ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষা
ঢাকাইয়া কুট্টি বাংলা | |
---|---|
পুরান ঢাকাইয়া বাংলা | |
ঢাকাইয়া | |
![]() | |
দেশোদ্ভব | বাংলাদেশ |
অঞ্চল | পুরান ঢাকা |
মাতৃভাষী | |
ইন্দো-ইউরোপীয়
| |
বাংলা বর্ণমালা | |
ভাষা কোডসমূহ | |
আইএসও ৬৩৯-৩ | – |
গ্লোটোলগ | vang1242 (Vanga বঙ্গ)[১] |
![]() ঢাকা জেলার মানচিত্র এবং যেসব এলাকায় ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষায় কথা বলা হয়। |
বাংলাদেশের সংস্কৃতি |
---|
বিষয় সম্পর্কিত ধারাবাহিক |
![]() |
ঢাকাইয়া কুট্টি বাংলা (পুরান ঢাকাইয়া বাংলা বা শুধু ঢাকাইয়া নামেও পরিচিত), হচ্ছে একটি বাংলা উপভাষা, যে উপভাষায় বাংলাদেশের পুরান ঢাকার কুট্টি সম্প্রদায়ের বাঙালিরা কথা বলে। এই উপভাষার শব্দভান্ডারে সামান্য কিছুটা বৈচিত্র্য থাকলেও এই উপভাষাটি প্রমিত বাংলা সহ অন্যান্য স্থানীয় উপভাষার সাথেও যথেষ্ট বোধগম্য। উপভাষাটি এখন আর আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহার করা হয় না, যদিও ঐতিহাসিকভাবে স্থানীয়দের দ্বারা বারো পঞ্চায়েতে কখনও কখনও এটি ব্যবহার করা হতো।[২][৩]
বৈশিষ্ট্য
[সম্পাদনা]বিপুল পরিমাণে ফার্সি ও আরবি শব্দভান্ডারে সমৃদ্ধ এই উপভাষাটি মূলত পূর্ববঙ্গীয় বাংলার একটি খণ্ড-উপভাষা। প্রমিত বাংলার সাথে তুলনা করলে এটির উচ্চারণে কিছুটা কম মহাপ্রাণধর্মী অক্ষর রয়েছে। ঘ [gʱ], ঝ [jʱ], ধ [d̪ʱ], ভ [bʱ]- মহাপ্রাণধর্মী বর্ণগুলো এই উপভাষায় অল্পপ্রাণধর্মী বর্ণের মতো উচ্চারিত হয়।[৪]
এর কিছু চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য হলো:[৫]
- ক) ‘চ’ বর্গীয় ধ্বনি এবং আরো কিছু ধ্বনির (যেমন: য) ঘৃষ্ট উচ্চারণ: উদাহরণ, প্রমিত বাংলায় যদি বলা হয়: ‘চাচা, চা খেয়ে আমার সঙ্গে যাবেন নাকি?’ এই বাক্যটি ‘চ’ ও ‘য’-এর ঘৃষ্ট উচ্চারণ দিয়ে এবং কিছু শব্দের ধ্বনি পরিবর্তনের মাধ্যমে কুট্টি উপভাষায় এভাবে বলা হয়: ‘চাচা চা খাইয়া আমার লগে যাইবেন নিকি?’
- খ) দ্বিত্ব ধ্বনি ব্যবহার: এই উপভাষারীতিতে শব্দ কোনো কোনো ধ্বনির দ্বিত্ব উচ্চারণ হয়: যেমন, ‘বাজার থন কী কিনছছ? কল্লা আর কদ্দু?’ (এখানে ‘ল’ ‘দ’ এর দ্বিতীয় উচ্চারণ হয়েছে।)
- গ) উর্দু-হিন্দি অব্যয়ের প্রভাব: উর্দু ও হিন্দি ভাষার প্রভাবে এই উপভাষায় ‘মাগার’ ‘ভি > বি’ ইত্যাদি অব্যয়ের ব্যবহার থাকতে যায়। অনন্বয়ী অব্যয় হিসেবে ‘আবে’ এর ব্যবহার এই উপভাষায় যত্রতত্র দেখা যায়। যেমন: ‘আবে জলিল্লা, হইল কী? আমি বি হুনলাম ছব (সব) ঠিক আছে, মাগার যাইয়া দেহি কিচ্ছু নাই।’
- ঘ) ‘শালা’ শব্দের নির্দোষ প্রয়োগ: প্রমিত বাংলা ভাষার সাধারণ প্রয়োগে ‘শালা’ প্রায়শ গালি হিসেবে ব্যবহার হলেও কুট্টি উপভাষায় শালা > হালা শব্দটির নির্দোষ প্রয়োগ দেখা যায়। তাই, বাবা, মা, শিক্ষক, গাছ, গরু, ছাগল সর্বত্র নির্দোষভাবে শালা > হালা, শালায় > হালায় শব্দ ব্যবহার হয়। যেমন: ’আইজকা ছার (স্যার) হালায় আমারে খুব আদর করছে।’ ‘গারি (গাড়ি) থুইয়া গরু বি হালায় দৌর (দৌড়) মারছে।’
- ঙ) ই বা উ-ধ্বনির আগমন: ঢাকাইয়া কুট্টিদের উচ্চারণে ই বা উ-ধ্বনির আগমন অর্থাৎ অপিনিহিতির প্রভাব অধিকমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। যেমন: ‘রাজত্বি পাইছ?’ ‘আইজকা থাউক গা, যায়া গুমা। আবার কাইলকা ছুরু করিছ।’
- চ) তাড়ন ও মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনিহীনতা: এই ভাষায় মহাপ্রাণ-ঘোষ ধ্বনিগুলো যেমন: ঘ, ঝ, ঢ, ধ, ভ, ড়, ঢ় উচ্চারণ যথাযথভাবে হয় না। এর বদলে ধ্বনিগুলো অল্পপ্রাণ- ঘোষ হয়ে যায়। যেমন: আঘাত > আগাত; ঝড় > জর; ঢাকা > ডাকা; ধান > দান; ভাত > বাত।
প্রমিত বাংলা | ঢাকাইয়া কুট্টি বাংলা |
---|---|
ছেলে | পোলা |
মেয়ে | মাইয়া |
ছেলেপেলে | পোলাপাইন |
সত্যি | হাচা |
কেন | ক্যালা |
কেমন | ক্যামতে |
শোন | হুন/শুন |
চা খেয়ে | চা খায়া |
আমার সঙ্গে যাবেন নাকি? | আমার লগে যাইবেন নিকি?[৫] |
থেকে | থেইকা/থন[৫] |
কলা | কল্লা[৫] |
লাউ/কদু | কদ্দু[৫] |
কিন্তু | মাগার[৫] (মাগার শব্দটি হিন্দুস্তানি ভাষা থেকে আগত) |
আমিও | আমি বি [৫] (এখানে বি হিন্দুস্তানি "ভি" থেকে আগত) |
সব | ছব[৫] |
দেখি | দেহি[৫] |
গিয়ে | যায়া[৫] |
যাচ্ছি | যাইতাছি |
করবো | করুম |
ইতিহাস
[সম্পাদনা]
মুঘল আমলে, সুবাহ বাংলা ধান চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং জাহাঙ্গীরনগর (বর্তমানে ঢাকা) প্রদেশের রাজধানী ছিল। ঢাকা কেন্দ্রিক আঠারো শতকের মধ্যভাগে চাল একটি গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্য ছিল। চাল রফতানি করা ব্যবসায়ীরা মূলত মারোয়ারি এবং মধ্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত ছিলেন। এই বণিকরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে চাল সংগ্রহ করত। প্যাকেজিংয়ের আগে ঢেঁকি ব্যবহার করে প্রথমে চাল পরিষ্কার করা হত এবং এই প্রক্রিয়াটিকে বাংলায় কুটা বলা হয়। অনেক স্থানীয় ধান চাষকারী এটি করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল। তারা এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় আসতেন এবং সেখানে যাওয়ার ও কাজটি করার জন্য দীর্ঘ এবং ক্লান্তি হওয়ায় তাদের অনেকে ঢাকায় বসবাস শুরু করেছিলেন। এই মাইগ্রেশনটি আনুুমানিক ১৭৬০ সালে হয়েছিল। তবে সকলেই ধানের ব্যবসায় জড়িত ছিল না। ঢাকায় মুঘলদের উপস্থিতির অর্থ ছিল যে সেখানে সাধারণত অনেক বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল, তাই তারা ঢাকাইয়া উর্দুভাষী নবাবদের এবং অন্যান্য অভিজাত পরিবারগুলির জন্য খানসামাহ, সৈন্য, প্রহরী, বাবুর্চি এবং চৌফারদের মতো অন্যান্য পেশা গ্রহণ করেছিল।[৬][৭] এই গোষ্ঠীগুলির লোকেরা একত্রে বাস করত এবং তাদের হিন্দুস্তানি লোকদের সাথে কথোপকথন এবং আড্ডায় জড়িয়ে পড়ে এবং তাদের প্রধান পেশা তাদের কুট্টি হিসাবে পরিচিতি দেয়। উর্দুভাষীদের সাথে স্থানীয় বঙ্গালী উপভাষী কুট্টি বাঙালিদের কথোপকথনের ফলে কুট্টি উপভাষার জন্ম হয়।[৮] বিংশ শতাব্দীতে ঢাকার বেসিস পঞ্চায়েতগুলি ঢাকাইয়া উর্দু বা ঢাকাইয়া কুট্টির মাধ্যমে আলোচনা করত।[৩] অবশেষে, পুরান ঢাকার লোকালয়ে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ এই উপভাষায় কথা বলতেন।[৯] ঢাকা শহর রাজধানী হওয়ায় পুরাতন ঢাকায় বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আগমনের বর্তমানে ঢাকার কুট্টি বাঙালিদের সংস্কৃতি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।[১০]
সাহিত্য এবং গণমাধ্যম
[সম্পাদনা]ঢাকার কুট্টি উপভাষায় লিখিত সাহিত্য রয়েছে। চান্নিপশর রাইতের লৌড় নামে জুয়েল মাজহারের একটি জনপ্রিয় কবিতা রয়েছে।[১১] শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষায় লেখা।[১২] ঢাকাইয়া কুট্টি নাটকগুলি দেশজুড়ে জনপ্রিয়, এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ও এই উপভাষায় সংলাপ লিখেছেন।[১৩] ঢাকাইয়া কুট্টি লোককথা সমূহ "কুট্টি কৌতুক" নামে এবং সাধারণত উপভাষার রম্য দিকের জন্য বিখ্যাত।[১৪] এটিকে বাংলা উপভাষাগুলির মধ্যে একটি মর্যাদাবান উপভাষা বলে মনে করা হয়।[১৫] সাধারণত "ঢাকাইয়া কুট্টি" লোকগাঁথায় উল্লেখিত, তারা বহিরাগতদের বা অ-ঢাকাইয়া বাঙালিদের "গাঁইয়া" নামে অভিহিত করে, যার অর্থ গ্রাম থেকে আগত,[১৬] এবং কোলকাতার অধিবাসীদের বিশেষ করে ডেমচি নামে ডাকে।[১৭]
আরো পড়ুন
[সম্পাদনা]- মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার লিখিত ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান - পুরান ঢাকার বাসিন্দারের দ্বারা কথা বলা, ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষা নামে পরিচিত বাংলার উপভাষা শব্দের অভিধান। (ঐতিহ্য, ২০১৫)
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ হ্যামারস্ট্রোম, হারাল্ড; ফোরকেল, রবার্ট; হাস্পেলম্যাথ, মার্টিন, সম্পাদকগণ (২০১৭)। "Vanga বঙ্গ"। গ্লোটোলগ ৩.০ (ইংরেজি ভাষায়)। জেনা, জার্মানি: মানব ইতিহাস বিজ্ঞানের জন্য ম্যাক্স প্লাংক ইনস্টিটিউট।
- ↑ হাফিজা খাতুন (১৭ জানু ২০১৭)। Dhakaiyas and Gentrification in Old Dhaka [পুরাতন ঢাকার ঢাকাইয়াগণ ও আধুনিক রুপায়ন] (পিডিএফ)। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। পৃষ্ঠা ৪। ৫ মে ২০২০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০২০।
- ↑ ক খ মুনতাসীর মামুন (২০১২)। "পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, ঢাকা"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ "ঢাকাইয়া কুট্টি উপভাষা - দৈনিক ইত্তেফাক ঈদ সংখ্যা"। Ittefaq.com.bd। সংগ্রহের তারিখ ৯ অক্টোবর ২০১৭।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ আখতার হামিদ খান (২১ জানুয়ারি ২০১৯)। "ঢাকার ভাষা"। দৈনিক সংগ্রাম। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০২১।
- ↑ কবির, আহমেদ মির্জা (১৯৯৫)। শতবর্ষের ঢাকা। রাশেদা হাসনা।
- ↑ ভৌমিক, সত্য এন. (১৯৯৩)। Die Sprachenpolitik der Muslim-League-Regierung und die Entstehung der Bengali-Sprachbewegung in Ostbengalen, 1947-1956 [মুসলিম লীগ সরকারের ভাষা নীতি এবং পূর্ব বঙ্গে বাংলা ভাষা আন্দোলনের উত্থান, ১৯৪৭-১৯৫৬] (জার্মান ভাষায়)। স্টুটগার্ট: এফ. স্টেইনার। পৃষ্ঠা ৬০। আইএসবিএন 3-515-06383-8। ওসিএলসি 29492392।
- ↑ মোশাররফ হোসেন ভূঞা। ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষার অভিধান। প্যারীদাস রোড-বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০: ঐতিহ্য। আইএসবিএন 978-984-776-204-3। ওসিএলসি 908660623।
- ↑ "Enthralling seminar on 'Dhakaiya Kutti' language and humor" ['ঢাকাইয়া কুট্টি' ভাষা ও হাস্যরস বিষয়ক মনোমুগ্ধকর সেমিনার]। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৭-৩০।
- ↑ বণিক, বিজয় কৃষ্ণ (২০১৪)। Kuttis of Bangladesh: Study of a Declining Culture [বাংলাদেশের কুট্টি: একটি ক্রমহ্রাসমান সংস্কৃতির অধ্যয়ন] (পিডিএফ) (গবেষণাপত্র)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
- ↑ "কলকাতার সল্টলেকে ঐহিক'র নিবিড় সাহিত্য-আড্ডা"। Banglanews24.com। ১৩ ফেব্রু ২০২০।
- ↑ ঢাকাইয়া ভাষায় আর কবিতা লেখেননি শামসুর রাহমান, প্রথম আলো, ২১ মার্চ ২০২০
- ↑ হায়দার, দাউদ (২ মে ২০১৯)। "সত্যজিৎ ও ঢাকাইয়া কুট্টি"। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
- ↑ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভানু। "আতমোকথা"। ভানু সমগ্র। পৃষ্ঠা ১৭–২০।
- ↑ আলম, শহীদ (২১ ফেব্রু ২০১৩)। "Reflections on a contemporary phenomenon" [একটি সমসাময়িক ঘটনার প্রতিফলন]। দ্য ডেইলি স্টার।
- ↑ ইমাম, আক্তার (১৯৮৮)। দূরের ছায়া। পৃষ্ঠা ৭।
- ↑ জলিল আজিজুল (২০০৬)। Turbulence and tranquillity [অস্থিরতা এবং প্রশান্তি]। ঢাকা: বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ২০। আইএসবিএন 984-05-1751-1। ওসিএলসি 70251520।