বিষয়বস্তুতে চলুন

মাদারিপুর সমিতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মাদারিপুর সমিতি
নীতিবাক্যব্রিটিশ তাড়াও
গঠিত১৯১০
ধরনগুপ্ত বিপ্লবী দল
উদ্দেশ্যভারতের স্বাধীনতা
অবস্থান
মূল ব্যক্তিত্ব
পূর্ণচন্দ্র দাস

মাদারিপুর সমিতি বঙ্গভঙ্গ বিরোধী বাংলার একটি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণচন্দ্র দাস চরমপন্থার মাধ্যমে ইংরেজ শাসনের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করতে এই ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ঢাকা অনুশীলন সমিতি (পুলিনবিহারী দাস প্রতিষ্ঠিত) ও যুগান্তর দল (যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত)-এর মতো এই সমিতি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে বৈপ্লবিক আন্দোলন পরিচালনা করতো। বিভিন্ন অভিযানে মাউজার পিস্তল, বোমা ও সাদা মুখোশ ব্যবহার করা হত। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ণচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে মাদারিপুর সমিতি পাঁচটি বড় বড় গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করে।[]

প্রেক্ষাপট

[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও স্থানীয় শাসকবর্গের সংঘর্ষের মধ্য অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারতীয় মধ্যবিত্ত সমাজের উত্থান এক "ভারতীয়" জাতি চেতনার জন্ম দেয়।[] উনিশ শতকের শেষভাগে এই জাতীয়তাবোধ থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ।[] ১৮৮৫ সালে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন তা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক উদারীকরণ, স্বায়ত্তশাসনের পরিধিবিস্তার ও সামাজিক সংস্কারের দাবিদাওয়া পেশের মঞ্চ হয়ে ওঠে।[] যদিও বাংলা ও পাঞ্জাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সশস্ত্র আকার ধারণ করে। বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ও দক্ষিণের অন্যান্য অঞ্চলে স্বল্প পরিসরে হলেও বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব কার্যকর হবার আগেই ১৯০৫ সালের ৭ই জুলাই তারিখে সুরেন্দ্রনাথ তার দি বেঙ্গলী পত্রিকার সম্পাদকীয়তে আসন্ন ঘটনাকে বলেছিলেন 'একটি ভয়ঙ্কর জাতীয় দুর্যোগ' এবং সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে সরকার যদি তার সিদ্ধান্ত না পাল্টায় তাহলে সামনে সর্বোচ্চ মাত্রার একটি জাতীয় প্রতিরোধ অপেক্ষমাণ রয়েছে। [][] বাস্তবেই এই ঘটনা এক প্রচণ্ড রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ছোটলাট এন্ড্রু ফ্রেজার ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জ জেলায় ইতিমধ্যে তৎপর চরমপন্থীদের নতুন প্রদেশে দমন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন। লর্ড কার্জন মূল প্রস্তাবটি লন্ডন পাঠান ১৯০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিষয়ক মন্ত্রী সেন্ট জন ব্রড্রিখ জুনে এই প্রস্তাব সঞ্চালন করেন।[] সরকার তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ১৯শে জুলাই, ১৯০৫ সালে এবং বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় একই বছরের ১৬ই অক্টোবর এবং তা কার্যকর করার পর বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন বিকাশ লাভ করে। পূর্ণচন্দ্র দাস ছিলেন মাদারিপুর সমিতির প্রধান ব্যক্তি ও আদর্শ। তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের লেখাপড়া পরিত্যাগ করে ১৯১০খ্রিঃ ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের গুপ্ত বিপ্লবী দল মাদারিপুর সমিতি গঠন করেন। সমিতিতে আরও সাতাশজন বিপ্লবী তরুন ছিলেন। এদেরমধ্যে অন্যতম ছিলেন চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, বিনোদ দাস প্রমুখ। মাদারিপুর হাই স্কুল-এর তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সৈারেন চৌধুরী (ডাবল এম.এ.) বিপ্লবী ছাত্রদের প্রশ্রয় দেয়ায় চাকরিচ্যুত হন এবং পরবর্তীতে বরিশাল বি.এম. কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯১৩খ্রিঃ ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলায় পূর্ণচন্দ্রসহ মাদারিপুর সমিতির প্রায় সদস্যরা গ্রেপ্তার হন এবং পাঁচ মাস জেল খাটেন।

পরবর্তী অবস্থা

[সম্পাদনা]

জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পূর্ণচন্দ্র দাস কলকাতায় গিয়ে জোরেসোরে কাজ শুরু করলে সিংহপুরুষ যতিন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় ও গভীর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ১৯১৫খ্রিঃ গোয়েন্দা অফিসার নীরদ হালদারকে গুলি করে হত্যা করেন। চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরী মিনিটে ৩৬০টি গুলি ছোড়ার কৃতিত্বে বাঘাযতিনের নিকট পুরস্কৃত হন। তিনি ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫খ্রিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন দিবসে পুলিশ ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখার্জীকে হত্যা করেন। ১৯১৫খ্রিঃ ৯ই সেপ্টেম্বর উরিস্যার বালেশ্বর জেলায় বুড়িবালাম নদীর তীরে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে তিনি শহীদ হন। বালেশ্বরের ট্রেঞ্চযুদ্ধে মাদারিপুর সমিতির সদস্যরা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে। বিপরীতপক্ষে চার্লস টেগার্ট, কমান্ডার রাদারফোর্ড, জেলা মেজিস্ট্রেট কিলডি সহ অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ ও সামরিক বাহিনী। নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত(২৩) ও মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত(১৭) ইংরেজদের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং ৩রা ডিসেম্বর বালেশ্বর জেলে তাদের ফাঁসি হয়।[]

   যুদ্ধে যতিন্দ্রনাথ গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে পূর্ণচন্দ্র দাশ হতাশাগ্রস্থ হয়ে কলকাতায় সমিতির সকল সদস্যদের অন্যতম বিপ্লবী নেতা অতুকৃষ্য ঘোষের নেতৃত্বে অর্পণ করেন। পূর্ণচন্দ্র ১৯১৪খ্রিঃ ভারত-রক্ষা আইনে ধৃত হয়ে ১৯২০খ্রিঃ পর্যন্ত জেলে আটক থাকেন। পরে তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্রের নবগঠিত ফরওয়ার্ড ব্লকের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৪০খ্রিঃ পুনরায় গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৪৬খ্রিঃ মুক্তি পান। তিনি জেলে মোট ২৭ বছর আটক ছিলেন। ২ বছর পলাতক অবস্থায় ছিলেন। তিনি ৩৩ দিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। দেশ বিভাগের পর দলীয় রাজনীতি ত্যাগ করেন এবং কলকাতায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বোর্ডের সদস্য হয়ে বাস্তুহারাদের কল্যাণে তৎপর হন। ১৯৫৬খ্রিঃ বালিগঞ্জে সুবোধ নামে এক প্রাক্তন বিপ্লবীর ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু ঘটে।[] কাজী নজরুল ইসলাম “পূর্ণ-অভিনন্দন” কবিতাটি তাকে উৎসর্গ করেন এবং কবিতায় তাকে মাদারিপুরের মর্দ্দবীর বলে সম্মোধন করেন। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তাকে ইংরেজদের আতঙ্ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আরও উল্লেখ করেছেন ১৯৩৬খ্রিঃ মাদারিপুর আবস্থানকালে পূর্ণ দাসের সভায় নিয়োমিত যাতায়াত করতেন এবং সেখান থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি হয়; ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই, স্বাধীনতা আনতে হবে।‌[১০] সমিতির আরেক সদস্য বিনোদ দাস পরবর্তীতে প্রণব সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গোরক্ষপুরের মহাযোগী গম্ভীরনাথজীর নিকট দীক্ষিত হন এবং আচার্য স্বামী প্রণবানন্দ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৭খ্রিঃ বাজিতপুরে একটি সেবাশ্রম গঠন করেন, ১৯২১খ্রিঃ সুন্দরবনে “ভারত সেবাশ্রম সংঘ” এবং ১৯২৪খ্রিঃ গয়া সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪১খ্রিঃ মাত্র ৪৫বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. মিয়া, আব্দুল জব্বার (১৯৯৪)। মাদারীপুর জেলা পরিচিতি। মাদারিপুর। পৃষ্ঠা ২৬৪। 
  2. Mitra 2006, পৃ. 63
  3. Desai 2005, পৃ. 30
  4. Yadav 1992, পৃ. 6
  5. রমেশচন্দ্র মজুমদার, History of the Freedom Movement in India, vol. II, কলিকাতা, ১৯৬৩, পৃষ্ঠা ৭
  6. http://www.natun-diganta.com/archieves/3rd%20year/4th%20edition/jatiotabad.html ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে জাতীয়তাবাদ, সামপ্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি -সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  7. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জুলাই ২০১৯ 
  8. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ২২৩, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  9. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গণ, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৭৩, ২২৩, ২৭৮।
  10. রহমান, শেখ মুজিবুর (২০১২)। অসমাপ্ত আত্মজীবনী। ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। পৃষ্ঠা ৯। আইএসবিএন 978-984-506-059-2