হরিদাস শাস্ত্রী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

শ্রী হরিদাস শাস্ত্রী (১৯১৮-২০১৩) একজন ভারতীয় গৌড়ীয় বৈষ্ণব পণ্ডিত এবং অনুশীলনকারী ছিলেন। [১] একজন বিশিষ্ট সংস্কৃত পণ্ডিত হিসেবে [২] তিনি ষাটটিরও বেশি বই লিখেছেন, যার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি গৌড়ীয় সংস্কৃত বইয়ের অনুবাদ এবং সেগুলির উপর তাঁর নিজস্ব ভাষ্য। তাঁর মূল রচনাগুলির মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত গ্রন্থ রয়েছে, যেমন, বেদান্ত-দর্শনম ভাগবত ভাষ্যোপেটম্, তাঁর স্বকৃত অনুবাদ-সহ- ষট সন্দর্ভের ভাষ্য এবং শ্রী-চৈতন্য-ভাগবত, শ্রী-চৈতন্য-চরিতামৃত, চৈতন্যমঙ্গল-এর লিপ্যন্তর। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনাথন এডেলম্যান শাস্ত্রীকে "তর্কাতীতভাবে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং সুশিক্ষিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব "অভ্যন্তরীণ" পণ্ডিত এবং "অধিক পরিচিত গৌড়ীয়-মঠ এবং ইসকন থেকে আলাদা একটি কণ্ঠ" বলে অভিহিত করেছেন। [৩] তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিশিষ্ট হলেন গৌড়ীয় পণ্ডিত ও অনুশীলনকারী ডক্টর সত্যনারায়ণ দাস[৩]

প্রারম্ভিক জীবন এবং কর্মজীবন[সম্পাদনা]

শ্রীহরিদাস শাস্ত্রী ১৯১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের রোপায় শ্রীমতি সুশীলা দেবী এবং শ্রীঅভয়চরণ চট্টোপাধ্যায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশব নাম ছিল ফণীন্দ্র নাথ। ১৯৩৩ সালে, তিনি মথুরা যাত্রা করেন, যেখানে তিনি পণ্ডিত বাবা শ্রী রাম কৃষ্ণদাসজির তত্ত্বাবধানে বাস করতেন। [২]

পণ্ডিত বাবা তাঁর একমাত্র বেশ শিষ্য শ্রী বিনোদ বিহারী গোস্বামীকে ফণীন্দ্র নাথের গুরু হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। ফণীন্দ্র শ্রী বিনোদ বিহারী গোস্বামীর কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা লাভ করেন এবং হরিদাস নামে তাঁর শিষ্য হন। এক বছর পর, শ্রী হরিদাস তাঁর কাছ থেকে বাবাজী-বেষ দীক্ষা লাভ করেন। তিনি তাঁর গুরুর সাথে বাস করতেন এবং অত্যন্ত ভক্তি সহকারে তাঁর সেবা করতেন। তিনি কয়েক বছর ধরে তাঁর গুরুর নিকটে থেকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন অধ্যয়ন করেন। তার গুরুর কাছ থেকে অধ্যয়ন করার পাশাপাশি, তিনি বৃন্দাবনের অন্যান্য বিখ্যাত পণ্ডিত, যেমন পণ্ডিত অমোলাক্রম শাস্ত্রী এবং ধনঞ্জয় দাসের কাছেও অধ্যয়ন করেন।

পরে, তার গুরুর নির্দেশে, শ্রী হরিদাস তারপর বেনারস যান যেখানে তিনি বারো বছর ভারতীয় দর্শন অধ্যয়ন করেন। তিনি ভারতীয় দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের ষড় দর্শন কভারিং করে নয়টি স্নাতক ডিগ্রি এবং তিনটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি বেনারসের শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত, যেমন বামাচরণ শাস্ত্রী এবং হরেরাম শাস্ত্রীর অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন।

তাঁর বিভিন্ন ডিগ্রী তাঁর বইগুলিতে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে (উদাহরণস্বরূপ, [৪]): কাব্য-তীর্থ, ব্যাকরণ-তীর্থ, সাংখ্য-তীর্থ, মীমাংসা-তীর্থ, বেদান্ত-তীর্থ, বৈশেষিক-তীর্থ, নব্য-ন্যায়-শাস্ত্রী, নব্য-ন্যায়াচার্য, তর্ক-তীর্থ (প্রত্যক্ষ), তর্ক-তীর্থ (অনুমান), তর্ক-তীর্থ (শব্দ) এবং বৈষ্ণব-দর্শন-তীর্থ।

তিনি ১৯৬৫ সালে বৃন্দাবনের কালীয়দহে শ্রী হরিদাস নিবাস আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। [২] এই আশ্রমের কেন্দ্রে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু এবং শ্রী গদাধর পণ্ডিত বিগ্রহ শোভিত বৃন্দাবনের প্রথম প্রধান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

পরম্পরা[সম্পাদনা]

শ্রী হরিদাস শাস্ত্রী ছিলেন গদাধর পরিবারের অন্তর্গত। [৩]গদাধর পরিবার হল গুরু-শিষ্যের একটি পরম্পরা যা শ্রী গদাধর পণ্ডিতের থেকে উদ্ভূত হয়েছে। [৫] শ্রী গদাধর পণ্ডিত শ্রী ভুগর্ভ গোস্বামী সহ বেশ কিছু শিষ্যকে দীক্ষা দিয়েছিলেন। শ্রী হরিদাস শাস্ত্রী শ্রী ভূগর্ভ গোস্বামীর পরম্পরার অন্তর্গত।

গদাধর-গৌর হরি প্রেস[সম্পাদনা]

শ্রীহরিদাস শাস্ত্রী গদাধর-গৌর হরি প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্যদের রচনা, প্রধানত জীব গোস্বামী-এর রচনা যা মূলত সংস্কৃত ভাষায় ছিল, জনসাধারণের কাছে সহজে বোধগম্য করে তোলা। তিনি সংস্কৃত ও হিন্দিতে প্রায় ৬০টি বই অনুবাদ ও প্রকাশ করেন। এই বইগুলির মধ্যে অনেকগুলিই তার নিজস্ব ভাষ্য ছিল। তিনিই সর্বপ্রথম জীব গোস্বামীর ষট সন্দর্ভ হিন্দিতে অনুবাদ ও তার টীকা করেন।[২] তিনি শ্রী গৌর-গদাধর গ্রন্থাগারম্ নামে একটি গ্রন্থাগারও প্রতিষ্ঠা করেন যা বর্তমানে বৃন্দাবনে অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে একটি। এডেলম্যান উল্লেখ করেন, "গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্যের বহু শিক্ষাবিদ হরিদাস শাস্ত্রী প্রকাশিত গোস্বামী সাহিত্যের সংস্করণ ব্যবহার করেছেন।" [৩]

তার ষট সন্দর্ভ গ্রন্থের অনুবাদ ও ভাষ্যের মূল উৎস ছিল পুরীদাস মহাশয়ের (১৮৯৫-১৯৫৮) সংস্করণ।

বেদান্তদর্শনম্[সম্পাদনা]

শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু ব্যাখ্যা করেছিলেন, শ্রীমদ্ভাগবতম্ হল বেদান্ত-সূত্র এর অকৃত্রিম ভাষ্য। কিন্তু দুটি ধর্মগ্রন্থের পৃথক শ্লোক কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি। শ্রী হরিদাস শাস্ত্রী গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যের এই মূল শূন্যতা তাঁর বেদান্ত-দর্শনম গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশের মাধ্যমে দূর করেছেন। [৬] এই বইটি ব্যাখ্যা করে কিভাবে শ্রীমদ্ভাগবতমের একটি শ্লোক বা শ্লোকসমূহ একটি নির্দিষ্ট বেদান্ত-সূত্রের উপর মন্তব্য করে। এই কাজটি তার পাণ্ডিত্যের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী, এবং বেনারসের নাগরী প্রচারণী সভা দ্বারা একটি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিল। [২]

তিনি গো-প্রেমিক ছিলেন এবং তাঁর আশ্রমে একটি গোশালা ছিল। তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রতিটি গরুর দেখাশোনা করতেন এবং তাদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তিনি ১৯৮১ সালের দিকে মাত্র দুটি গরু এবং একটি ষাঁড় দিয়ে তার গোশালা শুরু করেছিলেন এবং যখন তিনি তার দেহ ছেড়েছিলেন তখন গোশালাটি ২৫০টি গরু এবং ষাঁড়ে পূর্ণ হয়েছিল। তিনি যে পরিষেবাগুলি শুরু করেছিলেন তা তাঁর অনুপস্থিতিতে যেন অব্যাহত থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য, তিনি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের সাথে শ্রী হরিদাস শাস্ত্রী গাভী ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।

গ্রন্থবিবরণী[সম্পাদনা]

গ্রন্থ[সম্পাদনা]

  1. বেদান্ত-দর্শনম্ ভাগবত ভাগ্যোপেতম্
  2. শ্রী-সাধনামৃত-চন্দ্রিকা
  3. শ্রী-গৌর-গোবিন্দার্চন-পদ্ধতি
  4. শ্রী-রাধা-কৃষ্ণার্চন-দীপিকা
  5. শ্রী-গোবিন্দ-লীলামৃতম্ (৩ খণ্ড)
  6. ঐশ্বর্য-কাদম্বিনী
  7. শ্রী-সংকল্প-কল্প-দ্রুম
  8. চতুঃশ্লোকী-ভাষ্যম্ এবং শ্রী-কৃষ্ণ-ভজনামৃত
  9. প্রেম-সম্পুট
  10. শ্রী-ভগবদ-ভক্তি-সার-সমুচ্চয়
  11. ব্রজ-রীতি-চিন্তামণি
  12. শ্রী-গোবিন্দ-বৃন্দাবনম্
  13. শ্রী-কৃষ্ণ-ভক্তি-রত্ন-প্রকাশ
  14. শ্রী-হরি-ভক্তি-সার-সংগ্রহ
  15. ধর্মসংগ্রহ
  16. শ্রী-চৈতন্য-সূক্তি-সুধাকর
  17. শ্রী-নামামৃত-সমুদ্র
  18. সনৎ-কুমার-সংহিতা
  19. শ্রুতি-স্তুতি-ব্যাখ্যা
  20. রাস-প্রবন্ধ
  21. দিন-চন্দ্রিকা
  22. শ্রী-সাধন-দীপিকা
  23. স্বকীয়াত্ত্ব-নিরাস-পরকীয়াত্ব-নিরুপণম্
  24. শ্রী-রাধা-রস-সুধা-নিধি (মূল)
  25. শ্রী-রাধা-রস-সুধা-নিধি (সানুবাদ)
  26. শ্রী-গৌরাঙ্গ-চন্দ্রোদয়
  27. শ্রী-চৈতন্য-চন্দ্রামৃতম্
  28. শ্রী-ব্রহ্ম-সংহিতা
  29. ভক্তি-চন্দ্রিকা
  30. প্রমেয়-রত্নাবলী এবং নবরত্ন
  31. বেদান্ত-স্যামন্তক
  32. তত্ত্ব-সন্দর্ভঃ
  33. ভাগবত-সন্দর্ভঃ
  34. পরমাত্ম-সন্দর্ভঃ
  35. কৃষ্ণ-সন্দর্ভঃ
  36. ভক্তি-সন্দর্ভঃ
  37. প্রীতি-সন্দর্ভঃ
  38. দশঃ-শ্লোকী ভাষ্যম্
  39. ভক্তি-রসামৃত-শেষ
  40. শ্রী-চৈতন্য-ভাগবত (শুধু হিন্দি প্রতিবর্ণীকরণ)
  41. শ্রী-চৈতন্য-চরিতামৃত-মহা-কাব্যম্
  42. শ্রী-চৈতন্য-মঙ্গল (শুধু হিন্দি প্রতিবর্ণীকরণ)
  43. শ্রী-গৌরাঙ্গ-বিরুদাবলী
  44. শ্রী-কৃষ্ণ-চৈতন্য-চরিতামৃত
  45. শত-সঙ্গম
  46. নিত্য-কৃত্য-প্রকরণম্
  47. শ্রীমদ্-ভাগবত-প্রথম-শ্লোক
  48. শ্রী-গায়ত্রী-ব্যাখ্যা-বিবৃতিঃ
  49. শ্রী-হরি-নামামৃত-ব্যাকরণম্
  50. শ্রী-কৃষ্ণ-জন্ম-তিথি-বিধিঃ
  51. শ্রী-হরি-ভক্তি-বিলাসঃ
  52. কাব্য-কৌস্তুভঃ
  53. শ্রী-চৈতন্য-চরিতামৃত (শুধু হিন্দি প্রতিবর্ণীকরণ)
  54. অলঙ্কার-কৌস্তুভ
  55. শ্রী-গৌরাঙ্গ-লীলামৃতম্
  56. শিক্ষাষ্টকম্
  57. সংক্ষেপ-শ্রী-হরি-নামামৃত-ব্যাকরণম্
  58. প্রযুক্তাখ্যাত মঞ্জরী
  59. ছন্দো কৌস্তুভ
  60. হিন্দু-ধর্ম-রহস্যম্ বা সর্ব-ধর্ম-সমন্বয়ঃ
  61. সাহিত্য-কৌমুদী
  62. গো-সেবা
  63. রাসলীলা
  64. শ্রী মন্ত্র-ভাগবতম্

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sri Guru Darsanam। Shri Haridas Shastri Goseva Sansthan। ২০১৫। আইএসবিএন 978-81-929328-0-4 
  2. Śrī Guru Smaraṇam। ২০১৪। 
  3. Edelmann, Jonathan (২০১৪)। "Book Review of Jīva Gosvāmin. Śrī Bhagavat Sandarbha: God—His Qualities, Abode and Associates. Sanskrit Text with English Translation and Jīva-toṣaṇī Commentary. Translated and edited by Satyanarayana Dasa. Vrindavan, India: Jiva Institute of Vaishnava Studies.": 78। 
  4. Sāhitya Kaumudi। Vrindavan: Śrī Gadādhara Gaurahari press। ২০০৮। 
  5. "Our Guru Shishya parampara"sriharidasniwas.org। নভেম্বর ৭, ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ১, ২০১৭ 
  6. Vedāntadarśanam। Vrindavan: Gadādhara Gaurahari press। 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]