ময়মনসিংহের ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বঙ্গদেশের প্রাদেশিক মানচিত্রটি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত থাকা বৃহত্তর ময়মনসিংহ জিলা (টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জের সাথে বর্তমান বিভাগ) প্রদর্শন করছে

ময়মনসিংহ মধ্য বাংলাদেশে অবস্থিত একটি বিস্তৃত অঞ্চল। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ অবধি ময়মনসিংহ জেলা ছিল বাংলাদেশের বৃহত্তম জেলা। অন্যদিকে ময়মনসিংহ শহরটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের অনেক প্রাচীন পুস্তকেও এই শহরের নামোল্লেখ দেখা যায়। ময়মনসিংহের ঐতিহ্যের প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মৈমনসিংহ গীতিকা যা প্রাচীন পুঁথি ও লোকগাঁথার সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। ময়মনসিংহ বলতে এখানে সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ (বর্তমান ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুরকিশোরগঞ্জ) বোঝানো হয়েছে। এখানে প্রাচীনকাল বিবেচনায় নিলে এই অঞ্চলগুলোকে পৃথকভাবে দেখার অবকাশ নেই।

প্রাচীন কাল[সম্পাদনা]

প্রাচীনকাল বলতে এখানে বৈদিক কাল (খ্রি. পূ্. ২৫০০ অব্দ) থেকে শুরু করে মহাভারতের কাল হয়ে কালীদাসের সময় পর্যন্ত ইতিহাসকে বোঝানো হয়েছে। আর্যরা বহু পূর্বে ভারতবর্ষে আগমন করে অনার্যদের বিতারিত করে। তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিমে সুলেমান গিরিপুঞ্জ থেকে পূর্বে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থল, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে সিন্ধু নদ পর্যন্ত। বেদে বঙ্গদেশের কোন উল্লেখ নেই, সুতরাং এটি তখন অরণ্যসংকুল এবং অনার্যদের আবাস ছিল অথবা পূর্বাংশের এই ভূমিটি তখনও বঙ্গোপসাগরে নিমজ্জিত ছিল। এরপর আসে সংহিতার কাল। মনুসংহিতায়ও বঙ্গদেশের উল্লেখ নেই। তবে অনুমানের উপর বলা হয় এই অঞ্চল তখন আর্য্যাবর্ত্তের মধ্যে ছিল তবে এখানে আর্য্যধর্ম প্রসার লাভ করেনি। তাই এসময়ে বর্তমান ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোন অস্তিত্বের কথা জানা যায়না।

এরপর আসে রামায়ণ এবং মহাভারতের কালরামায়ণমহাভারতে বঙ্গের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। রামায়ণে অঙ্গ, বঙ্গ, মগধ, কাশী, কোশল প্রভৃতি অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে; তবে এদের অবস্থানের কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। মহাভারত অধ্যয়ন করলে অবস্থানের যে ধারণা পাওয়া যায় তা এরকম: প্রথমত, ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে বঙ্গদেশ নামে একটি রাজ্য ছিল; দ্বিতীয়ত, সেই দেশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল; তৃতীয়ত, তখনকার সময়েও তাম্রলিপ্তের (বর্তমান তমলুক) অস্তিত্ব ছিল এবং চতুর্থত, বঙ্গদেশ অতিক্রম করে পূর্বদিকে লৌহিত্য প্রদেশ এবং তার পূর্বে লৌহিত্য সাগর বিদ্যমান ছিল। এছাড়া বঙ্গের উত্তর সীমা হিসেবে এখানে প্রাগ্‌জ্যোতিষ দেশের উল্লেখ রয়েছে। তবে এই আলোচনায় ব্রহ্মপুতের অবস্থান জানা যায়না; আর ময়মনসিংহ অঞ্চল চিহ্নিতকরণের জন্য ইটিই জানা প্রয়োজন। মহাভারতের বিস্তৃত আলোচনায় জানা যায় ব্রহ্মপুত্র নদ তখন লৌহিত্য সাগর নামে পরিচিত ছিল যা ব্রহ্মকুণ্ড থেকে উৎপন্ন হয়ে হিমালয়ের পূর্বপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বিধায় আর্য্যবর্ত্তের মধ্য দিয়ে যায়নি। পরশুরাম প্রতিষ্ঠিত লৌহিত্য তীর্থ বলতে এই লৌহিত্য সাগরকেই বুঝানো হয়েছে। মূলত ব্রহ্মপুত্র নদী সাগরের সাথে মিলিত হয়েছে বলেই এদের সঙ্গমস্থলের নাম সাগর হয়েছে।

এছাড়া তাম্রলিপ্ত, করতোয়া ও বৈতরণীর উল্লেখ থেকে জানা যায় যে মহাভারতীয় যুগে ময়মনসিংহ জেলাসহ বঙ্গদেশের প্রায় ৩/৪ অংশ লৌহিত্য সাগরে নিমজ্জিত ছিল। আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদরাও এর সাথে একমত হয়েছেন; গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মুখানীত কাঁদা হতেই বঙ্গভূমির সৃষ্টি হয় বলে তারা অনুমান করেন। কারণ হিমালয়ের সন্নিহিত অঞ্চলেও অনেক সামুদ্রিক প্রাণীর কঙ্কাল ও অন্যান্য নিদর্শন পাওয়া গেছে।এর সাথেই ভেসে উঠে বর্তমান ময়মনসিংহ অঞ্চল। এরপর প্রায় ৩০০০ বছর অতিবাহিত হয়, এই সময়ের বর্ণনা পাওয়া যায় পুরাণে। প্রকৃতপক্ষে এই সময়েই লৌহিত্যগর্ভ থেকে বঙ্গদেশ উত্থিত হচ্ছিল এবং সেই সাথে ব্রহ্মপুত্র তীর্থরাজ হিসেবে এই দেশে পূজিত হচ্ছিল।

বৌদ্ধ যুগ[সম্পাদনা]

খ্রিস্টীয় অব্দের কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই বলা যায় এই দেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করে এবং শাসনকর্তার ভূমিকা পালন করেন বৌদ্ধ রাজারা। এই সময় আনুমানিক ৩০২ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের নির্দেশে গ্রিক পর্যটক মেগাস্থিনিস ভারতবর্ষে আসেন। এই ভ্রমণ নিয়ে তিনি লেখেন ইন্ডিকা নামীয় গ্রন্থটি। এই গ্রন্থের মানচিত্র থেকে জানা যায় তখন ময়মনসিংহ অঞ্চল বিস্তৃত কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কামরুপের মূল সীমানা ছিল পূর্ববঙ্গসহ উত্তর-পশ্চিমে মিথিলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মগধ পর্যন্ত। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০ অব্দে মহারাজ অশোক মগধের সিংহাসনে আরোহণ করে ভারতবর্ষের প্রায় সমগ্র অঞ্চল দখল করলেও বঙ্গদেশ দখল করতে পারেননি। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে মগধ রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন রাজা সমুদ্রগুপ্ত। এই শতাব্দীর শেষ দিকে কামরুপ তথা সমগ্র ময়মনসিংহ অঞ্চল এবং সমতট (ঢাকা, ফরিদপুর) মগধের অধীনে আসে।

এরপর ৬২৯ থেকে ৬৪৫ সালের মধ্যে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ভারতবর্ষে আসেন। হিউয়েন সাঙ পুণ্ড্রবর্ধন থেকে একটি বিশাল নদী অতিক্রম করে কামরুপ আসেন। তখন কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলো ছিল: আসাম, মণিপুর, কাছাড়, ময়মনসিংহ এবং শ্রীহট্ট আর এর শাসনকর্তা ছিলেন কুমার ভাস্কর বর্ম্মণ[১] হিউয়েন সাঙ'র বর্ণনা থেকে জানা যায় ব্রহ্মপুত্রের পূর্বে অবস্থিত বর্তমান পূর্ব ময়মনসিংহ ছিল কামরুপের অধীনে আর এই নদের পশ্চিমে অবস্থিত বর্তমান পশ্চিম ময়মনসিংহ ছিল পুণ্ড্রবর্ধনের অধীনে। সপ্তম শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণের ফলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব মলিন হয়ে যায়। এর মূলে ছিল তন্ত্রাদির আবির্ভাব। এই সময়ের যোগিনীতন্ত্র পাঠ করলে তখনকার সময়ে কামরুপের অবস্থান জানা যায়। তন্ত্রমতে করতোয়া থেকে দ্দিকরবাসিনী পর্যন্ত বিস্তৃত কামরুপের উত্তরে ছিল কঞ্জগিরি, পশ্চিমে করতোয়া, পূর্বে দিক্ষু নদী এবং দক্ষিণে লাক্ষ্ণা নদী। ৮ম শতাব্দী থেকে ১০ম শতাব্দী পর্যন্ত ময়মনসিংহের যে অংশ ৭ম শতাব্দীতে পুণ্ড্রবর্ধনের অধীন ছিল তা আবার কামরুপের অধীনে আসে।

বৌদ্ধ শাসনামল[সম্পাদনা]

পাল বংশ[সম্পাদনা]

৭৫৬ সাল থেকে ১১৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০০ বছর পাল রাজবংশ বঙ্গ ও বিহার শাসন করে। তন্মধ্যে প্রথম ১২০ বছর অধিক গুরুত্বপূর্ণ; এই সময় ময়মনসিংহের কাপাসিয়া, রায়পুরাধামরাই নামক অঞ্চলে শিশুপাল, হরিশ্চন্দ্র পাল এবং যশোপাল নামক তিনজন ক্ষুদ্র নৃপতি শাসন করেন। এছাড়া পশ্চিমাংশে মধুপুর অঞ্চল শাসন করেন পালরাজ ভগদত্ত (মহাভারতে উল্লেখিত ভগদত্ত নন)। ভাওয়ালের বনের গভীরে শিশুপালের বিশাল দীর্ঘ রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ এখনও অস্তিত্বশীল। মধুপুরেও মহারাজ ভগদত্তের স্মৃতিচিহ্ন অবশিষ্ট আছে: তার গৃহভগ্নাবশেষ, পুকুর, বারতীর্থ দীঘি, দেবালয় এবং মদন গোপালের বাড়ি। এখনও এই বারতীর্থাশ্রমে মেলা ও পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

সেন বংশ[সম্পাদনা]

দশম শতাব্দীতে পাল বংশের রাজত্ব যখন চলছে তখনই সেন বংশের উত্থান ঘটে। এই বংশের প্রতিষ্ঠা করেন বীরসেন বা আদিশূর। তিনি বিক্রমপুরে (বর্তমান রামপাল) রাজধানী স্থাপন করে সমতট এবং দক্ষিণ বঙ্গ শাসন করেন। তার প্রপৌত্র বিজয়সেন এতদ্ব্যতীত মদ্র, কলিঙ্গ, কামরুপ দখল করেন। তাই সে সময় ময়মনসিংহ বিজয়সেনের অধীনে ছিল; আর এখানকার ক্ষুদ্র পাল নৃপতি শাসিত অঞ্চলগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। বিজয়সেনের পর তার পুত্র বল্লালসেন (১১৬০ - ১১৭৮) রামপালের সিংহাসনে সমাসীন হয়ে বঙ্গকে ৫ ভাগে ভাগ করেন: রাঢ়, বাগড়ি, বারেন্দ্র, মিথিলা এবং বঙ্গ। এই ভাগ থেকে জানা যায় তখন পশ্চিম ময়মনসিংহ বঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সেন রাজা কর্তৃক শাসিত হচ্ছিল। আর পূর্ব ময়মনসিংহ (ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পার) কামরুপের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়ে দুইটি সন্দেহের অবকাশ রয়েছে:

  • ঐতিহাসিক হ্যামিল্টনের মতে বঙ্গের সীমানা উপর্যুক্ত বর্ণনার মত হলেও অনেক ঐতিহাসিক তা স্বীকার করেন না।
  • ময়মনসিংহের যে অংশ কামরুপের অধীন বলা হয়েছে তাও অনেকের মতে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

প্রথম সন্দেহের ক্ষেত্রে বলতে হয়, প্রত্নতত্ত্ববিদ কৈলাশচন্দ্র সিংহ হ্যামিল্টনের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মত পোষন করেন। তার এই মতের সাথে ব্লকম্যানের মতের মিল রয়েছে। তবে সকল দিক বিবেচনায় হ্যামিল্টনের মতই অধিক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত সন্দেহর নিরসন হয়েছে বল্লালসেনের অসবর্ণা স্ত্রী গ্রহণ এবং পূর্ব ময়মনসিংহে মানব বসতি স্থাপনের সূচনার কাহিনী থেকে। আনন্দভট্ট রচিত বল্লালচরিত গ্রন্থে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। এই মতে, বল্লালসেন ক্ষমতা দখল করে কৌলিন্য প্রথা প্রচলন করেন। এতে প্রাচীন বাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্যদের মধ্যে বিপ্লবের সৃষ্টি হয়। এমন সময় তিনি নিজ বর্ণের ভিন্ন বর্ণের (ডোম) এক নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এই নারীর অন্ন গ্রহণে সকলকে বাধ্য করেন। এতে জাত রক্ষার তাগীদে অনেক ব্যক্তি ও পরিবার বঙ্গ ত্যাগ করে ব্রহ্মপুত্রের অপর পারে চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট, পূর্ব ময়মনসিংহ এবং ত্রিপুরায় বসতি স্থাপন করে। এভাবে ব্রহ্মপুত্রের পূর্বে এদের বিচরণ শুরু হয়। তাই বলা যায়, বল্লাসেনের কালে পূর্ব ময়মনসিংহ কামরুপেরই অধীনে ছিল। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, এই স্থানান্তরের সময় দত্তবংশের আদিপুরুষ অনন্ত দত্ত বঙ্গ ছেড়ে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার কস্তল গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের বংশের এক প্রাচীন কুর্চিনামায় প্রাপ্ত শ্লোকে লেখা আছে, "১০৬১ সনে শ্রীমান অনন্ত দত্ত বল্লাল ভয়ে নিজগুরু শ্রীকণ্ঠ দ্বিজসহ বঙ্গ পরিত্যাগ করিলেন"। তাই এখানে কেবল পশ্চিম ময়মনসিংহের ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া যায়, কারণ বঙ্গের অধীনে এই অংশটিই ছিল। তবে পূর্ব ময়মনসিংহের ইতিহাস জানতে হলে কামরুপের ইতিহাস জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক।

কামরুপের ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রাচীন কাল থেকে ভূঞা শাসন[সম্পাদনা]

রামায়ণ ও মহাভারতের সময় কামরুপ প্রাগ্‌জ্যোতিষ দেশ নামে পরিচিত। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল প্রাগ্‌জ্যোতিষপুর যা বর্তমানে গৌহাটি নামে পরিচিত। খ্রি. পূ, সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এখানে ভগদত্ত বংশ রাজত্ব করে। এর পর ক্ষত্রিয় ও ব্রহ্মপুত্র বংশের রাজত্ব চলে। হিউয়েন সাঙ-এর ভ্রমণের সময় রাজত্ব করছিলেন নারায়ণ বংশীয় রাজা ভাস্করবর্ম। তার পরে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন কলিন্দ বর্ম্মা। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে বার ভূঞাদের আবির্ভাব হয়। ভূঞাদের অধীনে কামরুপ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই সুযোগে পূর্ব ময়মনসিংহে কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজ্য সৃষ্টি হয় যেগুলো গারো, কচ্চু প্রভৃতি আদিবাসী দ্বারা শাসিত হতো। এরা কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি, নেত্রকোনার খালিয়াজুরি, মদনপুরসুসঙ্গ, সদরের বোকাইনগর এবং জামালপুরের গড়দলিপায় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলো। এটি বল্লা সেনের সমসাময়িক কালের অবস্থা। এই সময়ই অনন্ত দত্ত তার গুরু শ্রীকণ্ঠ দ্বিজ সহ কামরুপে আসেন। এরাই ছিলেন পূর্ব ময়মনসিংহের প্রথম ভদ্র উপনিবেশ। দ্বাদশ শতাব্দী থেকে এই অঞ্চলের কামরুপের প্রভাব কমতে শুরু করে।

আদিবাসী গারো জাতির শাসন উৎখাত[সম্পাদনা]

ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে পূর্ব ময়মনসিংহের উত্তর ভাগে তথা সুসঙ্গ পাহাড়িয়া অঞ্চলে বৈশ্যা মান্দা নামক একজন গারো রাজত্ব করছিলো। সোমেশ্বর পাঠক নামীয় পরাক্রান্ত ভ্রমনকারী এই বৈশ্যা মান্দাকে সূকোঁশলে পরাজিত করে সুসঙ্গের শাসন অধিকার করেন। তিনি কান্যকুব্জ থেকে পূর্ব বঙ্গে এসেছিলেন ১২৮০ সালে। এই ঘটনাগুলো থেকে জানা যায় যে দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই পূর্ব ময়মনসসিংহে আদিবাসীদের শাসনের অবসান ঘটে।

ভাটী রাজ্য[সম্পাদনা]

ভাটী ছিল কামরুপের রাজধানী। চতুর্দশ শতাব্দীতে এই রাজধানী ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসী জিতারী কর্তৃক অধিকৃত হয়।মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মেঘনা নদীর পশ্চিম তট-ভূমিকে ভাটী বলে নির্দেশ করেছেন।[২] আবার অনেক প্রাচীন লিখনে ময়মনসিংহের পূর্ব প্রান্তের খালিয়াজুরিকে ভাটী নামে অভিহিত করা হয়েছে। জানা যায় কয়েক শতাব্দী পূর্বে লম্বোদর নামক ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসী এদেশে এসে ভাটীর শাসন অধিকার করেন। এই সন্ন্যাসীর বংশ এখনও বর্তমান আছে। এই বংশের পূর্বপুরুষেরা দিল্লীশ্বর বাদশাহ জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে ভাটী মুল্লুকের পাঞ্জাফরমান পেয়েছিলেন। এতে মনে হয় আসলেই তারা এই অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিলেন। সুতরাং এই সময় থেকে পূর্ব ময়মনসিংহের পূর্বভাগের সাথেও কামরুপের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় কারণ ভাটী পূর্ব অংশে ছিল। কিন্তু তখনও জঙ্গলবাড়ি, বোকাইনগর, মদনপুর, গড়দলিপা প্রভৃতি স্থান হাজংদের দ্বারা শাসিত হচ্ছিলো। তখনও মুসলিম অধিবাসীরা পূর্ব ময়মনসিংহে প্রবেশ করে নি।

প্রাথমিক মুসলিম শাসন[সম্পাদনা]

বাঙ্গালার শেষ হিন্দু রাজা বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষ্ণণ সেনের রাজত্বের শেষ দিকে এ অঞ্চলে অভ্যন্তরীন কোন্দল দেখা দেয়। ১২০৪ সালে মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়া আক্রমণ করেন। লক্ষ্ণণ সেন তখন নদীয়ায় অবস্থান করছিলেন। তিনি প্রতিরোধ না করে তক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা মুসলিম শাসনাধীনে আসে।[৩] বখতিয়ার তার সম্রাজ্যকে দুইটি অংশে ভাগ করেন: মিথিলা এবং রাঢ়ের রাজধানী লক্ষ্ণণাবতীতে (গৌড়) স্থাপিত হয় যা মুসলিম ইতিহাসে লখনৌতি নামে পরিচিত; অপর অংশ গঠিত হয় আরও পূর্বদিকে উত্তর বঙ্গ বা বরেন্দ্র অঞ্চল। তার রাজত্বের সীমানা উল্লেখ করা হয়: পূর্বে তিস্তাকরতোয়া নদী; দক্ষিণে পদ্মা নদী; উত্তরে দিনাজপুর জেলার দেবকোট হয়ে রংপুর শহর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে বিহার পর্যন্ত যা বখতিয়ার আগেই অধিকার করেছিলেন। এ হিসেবে দেখা যায় পূর্ব বঙ্গ বখতিয়ারের অধীনে আসেনি, অতএব ময়মনসিংহের (তথা কামরুপের) কোন অংশই নয়। তবে বখতিয়ার কামরুপে অভিযানে বের হয়েছিলন। কিন্তু বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদীর কারণে আর এগোতে পারেননি।[৩]

উজবেকের আক্রমণ ও তুগরল খাঁ'র বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

বখতিয়ারের মৃত্যুর পর ১২৫৭ সালে[৪] ইখতিয়ার উদ্দিন উজবেক রাঙামাটির দিক থেকে কামরুপ আক্রমণ করেন। এতে কামরুপের রাজা পালিয়ে যায়; এ সুযোগে গারো পর্বতের দক্ষিণ ভাগের সুসঙ্গ, মদনপুর, বোকাইনগর, গড়দলিপা, ভাটী, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি স্থানে স্বাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গোলযোগের সুযোগ নিয়ে তিনি কামরুপের রাজধানী পর্যন্ত অধিকার করেন। কিন্তু বর্ষা আরম্ভ হওয়ার পর কামরুপের প্রাক্তন রাজা আবার আক্রমণ করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করেন, উজবেক এই যুদ্ধে (১২৫৭ সালের জুলাই মাসে) মারা যান। পুনরায় ক্ষমতা পেলেও কামরুপরাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঞ্চলগুলোতে আবার শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। এ সময় পূর্ব ময়মনসিংহে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা স্বাধীনভাবে শাসন করছিল আর পশ্চিম ময়মনসিংহে সেন রাজবংশ তখনও স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের অস্তিত্ব ঘোষণা করছিল।[৫]

১২৭৯ সালে বাংলার শাসনকর্তা তুগরল খাঁ দিল্লীশ্বরের অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। এতে দিল্লীশ্বর গিয়াস উদ্দিন বলবন তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। তুগরল পলায়ন করলে বলবন তার পশ্চাদ্বাধন করেন, এভাবেই বলবন সোনারগাঁয়ে উপনীত হন। তখন সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা ছিলেন দনুজ রায়। দনুজ রায়ের সাথে বলবনের সন্ধি চুক্তি হয়। এই চুক্তির কথা জানতে পেরে তুগরল উড়িষ্যার পথে পালিয়ে যান কিন্তু পথে বলবনের সৈন্যের হাতেই মারা যান। ডাক্তার ফ্রান্সিস বুকানন, ডাক্তার ওয়াইজ, হেনরি ফার্ডিনান্ড ব্লকম্যান প্রমুখের বর্ণনামতে জানা যায়, বখতিয়ার নবদ্বীপ জয় করার পর সেন রাজারা সোনারগাঁয়ে আশ্রয় নেন, এখানে দেই-এক পুরুষ রাজত্ব করার পর দনুজ রায় কর্তৃক বিতাড়িত হন, এরপর পূর্ব রাজধানী রামপালে (বিক্রমপুর) পালিয়ে যান, সেখানে কয়েক বছর রাজত্বের পর মুসলিমদের আক্রমণে পরিজাত হন। গিয়াস উদ্দিন বলবন সুবর্ণগ্রাম (সোনারগাঁ) অদিকার করে তার দ্বিতীয় পুত্র নাসির উদ্দিন মুহাম্মদকে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে রেখে দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। বোঝা যায় এ সময়েও ময়মনসিংহ মুসলিম শাসনের অধীনে আসেনি।

বাংলাদেশে স্বাধীন মুসলিম শাসন[সম্পাদনা]

গিয়াস উদ্দিনের পর কায়কোবাদ এবং তার পর শাম্‌স উদ্দিন ফিরোজ শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। ফিরোজ শাহ বাংলাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। একটি বিভাগ হয় পূর্ব বঙ্গের যার রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় সোনারগাঁয়ে। পূর্ব বঙ্গের শাসনকর্তা হন বাহাদুর খাঁ, এর পর বহরম খাঁ এবং তার পর ফকির উদ্দিন। ফকির উদ্দিন সিংহাসনে আরোহণ করেই সুলতান সিকান্দার নাম ধারণ করে ১৩৩৮ সালে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন। তখন থেকে পর্যায়ক্রমে মোট ১৭ জন মুসলিম স্বাধীন নরপতি বাংলাদেশ শাসন করেন। কিন্তু তখনও ময়মনসিংহ মুসলিম শাসনাধীনে আসে নি বলে জানা যায়। ঢাকা ছিল বঙ্গে মুসলিম শাসনের শেষ সীমানা। ১৪৯১ সালে দ্বিতীয় ফিরোজ শাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করে ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং একাজে তিনি সেনাপতি মজলিস খাঁ হুমায়ুনকে সসৈন্য প্রেরণ করেন। মজলিস খাঁ ময়মনসিংহের উত্ত অংশে প্রবেশ করে শেরপুর প্রদেশ আক্রমণ করেন। তখন শেরপুরের অন্তর্গত গড়দলিপায় দলিপ সামন্ত নামক জনৈক কোচ রাজা শাসন করছিলেন। মজলিসের আক্রমণে দলিপ পরাজিত ও নিহত হন এবং এভাবে শেরপুরে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই ছিল ময়মনসিংহ প্রথম মুসলিম প্রবেশ। মজলিস খাঁর মৃত্যুর পর তার সমাধি গড়দলিপার দুর্গে স্থাপন করা হয়। এই সমাধি গ্রাত্রে আরবি ভাষার একটি লিপি পাওয়া যায় যার অর্থ:

হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকাল[সম্পাদনা]

১৪৯৮ সালে হুসেন শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময় সমগ্র ময়মনসিংহে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এ সম্বন্ধে ব্লকম্যানকৃত রিয়াজ-উস-সালাতিনের অনুবাদটিতে কিছু তথ্য আছে:

এ বিবরণ থেকে হুসেন শাহ ময়মনসিংহ জয় করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়না। কারণ এখানে উল্লেখিত রাজ্যগুলো কোথায় অবস্থিত তা জানা যায়নি। তবে অন্য আরও প্রমাণ দ্বারা হুসেন শাহের ময়মনসিংহ বিজয় সম্বন্ধে জানা যায়। যেমন, হুসেন শাহ যে অঞ্চল জয় করতেন সেখানেই নিদর্শনস্বরুপ একটি মসজিদ নির্মাণ করতেন। বর্তমান বৃহত্তর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত আটীয়া নামক স্থানে হুসেন শাহ নির্মিত একটি মসজিদ ছিল (বর্তমান আতিয়া মসজিদ নয়)। এই মসজিদ-গাত্রের প্রস্তর ফলকে হুসেন শাহের পশ্চিম ময়মনসিংহ বিজয়বার্তা আরবি অক্ষরে খোদাই করা ছিল। অধ্যাপক ব্লকম্যান এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন:

এছাড়া হুসেন শাহ ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব দিক জয় করে একেবারে ত্রিপুরা পর্যন্ত অধিকার করেন। তিনি খোয়াজ খাঁকে এ অঞ্চলের শাসনকর্তা মনোনীত করেন। খোয়াজ খাঁ ময়মনসিংহের অন্তর্গত মুয়াজ্জামাবাদে থেকে এই যুক্ত প্রদেশ শাসন করতে থাকেন। খোয়াজ খাঁর নামাঙ্কিত একটি প্রস্তর লিপিও আবুষ্কৃত হয়েছে যার অনুবাদ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশ করেছে:

লিপিতে উল্লেখিত এই মুয়াজ্জমাবাদ বর্তমানে আর নেই। ব্লকম্যানও এর সঠিক অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেননি। তিনি একবার একে সোনারগাঁ এবং অন্যবার পূর্ব ময়মনসিংহের অন্তর্গত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে হুসেন শাহ যে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় বঙ্গই দখল করেছিলেন তা এ থেকে সুস্পষ্ট। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলার হুসেনশাহী পরগণা এবং হুসেনপুর নামক স্থান হুসেন শাহের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। হেনরি টমাস কোলব্রুক এবং হেনরি ফ্রার্ডিনান্ড ব্লকম্যান বঙ্গে যে দশটি টাকশালের কথা উল্লেখ করেছেন তার একটি ছিল মুয়াজ্জামাবাদ। এ থেকে বোঝা যায় তৎকালীন বঙ্গ এই কয়টি অঞ্চলে বিভক্ত ছিল, আর তখন পূর্ব ময়মনসিংহ মুয়াজ্জামাবাদ নামে পরিচিত ছিল। মুয়াজ্জামাবাদের সঠিক সীমানা জানা না গেলেও এটুকু জানা যায় যে তা পূর্বদিকে শ্রীহট্টের লাউর প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

পাগলপন্থি বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

পাগলপন্থি বিদ্রোহ হচ্ছে ১৮২৪ - ১৮৩৩ সালের মধ্যে উত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাগলপন্থি সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে যে কৃষকবিদ্রোহ সংঘটিত হয় তার নাম। এই বিদ্রোহের চৌহদ্দি ছিলো দক্ষিণ পশ্চিমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, উত্তরে গারো পাহাড়রাজি এবং পূর্বে হাওড় এলাকা। এই বিদ্রোহের প্রথম পর্ব ছিলো ১৮২৪-২৫ সাল পর্যন্ত। এই সময় বিদ্রোহী কৃষকদের সব দাবি একমুখী হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত করারোপ, বেগার প্রথা, বার্মাযুদ্ধজনিত বিভিন্ন কর, রসদ সরবরাহ, পুলিসের অত্যাচার ও চাঁদা আদায় ইত্যাদির স্থলে টিপু শাহ কর্তৃক পরিমিত রাজস্ব প্রদানের প্রতিশ্রুতিতে কৃষক শ্রেণি পাগলপন্থিদের কর্মসূচিতে বিশ্বাস স্থাপন করে। ১৮২৫ সালের ১৯ জানুয়ারি বিদ্রোহীরা শেরপুর শহর ও জমিদারদের স্থাপ্নাসমূহ আক্রমণ করে। তারা কর্তব্যরত ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাবি তোলে যে তারা জমিদারি অত্যাচার ও শোষণ উৎপীড়ন মানতে রাজি নয়। ১৮৩৩ সালের ১ এপ্রিল সরকারি বাহিনী শেরপুর শহর পুনর্দখল করে। সরকার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে এবং ৩ মে সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায় এবং তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করে। ১৮৩৩ সালের ১৩ মে থেকে বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এর পর থেকে বিদ্রোহীরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি আদায়ের পন্থা অবলম্বন করে। তাদের পক্ষে দাবি আদায়ের জন্য উজির সরকারকে উকিল নিযুক্ত করে ময়মনসিংহে পাঠানো হয়। আদালতের লড়াইয়ে তাদের হাত শক্ত করার জন্য কলকাতা থেকে একজন এ্যাটর্নি আনা হয়।[৯]

এই বিদ্রোহ আদিবাসীদের বা কোনো ধর্মীয় আন্দোলন ছিলো না। এ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন সব ধর্মের ও বর্ণের। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন করম শাহ, টিপু শাহজানকুপাথর[৯]

সাধনা সমিতি এবং অনুশীলন সমিতি[সম্পাদনা]

ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ময়মনসিংহের সাধনা সমিতি। ময়মনসিংহ জেলায় হেমেন্দ্রকিশোর আচার্য চৌধুরী, মোহিনীশঙ্কর রায় এবং আনন্দকিশোর মজুমদারের প্রচেষ্টায় সাধনা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯০৬ সালে যতিন্দ্রনাথ মুখার্জীঅরবিন্দ ঘোষের সংস্পর্শে এসে তারা সশস্ত্র বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। সরকারি আদেশে সাধনা সমিতি বেআইনি ঘোষিত হলে বিপ্লবী যুগান্তর দল গুপ্তপথে অগ্রসর হতে থাকে।[১০] সাধনা সমিতির অন্যান্য সদস্য ছিলেন সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, শ্যামানন্দ সেন, সিধু সেন, পৃথ্বীশচন্দ্র বসু, কোহিনুর ঘোষ, বিনোদচন্দ্র চক্রবর্তী, মহেন্দ্রচন্দ্র দে, ভক্তিভূষণ সেন, ক্ষিতীশচন্দ্র বসু, মনোরঞ্জন ধর, সুধেন্দ্র মজুমদার, মতিলাল পুরকায়স্থ, সঞ্জীবচন্দ্র রায়, দ্বিজেন্দ্র চৌধুরী ননী ও নগেন্দ্রশেখর চক্রবর্তী। এঁদের সকলেই বহু বৎসর কারাগারে ও অন্তরীণে আবদ্ধ ছিলেন।[১১]

ময়মনসিংহের ইতিহাসে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ময়মনসিংহের অনুশীলন সমিতি। ময়মনসিংহ অনুশীলন সমিতি গঠন করেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। এই সমিতির সভ্য যারা দশ বছরের অধিক ব্রিটিশ সরকারের কারাগারে ছিলেন জ্ঞানচন্দ্র মজুমদার, রমেশচন্দ্র চৌধুরী, অমূল্যচন্দ্র অধিকারী, প্রভাতচন্দ্র চক্রবর্তী, যোগেন্দ্রকিশোর ভট্টাচার্য, সতীশচন্দ্র রায়, নরেশচন্দ্র সোম, চন্দ্রকুমার ঘোষ, অমৃতলাল সরকার, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, চারুচন্দ্র অধিকারী, ব্রজেন্দ্র রায়, প্রতুলচন্দ্র ভট্টাচার্য। এছাড়াও যারা আরো অনেকে এই সমিতির সভ্য হয়েছিলেন এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে ছিলেন এমন কয়েকজন হচ্ছেন পূর্ণ চক্রবর্তী পরেশচন্দ্র রায়, বিনয়েন্দ্র মোহন চৌধুরী, সুরাংশু অধিকারী, নরেন্দ্র ভট্টাচার্য, নরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, কুমুদ চক্রবর্তী, মনীন্দ্র ভট্টাচার্য, অমিয়শঙ্কর মজুমদার, বিনয়েন্দ্র রায়, ডা. স্নেহময় চৌধুরী, ডা. নীহাররঞ্জন রায়, ভূপেশচন্দ্র রায়, দেবব্রত রায়, হরসুন্দর চক্রবর্তী, যোগেশ দাস, যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, তারাপ্রসন্ন বল, শরদিন্দু মজুমদার, প্রিয়নাথ রায় জমিদার, অমরেন্দ্রনাথ ঘোষ, দ্বিজেন ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চন্দ্র কোনা, বসন্ত রক্ষিত ও কুলদা চক্রবর্তী প্রমুখ। ময়মনসিংহ অনুশীলন সমিতির গৃহী সভ্য ছিলেন চারুচন্দ্র রায়, ডা. বিপিনচন্দ্র সেন, গোপী রমণ গোস্বামী ও দুর্গা ভৌমিক।[১১]

তথ্যসূত্র এবং পাদটীকা[সম্পাদনা]

  1. প্রত্নতত্ত্ববিদ শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্তের মতে
  2. Mahamedan Historians call the coast strip from the Hugly of the Megna "Bhati". H. Blochmann's History & Geography of Bengal. কেদারনাথের ময়মনসিংহের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত
  3. বাংলাদেশের ইতিহাস: ড. মুহাম্মদ আবদুর রহিম, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. এ. বি. এম. মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম, নওরোজ কিতাবিস্তান প্রকাশিত ষষ্ঠ সংস্করণ (মে, ১৯৯৭); পৃ. ১১৪
  4. বাংলাদেশের ইতিহাস: ড. মুহাম্মদ আবদুর রহিম, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. এ. বি. এম. মাহমুদ, ড. সিরাজুল ইসলাম, নওরোজ কিতাবিস্তান প্রকাশিত ষষ্ঠ সংস্করণ (মে, ১৯৯৭); পৃ. ১৫৮
  5. ময়মনসিংহের ইতিহাস: শ্রী কেদারনাথ মজুমদার; আনন্দধারা কর্তৃক প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ (ফেব্রুয়ারি ২০০৫); পৃ. ২৫
  6. শেরপুরের হরচন্দ্র চৌধুরী এই প্রস্তরলিপি পেয়ে ১২৭১ বঙ্গাব্দে তা এশিয়াটিক সোসাইটিকে প্রদান করেন। ১৮৭৪ সালে এশিয়াটিক জার্নালের অধ্যাপক ব্লকম্যান হরচন্দ্র বাবুর বিবরণসহ তাকে প্রচুর ধন্যবাদ প্রদানপূর্বক তার প্রেরিত প্রস্তরলিপির এই অনুবাদ প্রকাশ করেন। কিছু স্থানে অক্ষর অস্পষ্ট থাকায় পূর্ণ অনুবাদ সম্ভব হয়নি।
  7. Notes on Arabic and Persian Inscriptures (J.A.S.B)
  8. On a new King of Bengal (J.A.S.B. 1872)
  9. আবদুল বাছির, বাংলার কৃষক ও মধ্যবিত্তশ্রেণি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ১৩৮-১৪০।
  10. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮১৬, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  11. ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, জেলে ত্রিশ বছর, পাক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ধ্রুপদ সাহিত্যাঙ্গন, ঢাকা, ঢাকা বইমেলা ২০০৪, পৃষ্ঠা ২১২-২১৩ ও ২২১-২২২।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]