উত্তরকুরু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(উত্তরকুুরু থেকে পুনর্নির্দেশিত)

উত্তরকুরু (সংস্কৃত: उत्तर कुरु; উত্তর কুরু) হলো প্রাচীন হিন্দু, বৌদ্ধ পুরাণ ও জৈন সৃষ্টিতত্ত্বে দ্বীপ বা "মহাদেশের" নাম। উত্তরকুরু দেশ বা উত্তর কুরু রাজ্য ও এর জনগণকে কখনও কখনও এশিয়া বা ভারতবর্ষের অন্তর্গত হিসেবে বর্ণনা করা হয়, আবার বিশেষ ক্ষেত্রে তারা পৌরাণিক বা অন্য জাগতিক স্বর্গীয় মানব হিসেবে বিবেচিত হয়। উত্তর কুরু নামের অর্থ "উত্তর দিকে অবস্থিত কুরু রাজ্য"। কুরুগণ ভারতে বৈদিক সভ্যতার সময় একটি উপজাতি ছিল। তাই বলা যায়, উত্তর কুরু ছিল কুরু রাজ্যের উত্তরে বা হিমালয় এর উত্তরে একটি জনপদ।

গ্রীক ওত্তরকোরাই এবং রোমান আত্তাকোরি কিংবদন্তি সম্ভবত উত্তর কুরু-র সাথে সম্পর্কিত।

কিছু ইতিহাসবিদ এই রাজ্যের অঞ্চলটিকে আধুনিক দিনের কিরগিজস্তান[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বলে চিহ্নিত করেছেন।

কোনো এক সময়ে পুরূরবা-ঐল (ভারতীয় রাজবংশ চন্দ্রবংশের সারিতে উল্লেখিত প্রথম রাজা) এর রাজত্বে উত্তর কুরু ও ভারতের কুরু একই কুরু সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। অর্জুন উত্তর কুরু থেকে যুধিষ্ঠির এর রাজসূয় যজ্ঞের জন্য কুরু রাজ্যের উত্তরে দিক বিজয়ের যাত্রার সময় কর সংগ্রহ করেছিলেন। মহাকাব্যগুলো আরও উল্লেখ করে, উত্তরকুরুর বাসিন্দারা কোনও রাজতন্ত্রবিহীন একটি প্রজাতন্ত্রী সংবিধান অনুসরণ করতো।

বৈদিক সাহিত্য[সম্পাদনা]

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ উত্তরকুরু এবং উত্তরমদ্রকে দৃশ্যমান জগতের জনপদ হিসেবে প্রথম উল্লেখ করে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুসারে, এই দুটি জাতি হিমালয় পর্বতশ্রেণীর (হিন্দুকুশের) বহির্ভাগে অবস্থিত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এই দুই জনপদকে প্রজাতন্ত্রীয় একটি (বৈরাজ্য) জাতির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এখানে সমগ্র জনপদ শাসনব্যবস্থার পবিত্রকরণ গ্রহণ করেছিল।[১]

ঐতরেয় ব্রাহ্মণ আবার উত্তরকুরুকে দেবক্ষেত্র বা স্বর্গীয় ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

পুরাণ[সম্পাদনা]

পুরাণ এর বর্ণনার উপর ভিত্তি করে, উত্তরকুরু পৃথিবীতে রয়েছে বলে মনে হয়।

পুরাণের মহাবিশ্ববিদ্যা অনুসারে, আমাদের পৃথিবীতে সাতটি কেন্দ্রীভূত দ্বীপ রয়েছে। জম্বুদ্বীপসহ সাতটি দ্বীপকে সপ্ত সমুদ্র ঘিরে রয়েছে। অন্তর্বর্তী মহাদেশ জম্বুদ্বীপ মহাদেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কেন্দ্রিক দ্বীপ। জম্বুদ্বীপে নয়টি দেশ (বর্ষ) এবং নয়টি পর্বত আছে। ইলাবৃত ভূমি জম্বুদ্বীপের মধ্যভাগে অবস্থিত যার কেন্দ্রে অবস্থিত মেরু পর্বত। উত্তরকুরু দেশ মেরু/কৈলাশ পর্বতের উত্তরে অবস্থিত।[২]

ভাগবত পুরাণ উত্তরকুরুকে "উত্তর কুরু" বর্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা দক্ষিণ কুরুদের থেকে পৃথক ছিল। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণবায়ুপুরাণ বলে মতে, পুরু বংশের পূর্বপুরুষ পুরূরবা একদা উত্তরকুরুতে উর্বশীর সাথে বসবাস করতেন। মৎস্যপুরাণ-এ, উত্তরকুরুকে 'তীর্থ' বলে বর্ণনা করেছে। অর্থাৎ, উত্তরকুরু একটি বিশুদ্ধ স্থান যেখানে মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে স্নান করতে যেতো।

মহাভারত[সম্পাদনা]

মহাভারত কখনও কখনও উত্তরকুরুকে দেব ভূমি হিসাবে মহিমান্বিত করে। এস্থানকে ভাগ্যবান আত্মাগণের পরম আবাস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আশীর্বাদপ্রাপ্ত আত্মা ও মহিমান্বিত ক্ষত্রিয়গণ যুদ্ধে হত হয়ে মৃত্যুর পরে উত্তরকুরুতে গমন করে।

মহাভারতের আদিপর্বে "উত্তরকুরুর" অধিবাসীরা মধ্যে মুক্ত প্রেম অনুশীলন করে এরকম বলা হয়েছে। সেখানে পাখি ও পশুদের মাঝে কোন ভেদ নেই, কোন কাজ করতে ঋষিদের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না। সেখানকার বাসিন্দারা মুক্ত ও স্বাধীন। যার ফলে তাদের পাপ স্পর্শ করতে পারে না। অপরদিকে, মহাভারত উত্তরকুরুবাসীদের জীবন্ত সত্ত্বা হিসাবে বর্ণনা করে এবং তাদের প্রকৃত কুরুর সাথে সংযুক্ত করে।

রাজা যুধিষ্ঠির কর্তৃক অনুষ্ঠিত রাজসূয় যজ্ঞে-উত্তর-পশ্চিমের রাজারা উপহার নিয়ে এসেছিলেন, যার মধ্যে কতিপয় উত্তরকুরুর অধিপতিও ছিলেন।

হিন্দুকুশ এর দক্ষিণে কম্বোজ ও দর্দদের জয় করার পর, অর্জুন হিন্দুকুশ অতিক্রম করেন ও কম্বোজের লোহাগণের সাথে যুদ্ধ করেন, তারপর ঋষিক জয় করেন। এরপরে, অর্জুন কিম্পুরুষ, হরাতকগণ এবং উত্তরাকুরুদের বশীভূত করেন, যারা হিমালয় অঞ্চলের প্রতিবেশী উপজাতি ছিল।

কর্ণ যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র ইউরেশিয়া জয় করে বিজয়যাত্রা শুরু করেন।

রামায়ণ[সম্পাদনা]

উত্তরের দেশ গণনায়, রামায়ণ উল্লেখ করে কম্বোজ, যবন, শক, পারদ ও তারও উত্তর দিকে, উত্তর 'দেশ' অবস্থিত। 'উত্তরকুরু' ভূমি 'শৈলোদা' নদীর পারে ও 'কিচকবাঁশ' উপত্যকায় অবস্থিত। রামায়ণে উত্তরকুরু অঞ্চলের খুব প্রাণবন্ত ও চিত্রানুগ বিবরণ পাওয়া যায়।[৩]

বৌদ্ধ সাহিত্য[সম্পাদনা]

বৌদ্ধ সাহিত্যেও উত্তরকুরুর অসংখ্য উল্লেখ পাওয়া যায়। দীর্ঘ নিকায়-এ উত্তরকুরু শহর-এর নাম বলা হয়েছে। ললিত-বিস্তর উত্তরকুরুকে প্রত্যন্ত-দ্বীপ বা সীমান্তবর্তী দ্বীপ বলে বর্ণনা করেছে।

উত্তরকুরুর বর্ণন দীর্ঘ নিকায়-এর আতানতিয় সুত্ত-এ বিশদভাবে করা হয়েছে। এটি জম্বুদ্বীপ থেকে ২৪,০০০ যোজন দূরত্বে অবস্থিত একটি দ্বীপ। এটি মহাদ্বীপ বা মহাদেশগুলোর মধ্যে একটি। বলা হয়, এটি বিশাল প্রাচুর্যময় স্থান। এস্থান স্বর্গীয় রাজা বেস্সবন-এর অধীনস্থ। আতানতিয় এই ভূখণ্ডের একটি বিখ্যাত শহর। সেখানকার বাসিন্দাগণের চেহারা মার্জিত, নিঃস্বার্থ, (৭ দিনের বেশি) কোন বৈবাহিক সম্পর্ক থাকে না, তাদের নিজস্ব কোন সম্পত্তি নেই, গৃহ নেই। কিন্তু তারা ভূমিতে ঘুমাতে সক্ষম, তুষ ছাড়া মিষ্টি গন্ধযুক্ত চাল স্বয়ং সেখানে উৎপন্ন হয়, এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপসহযোগে স্ফটিক প্রস্তরনির্মিত উনুনে হাঁড়িতে চাল রান্না হয়। উত্তরকুরুর লোকেদের স্বভাবতই পঞ্চশীল বিদ্যমান। তত্রস্থ বৃক্ষে প্রচুর ফল রয়েছে, পাখিরা সুন্দর গান গায় (কেউ কেউ কান্নাকাটিও করে তাদের "জীবন" দীর্ঘায়ু বলে)। সেখানে রয়েছে কল্পবৃক্ষ। এও বলা হয়, শুধুমাত্র মহান ইদ্ধি ক্ষমতাসম্পন্ন বা চক্কবত্তি রাজারাই এই স্থানটি দেখতে পারেন। এই লোকেরা ধম্ম হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না।

লোকপন্নত্তি নামে একটি বার্মিজ পুস্তক উত্তরকুরুর আরও বিশদ বিবরণ প্রদান করে।

সুমঙ্গলবিলাসিনী মতে, একজন চক্রবর্তী রাজা উত্তরকুরু বা মদ্র রাজবংশের স্ত্রী বিবাহ করে থাকেন।

বুদ্ধঘোষ একটি ঐতিহ্যবাহী পুস্তক লিপিবদ্ধ করেন। তার মতে, বৈদিক রাজা মান্ধাতা যখন চতুর্মহাদিপ নামক তাঁর রাজ্যে জম্বুদ্বীপে থেকে ফিরে আসেন, তখন তাঁর দলে প্রচুর সংখ্যক 'উত্তরকুরুবাসী' মানুষ ছিল। তারা সকলেই জম্বুদ্বীপে বসতি স্থাপন করেছিল এবং তাদের নগরী কুরুরাত্থ (কুরু রাষ্ট্র) নামে পরিচিত হয়েছিল। এছাড়াও মজ্ঝিম ভাষ্য[৪] উল্লেখ করে যে, কুরুরাত্থের লোকেরা মূলত উত্তরকুরুর অন্তর্গত ছিল। উত্তরকুরুর কথা ধম্মপদ শ্লোক ৪১৬-এ জোতিক প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজগৃহের একজন কোষাধ্যক্ষ ও অসাধারণ ধনী ব্যক্তি জ্যোতিক বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন। তিনি পরে অর্হৎ হয়েছিলেন। তাঁর এক বহির্দেশীয় স্ত্রী ছিল যাকে দেবতারা তাঁর কাছে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি উত্তরকুরু বা 'উত্তর দ্বীপ' থেকে এসেছিলেন। উত্তরকুরু মেরু পর্বতের উত্তরে অবস্থিত।মেরু পর্বত মহাবিশ্বের একটি পৌরাণিক পর্বত যাকে বিভিন্ন লোক/গ্রহগুলো আশ্রয় করে রয়েছে। পৃথিবীতে জোতিকের স্ত্রীর নাম ছিল সতুলকাই। সে তার সাথে একটি চালের পাত্র এবং তিনটি স্ফটিক পাথরের চুলা নিয়ে এসেছিল যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাত রান্না করত এবং অনেক লোকের খাবার পরিবেশন করতে পারত। তিনি জোতিকার সাথে ছিলেন যতক্ষণ না তিনি সংঘে যোগ দেন এবং অর্হৎ হন। তারপরে সতুলকাই উত্তরকুরুতে ফিরে যান।

অভিধম্ম পাঠে উত্তরকুরুর উল্লেখ করা হয়েছে, বুদ্ধ দেবতাদের স্বর্গীয় জগৎ তাবতিংস স্বর্গে গিয়েছিলেন। সেখানে বুদ্ধ বর্ষাবাস (বস্সা) অতিবাহিত করেন।[৫] তিনি দেবতাদের কাছে অভিধম্মের ব্যাখ্যা করেছিলেন। যেহেতু বুদ্ধ একজন মানুষ ছিলেন তাই তাকে তাবতিংসে একটি সংক্ষিপ্ত মেয়াদে তার শারীরিক দেহে অবস্থান করতে হয়েছিল যা পৃথিবীতে চার মাসের সমান। তিনি উত্তরকুরুতে ভিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন যা তাবতিংস স্বর্গের কাছে অবস্থিত মানুষদের আবাস এবং তিনি পৃথিবীতে ফিরে আসেননি।[৬]

উত্তরকুরুর উল্লেখ সর্বাস্তিবাদ বৈভাষিক সূত্রেও আছে। পণ্ডিত বারেই তার সংকলন ২৩-এ[৭] বলেছেন: (উত্তরকুরুর নাগরিকদের বৈরাগ্য (বিরাগ) নেই এবং উচ্চপদস্থরা (আর্য) সেখানে জন্মগ্রহণ করেন না।)

কালহানের রাজতরঙ্গিনী[সম্পাদনা]

কালহান-এর রাজতরঙ্গিনী অনুসারে, কাশ্মীর রাজা ললিতাদিত্য মুক্তপিদ উত্তরের (অর্থাৎ কাশ্মীরের উত্তরে) গোত্রের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ অভিযানের নেতৃত্ব দেন এবং ধারাবাহিকভাবে, কম্বোজ, তুষার, ভৌত্ত, দরদা, বালুকাম্বুধি, উত্তরকুরু, স্ত্রীরাজ্য (পৌরাণিক) এবং প্রাগজ্যোতিষের মুখোমুখি হন। তাদের সাথে তিনি একের পর এক যুদ্ধ করেন।

বিদেশী উৎস[সম্পাদনা]

টলেমি-এর ভূগোল অনুসারে, ওত্তোরোকোরাই (উত্তরকুরু) উপজাতি, ওত্তোরোকোরা একটি শহর এবং ওত্তোরোকোরাস একটি নদী।[৮]

প্লিনি-এর আত্তাকোরি সম্ভবত উত্তরকুরুর মানুষ এবং তাদের দেশকেও বোঝায়।[৯]

ভৌগোলিক অবস্থান[সম্পাদনা]

যদিও পরবর্তী গ্রন্থগুলো উত্তরকুরুর পৌরাণিক বিবরণের সাথে আধুনিক স্থানগুলোর একত্রীকরণ করার চেষ্টা করে, তবুও পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী কিছু গ্রন্থে উত্তরকুরুবাসীদের প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক মানুষ বলে মনে হয়। তাই পণ্ডিতরা উত্তরকুরুর প্রকৃত অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন।

পৌরাণিক বিবরণ সর্বদা উত্তরকুরু বর্ষকে জম্বুদ্বীপের উত্তরাঞ্চলের স্থান বলে শনাক্ত করে।

উত্তরকুরুকে কেউ কেউ ঋগ্বেদে উল্লিখিত কুরু দেশের সাথে অভিন্ন বলে মনে করেন। কুরু এবং পাঞ্চাল ঋগ্বেদের বৈকরণ গঠন করে। এই বৈইকরণকে প্রায়শই কাশ্মীরের সাথে চিহ্নিত করা হয়। তাই, ডাঃ জিমার উত্তরকুরুদের সাথে বৈইকরণ কুরুদের শনাক্ত করতে এবং তাদের কাশ্মীরবাসীর পর্যায়ে রাখতে পছন্দ করেন।

মাইকেল উইটজেল উত্তরাখণ্ড রাজ্যেকে উত্তরকুরু বলে মনে করেন। অধ্যাপক সুভাষ কাকের মতে, উত্তরকুরু ছিল চীনের জিনজিয়াং এর তারিম অববাহিকা।

কিছু পণ্ডিতদের মতে, উপরের অবস্থানগুলো যদিও সঠিক বলে মনে হয় না কারণ তা ঐতরেয় ব্রাহ্মণের প্রমাণের বিরুদ্ধে যায় যেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, উত্তরকুরু এবং উত্তরমদ্র হিমালয়ের বহির্ভাগে অবস্থিত (প্রেন হিমবন্তম্ জনপদ উত্তরকুর্ব উত্তরমদ্র)। অধিকন্তু, উত্তরকুরুর উপরোক্ত অবস্থান ঠিক করার সময় উত্তরমদ্রদের (বাহ্লীক, ব্যাক্ট্রিয়) কোন তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ প্রমাণ অনুসারে উত্তরকুরুগণ এবং উত্তরমদ্রদের হিমালয়ের বহিরাঞ্চলের নিকটবর্তী প্রতিবেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রামায়ণের মতে, কুরুদের আদি নিবাস ছিল বাহলি দেশে। প্রজাপতি কর্দ্দমের পুত্র ইল ছিলেন বাহলির রাজা। বাহলি শব্দটি সংস্কৃত বাহ্লীক (ব্যাক্ট্রিয়) রাজ্যকেও নির্দেশ করে। এছাড়াও ঐল বংশের রাজাদেরকে কার্দ্দমেয় বলা হয়। ঐল বংশকে কুরুদের বংশও বলা হয়। কার্দ্দমেয়রা পারস্য/প্রাচীন ইরানের কর্দ্দম নদী থেকে তাদের নাম গ্রহণ করেছিল। অধিকন্তু, শতপথ ব্রাহ্মণ কৌরব্য বংশের বাহ্লীক প্রতিপেয় নামে একজন রাজার উল্লেখ করেছে। বাহ্লীক প্রতিপেয় নাম থেকেই বোঝা যায়, বাহ্লীক একজন (ব্যাক্ট্রিয়) রাজকুমার ছিলেন। সুতরাং, বাহলি, বাহ্লীক ছিল কুরুগণের আদি বাসস্থান। অতএব, বাহ্লীক বা ব্যাকট্রিয়া রাজ্য উত্তরকুরু হতে পারে। মহাভারত ও সুমঙ্গলবিলাসিনী আরও উল্লেখ করেছে, কুরু সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত উত্তরকুরু থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল। ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্য স্পষ্টতই হিন্দুকুশ অর্থাৎ হিমালয়ের বাইরে অবস্থিত। প্রাচীন সাহিত্যে, হিমালয়কে পূর্ব মহাসাগর থেকে পশ্চিম মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বলা হয়েছে। আজও এই তথ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি।

উত্তরকুরুর উপরোক্ত পরিচয় ডাঃ এম.আর. সিং বলেছেন।

কে.পি. জয়সওয়াল হিন্দুকুশ পর্বতমালার সাথে পুরাণের মেরু পর্বতের তুলনা করেছেন এবং পামিরের উত্তরে উত্তরকুরুকে শনাক্ত করেছেন।

ভি. এস. আগরওয়াল মনে করেন, উত্তরকুরু মধ্য এশিয়ার পামিরের উত্তরে অবস্থিত ছিল ও তিত্তিরকল্মশ্ জাতের ঘোড়ার জন্যও বিখ্যাত ছিল। এভাবে এটি সম্ভবত কিরগিজস্তান এবং তিয়ান-শানের অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। ঘটনাক্রমে, উত্তরকুরুর ঘোড়ার উল্লেখ কাশ্মীর ও উত্তরাখণ্ড রাজ্যে উত্তরকুরুদের অবস্থানের যেকোনো সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে কারণ এই অঞ্চলগুলোতে তাদের ঘোড়াগুলোর উল্লেখ কখনও করা হয়নি।

বুদ্ধপ্রকাশ চীনের সিঙ্কিয়াং প্রদেশে উত্তরকুরু-বর্ষের অবস্থান নির্ণয় করেছে।

মহাভারতের ভীষ্মপর্ব প্রমাণ করে, উত্তরকুরু দেশটি মেরুর উত্তরে এবং নীল পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত।

হিন্দু ঐতিহ্যে মেরু পর্বতের সাথে পামিরকে চিহ্নিত করা হয়। নীল পর্বত সম্ভবত আলতাই-পর্বত হতে পারে।

মহাভারত শৈলোদা নদীর তীরে স্থিত কিচকবাঁশের কথা উল্লেখ করে। মহাভারত আরও বলে, কিচকবাঁশ অঞ্চলটি মেরু পর্বত (পামির) এবং মন্দার (আলতাই) পর্বতের মধ্যে অবস্থিত ছিল। এই দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী নদী উপত্যকাগুলো এখনো কিচকবাঁশের বন দ্বারা পরিপূর্ণ।

রামায়ণ আরও উল্লেখ করে, শৈলোদা নদীর উপত্যকাগুলো কিচকবাঁশ দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। উত্তরকুরুর দেশ শৈলোদা নদীর ওপারে কিচকবাঁশের উপত্যকাগুলো ছিল।

রামায়ণ এবং মহাভারতের শৈলোদা নদীকে বিভিন্ন পণ্ডিতরা ইয়ারকন্দ ও সির (জাক্সার্টেস) নদীর সাথে সংযুক্ত বলে উল্লখ করেছেন।

রঘুবংশ মতে, সংস্কৃতে দীর্ঘবেনু শব্দটি পামির বা মেরু পর্বতমালার পূর্বাঞ্চলে মধ্য এশিয়ার কিচাকবাঁশ স্থানকে নির্দেশ করে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায়, উত্তরকুরুদের ভূমি শৈলোদা নদীর উত্তরে ও কিচকবাঁশের উপত্যকায় অবস্থিত ছিল।

রাজতরঙ্গিনী আবার স্ত্রীরাজ্যের প্রতিবেশি দেশ হিসেবে উত্তরকুরু ভূমির উল্লেখ করে। জুয়ানজাং-এর প্রমাণের উপর ভিত্তি করে স্ত্রীরাজ্যকে কাশ্মীরের উত্তরে, খোতানের দক্ষিণে ও তিব্বতের পশ্চিমে অবস্থিত একটি দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এভাবে, রামায়ণ, মহাভারত এবং রাজতরঙ্গিণীতে যে উত্তরকুরুর উল্লেখ পাওয়া যায়, তা সম্ভবত বাহ্লীক বা ব্যাক্ট্রিয়া রাজ্যের সাথে শনাক্ত করা যায় না যেমনটি এম.আর. সিং বলেছেন।

উত্তরকুরু সম্ভবত চীনের সিঙ্কিয়াং প্রদেশের উত্তর-পশ্চিম এবং তিয়ান-শান পর্বতমালার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত।

ক্রিশ্চান ল্যাসেন বলেন, টলেমির বর্ণিত ওত্তোরোকোরাই কাশগরের পূর্বে অর্থাৎ তারিম অববাহিকায় অবস্থিত হতে পারে।

কিছু লেখক অবশ্য দাবি করেন, উত্তরকুরু হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত আর্কটিক বৃত্ত পর্যন্ত বিস্তৃত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নাম।

কিছু লোক হিমালয়ের উত্তরে অবস্থিত ইন্দো-ইউরোপীয়দের টোচারিয়ান (উত্তরকুরু = টোখারি) শাখার পূর্বপুরুষদের সাথে উত্তরকুরুগণ এবং উত্তরমদ্রদের শনাক্ত করার প্রচেষ্টা করেন।

টোখারি বা তুখারা বা পরবর্তী ইউচিস, মহাভারতের ঋষিকদের মতো প্রায় একই হতে পারে।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. তস্মাদ্ অতস্যম্ উদিচ্য দিশি যে কে চ প্রেন হিমবন্তম্ জনপদ উত্তরকুর্ব উত্তরমদ্র
    ইতি বৈরাজ্য তে।অভিষিচ্যন্তে।
    (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৮/১৪)
  2. Singh, M.R. (১৯৮১)। Geographical Data in Early Puranas 
  3. Ramayana 4.43.1-62.
  4. Vol I, p 184.
  5. "... vassa ('rains') signifies a three-month period of residence in one place during the rainy season, enjoined upon bhikkhus by the Buddha in order that they should not travel about trampling down crops and so annoy farmers. To translate it by 'lent' as is sometimes done lets in a historical background and religious atmosphere of mourning and fasting quite alien to it (with no etymological support)." The Path of Purification: Visuddhimagga by Bhadantarariya Buddhaghosa & translated by Bhikkhu Nanamoli, pg. liii-liv, (http://www.accesstoinsight.org/lib/authors/nanamoli/PathofPurification2011.pdf).
  6. DhA.iv.199-213
  7. Les sectes bouddhiques du petit véhicule, A.Bareau, EFEO Paris 1955, p.141
  8. Richard L. Thompson, The Cosmology of the Bhāgavata Purāṇa: Mysteries of the Sacred Universe
  9. Gerald J. Gruman, MD, PhD, A History of Ideas About the Prolongation of Life

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]