডিও সম্প্রচারে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে সোভিয়েত ইউনিয়ন "প্রকৃত কমিউনিস্টদের" সাহায্য করবে যাঁরা মাও ও তাঁর "ভুল পন্থা"কে উৎখাত করেছিল।[১৩](p141) উপরন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর ভিয়েতনামের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামরিক সংঘর্ষ চীনা নেতৃত্বকে ভীত করে তোলে, তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন যে চীনের সমর্থন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভাব্য চীনা সম্পদ অনুসন্ধানের দিকে পরিচালিত করতে পারে।[১৩](p141)

পূর্বাভাস[সম্পাদনা]

গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড সম্পর্কীয় কার্যক্রম ব্যর্থ হওয়ায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা ঘটে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ধনীক শ্রেণীর সদস্যদের বিতাড়নেও মাও চেষ্টা চালান। দল থেকে তাঁদেরকে বিতাড়িত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি সাম্যবাদী শিক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এ আন্দোলনটি ১৯৬২ থেকে শুরু হয়ে ১৯৬৫ সালে শেষ হয়। একই সময়ে বিদ্যালয়ের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা হয় ও ছাত্রদের শিক্ষার পাশাপাশি কারখানা ও দলে কাজ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। ধীরে ধীরে ১৯৬৫ সালে লিন পিয়াও, চিয়াং চিং ও ছেন পোতার সমর্থন নিয়ে মাও ক্ষমতার দিকে যাত্রা করেন।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

মাওয়ের সমর্থক ও তেং শিয়াওফিংয়ের সমর্থকের কারণে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে যায়। চীনের তরুণদের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে লিটল রেড বুক নামে মাওয়ের বক্তব্যমালা প্রকাশ করেন।[১] তরুণদেরকে নিয়ে গঠিত রেড গার্ডও জনপ্রিয়তা পায়। তাঁরা মাওয়ের বক্তব্যগুলোকে সর্বত্র প্রচার করতে থাকেন। এছাড়াও তাঁরা মাওয়ের বিরুদ্ধবাদীদের মারধর করতে থাকে ও বাড়ি-ঘর, যাদুঘর ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়।[১৪] অনেক জায়গাতেই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ও চীনে অরাজক পরিবেশের সৃষ্টি হয়।[১] বিপ্লবকালীন সময়ে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি চীনে জোরপূর্বক অবস্থান করতে বাধ্য হন। তন্মধ্যে রাষ্ট্রপ্রধান লিও শাওছি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব তেং শিয়াওফিং অন্যতম।[১৫]

উদ্দেশ্য[সম্পাদনা]

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী সংস্কৃতির জন্ম দেওয়া, প্রাচীন পুঁজিবাদী ও সামন্তীয় সংস্কৃতির বিলোপ সাধন করে সমগ্র সমাজে জ্ঞান ভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তির জাগরণ সৃষ্টি করা।[১৬] টেকসই সমাজতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণে সাংস্কৃতিক বিপ্লব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই তত্ত্বটি ভ্লাদিমির লেনিনের, এটিকে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে এক আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে মূল্যায়ন করেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে সাংস্কৃতিক বিপ্লব তেমন অগ্রসর না হলেও পরবর্তীকালে চীনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়।

পরবর্তী ঘটনাবলী[সম্পাদনা]

উত্তরণ যুগ[সম্পাদনা]

১৯৭৬ সালে মাওয়ের মৃত্যুর পর হুয়া কুওফেং চীনের নেতা হন। যদিও ১৯৭৬ সালে হুয়া প্রকাশ্যে গ্যাং অফ ফোরকে নিন্দা করেছিলেন, তবুও তিনি মাও-যুগের নীতিগুলোকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য মাও-এর নাম আহ্বান করতে থাকেন। হুয়ার নেতৃত্ব "দুইটি যা কিছু" নামে পরিচিতি লাভ করে,[১৭] যেগুলো হলো, "যা কিছু নীতি সভাপতি মাও থেকে উদ্ভুত, আমাদের অবশ্যই তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে", এবং "যা কিছু নির্দেশনা সভাপতি মাও আমাদের দিয়েছিলেন, আমাদের অবশ্যই তা অনুসরণ করতে হবে"। তেং শিয়াওফিং-এর মতোই হুয়াও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তেং চীনের জন্য নতুন অর্থনৈতিক মডেলের প্রস্তাব করতে চেয়েছিলেন, এর বিপরীতে হুয়া ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত-পদ্ধতির পরিকল্পনার দিকে চীনা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।[১৮][১৯]

হুয়ার কাছে এটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, তেং শিয়াওফিং ছাড়া রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে যাওয়া কঠিন ছিল। ১০ অক্টোবর, তেং শিয়াওফিং ব্যক্তিগতভাবে হুয়াকে একটি চিঠি লেখেন যাতে তিনি রাষ্ট্র ও দলীয় বিষয়ে তাঁকে পুনরায় ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন; দলের প্রবীণরাও তেং-কে ফেরানোর আহ্বান জানিয়েছেন। চারদিক থেকে ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী হুয়া ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে তেং-কে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত করেন এবং পরে তাঁকে অন্যান্য বিভিন্ন পদে উন্নীত করা হয়, যলে তেং কার্যকরভাবে চীনের দ্বিতীয়-সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সে বছর আগস্টে বেইজিংয়ে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১১ তম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে (পদমর্যাদা ক্রমে) হুয়া কুওফেং, ইয়ে চিয়ানিং, তেং শিয়াওফিং, লি শিয়াননিয়ান এবং ওয়াং তংশিং-কে পলিটব্যুরো স্থায়ী কমিটির নতুন সদস্য হিসাবে নামকরণ করা হয়।[২০]

তেং শিয়াওফিং কর্তৃক সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রত্যাখ্যান[সম্পাদনা]

১৯৭৮ সালে তেং শিয়াওফিং চীনের সর্বোচ্চ নেতা হন। তিনি "পোলুয়ান ফানচেং" সূচনা করেন, যা দেশকে পুনরায় শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং তিনি চীনের ঐতিহাসিক সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ কার্যক্রম শুরু করেন।

১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরে তেং শিয়াওফিং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভুলগুলো সংশোধন করার জন্য সর্বপ্রথম "পোলুয়ান ফানচেং" ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের মে মাসে তেং তাঁর অভিভাবক হু ইয়াওপাং-কে ক্ষমতায় উন্নীত করার সুযোগটি গ্রহণ করেন। হু দৈনিক কুয়াংমিং-এ একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি তেং-এর ধারণাটির প্রশংসা করার জন্য মাও-এর উদ্ধৃতিগুলোকে চতুরভাবে ব্যবহার করেন। এই নিবন্ধটি অনুসরণ করে, হুয়া তেং-এর সমর্থনে তাঁর সুর বদলাতে শুরু করেন। এরপর থেকে নানাভাবে মাওয়ের আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা এবং পোলুয়ান ফানচেং-এর ধারণাটিকে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রয়াস চালাতে থাকেন তেং। সে বছর ১লা জুলাইয়ে তেং গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের ব্যর্থতার বিষয়ে ১৯৬২ সালে মাওয়ের আত্ম-সমালোচনা বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বর্ধিত শক্তির সমর্থনে, তেং প্রকাশ্যে হুয়া কুওফেং-এর "দুইটি যা কিছু"র ধারণাটিকে আক্রমণ করতে শুরু করেন।[১৭]

১৯৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর, ১১ তম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেটি ছিল চীনের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সভায় তেং "চিন্তার স্বাধীনতা"কে আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং দলকে "প্রকৃত ঘটনা থেকে সত্য খোঁজার" এবং মতাদর্শগত মতবাদ ত্যাগ করার আহ্বান জানান। অধিবেশনটি আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক সংস্কার যুগের সূচনা করে এবং তেং চীনের সর্বোচ্চ নেতা হন। হুয়া কুওফেং আত্ম-সমালোচনায় জড়িত হন এবং তাঁর "দুইটি যা কিছু"কে একটি ভুল বলে অভিহিত করেন। মাওয়ের বিশ্বস্ত মিত্র ওয়াং তংশিং-এরও সমালোচনা করা হয়। অধিবেশনে কমিউনিস্ট পার্টি তিয়ানানমেনের ঘটনার উপর এর রায়কে পালটে ফেলে। এছাড়াও পার্টি বিপ্লবের সময় অপমানিত প্রাক্তন চীনা রাষ্ট্রপতি লিউ শাওছির একটি বিলম্বিত রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজনের অনুমতি প্রদান করে।[২১] চীনের দশজন মার্শালের একজন এবং প্রথম জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফেং তেহুয়াই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন; তাঁকেও ১৯৭৮ সালে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন দেওয়া হয়।

১৯৮০ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম অধিবেশনে, ফেং চেন, হে লং এবং অন্যান্য নেতাদের যাঁদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নির্মূল করা হয়েছিল তাঁদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন দেওয়া হয়। হু ইয়াওফাং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সম্পাদকীয় পরিষদের প্রধান হন। সে বছর সেপ্টেম্বরে, হুয়া কুওফেং পদত্যাগ করেন এবং দেংয়ের আরেক সহযোগী চাও সি ইয়াংকে চীনের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয়। তেং কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন, কিন্তু আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা বাস্তববাদী সংস্কারকদের নতুন প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল, যাঁরা পোলুয়ান ফানচেং-এর সময়কালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নীতিগুলিকে অনেকাংশে পালটে দিয়েছিলেন। ১৯৭৮ থেকে কয়েক বছরের মধ্যে, তেং শিয়াওফিং ও হু ইয়াওপাং সাংস্কৃতিক বিপ্লবে ৩০ লাখের বেশি "অন্যায়, মিথ্যা, ভ্রান্ত" মামলায় অভিযুক্তদের পুনর্বাসনে সহায়তা করেছিলেন।[২২] বিশেষ করে ১৯৮০ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত বেইজিংয়ে গ্যাং অফ ফোর-এর বিচার হয়েছিল এবং আদালত জানায় যে ৭,২৯,৫১১ জন লোক গ্যাং দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে ৩৪,৮০০ জন মারা গেছে বলে জানা গেছে।[২৩]

১৯৮১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি প্রস্তাব পাস করে এবং ঘোষণা করে যে সাংস্কৃতিক বিপ্লব "গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনগণ, দেশ ও দলের জন্য সবচেয়ে গুরুতর আঘাত এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতির জন্য দায়ী।"[৪][৫][৬]

প্রভাব[সম্পাদনা]

১৯৬৮ সালে বেইজিংয়ের একটি মানচিত্র যেখানে দেখানো হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় পুনঃনামকৃত সড়ক ও স্থাপনাসমূহ। আন্দিংমেন আন্তঃসড়কের নাম হলো "সম্মুখগামী মহালম্ফ সড়ক", তাইচিছাং সড়কের নাম হলো "চিরন্তন বিপ্লবের সড়ক", তংচিয়াওমিনশিয়াং-এর নাম হলো "সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সড়ক", পেইহাই পার্কের নাম হলো "শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক পার্ক" এবং চিংশান পার্কের নাম হলো "লাল প্রহরী পার্ক।" সাংস্কৃতিক বিপ্লব যুগের অধিকাংশ নামই পরবর্তীতে পালটে ফেলা হয়।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে চীনে অনেক ধরনের সমস্যার তৈরি হয়। কলকারখানায় নিযুক্ত কর্মীরা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ায় উৎপাদন বেশ কমতে থাকে। এছাড়াও কর্মরত ব্যক্তিরা জানতো না যে কী কারণে তাঁরা বিপ্লবে সামিল হয়েছে। পরিবহন ব্যবস্থায়ও এর প্রভাব পড়ে। অনেক রেলগাড়ি দেশের সর্বত্র রেড গার্ডদের জন্য ব্যবহার করা হয়। বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলীদেরকে কারাগারে প্রেরণ করা হয় কিংবা খামারের কাজে নিযুক্ত করা হয়। এর ফলে তাঁদের জ্ঞান বিফলে যায়। এ ধরনের পরিবর্তনের কারণে চীনের শিল্পজাত দ্রব্য উৎপাদন ১৪ শতাংশে নেমে যায়।[২৪]

শিক্ষা[সম্পাদনা]

ইয়াও তংপিং, চীনের অন্যতম প্রধান ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় (১৯৬৮) বেইজিংয়ে জনতার একটি গণপিটুনিতে মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে চৌ এনলাই প্রধান প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞদের জন্য বিশেষ সুরক্ষার আদেশ দেন।[২৫]
১৯৬৭ সালে বেইজিং নং. ২৩ মিডল স্কুলের একটি শ্রেণিকক্ষ। সেই সময় শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরে যেতে এবং "পুনরায় ক্লাস শুরু করার পাশাপাশি বিপ্লব চালিয়ে যাওয়ার" নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।[২৬] পিছনের ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা রয়েছে "অভিযোগ ও সংশোধনবাদী শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করার জন্য সভা"।

অনেক চীনাদের শিক্ষাজীবন দ্রুততম সময়ে শেষ হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানের তুলনায় শহরগুলোতেই শিক্ষা পদ্ধতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও, 'তরুণদেরকে প্রেরণ করো' শিরোনামে পরিকল্পনা গ্রহণ করায় শিক্ষাজীবন বাঁধাগ্রস্ত হয়। ঐ পরিকল্পনায় শিক্ষার্থীদেরকে শহর থেকে দেশের সর্বত্র প্রেরণ করা হয়েছিল।[২৭]

কুটনৈতিক সম্পর্ক[সম্পাদনা]

জাকার্তায় চীনা দূতাবাস পুড়িয়ে দেওয়া

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পাশাপাশি কমিউনিস্ট মতাদর্শ রপ্তানি করে, পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সাম্যবাদী দলগুলোকে সমর্থন দেয়–ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার এবং বিশেষ করে কম্বোডিয়ার খেমার রুজ, যা কম্বোডিয়ার গণহত্যার জন্য দায়ী।[২৮] এটি মনে করা হয় যে খেমার রুজের প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের অন্তত ৯০% চীন থেকে এসেছিল এবং কেবল ১৯৭৫ সালেই ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সুদ-মুক্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য ও ২ কোটি মার্কিন ডলার চীন থেকে উপহার হিসেবে দিতে দেখা যায়।[২৯] সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় তা ১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামকে সহায়তা করার জন্য চীনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, যার ফলে এক সময়ের মিত্র দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়।[৩০]

সেসময় চীনের সাথে কূটনৈতিক বা অর্ধ-কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারী ৪০ টিরও বেশি দেশের মধ্যে প্রায় ৩০ টি দেশ চীনের সাথে কূটনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়ে–এমনকি মধ্য আফ্রিকা, ঘানাইন্দোনেশিয়াসহ কিছু দেশ চীনের সাথে তাঁদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।[৩১]

  • রেড গার্ডরা বেইজিংয়ে ব্রিটিশ লিগেশনে প্রবেশ করে এবং তিনজন কূটনীতিক ও একজন সচিবকে মারধর করে, পরে আগুন লাগিয়ে দেয়। পিআরসি কর্তৃপক্ষ এই কর্মের নিন্দা জানাতে রাজি হয় নি। সাংহাইয়ে একটি পৃথক ঘটনায় ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল, কারণ পিআরসি কর্তৃপক্ষ সেখানে অফিসটি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল।[৩২]
  • রেড গার্ডরা সোভিয়েত, ফরাসি ও ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাস অবরোধ করে এবং মঙ্গোলীয় রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।[৩৩]
  • বিদেশে চীনা দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোর সাহায্যে সিসিপি মাও-এর জন্য বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা শুরু করে, যেমন স্থানীয় নাগরিকদের কাছে লিটল রেড বুক ও সভাপতি মাও ব্যাজ পাঠানো হয়।[৩১]
  • চীনের অনেক রাষ্ট্রদূত ও কনসালকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে জড়িত থাকার জন্য চীনে ফেরত ডাকা হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ২য় পররাষ্ট্রমন্ত্রী চেন ইয়ের মতো সিনিয়র কর্মকর্তারা বিপ্লবের সময় নির্যাতিত হয়েছিলেন।[৩৪][৩৫]
  • অনেক বিদেশী অতিথিকে অন্যান্য চীনা নাগরিকদের মতোই মাও সেতুং-এর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে, লিটল রেড বুক ধরে রেখে এবং মাওকে "সম্মান" করতে "বাধ্য" করা হয়েছিল।[৩৬]

মূল্যায়ন[সম্পাদনা]

এই দেয়ালটির কেন্দ্রীয় অংশে একটি প্রচারমূলক স্লোগানের ক্ষীণ অবশিষ্ট চিহ্নগুলো দেখা যায় যা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় করা হয়েছিল, কিন্তু তারপর সরানো হয়েছে। স্লোগানটি ছিল "সভাপতি মাওয়ের প্রতি সীমাহীন বিশ্বাস।"

মে, ১৯৬৬ সালে ধীরে ধীরে শুরু হওয়া এ বিপ্লবটি ১৯৬৯ সালে শেষ হয়। নবম জাতীয় পার্টি কংগ্রেসের এক সভায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তা স্বত্ত্বেও ১৯৭১ সালে সামরিক কর্মকর্তা লিন পিয়াওয়ের দেহাবসান পর্যন্ত এর প্রভাব সক্রিয় ছিল। মাওয়ের দেহাবসানের পর গ্যাং অফ ফোরকে ১৯৭৬ সালে গ্রেফতার করা হয়। ডিসেম্বর ১৯৭৮ সালে সংস্কারপন্থী তেং শিয়াওফিং চীনের নেতৃত্বে আসার পর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সাথে সম্পৃক্ত মাওয়ের নীতিগুলো অপসারণ কার্যের সূচনা ঘটে, যা পোলুয়ান ফানচেং নামে পরিচিত। ১৯৮১ সালে পার্টি ঘোষণা করে যে, সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীন গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দল, দেশ ও ব্যক্তিকে অনেক পিছিয়ে নিয়েছে ও গুরুতর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।[৩৭]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. People's Republic of China: III. Retrieved on 2009-9-12.
  2. Bradsher, Keith; Wellman, William J. (২০০৮-০৮-২০)। "Hua Guofeng, Transitional Leader of China After Mao, Is Dead at 87"The New York Times (ইংরেজি ভাষায়)। আইএসএসএন 0362-4331। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-১৬ 
  3. Barmé, Geremie R.। "History for the Masses"Morning Sun। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৩-১৬ 
  4. "关于建国以来党的若干历史问题的决议"The Central People's Government of the People's Republic of China (চীনা ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ২৩, ২০২০ 
  5. "Resolution on Certain Questions in the History of Our Party since the Founding of the People's Republic of China" (পিডিএফ)Wilson Center। জুন ২৭, ১৯৮১। 
  6. Sixth Plenary Session of the 11th Central Committee of the Chinese Communist Party. June 27, 1981. "Resolution on Certain Questions in the History of Our Party Since the Founding of the People's Republic of China." Resolution on CPC History (1949–81). Beijing: Foreign Languages Press. p. 32.
  7. Lu, Xing (২০০৪)। Rhetoric of the Chinese Cultural Revolution: The Impact on Chinese Thought। পৃষ্ঠা 2। Known to the Chinese as the ten years of chaos [...] 
  8. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; সম্মুখগামী মহালম্ফ mirsky নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  9. Perkins, Dwight (1991). "China's Economic Policy and Performance". Chapter 6 in The Cambridge History of China, Volume 15, ed. by Roderick MacFarquhar, John K. Fairbank and Denis Twitchett. Cambridge University Press.
  10. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ১৬ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ 
  11. Perkins (1991). pp. 483–486 for quoted text, p. 493 for growth rates table.
  12. MacFarquhar, Roderick; Schoenhals, Michael (২০০৬)। Mao's Last Revolution। Harvard University Press। আইএসবিএন 978-0-674-02332-1 
  13. Meyskens, Covell F. (২০২০)। Mao's Third Front: The Militarization of Cold War China। Cambridge, United Kingdom: Cambridge University Pressআইএসবিএন 978-1-108-78478-8এসটুসিআইডি 218936313ওসিএলসি 1145096137ডিওআই:10.1017/9781108784788 
  14. Red Guards. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৬ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে ThinkQuest. Retrieved on 2009-9-12
  15. Butterfield, Fox (1976-9-10), Mao Tse-Tung: Father of Chinese Revolution, সংগ্রহের তারিখ 2009-9-12  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ=, |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  16. সাদি, অনুপ (ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)। "সাংস্কৃতিক বিপ্লব"। সমাজতন্ত্রঢাকা: ভাষাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ৬১–৬৪। আইএসবিএন 978-9849101383  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য);
  17. Harding, Harry. [1987] (1987). China's Second Revolution: Reform after Mao. Brookings Institution Press. আইএসবিএন ০-৮১৫৭-৩৪৬২-X
  18. Rozman, Gilbert. 2014. The Chinese Debate about Soviet Socialism, 1978–1985. Princeton: Princeton University Press. pp. 63–68. আইএসবিএন ৯৭৮-১৪০০৮৫৮৫৯০.
  19. Ferdinand, Peter. 1986. "China." pp. 194–204 in Leadership and Succession in the Soviet Union, Eastern Europe, and China, edited by M. McCauley and S. Carter. Armonk, NY: M. E. Sharpe.
  20. Basic Knowledge about the Communist Party of China: The Eleventh Congress ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত জুন ২৪, ২০০৭ তারিখে
  21. Andrew, Christopher. Mitrokhin, Vasili. [2005] (2005). The World was Going Our Way: The KGB and the Battle for the Third World. Basic Books Publishing. আইএসবিএন ০-৪৬৫-০০৩১১-৭
  22. "胡耀邦同志领导平反"六十一人案"追记"www.hybsl.cn (চীনা ভাষায়)। People's Daily। জুন ১, ১৯৮৯। জানুয়ারি ৩, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০ 
  23. James P. Sterba, The New York Times, January 25, 1981
  24. /r-2713.html China: Events During the Cultural Revolution Decade, 1966-76 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ এপ্রিল ২০০৬ তারিখে. Retrieved on 2009-9-12.
  25. Stokes, Mark A. (জুলাই ২০০৩)। "The People's Liberation Army and China's Space and Missile Development"। Laurie Burkitt; Andrew Scobell; Larry WortzelThe Lessons of History: The Chinese people's Liberation Army at 75 (পিডিএফ)Strategic Studies Institute। পৃষ্ঠা 198। আইএসবিএন 978-1-58487-126-2। ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ জানুয়ারি ১১, ২০২২ 
  26. Wu, Yiching (২০১৪)। The cultural revolution at the margins : Chinese socialism in crisis। Cambridge, Mass.: Harvard University Press। পৃষ্ঠা 145। আইএসবিএন 978-0-674-41985-8ওসিএলসি 881183403 
  27. Giles, John; Park, Albert; Wang, Meiyan (April 2007), সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি (পিডিএফ), ২০১০-০৬-০৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা, সংগ্রহের তারিখ 2009-9-12  অজানা প্যারামিটার |Title= উপেক্ষা করা হয়েছে (|title= ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য); এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  28. "When Pol Pot lounged by Mao's pool: how China exported Maoism"South China Morning Post। মার্চ ৮, ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১, ২০২০ 
  29. Laura, Southgate (২০১৯)। ASEAN Resistance to Sovereignty Violation: Interests, Balancing and the Role of the Vanguard State। Policy Press। আইএসবিএন 978-1-5292-0221-2 
  30. Path, Kosal (১৮ এপ্রিল ২০১১)। "The economic factor in the Sino-Vietnamese split, 1972–75: An analysis of Vietnamese archival sources"Cold War History11 (4): 519–555। এসটুসিআইডি 155036059ডিওআই:10.1080/01446193.2010.512497। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০২৩ 
  31. Huang, Hua (ডিসেম্বর ৬, ২০১৪)। "文革时期的荒诞外交"Ai Si Xiang (爱思想) (চীনা ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১, ২০২০ 
  32. Harold Munthe-Kaas; Pat Healy (২৩ আগস্ট ১৯৬৭)। "Britain's Tough Diplomatist in Peking"The Times। London। পৃষ্ঠা 6। আইএসএসএন 0140-0460 
  33. "The Cultural Revolution: All you need to know about China's political convulsion"TheGuardian.com। মে ১১, ২০১৬। 
  34. Curran, Thomas D. (২০০০)। "Chinese Foreign Policy during the Cultural Revolution (Book Review)"History Faculty Publications 
  35. Gurtov, Melvin (১৯৬৯)। "The Foreign Ministry and Foreign Affairs during the Cultural Revolution"। The China Quarterly (40): 65–102। জেস্টোর 651980 
  36. "沉重的外交笑话:外国大使需挥舞《毛主席语录》"Phoenix New Media। আগস্ট ২৬, ২০১০। জুন ৮, ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ১, ২০২০ 
  37. "Resolution on Certain Questions in the History of Our Party Since the Founding of the People's Republic of China," adopted by the Sixth Plenary Session of the Eleventh Central Committee of the Communist Party of China on June 27, 1981 Resolution on CPC History (1949-81). (Beijing: Foreign Languages Press, 1981). p. 32.

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

সাধারণ[সম্পাদনা]

নির্দিষ্ট[সম্পাদনা]

অন্যান্য[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]