লালকেল্লা
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান | |
---|---|
মানদণ্ড | সাংস্কৃতিক: ii, iii, iv |
সূত্র | 231 |
তালিকাভুক্তকরণ | ২০০৭ (৩১ তম সভা) |
লালকেল্লা (হিন্দি: लाल क़िला; উর্দু: لال قلعہ; ইংরেজি: Red Fort) খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রাচীর-বেষ্টিত পুরনো দিল্লি (অধুনা দিল্লি, ভারত) শহরে মুঘল সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক নির্মিত একটি দুর্গ। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এই দুর্গটি ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। এরপর ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নির্বাসিত করলে ভারতের রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশরা এই দুর্গটিকে একটি সামরিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করত। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র এবং ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের একটি শক্তিশালী প্রতীক। প্রতি বছর ভারতীয় স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লার লাহোরি গেটসংলগ্ন একটি স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে থাকেন। ২০০৭ সালে লালকেল্লা ইউনেস্কো বিশ্বঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে নির্বাচিত হয়।
১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান সুবৃহৎ এই কেল্লাটির নির্মাণকার্য শুরু করেন। নির্মাণকার্য শেষ হয় ১৮৪৮ সালে।[১] প্রথম দিকে এই দুর্গের নাম ছিল 'কিলা-ই-মুবারক' ('আশীর্বাদধন্য দুর্গ'); কারণ এই দুর্গে সম্রাটের পরিবারবর্গ বাস করতেন। দুর্গটি যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। এই নদীর জলেই পুষ্ট হত দুর্গপ্রাকারের পরিখাগুলো। দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণের প্রাচীর সালিমগড় দুর্গ নামে অপর একটি প্রাচীন দুর্গের সঙ্গে সংযুক্ত। ১৫৪৬ সালে ইসলাম শাহ সুরি এই প্রতিরক্ষা দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। লালকেল্লার পরিকল্পনা ও সাজসজ্জা শাহজাহানের শাসনকালে মুঘল স্থাপত্য ও চিত্রকলার উৎকর্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে লালকেল্লা ছিল দিল্লিক্ষেত্রের সপ্তম নগরী তথা শাহজাহানের নতুন রাজধানী শাহজাহানাবাদের রাজপ্রাসাদ। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি দিল্লি থেকে আগ্রা শহরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন।
লালকেল্লায় বসবাসকারী শেষ মুঘল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর ১৭ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর লালকেল্লা পরিত্যাগ করেন। পরে তিনি ব্রিটিশ বন্দী হিসেবে এই দুর্গে ফিরে আসেন। এখানেই ১৮৫৮ সালের ২৭ জানুয়ারি তার বিচার শুরু হয় এবং ৭ অক্টোবর তাকে নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর লালকেল্লার কর্তৃত্ব ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। তারা এটিকে একটি ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের পরাজয়ের পর লাল কেল্লাতেই যুদ্ধবন্দীদের বিচার হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত এই কেল্লাটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন।
স্থাপত্য
[সম্পাদনা]লালকেল্লার অলংকরণ ও শিল্পকর্ম অতি উচ্চমানের। পারসিক, ইউরোপীয় ও ভারতীয় শিল্পকলার সংমিশ্রণে সৃষ্ট এই অভিনব শিল্পকলা ব্যঞ্জনাময়, বর্ণময় এবং স্বতন্ত্রতার দাবিদার। দিল্লির লালকেল্লা ভারতের সেই সকল স্থাপনাগুলোর অন্যতম যার সঙ্গে ভারতীয় শিল্পের যোগ ঐতিহাসিকসূত্রে গ্রথীত। স্থাপত্যসৌন্দর্যের বিচারেও এই দুর্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে ১৯১৩ সালে লালকেল্লা জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন স্থাপনা রূপে ঘোষিত হয় এবং সরকার কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে।
দুর্গের প্রাচীর মসৃণ এবং দৃঢ়। দুর্গের দুটি প্রধান দরজা : দিল্লিগেট ও লাহোরগেট। লাহোরগেট হল প্রধান দরজা। এই গেট দিয়ে ঢুকলে একটি লম্বা আচ্ছাদিত বাজারপথ পড়ে। এর নাম চট্টাচক। এই পথের দু দিকের দেওয়াল দোকানের মতো করে স্টল দিয়ে সাজানো। চট্টাচক ধরে সোজা এলে উত্তর-দক্ষিণ পথ পাওয়া যায়। এই পথটি আসলে দুর্গের পশ্চিমের সামরিকক্ষেত্র ও পূর্বের রাজপ্রাসাদের সীমানা। এই পথের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দরজাটিই হল দিল্লিগেট।
লাল কেল্লার অভ্যন্তরীণ স্থাপনাসমূহ
[সম্পাদনা]দিওয়ান-ই-আম
[সম্পাদনা]দিল্লিগেটের বাইরে একটি বড়ো মুক্তাঙ্গন রয়েছে। এটি এককালে দিওয়ান-ই-আম-এর অঙ্গন রূপে ব্যবহৃত হত। এখানে ঝরোখা নামে একটি অলংকৃত সিংহাসনে বসে সম্রাট জনসাধারণকে দর্শন দিতেন। এই স্তম্ভগুলো সোনায় চিত্রিত ছিল এবং সোনা ও রুপোর রেলিং দিয়ে সাধারণকে সিংহাসনের থেকে পৃথক করে রাখা হত।
দিওয়ান-ই-খাস
[সম্পাদনা]দিওয়ান-ই-খাস ছিল পুরোপুরি শ্বেতপাথরে মোড়া একটি কক্ষ। এর স্তম্ভগুলো পুষ্পচিত্রে সজ্জিত ছিল। ভিতরের অলংকরণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রায়-মহামূল্যবান ধাতুসমূহ।
নহর-ই-বেহিস্ত
[সম্পাদনা]সিংহাসনের পশ্চাতে ছিল সম্রাটপরিবারের নিজস্ব কক্ষগুলো। এই কক্ষগুলো দুর্গের পূর্বপ্রান্ত-ঘেঁষা দুটি কক্ষের সারির উপর অবস্থিত ছিল। এই সারি দুটি উচ্চ বেদীর উপর অবস্থিত ছিল এবং কক্ষগুলো থেকে যমুনা নদীর দৃশ্য দেখা যেত। কক্ষগুলো নহর-ই-বেহিস্ত (স্বর্গোদ্যানের জলধারা) নামে একটি নীরবচ্ছিন্ন জলধারা দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই জলধারা প্রত্যেক কক্ষের মাঝ বরাবর প্রসারিত ছিল। যমুনা নদী থেকে দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত শাহবুর্জ নামে একটি মিনারে জল টেনে তুলে এই জলধারাকে পুষ্ট করা হত। প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল কুরআনে বর্ণিত স্বর্গোদ্যানের অনুকরণে। প্রাসাদের ভিতরের গাত্রে 'যদি পৃথিবীতে কোথাও স্বর্গ থাকে তবে তা এখানেই, তা এখানেই, তা এখানেই' কথাটি উপর্যুপরি দেওয়ালে খোদিত হয়েছিল। ইসলামি শিল্পকলা অনুযায়ী নির্মিত হলেও এই সব কক্ষে হিন্দু শিল্পকলার প্রভাবও খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাসাদ প্রাঙ্গনটিকে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলে মনে করা হয়।
জেনানা
[সম্পাদনা]প্রাসাদের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত কক্ষ দুটি ছিল জেনানা বা মহিলাদের বাসস্থান। ছোটো কক্ষটির নাম মুমতাজ মহল (বর্তমানে একটি সংগ্রহালয়) এবং অপরটির নাম রংমহল। রংমহল তার চাকচিক্যময় অলংকৃত সিলিং এবং নহর-ই-বেহিস্ত-এর জলধারাপুষ্ট শ্বেতপাথরের জলাধারটির জন্য প্রসিদ্ধ।
মোতি মসজিদ
[সম্পাদনা]হামামের পশ্চিমে রয়েছে মোতি মসজিদ । এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল অনেক পরে। ১৬৫৯ সালে শাহজাহানের পুত্র আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগত মসজিদ হিসেবে এটি নির্মাণ করেন। এটি একটি ছোটো, তিন-গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এটি পুরো শ্বেতপাথরে নির্মিত।
হায়াত বক্স বাগ
[সম্পাদনা]কেল্লার উত্তরে রয়েছে একটি আনুষ্ঠানিক উদ্যান। এর নাম হায়াত বক্স বাগ বা জীবন প্রদায়ী উদ্যান। উদ্যানটি দুটি পরস্পরচ্ছেদী জলধারা দ্বারা বিভক্ত। উত্তর-দক্ষিণ জলধারাটির দুই প্রান্তে দুটি কক্ষ রয়েছে। ১৮৪২ সালে শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর তৃতীয় কক্ষটি নির্মাণ করেন উদ্যানকেন্দ্রে দুই জলধারার ছেদনস্থলের উপরে।
আজকের লালকেল্লা
[সম্পাদনা]লালকেল্লা পুরনো দিল্লির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। প্রতিবছর সহস্রাধিক পর্যটক এই কেল্লাটি দেখতে আসেন। এই কেল্লার প্রাঙ্গনেই প্রতি বছর ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। লালকেল্লা পুরনো দিল্লির বৃহত্তম স্থাপনাও বটে।
বর্তমানে সন্ধ্যায় লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’র মাধ্যমে কেল্লায় মুঘল ইতিহাসের প্রদর্শনী করা হয়। এখানে ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামে শহিদদের স্মৃতিতে একটি জাদুঘরও রয়েছে। এই জাদুঘর ছাড়াও রয়েছে একটি পুরাতাত্ত্বিক জাদুঘর ও একটি ভারতীয় যুদ্ধস্মারক সংগ্রহালয়।
২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে লস্কর-ই-তৈবা নামক জঙ্গিগোষ্ঠীর আক্রমণে লাল কেল্লা প্রাঙ্গনে দুই সেনা জওয়ান ও এক সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়।
আরও দেখুন
[সম্পাদনা]চিত্রাবলি
[সম্পাদনা]-
প্রধান দরজা লাহোরগেট
-
দিওয়ান-ই-আমের অন্দরসজ্জা
-
রংমহল
-
দিওয়ান-ই-খাস (বামে) ও খাসমহল (ডানে)
-
দিওয়ান-ই-খাসের অন্দরসজ্জা
-
দিওয়ান-ই-খাসের অন্দরসজ্জার অলংকরণ
-
মোতি মসজিদ
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Controversy: Though this fort was thought to be built in 1639, there are documents and a painting available of Shah Jahan receiving the Persian ambassador in 1638 at the jharokha in the Diwan-i-Aam in the Red fort. This painting preserved in the Bodleian Library, Oxford, was reproduced in the Illustrated Weekly of India (page 32) of 14 March 1971. However the painting shows the jharokha at Lahore, and not Delhi. See History of Mughal Architecture, R. Nath, Abhinav Publications, 2006