পাকবিড়রা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পাকবিড়রা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার পুরুলিয়া শহর থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে পুঞ্চা থানার অন্তর্গত পুঞ্চা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের প্রত্নস্থল। পাকবিড়রার পুরাক্ষেত্রের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে সঠিক সিদ্ধান্তে এখনো উপনীত হওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় এই অঞ্চলের ভাস্কর্য ও স্থাপত্য আনুমানিক দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর।[১]:১৮২

মূর্তি[সম্পাদনা]

এই স্থানে অজস্র জৈন সম্প্রদায়ের মূর্তি এক বিশাল ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নিম্নে তাদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল[১]:১৭৬-১৮১

মূর্তি চিত্র বৈশিষ্ট্য
শীতলনাথ
সাত ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট কালো পাথরে খোদাই করা একটি কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান মূর্তি। এই মূর্তির নিচে চামর হাতে একটি পুরুষ মূর্তি ও লাঞ্ছনচিহ্ন শ্রীবৎস বর্তমান।
শীতলনাথ তিন ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ও দুই ফুট দুই ইঞ্চি প্রস্থের মূর্তি। মূর্তির দুপাশে খোদিত চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি। নিচের দিকে খোদিত দুইটি সিংহমূর্তি। লাঞ্ছনচিহ্ন কল্পবৃক্ষ।
শীতলনাথ ভগ্নমূর্তি, কায়োৎসর্গ মুদ্রায় পদ্মের ওপর দন্ডায়মান ছিল। ভগ্ন অংশের উচ্চতা তিন ফুট। মূর্তির দুপাশে খোদিত তীর্থঙ্করের মূর্তি, চামর হাতে দুইটি পুরুষ মূর্তি। লাঞ্ছনচিহ্ন কল্পবৃক্ষ।
পার্শ্বনাথ তিন ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ও দুই ফুট দুই ইঞ্চি প্রস্থের একটি কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান মূর্তি। এই মূর্তির ওপরে গন্ধর্ব ও গন্ধর্বীর মূর্তি খোদিত এবং নিচের দিকে লাঞ্ছনচিহ্ন সাপের মূর্তি বর্তমান।
পার্শ্বনাথ ভগ্নমূর্তি, কায়োৎসর্গ মুদ্রায় পদ্মের ওপর দন্ডায়মান ছিল। দুপাশে নাগকন্যা ও চামরধারী মূর্তির অস্তিত্ত্ব বর্তমানে নেই। নিচে উপাদনারত নারী ও সিংহ মূর্তি বর্তমান।
আদিনাথ তিন ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার ও দুই ফুট পাঁচ ইঞ্চি প্রস্থের একটি কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান মূর্তি। মূর্তির দুপাশে খোদিত চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি। দুইধারে চামর হাতে দুইটি পুরুষ মূর্তি। লাঞ্ছনচিহ্ন বৃষ ও তার দুইপাশে সিংহ, রমণী ও জম্বুদ্বীপের মূর্তি।
আদিনাথ সাড়ে তিন ফুট উচ্চতার মূর্তি। মূর্তির দুপাশে খোদিত চার জন তীর্থঙ্করের মূর্তি। লাঞ্ছনচিহ্ন বৃষ, নিচে দুই পাশে দুইটি সিংহ, নারী ও চামর হাতে দুই পুরুষ মূর্তি এবং ওপরের দুই পাশে বাদ্যবাদনরত মূর্তি রয়েছে।
আদিনাথ দন্ডায়মান মূর্তি। দুপাশে তিনটি সারিতে ছয়টি করে মোট বারোজন তীর্থঙ্কর বর্তমান, যাদের মধ্যে ওপরের চার জন দণ্ডায়মান ও বাকিরা পদ্মাসনে আসীন। লাঞ্ছনচিহ্ন বৃষ সুস্পষ্ট। নিচে দুই পাশে চামর হাতে দুইটি মূর্তি বর্তমান।
আদিনাথ চার ফুট উচ্চতার ও দুই ফুট ছয় ইঞ্চি প্রস্থের পদ্মের ওপর কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান মূর্তি। মূর্তির দুপাশে খোদিত চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি। দুইধারে চামর হাতে দুইটি পুরুষ মূর্তি। লাঞ্ছনচিহ্ন বৃষ ও সর্বনিম্নে সিংহ ও রমণী মূর্তি বর্তমান।
আদিনাথ ভগ্নমূর্তি, কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান ছিল। লাঞ্ছনচিহ্ন বৃষ ও দুইধারে চামরধারীর ভগ্ন মূর্তি।
আদিনাথ ভগ্নমূর্তি, পা দুটি বর্তমান। দুইধারে চামরধারীর দুইটি মূর্তি খোদিত। নিচের দিকে কয়েকজন তীর্থঙ্করের খোদিত মূর্তি
আদিনাথ ভগ্নমূর্তি, মস্তক অংশ খন্ডিত। আনুমানিক উচ্চতা পাঁচ ফুট। দুইধারে চামরধারীর দুইটি মূর্তি ও সিংহের মূর্তি অক্ষত। লাঞ্ছনচিহ্ন বৃষ।
মহাবীর তিন ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার ও দুই ফুট প্রস্থের মূর্তি। চারদিকে সরস্বতী, ভৈরবনাথ প্রভৃতির মূর্তি খোদিত। দুইধারে চামরধারীর মূর্তি। তিনটি সিংহ মূর্তি।
চন্দ্রপ্রভ দুই ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার ও এক ফুট প্রস্থের মূর্তি। লাঞ্ছনচিহ্ন অর্ধচন্দ্র।
চন্দ্রপ্রভ ভগ্নমূর্তি, কায়োৎসর্গ মুদ্রায় পদ্মের ওপর দন্ডায়মান ছিল। বর্তমানে দুইটি পা ও লাঞ্ছনচিহ্ন বর্তমান। দুপাশে দুইটি উপাসনারত রমণী মূর্তি বর্তমান।
অজিতনাথ ভগ্নমূর্তি, বর্তমানে দুইটি পা ও লাঞ্ছনচিহ্ন হস্তীমূর্তি বর্তমান। দুপাশে দুইটি উপাসনারত রমণী মূর্তি ও একটি সিংহ বর্তমান।
বিমলনাথ ভগ্নমূর্তি, লাঞ্ছনচিহ্ন শূকর দেখে মূর্তি শনাক্ত করা যায়। নিচে দুইটি সিংহ মূর্তি ও উপাসনারত দুইটি নারী মূর্তি।
অম্বিকা তিন ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার ও দুই ফুট তিন ইঞ্চি প্রস্থের মূর্তি। দুইপাশে দুইটি রমণী মূর্তির মধ্যে একটি বিনষ্ট। এছাড়াও একটি সিংহমূর্তি বর্তমান।
অম্বিকা ছোট মূর্তি। দেবী মূর্তি সিংহারূঢ়া।
চক্রেশ্বরী গরুড়ের ওপর উপবিষ্টা অষ্টভূজা দেবীমূর্তি। আট হাতে আটটি অস্ত্র বর্তমান। দুইপাশে দুইটি সিংহ মূর্তি, নিচের দিকে তীর ধনুক হাতে দুইটি পুরুষমূর্তি। সর্বনিম্নে চক্র খোদিত রয়েছে।
শিশু কোলে যুগল তিন ফুট নয় ইঞ্চি উচ্চতার ও দুই ফুট চার ইঞ্চি প্রস্থের পুরুষ ও নারীর মূর্তি। উভয়ের বাম হাতে ছোট শিশু সন্তান। নিচে কলস ও তার নিচে বাঘের পিঠে চারটি শিশু হাতে চারজন রমণী মূর্তি।

চৈত্য[সম্পাদনা]

পাকবিড়ার পুরাক্ষেত্রে চারটি চৈত্যের অস্তিত্ব বর্তমান। চৈত্যগুলির উচ্চতা আড়াই থেকে তিন ফুটের মধ্যে। প্রতিটি চৈত্যের চারদিকে চারজন তীর্থঙ্করের মূর্তি ও তাদের লাঞ্ছনচিহ্ন বর্তমান। প্রথম চৈত্যে পার্শ্বনাথ, কুন্থুনাথ, আদিনাথমহাবীর, দ্বিতীয় চৈত্যে অরনাথ, শান্তিনাথ, চন্দ্রপ্রভঅজিতনাথ, তৃতীয় চৈত্যে চন্দ্রপ্রভ, আদিনাথ, পার্শ্বনাথশান্তিনাথ এবং চতুর্থ চৈত্যে পার্শ্বনাথ, মহাবীর, চন্দ্রপ্রভআদিনাথ তীর্থঙ্করের মূর্তি।[১]:১৮১

দেউল[সম্পাদনা]

পাকবিড়রার দুইটি প্রাচীন দেউল

পাকবিড়ায় বর্তমানে একটিও পূর্ণাঙ্গ প্রাচীন দেউল নেই। বর্তমান তিনটি দেউলের অস্তিত্ব রয়েছে। এই দেউলগুলির প্রবেশপথে কারুকার্যমন্ডিত কোন খিলান নেই। প্রথম দেউলটিতে সাড়ে চার ফুট উচ্চ ও দুই ফুট প্রস্থের পদ্মের ওপর কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান শান্তিনাথ তীর্থঙ্করের মূর্তি বর্তমান। মূর্তির চারপাশে চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি, দুইপাশে দুইটি চামরধারী মূর্তি ও লাঞ্ছনচিহ্ন হরিণের মূর্তি বর্তমান। দেউলের ভেতরে পাথরের ওপর খোদিত একটি লিপি বর্তমান যার পাঠোদ্ধার এখনো পর্যন্ত হয়নি। উত্তরমুখী এই দেউলের প্রবেশপথের ডানদিকে চার ফুট লম্বা ও দুই ফুট চওড়া তীর্থঙ্করের পট রয়েছে, যার ষোলটি সারির প্রতিটিতেই চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি খোদিত রয়েছে। পটটির শীর্ষদেশে ধ্যানরত আদিনাথ তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে। দ্বিতীয় দেউলের ভেতরে উচ্য বেদীতে চার ফুট লম্বা পদ্মের ওপর কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দন্ডায়মান আদিনাথ তীর্থঙ্করের মূর্তি বর্তমান। মূর্তির চারপাশে চব্বিশ জন তীর্থঙ্করের মূর্তি, দুইপাশে দুইটি চামরধারী মূর্তি এবং ওপরে গন্ধর্ব ও গন্ধর্বীর মূর্তি রয়েছে। তৃতীয় দেউলটি পঁচিশ ফুট উচ্চ ও এতে কোন মূর্তি নেই।[১]:১৮২

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সুভাষ রায়, পুরুলিয়া জেলার পুরাকীর্তি, পুরুলিয়ার কয়েকটি প্রত্নস্থল, অনৃজু প্রকাশনী, চেলিয়ামা, পুরুলিয়া, ৭২৩১৪৬, প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৪১৯