কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহ
এই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদটি একটি নির্দিষ্ট বিষয়কে উপস্থাপন করছে না। (আগস্ট ২০২০) |
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান | |
---|---|
কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহ | |
মানদণ্ড | সাংস্কৃতিক: iv |
সূত্র | 233 |
তালিকাভুক্তকরণ | ১৯৯৩ (১৭ তম সভা) |
কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহ দিল্লীর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। লাল বেলেপাথরে নিৰ্মিত এই মিনারটির উচ্চতা ৭২.৫ মিটার (২৩৮ ফুট)। মিনারটির পাদদেশের ব্যাস ১৪.৩২ মিটার (৪৭ ফুট) এবং শীৰ্ষঅংশের ব্যাস ২.৭৫ মিটার (৯ ফুট)। ত্ৰয়োদশ শতাব্দীর প্ৰথম দিকে এই মিনারের নিৰ্মাণকাৰ্য সমাপ্ত হয়। মিনার প্ৰাঙ্গনে আলাই দরজা (১৩১১), আলাই মিনার (এটি অসমাপ্ত মিনারের স্তূপ, এটা নিৰ্মাণের কথা থাকলেও, নিৰ্মাণকাৰ্য সমাপ্ত হয়নি), কুব্বত-উল-ইসলাম মসজিদ (ভারতের প্ৰাচীনতম মসজিদসমূহের অন্যতম, যেসব বৰ্তমানে আছে), ইলতোতমিসের সমাধি এবং একটি লৌহস্তম্ভ আছে। একাধিক হিন্দু এবং জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে এই মিনার নিৰ্মিত হয় বলে কথিত আছে। অনুমান করা হয় যে ভারতে ইসলাম শাসনের প্ৰথম দিকে বহিরাগত আক্ৰমণে এই মন্দিরসমূহ ধ্বংসপ্ৰাপ্ত হয়েছিল। প্ৰাঙ্গন কেন্দ্ৰস্থল ৭.০২ মিটার (২৩ ফুট) উচ্চতাবিশিষ্ট যেখানে চকচকীয়া লৌহস্তম্ভ আছে, যেখানে আজপৰ্যন্ত একটুও মরচে ধরেনি। এই লৌহস্তম্ভে সংস্কৃত ভাষায় দ্বিতীয় চন্দ্ৰগুপ্তের একটা লেখা আছে। ১১৯২ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক এই মিনারের নিৰ্মাণ কাজ আরম্ভ করেছিলেন। ইলতোতমিসের রাজত্বকালে (১২১১-৩৮) মিনারের কাজ শেষ হয়। আলাউদ্দিন খিলজীর রাজত্বকালে (১২৯৬-১৩১৬) এটার প্রাঙ্গণ এবং নির্মাণ নিৰ্মাণকাৰ্য সম্পাদন হয়। পরবৰ্তীকালে বজ্ৰপাতে মিনার ক্ষতিগ্ৰস্থ হয় যদিও তার সংস্কার করা হয়েছিল। ইসলামিক স্থাপত্য এবং শিল্পকৌশলের এক অনবদ্য প্ৰতিফলন হিসাবে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার (iv) বিভাগে এই প্রাঙ্গণ বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মৰ্যাদা লাভ করে।[১][২]
আলাই দরজা[সম্পাদনা]

কুতুব মিনার[সম্পাদনা]
কুওওতুল-ইস্লাম মস্জিদ[সম্পাদনা]
দিল্লী জয় করে কুৎবউদ্দীন আইবক সর্বপ্রথমে নির্মাণ করলেন জাম-ই-মস্জিদ, যার নাম ‘কুওওতুল ইস্লাম’ মস্জিদ।[৩] তার অর্থ ইস্লামের শক্তি।[৩]
মস্জিদের প্ল্যানিং একটি আয়তক্ষেত্র। চিরাচরিত পদ্ধতিতে তার পশ্চিমে মূল উপাসনাগৃহ; পূর্বে একটি গম্বুজের ভিতর দিয়ে রবেশদ্বার।[৩] তিন পাশে বারান্দা—সারি-সারি স্তম্ভের উপর সমতল ছাদ। ইস্লামী স্থাপত্যে যার নাম লিয়ান।[৩]
পরবর্তী সুলতান ইল্তুৎমিস্ এই মস্জিদটি সম্প্রসারিত করেন। তারও পরবর্তী যুগে, বস্তুত পরবর্তী খিল্জী বংশের আলাউদ্দীন খিল্জীর আমলে এই মস্জিদটি আরও বড় করে সম্প্রসারিত করা হয়।[৩]
এই কুওওতুল-ইস্লাম হিন্দু ও মুস্লীম একটি অদ্ভুত সংমিশ্রণ হয়েছে। আকবর পরিকল্পিত ফতেপুর-সিক্রিতে হিন্দু-মুস্লীম স্থাপত্যের সজ্ঞানকৃত সুষ্ঠু মিলন ঘটেছে, প্রীতির বন্ধনে, দেওয়া-নেওয়ার ছন্দে; এখানে তা নয়। এখানকার সংমিশ্রণ বিজিত ও বিজয়ীর বাধ্যতামূলক সহাবস্থান। কারণ কুৎবউদ্দীন কিল্লা রায় পিথোয়ায় সাতাশটি হিন্দু ও জৈন মন্দির ধ্বংস করেন।[৪] সেই মন্দিরের স্তম্ভগুলি সংগ্রহ করে এই মস্জিদের লিয়ানের অলিন্দ নির্মিত হয়।[৩] লিয়ানের উচ্চতা বৃদ্ধি করতে দুটি স্তম্ভকে মাথায়-মাথায় বসানো হয়েছে। মস্জিদ চত্বরের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় আবার ঐ স্তম্ভগুলিকে একরদ্দায় সাজিয়ে দ্বিতল মোকাম বানিয়ে ছন্দবৈচিত্র ঘটানো হয়েছে।[৩] তাই এ মস্জিদের স্তম্ভে হিন্দু-ভাস্কর্যের ছাপ—ফুল-লতা-পাতা, পদ্ম-শঙ্খ-ঘণ্টা-চক্র সবই হিন্দু-শৈলীর কারুকার্য। এমনকি খুঁজে পাওয়া যায় চতুর্ভুজ দেবতার মূর্তি।[৩]
স্তম্ভ শোভিত লিয়ান নয়, এ মস্জিদের সবচেয়ে দর্শনীয় বস্তুটি উপসনা-কক্ষের সম্মুখস্থ খিলান-সমন্বিত প্রাচীর—ইস্লামী স্থাপত্যে যার অভিধা: মাখ্সুরাহ্।[৩] কুৎবউদ্দীন নির্মিত আদিম মস্জিদে আছে পাঁচটি খিলান, কেন্দ্রস্থটি উচ্চতর, দু’পাশে দুটি অপেক্ষাকৃত ছোট। ইল্তুৎমিসের সম্প্রসারিত অংশে এক-একদিকে তিন-খিলান-ওয়ালা দুটি মাখ্সুরাহ্ এবং আলাউদ্দীন খিল্জী শুধুমাত্র উত্তরদিকে মস্জিদ সম্প্রসারণকালে নির্মাণ করেন পরপর নয়টি খিলান।[৩] এর ভিতর আলাউদ্দীন-নির্মিত খিলানের চিহ্নমাত্র নেই, ইল্তুৎমিস্-মাখ্সুরাহ্-র সামান্য ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়; অথচ সর্বপ্রথম-আদিম পাঁচটি তিনটি এখনও অটুট।[৩]
আদিম মাখ্সুরাহ্-র দৈর্ঘ্য ৩৩ মিটার, গভীরতা ২.৫৬ মিটার এবং ১৫.২৫ উচ্চতা মিটার। কেন্দ্রীয় খিলানের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার এবং তার স্প্যান ৬.৬ মিটার।[৩] “স্থানীয় স্থপতিরা পশ্চিম-এশীয় আর্কুয়েট (arcuate) প্রথার সঙ্গে পরিচিত না-থাকার ফলে এই খিলানগুলি নির্মাণে ভারত প্রচলিত ট্রাবিয়েট (trabeate) প্রথার প্রয়োগ করেন।”[৫]
ভারতীয় স্থপতি ‘আর্চ’ বা ‘প্রকৃত-খিলান’ বানাতে জানতো না। তারা কার্বেলিঙ করতে জানতো।[৩] কার্বেলিঙ করতে হলে প্রতিটি রদ্দায় পাথরখানাকে সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকিয়ে বসাতে হবে। যাতে প্রতিটি রদ্দায়—অর্থাৎ জমির সমান্তরাল ‘লেয়ার’-এ, ফাঁকটা অল্প একটু করে কমে আসে।[৩] এ পদ্ধতিতে ভারসাম্য তখনই রক্ষিত হবে যখন ফোকরের বিপরীত-প্রান্তে গাঁথনির ওজন চাপবে, ঝুঁকে থাকা অংশটাকে পিছন দিক থেকে চেপে ধরে রাখবে।[৩]
প্রকৃত-খিলান বা আর্চ কিন্তু এভাবে গাঁথা হয় না। সেখানে ইট বা প্রস্তরখণ্ডগুলিকে বিশেষভাবে ছেঁটে নিয়ে কেন্দ্রবিন্দুর দিকে মুখ করে বসানো হয়।[৩] এগুলিকে বলে ভসৌর।[৩] লক্ষণীয়, তার নীচের দিকটা সরু, উপর দিকটা মোটা—অনেকটা কাঠের গজাল বা চৌকো ফুলগাছের টবের মতো। আর প্রতিটি ভসৌরের পাশের রেখাগুলি কেন্দ্রবিন্দুর দিকে সম্প্রসারিত করলে তা ঐ কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে মিশবে।[৩] খিলানের কেন্দ্রস্থলে সর্বোচ্চ ভসৌরটির নাম কি-স্টোন।[৩] ভসৌরগুলি এমন কায়দায় সাজানো হয় যাতে কেন্দ্রস্থ কি-স্টোন তার দু’পাশের ভসৌরের স্কন্ধে পার্শ্বচাপে দেহভার ন্যস্ত করে। ভসৌরগুলি পার্শ্ববর্তিনীদের চাপ দিতে দিতে ওজনটা দু’পাশের খাম্বিরায় (pier) পাচার করে।[৩]
মদিনায় স্বয়ং পয়গম্বর যে মস্জিদটি নির্মাণ করিয়েছিলেন তাতে খলিফা ওসমান তৈরি করিয়েছিলেন একটি মাখ্সুরাহ্; জেরুজালেমের ওমরের মসজিদেও (ডম-অফ-দ্য-রক) আছে মাখ্সুরাহ্।[৩] কুৎবউদ্দীন আইবক ঠিক তেমন জিনিস বানাতে চাইলেন; যার খিলানের বদনখানা হবে অর্ধচন্দ্রাকৃতি নয়, সূচিমুখ অশ্বক্ষুরাকৃতি।[৩]
১২০৬ সালে কুতুবুদ্দিন আইবক দিল্লি সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন ও তিনি ভারতীয় স্থাপত্যকে মধ্য এশীয় স্থাপত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।[৬] দিল্লির কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহের নির্মাণ কাজ ১১৯৯ সালে মুহাম্মদ ঘুরির শাসনামলে শুরু হয়েছিল। এরপর এটির নির্মাণকাজ চলে কুতুবুদ্দিন আইবকসহ অন্যান্য সুলতানদের আমলে। কুতুব মিনার ও স্থাপনাসমূহের ধ্বংসপ্রাপ্ত কুয়্যাত-উল-ইসলাম মসজিদ হল এর প্রথম ইমারত। এটি নির্মাণে প্রথম দিককার ইসলামি ইমারতগুলোর মত ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু ও জৈন মন্দিরের স্তম্ভ ব্যবহার করা করেছিল। ঐ অঞ্চলে অবস্থিত একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু মন্দিরের কাঠামোর উপরে নির্মিত হয়েছিল। ইরানি স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই ইমারতটির খিলানগুলো ছিল ভারতীয় স্থাপত্যরীতির। [৭]

লৌহস্তম্ভ[সম্পাদনা]
সমাধিস্তম্ভ[সম্পাদনা]
ইলতোতমিসের সমাধিস্তম্ভ[সম্পাদনা]
আলাউদ্দীন খিলজীর সমাধিস্তম্ভ ও মাদ্রাসা[সম্পাদনা]
আলাই মিনার[সম্পাদনা]
গ্যালারী[সম্পাদনা]
Tomb of Alauddin Khilji, Qutub Minar complex
তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]
- ↑ "Qutb Minar and its Monuments, Delhi"। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১০-০৩।
- ↑ "World Heritage List: Qutb Minar and its Monuments, Delh, No. 233" (pdf)। UNESCO। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-১০-০৩।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ দ ধ ন প ফ নারায়ণ সান্যাল (আগস্ট ১৯৮৫)। অপরূপা আগ্রা। ৬বি, রামনাথ মজুমদার স্ট্রিট, কলকাতা: ভারতী বুক স্টল।
- ↑ “Gen. Cunningham found an inscription on the walls recording that twenty-seven temples of the Hindus have been pulled down to provide materials for the mosque.” Arch. Report, Cunningham, Vol. I, পৃঃ ১৭৬
- ↑ দাস, শ্রীদীপকরঞ্জন। "ইন্দো ইসলামিক স্থাপত্য"। বিশ্বকোষ। ৮ম। পৃষ্ঠা ১০৯।
- ↑ Harle, 423-424
- ↑ Yale, 164-165; Harle, 423-424; Blair & Bloom, 149
গ্ৰন্থ সংযোগ[সম্পাদনা]
- Cole, Henry Hardy (১৮৭২)। The Architecture of ancient Delhi : especially the buildings around the Kutb Minar। London : Published by the Arundel Society for Promoting the Knowledge of Art।
- Beglar, J. D.; Carlleyle, A. C . L. (১৮৭৪)। Archaeological Survey of India: Report for the Year 1871-72: Delhi, and Agra (1874)। Office of the Superintendent of Government Printing।
- R. N. Munshi (১৯১১)। The History of the Kutb Minar (Delhi)। G.R.Sindhe, Bombay।
- Hearn, Gordon Risley (১৯০৬)। The Seven Cities of Delhi। W. Thacker & Co., London।
- Munshi, Rustamji Nasarvanji (১৯১১)। The History of the Kutb Minar (Delhi)। Bombay : G.R. Sindhe।
- Page, J. A, Archaeological Survey of India (১৯২৭)। Guide To The Qutb, Delhi। Calcutta, Government of India, Central Publication Branch।
- The World heritage complex of the Qutub, by R. Balasubramaniam. Aryan Books International, 2005. আইএসবিএন ৮১-৭৩০৫-২৯৩-X.
বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]

- Entry in the UNESCO World Heritage Site List
- Quwwat Al-Islam Mosque[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- Corrosion resistance of Delhi iron pillar ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ জানুয়ারি ২০০৪ তারিখে
- Nondestructive evaluation of the Delhi iron pillar Current Science, Indian Academy of Sciences, Vol. 88, No. 12, 25 June 2005 (PDF)
- Photo gallery of the Qutb complex