ইন্দো-ফার্সি সংস্কৃতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরে অবস্থিত তাজমহল ফার্সিভারতীয় সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যদের ঐক্যবদ্ধ করে। এটি ইন্দো-ফার্সি সংস্কৃতির সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণের অন্যতম এবং এটি ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম প্রতীক।

ইন্দো-ফার্সি সংস্কৃতি বলতে দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে ফার্সি সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে বোঝায়। বিভিন্ন মুসলিম তুর্কি শাসকেরা উপমহাদেশে ফার্সি সংস্কৃতি সর্বপ্রথম চালু করেছিলেন, যেমন একাদশ শতকে সুলতান মাহমুদ গজনভি উত্তরপশ্চিম ভারতে (বর্তমান পাকিস্তানে) প্রচণ্ড হারে ফার্সিকরণ চালিয়েছিলেন। সেখানে ইসলামি প্রভাবও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত দিল্লী সালতানাত ও ষোড়শ থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের সময় এই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ হতে লেগেছিল।[১] তুর্কি, ভারতীয় ও আফগান জাতির বিভিন্ন মুসলিম রাজবংশ ফার্সি ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং ইন্দো-ফার্সি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন।[২] দিল্লী সালতানাত ফার্সি ও ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য ও কলার উপর ভিত্তি করে তাঁদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্ত্বার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন, যা ভারতীয় মুসলিম সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল।[৩]

ফার্সি ভাষা দিল্লী সালতানাত, বাংলা সালতানাত ও মুঘল সাম্রাজ্যসহ ভারতের বেশিরভাগ মুসলিম রাজবংশের সরকারি ভাষা ছিল, এমনকি শিখ সাম্রাজ্যেরও সরকারি ভাষা ছিল। এটি সাহিত্যের প্রধান ভাষাও ছিল। বেশিরভাগ সুলতানগণ মধ্য এশিয়ার ফার্সিকৃত তুর্কি ছিলেন এবং তাঁদের মাতৃভাষা তুর্কীয় ভাষাসমূহের অন্তর্গত। মুঘলরাও ফার্সিকৃত মধ্য এশীয় ছিলেন, তবে তাঁরা প্রথমদিকে প্রথম ভাষা হিসেবে চাগাতাই ভাষা ব্যবহার করতেন এবং পরবর্তীকালে তাঁরা ফার্সি ভাষা ব্যবহার করতে লাগলেন। উত্তর ভারতের মুসলিম বুর্জোয়াদের কাছে ফার্সি পছন্দের ভাষা হয়ে গিয়েছিল। মুঘল ও ইন্দো-ফার্সি ইতিহাসের এক পণ্ডিত মুজফফর আলমের মতে ফার্সি ভাষা আকবরের সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে ফার্সি ভাষা মুঘল সাম্রাজ্যের সরকারি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কাতে পরিণত হয়েছিল।[৪]

ভারতে ফার্সিকরণের ফলে এটি এক কসমোপলিটান ফার্সি জগতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল, যা পণ্ডিতমহলে বৃহত্তর ইরান নামে পরিচিত, যার ফলে ঐতিহাসিকভাবে বহু অধিবাসীদের মধ্যে এক ধর্মনিরপেক্ষ ফার্সি সত্ত্বার বিকাশ ঘটেছিল।[৫]

ভাষা[সম্পাদনা]

ব্রিটিশের শাসনের আগে ফার্সি ভাষা ভারতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা এবং উত্তর ভারতের সবচেয়ে বহুল প্রচলিত সরকারি ভাষা ছিল। একাদশ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন তুর্কীয়আফগান রাজবংশ (যেমন গজনভি, দিল্লী সালতানাতমুঘল রাজবংশ) এই ভাষাকে ভারতে পেশ করেছিল। ফার্সি ভাষা এই সাম্রাজ্যগুলির দরবার ও প্রশাসনে সরকারি মর্যাদা বজায় রাখত। ভারতের রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা, ও সামাজিক অবস্থানের ভাষা হিসেবে এটি সংস্কৃত ভাষার জায়গা দখল করেছিল।[৬]

স্থাপত্য[সম্পাদনা]

শাহ রুকন-এ-আলমের সমাধিসৌধ, পাকিস্তানের মুলতানে ১৩২০ সাল থেকে ১৩২৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে নির্মিত
বুলন্দ দরওয়াজা, ফতেপুর সিকরির প্রবেশপথ, ১৬০১ সালে আকবর কর্তৃক নির্মিত

ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্য বলতে ভারতীয় উপমহাদেশের এমন স্থাপত্যকে বোঝায় যেগুলো ভারতের মুসলমান শাসকদের দ্বারা তাদের প্রয়োজনে নির্মিত হয়েছে। সিন্ধু সপ্তম শতাব্দীতে মুসলমান শাসকদের অধীনে গেলেও, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসনের ইতিহাস মূলত মুহাম্মাদ ঘুরির ১১৯৩ সালে দিল্লিকে মুসলিম সাম্রাজ্যের রাজধানী বানানোর মাধ্যমে শুরু হয়। দিল্লির সুলতান ও মোগল সম্রাটরা মধ্য এশিয়া থেকে আফগানিস্তান হয়ে এসেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে। তারা তাদের নির্মিত স্থাপত্যে ইসলামি স্থাপত্যের মধ্য এশীয় রীতি ব্যবহার করেছিলেন, যা ইরানি ইসলামি স্থাপত্যরীতি থেকে উদ্ভূত।[৭]

মুসলিম আমিরদের যে ধরনের ও যে আকারের বৃহৎ ইময়ারতের প্রয়োজন ছিল, সেগুলো ভারতীয় উপমহাদেশে পূর্বে নির্মিত ইমারতগুলো থেকে আলাদা। তারা যেসব ইমারত ভারতীয় উপমহাদেশে নির্মাণ করেছিলেন, তন্মধ্যে প্রধান ছিল মসজিদ ও সমাধিসৌধ। মুসলমান শাসকদের দ্বারা নির্মিত ইমারতের বহির্মুখের ওপরে প্রায়শই বড় গম্বুজের দেখা মেলে। এছাড়া, এসব ইমারতে তোরণের দেখা যায় খিলানের ব্যবহার। গম্বুজখিলানের ব্যবহার ভারতীয় স্থাপত্যরীতি ও হিন্দু মন্দিরে কদাচিৎ দেখা যায়। মুসলমান শাসকদের নির্মিত মসজিদ ও সমাধিসৌধে একটি বিশাল ফাঁকা জায়গাত উপরে বৃহৎ গম্বুজের দেখা মেলে। এসব ইমারতে মানবমূর্তির চিত্রায়ন বাদ দেওয়া হয়েছে, যেগুলো হিন্দু মন্দিরের আবশ্যকীয় অঙ্গ।[৮]

ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যরীতিকে শুরুর দিকে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যরীতিকে নিজেদের মত করে আপন করতে হয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের ইসলামি স্থাপত্যরীতিতে ইটের ব্যবহার দেখা গেলেও, ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যরীতিতে ইটের পরবর্তী পাথরকে ইমারতের মূল উপাধান হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা যায় কেননা, ভারতীয় কারিগররা পাথর দিয়ে উন্নত মানেত ইমারত নির্মাত করতে জানতেন।[৯] দিল্লি কে কেন্দ্র করে ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যরীতি গড়ে উঠলেও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের মুসলমান শাসকদের হাতে এর নানা ধরনের আঞ্চলিক স্থাপত্যরীতি গড়ে ওঠে। মোগল আমলে ইন্দো ইসলামি স্থাপত্যরীতির প্রভাব দেখা যায় হিন্দুদের মাঝেও। তারা মন্দির নির্মাণে গম্বুজখিলানের ব্যবহার শুরু করে। বিশেষত, তারা তাদের বসবাসের জন্য ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে গম্বুজখিলান রাখা শুরু করে।

এছাড়াও, আধুনিক ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি স্থাপত্যশৈলীতে প্রভাব দেখা যায় ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যের। এছাড়াও, ব্রিটিশদের হাতে ভারতবর্ষে যাত্রা শুরু হওয়া ইন্দো-গোথিক স্থাপত্যরীতির এর প্রভাভ বিদ্যমান। ইন্দো-গোথিক স্থাপত্যরীতির ধর্মীয় ও সাধারণ, সব ধরনের ইমারতেই ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ইন্দো-ইসলামি স্থাপত্যে ভারতীয়, ইসলামি, ইরানি, মধ্য এশীয় ও অটোমান তুর্কি স্থাপত্যের প্রভাব বিদ্যমান।

সঙ্গীত[সম্পাদনা]

গোলকোন্ডা, ১৬৬০–১৬৭০। সঙ্গীতশিল্পীগণ একধরনের রুবাব বাজাচ্ছেন। সম্পর্কিত বাদ্যযন্ত্র হলো মধ্যযুগীয় ইরানের রুবাব, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ও ভারতের রুবাব, ভারতীয় সরোদসুরসিঙ্গার। যন্ত্রপাতির এই পরিবার ভারতীয় ও ফার্সি সংস্কৃতিকে সমন্বিত করেছে, এবং এগুলি হিন্দু, বৌদ্ধ, ও মুসলিমরা বাজিয়েছে।

ইসলামি আক্রমণের আগে ভারতের সঙ্গীতকলা বৈদিক সংস্কৃতি থেকে জাত। আক্রমণের পরবর্তী ইন্দো-ফার্সি সংমিশ্রণের ফলে ইরানি সঙ্গীতের বিভিন্ন উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এর ফলে নতুন ফার্সিকৃত শাসকগণের পৃষ্ঠপোষকতায় ঐ অঞ্চলের সঙ্গীত সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। এটি সম্ভবত স্থানীয় সঙ্গীতের বিচ্যুতির প্রেরণা এবং এর ফলে কর্নাটকী সঙ্গীত থেকে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত পৃথক হয়ে গিয়েছিল। এই সঙ্গীতে ব্যবহৃত কিছু মূল বাদ্যযন্ত্র, যেমন সেতারসরোদ, ফার্সি বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। এই সঙ্গীতের ধারা (যেমন খেয়ালগজল) ইন্দো-ফার্সি সঙ্গীত সঙ্গমের এক উদাহরণ। এছাড়া, কাওয়ালির মতো সুফি আধ্যাত্মিক সঙ্গীতে ফার্সি প্রভাবের সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষ করা যায়।[১০]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Sigfried J. de Laet. History of Humanity: From the seventh to the sixteenth century UNESCO, 1994. আইএসবিএন ৯২৩১০২৮১৩৮ p 734
  2. Franklin D. Lewis (২০১৪)। Rumi - Past and Present, East and West: The Life, Teachings, and Poetry of Jalâl Al-Din Rumiআইএসবিএন 9781780747378 
  3. Abd Allāh Aḥmad Naʻīm (২০০২)। Islamic Family Law in a Changing World: A Global Resource Book। Bloomsbury Academic। পৃষ্ঠা 202। আইএসবিএন 9781842770931 
  4. Alam, Muzaffar. "The Pursuit of Persian: Language in Mughal Politics." In Modern Asian Studies, vol. 32, no. 2. (May, 1998), pp. 317–349.
  5. Muzaffar, Alam (২০০৩)। "The Culture and Politics of Persian in Precolonial Hindustan"। Pollock, Sheldon I.। Literary cultures in history : reconstructions from South Asia। Berkeley: University of California Press। আইএসবিএন 978-0-520-92673-8ওসিএলসি 835227498 
  6. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :2 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  7. Yale, 164-165
  8. Harle, 421, 425; Yale, 165; Blair & Bloom, 149
  9. Harle, 424; Yale, 165
  10. "The Indo-Persian Musical Confluence"Stanford Center for South Asia 

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]