ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ বা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে থাইল্যান্ডে স্থাপিত ভারতীয় বিপ্লবী সংগঠন। এই সংগঠন পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে ভারতবর্ষের মুক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠে এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যুক্তভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

প্রস্তুতি ও প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাবা অমর সিং ব্রহ্মদেশের দীর্ঘ বাইশ বছরের সশ্রম কারাদন্ড থেকে মুক্তিলাভ করে থাইল্যান্ডে চলে যান। সেখানে তিনি ব্যাঙ্ককে শিখ ধর্মপ্রচারক যুবক জ্ঞানী প্রীতম সিংকে বিপ্লবী কাজে উপযুক্ত করেন। তার নির্দেশে জ্ঞানী প্রীতম সিং পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মালয় ও ব্রহ্মদেশে অবস্থিত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে প্রচারকাজ চালিয়ে যান। অন্যদিকে স্বামী সত্যানন্দ পুরী থাইল্যান্ডের ব্যাংককে থাই-ভারত সংস্কৃতি ভবন স্থাপন করে বিপ্লবী কার্যকলাপে সহায়তা শুরু করেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই ডিসেম্বর জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রগ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ও জাপানী সামরিক বাহিনী থাইল্যান্ডে পদার্পণ করে। পরদিন ৯ই ডিসেম্বর বাবা অমর সিংয়ের নেতৃত্বে ব্যাংককে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বামী সত্যানন্দ পুরী সেদিনই থাই-ভারত সংস্কৃতি ভবনকে ভারতীয় জাতীয় পর্ষদে রূপান্তরিত করে লীগের সঙ্গে যুক্ত হন।[১]

সিঙ্গাপুর সম্মেলন[সম্পাদনা]

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই মার্চ সিঙ্গাপুরে থাইল্যান্ড ও মালয়ের ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন পেনাং এর ব্যারিষ্টার এন রাঘবন। এই সম্মেলনে যোগ দেন স্বামী সত্যানন্দ পুরী, বাবা অমর সিং, জ্ঞানী প্রীতম সিং, ক্যাপ্টেন মোহন সিং, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এন এস গিল, মেজর মহম্মদ জামান কিয়ানি প্রমুখ। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে সুভাষচন্দ্র বসুকে টোকিওয় এসে পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ করা হবে। [১]

টোকিও সম্মেলন[সম্পাদনা]

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে মার্চ সাংহাই, মালয়, হংকং ও থাইল্যান্ডের ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রতিনিধিদের নিয়ে টোকিওতে সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে যোগ দিতে আসার সময় ১৩ই মার্চ স্বামী সত্যানন্দ, জ্ঞানী প্রীতম সিং, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ আকরামনীলকন্ঠ আয়ারের বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে। টোকিও সম্মেলনে জাপান সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন কর্নেল ইয়াকুরো। এই সম্মেলনে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঠিক হয় লীগের আদর্শ হবে ‘ঐক্য, আত্মবিশ্বাস ও আত্মোৎসর্গ’। অন্য একটি প্রস্তাবে জাপান সরকারকে ভারতের প্রতি তাদের মনোভাব ব্যক্ত করার অনুরোধ করা হয়। এই সম্মেলনে জাপান সরকারের কাছে এই মর্মে প্রস্তাব করা হয়, যাতে তারা ভারতের স্বাধীনতালাভে জাপানের তরফ থেকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা, স্বাধীনতার পর ভারতের সার্বভৌমত্বে স্বীকৃতিদান এবং সংবিধান প্রণয়নে শুধুমাত্র ভারতের জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বের স্বীকৃতিদানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করেন। এই সম্মেলনে নির্বাচনের মাধ্যমে লীগের কর্মপরিষদ গঠনের সিধান্ত নেওয়া হয় এবং রাসবিহারী বসুকে কর্মপরিষদের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। [১]

ব্যাঙ্কক সম্মেলন[সম্পাদনা]

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই জুন জাপান, মাঞ্চুকুও, হংকং, ব্রহ্মদেশ, বোর্ণিও, জাভা, মালয়, থাইল্যান্ড, সাংহাই, ম্যানিলা ও ইন্দোচীনের ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রতিনিধিদের নিয়ে ব্যাংককে সম্মেলন বসে। এই সম্মেলনে টোকিও সম্মেলনের সমস্ত প্রস্তাব অনুমোদন লাভ করে। রাসবিহারী বসু, এন রাঘবন, জেনারেল মোহন সিং, কে পি কে মেনন, কর্নেল জি কিউ গিয়ানীকে নিয়ে কর্মপরিষদ গঠিত হয়। প্রতিটি এলাকায় লীগ ও প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কর্মপরিষদকে দেওয়া হয়। এই সম্মেলন সুভাষচন্দ্র বসুকে পূর্ব এশিয়ায় আনানোর জন্য জার্মান সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ব্যবস্থা করতে জাপান সরকারকে অনুরোধ করে। [১]

ফুজিওয়ারা কিকান ও ইয়াকুরো কিকান[সম্পাদনা]

লীগের কর্মপরিষদের সদর দপ্তর ব্যাংককে স্থাপন করা হয়। কর্মপরিষদ জাপান সরকারের সঙ্গে প্রথমে মেজর ফুজিওয়ারা ও পরে কর্নেল ইয়াকুরোর অধীনে সংযোগরক্ষা অফিস বা কিকানের মাধ্যমে সংযোগ রক্ষা করত। ইয়াকুরো কিকান টোকিও সম্মেলনের দাবী অনুযায়ী জাপান সরকারের নিকট ভারতের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণা আদায় করতে পারেনি।[১]

প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের অবলুপ্তি ও লীগের ভাঙন[সম্পাদনা]

লীগের সাথে বোঝাপড়া সত্ত্বেও ব্রহ্মদেশে জাপানী সেনাবাহিনী উদ্বাস্তু ভারতীয়দের সম্পত্তিকে শত্রুপক্ষের সম্পত্তি রূপে গণ্য করে সেগুলি হস্তগত করে। অন্যদিকে জাপানীদের সরবরাহ করা অস্ত্র পরিমাণগত ও গুণগত বিচারে প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। জাপানীরা লীগের কর্মপরিষদের সঙ্গে কোন পরামর্শ না করে ও জেনারেল মোহন সিংয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এসবের ফলে জাপানীদের সঙ্গে লীগের দুরত্ব বেড়ে যায়। জাপানীদের সঙ্গে লীগের সভাপতি রাসবিহারী বসু অনমনীয় ব্যবহার করতে ব্যর্থ হলে লীগের কর্মপরিষদের সদস্য ও জেনারেল মোহন সিংয়ের সঙ্গে সভাপতির দুরত্ব তৈরী হয়। ফলস্বরূপ সভাপতি ও রাঘবন ছাড়া বাকি সকলে পদত্যাগ করেন। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর জাপানীরা জেনারেল মোহন সিংকে সিঙ্গাপুর থেকে গ্রেপ্তার করলে প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজের অস্তিত্ব লোপ পায়। কয়েকদিন পরে লীগের কর্মপরিষদের অবশিষ্ট সদস্য রাঘবন পদত্যাগ করেন। [১]

লীগের পুনর্গঠন[সম্পাদনা]

এরপর রাসবিহারী বসু লীগ ও সামরিক বাহিনীকে নতুন করে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। তিনি ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে লীগের সদর দপ্তর ব্যাংকক থেকে সিঙ্গাপুরে সরিয়ে আনেন। ডঃ লক্সুমিয়া অসামরিক শাখায় রাঘবনের স্থলাভিষিক্ত হন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল যশবন্ত রাও ভোঁসলে আজাদ হিন্দ ফৌজের সামরিক ব্যুরোর ডিরেক্টর ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহম্মদ জামান কিয়ানি কম্যান্ডার নিযুক্ত হন। [১]

সুভাষচন্দ্র বসুর দায়িত্বভার গ্রহণ[সম্পাদনা]

১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই মে সুভাষচন্দ্র বসু টোকিও পৌঁছে জাপানী প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজোর সঙ্গে দুবার দেখা করে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে জাপানের সাহায্য সম্পর্কে বোঝাপড়া করেন। ২রা জুলাই রাসবিহারী বসুকে সঙ্গে নিয়ে সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুর পৌছলে আজাদ হিন্দ ফৌজ তাকে সামরিক অবিভাদন জানায়। ৪ঠা জুলাই ক্যাথে সিনেমা হলে সুভাষচন্দ্র রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে লীগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। পরদিন সিঙ্গাপুর টাউন হলের বিপরীত দিকে আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীরা তাকে সামরিক অভিবাদন জানায়। তিনি লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সাধারণ বিভাগ, অর্থ বিভাগ, প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ, গুপ্তচর বিভাগ, সৈন্য সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ বিভাগকে সংগঠিত করেন। এছাড়া স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ, জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতি, পুনর্গঠন, সরবরাহ, বৈদেশিক, গৃহ নির্মাণ ও মহিলা বিভাগ এই সাতটি বিভাগ তৈরী করেন। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে অক্টোবর ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের উপস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ বা আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের ঘোষণা করেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে লীগের দ্বিতীয় সদর দপ্তর রেঙ্গুনে স্থাপন করা হয়। [১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. আজাদ হিন্দ ফৌজ - সুব্বীর আপ্পাদুরাই আইয়ার, অনুবাদ - জগবন্ধু ভট্টাচার্য, প্রথম প্রকাশ, দশম পুনর্মুদ্রণ, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নেহেরু ভবন, বসন্ত কুঞ্জ, নয়াদিল্লী ১১০০৭০, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২৩৭-০৭০২-০