খাড়ি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

খাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার রায়দিঘি থানার অন্তর্গত আদিগঙ্গার পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি প্রত্নস্থল।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

উত্তর-পশ্চিম সুন্দরবন-এর অন্তর্গত এই গ্রামটি হিন্দুযুগের প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান 'খাড়ি-মণ্ডল' বা 'খাড়ি বিষয়'-এর ভৌগোলিক স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। এই অঞ্চলের নিকট দিয়ে ভাগীরথী বা 'আদিগঙ্গা' অজস্র সংকীর্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত৷ প্রাচীন ভাগীরথীর পশ্চিমতীর ছিল 'পশ্চিমখাড়ি' (এর অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান হাওড়া জেলার 'বেতড়') এবং পূর্বতীর ছিল 'পূর্বখাড়ি' (বর্তমান খাড়ি গ্রাম)। এই পূর্বখাড়ি ছিল পাল ও সেনযুগের পৌণ্ড্রবর্ধনভুক্তির অধীনে।[১]

দশম-একাদশ শতাব্দীতে রচিত বৌদ্ধ ডাকার্ণব তন্ত্র গ্রন্থে খাড়িকে বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের চৌষট্টি পীঠের একটি পীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খাড়ি গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত লাট বকুলতলা থেকে আবিষ্কৃত লক্ষ্মণ সেনের তাম্রলিপিতে খাড়িকে পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির একটি মন্ডল হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে।[২]:৮৬

পুরাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

সাবেক চব্বিশ পরগনা অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সেনরাজা বিজয়সেনলক্ষ্মণসেন-এর দুটি তাম্রপট্টলিপিতে খাড়িকে একটি 'বিষয়' (বিজয়সেনের বারাকপুরলিপি) এবং 'মণ্ডল' (লক্ষণসেনের সুন্দরবনলিপি) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই 'বিষয়' বা 'মণ্ডল' অনেকটা আধুনিক 'মহকুমা'র মত ছিল বলে অনুমিত হয়।
লক্ষ্মণসেনের সুন্দরবনলিপি থেকে জানা যায়, দ্বাদশ শতকের শেষে (১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ) অযোধ্যা থেকে আগত পালবংশের 'মহারাজাধিরাজ' উপাধিধারী শ্রীমদ্ ডোম্মনপাল নামে এক সামন্ত রাজা 'পূর্বখাড়ি'তে (বর্তমান খাড়ি গ্রাম) স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন।
লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের শেষদিকে তাঁর অধীন সামন্তরাজারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীনতা করায় কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ছিল। এখানকার জাতিভেদ-বর্ণপ্রথা জর্জরিত পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়মাহিষ্যপ্রধান হিন্দুসমাজ শ্রীমদ্ ডোম্মনপালের নেতৃত্বে সামাজিক বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল বলে অনুমান করা হয়।[১]

ঐতিহাসিক নিদর্শন[সম্পাদনা]

খাড়ি গ্রামের নারায়ণীতলায় একটি সাধারণ ইটের ঘরে শক্তিমূর্তি 'নারায়ণী'র অধিষ্ঠান; মূর্তিটি চতুর্ভূজা, ত্রিনয়না ও সিংহবাহিনী। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতেই এই ধরনের তান্ত্রিক পীঠস্থানের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়।[৩] নারায়ণী মূর্তির পাশেই ঘোড়ার পিঠে আসীন ধর্মযোদ্ধা গাজীসাহেবের (পীর বড়খাঁ গাজী) মূর্তি অবস্থিত। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গাজীসাহেবের পূজারী ভক্ত বিদ্যমান। সেনরাজত্বকালের শেষে এখানকার জাতিভেদ-বর্ণপ্রথা জর্জরিত নিম্নবর্গীয় হিন্দুসমাজের মুসলমান পীর-গাজী সাহেবদের থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের স্পষ্ট আভাস মেলে। ইংরেজ আমলে পাদরী সাহেবদেরও খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অন্যতম ক্ষেত্র ছিল এটি৷ ১৮৫৭ সালেই খাড়ি গ্রামে একটি গির্জা, একটি ইংরেজি স্কুল এবং বহু বাঙালি খ্রিস্টানের (ধর্মান্তরিত) বিবরণ পাওয়া যায়।[৪] সমাজ ও সংস্কৃতির বিভিন্ন সময়ের স্তর আজও খাড়ি গ্রামে সুবিন্যস্ত।[১]

প্রত্নসামগ্রী[সম্পাদনা]

ঊনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে সুন্দরবন অঞ্চলের জঙ্গল কাটার সময় খাড়ি অঞ্চলে বেশ কিছু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। এছাড়া ব্রোঞ্জ ও পাথর নির্মিত বেশ কয়েকটি মূর্তি ও অন্যান্য প্রত্নসামগ্রী এই অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অঞ্চল থেকে আবিষ্কৃত আনুমানিক দশম-একাদশ শতাব্দীতে নির্মিত কালো পাথরের দুইটি বিষ্ণুমূর্তি ও কালো পাথরের তিনটি অলঙ্কৃত দেওয়াল স্তম্ভ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহালয়ে সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে একটি প্রাচীন দক্ষিণমুখী, ত্রিখিলান একরত্ন রাধা-গোবিন্দ মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।[২]:৮৫

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২৬১-২৬৪
  2. সাগর চট্টোপাধ্যায়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার পুরাকীর্তি, প্রকাশনা প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ৩৩ চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউ, কলকাতা-৭০০০১২, প্রথম প্রকাশ, ২০০৫
  3. The Sakta Pithas: Dr. D.C. Sirkar: J.A.S.B. Letters, Vol. 14, Ne 1948
  4. Hunter: Statistical Account of Bengal, Vol. 1, page-235